জ্বলদর্চি

বটুদা এন্ড কোং/শ্রীজিৎ জানা

বটুদা এন্ড কোং

শ্রীজিৎ জানা


সব পাড়ায় একজন করে দাদা থাকে।আজকাল হোয়েছে ভারী ঝক্কিঝামেলার ব্যাপার। দাদা বল্লেই সেইসব দাদাদের কথা সকলে ভাবতে শুরু করে দেবে। যাদের কথায় দেয়ালের টিকটিকিরা পর্যন্ত ইচ্ছেমতো টকটকাটক শব্দ বের করতে ভয় পায়। কিন্তু সেই প্রাণীটি যে তার স্বাভাবিক কর্মটি করতে পারলো না। মানে মোক্ষম সময়ে টকটকাটক করে অন্যের যাত্রায় ব্যাগড়া দিয়ে অপার আনন্দ লাভ করতে পারলো না তার দায় কে নেবে? তবে  অনেক সময় শাপে বর লাভ হয়। ভয়ে-দ্বিধায় কিছুক্ষণ থমকে পা ঘষতে থাকে। কেউ কেউ অশুভ ঈঙ্গিত ভেবে গমন পথের আগে পূর্ণছেদ বসিয়ে দেয়।দেখা যায় ব্যাক্তিটি গেল না বলে আপদ টলে গেল। নইলে মহা ফ্যাসাদ ঘটত।

  বোস পাড়ার দাদা তেমন দাদা নয়। ওই যে মিত্তির বাবুদের পাড়ায় ঘনাদা ছিলেন। কিম্বা ধরুন গাঙ্গুলীবাবুদের পাড়ায় থাকতেন টেনিদা। বটুদা তেমনি আমাদের পাড়ার দাদা। উচ্চতা পাঁচ ফুট ছয়। গায়ের রঙ শ্যামলা। গড়ন পাতলা।মানে একখানা হাড়-পাঁজরার কাঠামোর উপর পাতলা  চামড়ার চাদর যেন টানটান করে জড়িয়ে দেওয়া হোয়েছে।পা থেকে কোমর পর্যন্ত সোজা এসে ঈষৎ বাঁক নিয়ে পুনরায় মেরুদন্ড সটান হোয়েছে।  হয়তো আচমকাই বলে ফেল্লুম,
---বুঝলে বটুদা একটা কথা মনে অনেকদিন থেকেই বুড়বুড়ি কাটছে,একটু সাহস দাও তো উগরে দিই।
অম্নি স্মাইলিং ফেসে ডান হাত দিয়ে ধাঁ করে একটা পিঠে থাবকা মেরে সম্মতির স্বরে বলে উঠবে,
---ওরে বটুদা কি তোদের ভয়ের লোক! জাস্ট ফ্রেন্ড-ফিলোজফার এন্ড গাইড। চল্ বলে ফ্যাল দেখি পটাৎ করে।

----মানে, বলছিলাম তোমার পার্সনালিটির সাথে চেহারাটা ঠিক খাপ খায় না। আরেকটু গোলগাল হলে জমে যেত।
----এদ্দিনে এদ্দুর!শরীরে মেদ আর খেদ দুটো রাখতে নেই জানিস না সেকথা। মানে বপু বেশি স্নেহপ্রবণ হোলে সব গেল। দেখছিস না ক্যামন স্নেহবর্জিত কাঠামো ধরে রেখেছি। লাইক এ স্পোর্টস ম্যান। 
বলেই দুই হাত ভাঁজ করে বাইসেপ দেখানোর ভঙ্গীতে উঠে দাঁড়াবে বটুদা। ঢিলে পাঞ্জাবির ভেতরে একটি শরীর এমনভাবে রাগত মুখে দাঁড়াবে যে পেশী চোখে পড়া তো দূর কি বাত্ সর্ষে ক্ষেতের কাকতাড়ুয়ার চেহারা ভেসে উঠবে সামনে। কিন্তু  আমাদের মনের এমনতর উপমা ভাবনার কথা বটুদা কস্মিনকালেও জানতে পারবে না। এটাই রক্ষে। কিন্তু বটুদা তখনো দমবার পাত্র নয়। সোজাসুজি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলবে,
---আয় দেখি পুরো মাঠটায় দেড়হাজার বার চক্কর লাগাই।

