অশোক মহান্তীর কবিতা : জীবন ভাঙা পথে ঈশ্বরের গান
দিলীপ মহান্তী
।৮।
রাইনের মারিয়া রিলকে ঈশ্বরকে খুঁজে পেয়েছিলেন রাশিয়ায়। যে ঈশ্বর আলাদা আলাদা রূপে ছড়িয়ে আছেন টলস্টয় ও দস্তয়েভস্কির উপন্যাসের পাতায় পাতায়, পংক্তিতে পংক্তিতে। অশোক মহান্তীও ঈশ্বরকে খুঁজে পেয়েছেন জীবনের ক্ষণে ক্ষণে আর প্রকৃতির শূন্যতা ও পূর্ণতায়। কালকূটের মতো তাঁরও জিজ্ঞাসা ছিল: কোথায় পাবো তারে? প্রকৃতির মধ্যে, মানুষের মধ্যে নাকি যাবতীয় সৃষ্টির মধ্যে? সেই জিজ্ঞাসা থেকেই কখনো তিনি দেখেছেন ঈশ্বর ভাতের হাঁড়ির মধ্যে অবাধে ফুটছেন আর কখনো চৈত্রের বাতাস হয়ে ঝরিয়ে দিচ্ছেন সব পাতা আবার কখনো ফুল হয়ে গাছকে ভরিয়ে দিচ্ছেন সৌন্দর্যের কানায় কানায়। সকল নিয়মের মধ্যে ঈশ্বর আছেন এবং তিনিই হয়তো নিয়ম।
যাবতীয় জ্বালা যন্ত্রণা, উত্থান পতন, সৃষ্টি ও ধ্বংসের মধ্যে নিয়ম হয়েই নিয়ম করেই ঈশ্বর আছেন। ঈশ্বরের নাম গানেই বাতাসে বয় ক্ষত নিরাময়ের ওষুধ। বুকে যে হাহাকার বাসা বাঁধে তার সঙ্গে লড়াই করার অবলম্বন। জ্বলে পুড়ে যাওয়া মাটিতে এক পশলা শ্রাবণ। এজন্যই বার বার জল আর আগুন হয়ে শব্দরা আসে। সেটা একেবারে প্রথম পর্যায় থেকেই:
‘মধ্যরাত, অনুকম্পাহীন নক্ষত্রটি ঝুলে আছে অর্জুন গাছের ঠিক মাথার উপরে
আড়াআড়ি ঝুলে আছে চাঁদ
ঐখানে টিলা ছিল, একদা বল্মীক তস্করের নাম গানে
হয়তো বা মুগ্ধ হয়ে পাশাপাশি বেঁধেছিল ঘর
সেই ঘর ক্রমে ভুবনে বিস্তৃত হল, ভেঙ্গে গেল টিলা
সেই ঘর ক্রমে মাটিতে বিলীন হল, তারই কিছু ছায়া
আজও সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে মধ্যরাতে আরো কিছু কথা থাকে বাকি
এমনি সুদৃর থেকে পরাহত আমাদের সুরে ও বেসুরে বাজে গান
আরো কিছু দৃষ্টি থাক বাকি
জন্মান্তরে দেখা হবে এই কথা বলে কেউ চলে গেছে
এখনো ফেরেনি
অতীতকে মুছে ফেলো এই কথা বলে কেউ মুছে গেছে
অতীত মোছেনি
এখনই যেও না চলে মধ্যরাত জ্যোৎস্নাময় পিঙ্গলবরণ
আরো কিছু কথা আছে
কিছু বাক্যালাপ থাক বাকি
ঐখানে টিলা ছিল এখনো বল্মীক তার আনাচে কানাচে
ঘোরে সন্ধেবেলা। তস্করেরা চলে গেছে
তবু মহানামের আগুনে নির্জনে গাছের নিচে পোড়ে মাটি পাথর আগুন
সে আগুন হয়তো-বা জ্বেলেছিল ব্যক্তিগত লালসায় নাবাল ঈশ্বর
আজ তার মহাপান মধ্যরাতে অনুকম্পাহীন একা একা
আমাকে অস্থির করে
জ্যোৎস্নাময় পিঙ্গলবরণ