সংখ্যাটি শোনামাত্রই স্বাভাবিক ভাবেই আমরা পিঠটান দেব। আর তখনই একটা সশব্দের তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলবে,
----দেখলি তো রোগা হাড়ের ভেলকি।তবুও তো মাত্র দেড়হাজার পাক ছুটার কথা বল্লাম।তাতেই তোদের আত্মারাম শুকিয়ে কাঠ। আগে মানে তোদের মতো যখন বয়েস তখন রোজ ভোরে আড়াইহাজার পাক দৌড়াতুম। আফটার রান বাড়িতে গিয়ে এককেজি ভেজানো ছোলা-বাদাম  আর দু'পোয়া দুধ উদরস্থ করে বেরিয়ে পড়তুম কাজে।
এসব শোনার পর আমাদের চোখেমুখ থেকে শুধুই বিস্ময় বিচ্ছুরিত হোতো। কথা বেরুতো না মোটেই।

  বটুদার চুলের ছাঁট অনেকটাই মিঠুন চক্রবর্তীর যুবক বেলার মতো। গাঁয়ের সেলুনে যাকে বোলতো মিঠুনছাঁট চুল। চেকের জামা আর রাজেশ খান্না স্টাইলের প্যান্ট ছিল বটুদার বেশি পছন্দের। চার ভাইয়ের মধ্যে বটুদা ছোট। এডুকেশন নিয়ে কোন কথা জিজ্ঞেস করা যাবে না বটুদাকে। অম্নি একখানা লম্বা স্পিচ ঝেড়ে দেবে সপাটে,
---তোরা এডুকেশান বোলতে বুঝিস গুচ্ছের ডাটা মগজে ভরে নেওয়া। আর যেনতেন কায়দাবাজি করে একটা চাকরি বাগিয়ে নেওয়া। ওরে তোদের বটুদা ওইজন্যে জম্মায়নি। এদিকে বাবার মুখের উপর বলাতে সাহসে কুলোচ্ছিল না। বাট্ তোদের বটুদার ব্লাডে এক্সট্রা একটা কণিকা আছে সেটার নাম জেদকণিকা। বাগিয়ে নিলুম ধূম জ্বর। মা ধমকে দিলো বাবাকে। জ্বর নিয়ে ছেলে পরীক্ষায় বসবে না।ব্যাস ওখানেই পড়ায় ফুলস্টপ বসিয়ে দিলুম জম্মের মতো। 

  তাইবলে বটুদার নলেজ নিয়ে কোনো কথা হবে না।পৃথিবীর সমস্ত বিষয়ে তার একটা লম্বা তথ্যবহুল ভাষণ থাকবেই থাকবে। যদিও তার ল্যাজামুড়ো খুঁজে বের করা দুঃসাধ্য। নতুনদের কাছে আকাট গাঁজাখুরি গল্প মনে হতেই পারে। তবে বটুদার এলেম এখানেই সে সব কথাকে এমন ডেসিবেলে থ্রো করে,সাথে কনফিডেন্টলি বলে যে, কর্ণকুহর কখনো ফেলে দিতে পারে না। আর আমাদের মতো বটুদার গুণমুগ্ধ যারা,তাদের কাছে বটুদার যেকোন বচনই টেস্টি এন্ড টেরিফিক!
তো সেই অদ্বিতীয়ম্ বটুদার সাথে আমার আড্ডা বসে কাঁসাই পাড়ের বটতলায়। আড্ডায় মাঝেসাঝে যোগ দেয় শিবেন। বটুদা শিবেনকে উপাধি দিয়েছে তর্কালঙ্কার। তর্কে শিবেনের কোনো জুড়ি নেই। এম্নিতে আমরা দুজনেই রাজনগর ইউনিয়ন স্কুলের গড়পড়তা ছাত্র। বটুদার কাছে তা অজ্ঞাত নয়।ফলে কোনো ডিবেটে শিবেন যখন যুক্তির জালে বটুদাকে প্রায় এঁটে ফেলতে যাবে, ঠিক তখনই তার মোক্ষম বাক্যবাণটি ছুঁড়বে,
---তর্কালঙ্কার কি সাধে বলি রে সুপার ঢেঁড়স কত পেয়েচিস এবচ্ছর। ওই তো নমো নমো করে মার্কশিটের ঘরগুলোতে বিশ-ত্রিশ করে নম্বর। তোর দৌড় জানি বাপু। একটু শান্ত হ। বস্। ম্যালা না বকে চারবার কপালভাতি করে দ্যাখা।
শিবেন রাগে গরগর করলেও কথায় তখনো তার ঝাঁজ বোঝা যাবে না। মুখটাকে বাঁকিয়ে বলবে
---এটা তোমার অন্যায় বটুদা। তুমি নিজেই প্রথাগত শিক্ষার বিরোধী, অথচ কথায় কথায় মার্কশিটের খোঁচা কেন দাও বুঝতে পারি না।
---রাগ করে না বাবা শিবেন। আয় কাছে আয় এট্টু আদর করে দিই।

  বলেই বাতাকাঠি হাতের মাথায় খুন্তির চওড়া প্রান্তের মতো তালু দিয়ে ঠিক লঘু মস্তিষ্ক বরাবর বার কয়েক উপর -নীচ করে বুলিয়ে দেবে। শেষে ধাঁই করে একটা চপেটাঘাত করে ইতি টানবে। আদর নাকি কৌশলী অনাদর বোঝা বড় মুশকিল হবে।তবু আমরা ছিনেজোঁকের মতো বটুদার পিছু ছাড়ি না।
কারণটা অন্যদের কাছে হ্যালাফ্যালা হোতে পারে। আমার আর শিবেনের কাছে ভীষণ সিরিয়াস ব্যাপার। তা হোলো ভাকুদার নিত্যনতুন ভাবনা। শুধু ভেবেই সে ক্ষ্যান্ত থাকে না। সেই ভাবনা রূপায়নে তার যে পরিকল্পনা তা আরো মারাত্মক। যদিও আজ অব্দি কোনোটাই বাস্তবায়িত করতে পারেনি সে। কিন্তু হতোদ্যম হবার পাত্র তো  নয় বিপিন বটব্যাল মানে বটুদা।

  সেদিন বিকেলের আড্ডায় যথারীতি আমরা হাজির। অথচ বটুদার তখনো পাত্তা নেই। এমনটা তো সচরাচর হয় না। শিবেনের মুখ তো থেমে থাকে না সহজে।
--কি রে বটুদা  আজ ডুব মারলো নাকি?
---নিশ্চই নতুন কোন চিন্তা বটুদার মগজে  আসিয়াছে। তাহার জন্যই তিনি লেট লতিফ।
--লেট বাট বেটার দ্যান নেভার। 
বলেই তর্জনির খোঁচা তলপেটে চালিয়ে ঝটিতে আবির্ভূত হলেন ওয়ান এন্ড ওনলি বটুদা। সাথে সাথেই শিবেনের দিকে আড়চোখ তাকিয়ে ছুঁড়ে দিলে প্রশ্নবাণ,
--- কার্টোগ্রাফি বুঝিস? কার্টোগ্রাম?
আজব দুখানি শব্দ শুনে লেধুস মাছের মতো মুখ করে তাকিয়ে থাকি। কোপ বুঝে বটুদা খোঁচা দিতে ছাড়ে না,
--তোদের দৌড় আমার আগেই জানা ছিল। জাস্ট তোদের কে আর একবার নিশ্চিত করালুম।
খোঁচা হজম করে বললাম,
---সে তুমি যখন জানোই, পুরোটা খুলে বল্লেই পারো।
--তবে শোন রে বুদ্ধুর দল। কার্ডোগ্রাম মানে হল মানচিত্র অঙ্কনবিদ্যা।যেটা নিয়ে আজকাল গবেষণা কচ্ছি।
শুনেই অতি উৎসাহে শিবেন বলে উঠে,
---তা বটুদা গবেষণায় কিছু পেলে?
---রহো বাবা শিবেনচন্দর। বেশি পুঁটিলাফ লাফিও না। পেলুম কি বলিস! এতো দেখি পুরো গ্যাজারিয়াস ব্যাপার!
বটুদা কথার মাঝে একটা আধটা অদ্ভুতুড়ে ইংরেজি শব্দ বলে। খানিকটা হাঁসজারুর মতো। তা শুনে আমরা অভ্যস্ত।অতএব সোজাসুজি জানতে চাইলাম।
--- ব্যাপারটা কী এবার তো বলো বটুদা। আর যে তর সইছে না।
---এই যে তোরা ইন্ডিয়ান ম্যাপ দেখিস,ওতে কোন কী ফল্ট তোদের চোখে পড়ে? পড়ে না তো? 
শিবেন জিরাফের মতো গলা বাড়িয়ে বলে,
--ইন্ডিয়ান ম্যাপে ফল্ট! ক্লাসে ভূগোলের স্যারেরা তো কখনো বলেন নি
---ওর জন্য পড়লে হয় না। অবজারভেশনের জন্য দুটো চোখ চাই। আর যার দৃষ্টিতে থাকবে রঞ্জন রশ্মির পাওয়ার। সাথে পরিভ্রমণের অভিজ্ঞতা।