( মধ্যরাতে একা : আবহ সকাল )
একদিন দস্যু রত্নাকর নিজ কর্মের অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে পরিত্রাণের জন্য মহানাম জপ করেছিল তার চতুর্দিকে বল্মীকের টিলা হয়েছিল। সেখানেও ঘর বাঁধা আর ঘর ভাঙার গল্প। সেই ঘর ক্রমে ভুবন বিস্তৃত হল। পুরনো দিন আছড়ে পড়ছে বর্তমান সময়ে। সভ্যতার অগ্রগতি ও তার বিপদের দিকে খুব সচেতনভাবে আমাদের এগিয়ে দিচ্ছেন। ইঙ্গিত থেকে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে নগরায়ন, বিশ্বায়ন ইত্যাদি গালভরা শব্দ। বিশ্বায়নের চরম রূপ তিনি হয়তো দেখেননি কিন্ত নগরায়নের ভবিষ্যত আন্দাজ করেছিলেন। ঘর ভেঙে যাওয়া আর ঘর গড়ে ওঠার মধ্যের বিষাদ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। জন্মান্তর পেরিয়ে যায় তবু অতীত মুছে যায় না। বড্ড বেশি বুকের গোপনে থেকে যায়। কুরে কুরে খায় উইপোকা। রূপ বদলে যায়। ঘর বদলে যায়। তবুও কোনো সুরে গানে হৃদয়ের মাটি পাথর পুড়ে যায়। আর সেই আগুন জ্বেলে দেন স্বয়ং ঈশ্বর।
১. ‘একদিন খররৌদ্র যখন আমাদের পা পুড়িয়ে দিয়েছে আমরা জলের কাছে
হেঁটে গেছি, ছায়ার হদিস করেছি, যে ছায়া নেমে এসেছিল গাছ থেকে
আরও গাছ হয়ে, আমরা ছায়াকেই গাছ আর গাছকেই ছায়া ভেবে
প্রণাম রেখেছি মাটির ধুলোয়।
ধুলোর উপর বৃষ্টি পড়লো যখন ধুলোর মন জেগে উঠলো।
ধুলো হয়ে গেল মাটি, মাটি হয়ে গেল সোনা, আর সোনার গা ফেটে
ঝন্ ঝন্ ঝন্ ঝন্ করে বেজে উঠলো শস্যের বাজনা।’
( মাটির মন : মাটির মন )
২. ‘আজ আমি বিদ্যুৎ আলোতে আছি। আমার চারদিকে গড়ে
উঠেছে উদ্বাস্তু বস্তি, মূলোৎছিন্ন মানুষের ঢল।
হৃদয় এখানে তাই পরাভূত। প্রতিযোগিতার শেষে কেউ কেউ
দেখেছে বাড়ির মাথা অকারণে উঁচু হয়ে গ্যাছে
কেউ কেউ বিস্তৃত বাগান-ঘেরা জমিটুকু বেচেছে শস্তায়।
ধুলো আকাশে উড়েছে কতবার। কতবার নিচে নেমে এসে
আবার মিশেছে ওই ধুলোর সাম্রাজ্যে ওই মাটির বুকের আস্তরণে
ওই পাথরের গায়ে গায়ে শাল-পিয়ালের পাতায়।
( কালো রুক্ষ হাত: আলোক শিশির )
৩.
‘মানুষ তো সৃষ্টির আদিম মূল, ঈশ্বরের সৃষ্টি তারপর।
ঘুম স্বপ্ন পার হয়ে যে-মানুষ চলে গেছে বোধের গভীরে
তাকে, ডেকে নেয় আরেক সকাল, সকালের রক্তবর্ণ আলো।
আলোর উজ্জ্বল নিচে মানুষের প্রেম, আরো এক ইতিহাস
গড়ে নেবে বলে প্রতিশ্রুত। প্রতিশ্রুত তুমিও, আমিও।
৪.