শিবেনের উপরে আছড়ে পড়লাম রাগে,
--তুই থামবি!তুমি বল তো বটুদা ফল্ট কী দেখলে?
বিজ্ঞের মতো চোখেমুখে ভাব এঁকে যা বল্লে তা শুনে আমাদের তো আক্কেলগুড়ুম।
---বুঝলি বিশে,ম্যাপে ওই যে নর্থ পিকে খাঁজ অংশটা, ওটা অতখানি হবে না।সামান্য ফ্ল্যাট হবে। ঠিক একইরকম দশা  করমন্ডল উপকূল আর কচ্ছের রন অঞ্চলেও । ভাবছি নতুন করে আঁকতে হবে ম্যাপ। এস ও আই দপ্তরে ইতোমধ্যে চিঠি সেন্ড করেছি। গ্রীন সিগনাল পেলেই একটা কোম্পানি খুলবো ভেবেছি। আর তোরা হবি আসার অ্যাসিটেন্ট।
এবার শিবেন বটুদাকে বাগে পেয়েছে ভেবে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়
---কিন্তু বটুদা তুমিই যে ঠিক তার তথ্যপ্রমাণ আছে তোমার কাছে?
এবার আমিও সুযোগ বুঝে প্রশ্ন করে উঠি
---তোমার প্রস্তাব দপ্তর মানবে কেন? কিভাবে তুমি এতটা সিওর হোচ্ছো?
পায়ের উপর পা তুলে পাতাটাকে উপরনিচ নাচাতে নাচাতে এবার বটুদা আরো একটা বোমা ফাটালো,
---রেনেল সাহেবের নাম শুনেছিস?
আমাদের বিস্ফারিত চোখ ও স্পন্দনহীন মুখ দেখে বটুদা না থেমে বলে গেল তার কথা,
---গতকাল রাতে তোদের বটুদার সাথে সেই এক্স্ট্রা অডিনারি রেনেল সাহেবের সঙ্গে কথা হোলো ঝাড়া দুঘন্টা। তিনি তো বলেই ফেল্লেন, 'বটব্যাল এ টুমি কী করিয়াছো!ব্রাভো -ব্রাভো'! 
রেনেল নাম প্রথম শোনা ঠিকই কিন্তু সাহেব মানে বিফোর স্বাধীনতার কাল। শিবেন সুযোগ ছাড়বে কেন?
---তা বটুদা সাহেবের সাথে কথা হোলো কিভাবে?
--জানতুম এই প্রশ্নই তোর মাথায় আগে আসবে। ওরে হিপোপটেমাস তোদের বটুদা যে প্ল্যানচেট করে সেটা তো জানিস না কি!
বিস্ময়ে আমার মুখ থেকে এম্নিই  কখন যে কথা বেরুলো টের পেলাম না,
---প্ল্যানচেট করে তুমি গতকাল রেনেল সাহেবের সঙ্গে কথা বল্লে!
---হ্যাঁ, বল্লুম। আজও অ্যাপু নিয়ে রেখেছি। বাকি বিষয়ে ডিসকাস হবে।
শিবেন এবার কিছুটা উৎসাহিত হোয়ে বটুদার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
--- সে তুমি কথা বলো।আমি কিন্তু এরইমধ্যে কোম্পানীর নাম ঠিক করে ফেলেছি। কোম্পানীর নাম হবে বটুদা এন্ড কোং।
শুনে বটুদার মুখ থেকে খসে পড়ল দুটি শব্দবন্ধ
--নট ব্যাড।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments

  1. খুব ভালো লিখলেন, কিন্তু বটুদা হঠাৎ এক জায়গায় ভাকুদা হয়ে গেছে , এডিট করে দেন 👌

    ReplyDelete