মানুষের চতুর্দিকে অন্ধকার বাড়ে, তবু ভেতরে ভেতরে আলো
জ্বলে ওঠে বহু কালান্তর। মানুষ না থাকে যদি সব সৃষ্টি
ব্যর্থ হয়ে যাবে, তাই আলোর ভেতরে মৃত মানুষের মুখ দেখে দেখে
মানুষ প্রশান্ত হয়। তুমি এই সন্ধেবেলা যাকে খুঁজে হয়েছো কাতর
আমি তার ঘ্রাণ পাই। ঘ্রাণ আগুনের মতো, গলানো পিচের মতো
ফিরে আসে রাতে, মধ্যযামে, যখন কবিতা লিখি।
( রঞ্জনার একরাত্রি : আলোক শিশির )
শুধু 'অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয় - / আরও এক বিপন্ন বিস্ময় /আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে/ খেলা করে' ; - এই বিপন্ন বিস্ময় অশোক মহান্তীর কবিতাতেও বার বার খেলা করে গেছে। তাকে হয়তো ক্লান্ত করেছে কিন্তু তিনি হার মানেন নি জীবনের প্রতিকূলতার কাছে। জীবনের অন্ধকারের কাছে। কিছু অপ্রাপ্তি, কিছু অতৃপ্তি, কিছু অশান্তি তাঁকে হয়তো ব্যথিত করেছিল কিন্তু বাস্তব মেনে নিয়েই তিনি এগিয়ে যেতে চান। তিনি কখনোই আত্ম সর্বস্ব নন। পরিবারের সবার প্রতিই তিনি যত্নশীল, সহানুভূতিশীল। অবিশ্বাসের দোলায় যে তিনি দোলেন নি তা নয়, সম্পর্কের জটিলতায় তিনিও ক্ষতবিক্ষত হন নি এমনও নয়, কিন্তু দেখি যাবতীয় বাধা সরিয়ে কত সুচারু ভাবে, কত সাবলীলভাবে, কত নিশ্চিত ভাবে, কত সৌম্য শান্ত ভাবে, কত ব্যস্ততাহীনভাবে, কত নিপুণ ভাবে এগিয়ে চলেছেন আর লিখে রাখছেন দৈনন্দিন জীবনকে ও সাধনাকে যা বাংলা কবিতার ধারায় চিরন্তন সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে :
১. ‘কবিতা দিয়ে কি কিছু ভোলা যায়?
বস্তুর সমস্যা, ক্রোধ, বিজ্ঞাপন, ক্ষুধার বিস্তার
কবিতা দিয়ে কি কিছু গড়া যায়?
রিলকেও বুঝতেন,যুদ্ধউন্মাদিত এই পৃথিবীতে শিল্পের সামর্থ্য নেই।
রবীন্দ্রও একথা বুঝতেন।
আর আমরা দাম্পত্য নিয়ে এতকাল যা- বুঝেছি সেও এক অবশিষ্ট ঘৃণা
জড়িত বিভ্রম সন্দেহের। আর কিছু নয়।
তবু শিশুসন্তানের জন্য একই সহমর্মিতার বোধ
আমরাও রেখে যেতে চেয়েছি অনেককাল।
আমরাও উজ্জ্বল- আরো পৃথিবীর খোঁজে একটি বা দুটি সন্তানের মধ্যে
নিজেদের বিভক্ত করেছি
যদি, প্রকৃত পৃথিবী গড়ে কোনদিন।
আগামীর সমস্ত শিশুর জন্য বিশ্বাসের অমোঘ পৃথিবী।
( দাম্পত্য: দ্বিতীয় সঙ্কেত)
২.
১০.
‘সবই কি বোঝার কথা মানুষের? সব মানুষের? একটি গভীর প্রশ্ন
কতদিন থেকে বুকে ঢুকিয়ে শেকড়, প্রতিরাত্রে নড়ে ওঠে।
একদিন অন্ধকারে বেড়াতে গিয়েছি কবে বকুল বাগানে, সেই স্মৃতি
একদিন অন্ধকারে কাঁসাই নদীর পাড়ে ভেসে এসেছিল কার শব, সেই ভয়
একদিন প্রকাশ্য দিনের বেলা কবিতার মতো কোন্ নারীকে দুহাত দিয়ে টেনে
বলেছি, এ জীবন উৎসব, সেই গ্লানি, সব কি হয়েছে বোঝা?
১১.
সমস্ত বোঝার পরও আরেক অবুঝ থেকে যায়। সেও স্থির, সেও দীর্ণ।
বসন্ত-সংঘাত বলে কিছু থাকে, অস্তির সংঘাত। কে আছে এমন
এই পৃথিবীতে, যার কোনো লজ্জা নেই,লজ্জার মুহূর্ত নেই
অবসাদহীন?আমি হাত ধরি, আর হাতের বালাই এই প্রত্নতত্ত্ব
ছুঁড়ে দিই মাটিতে পাথরে, জ্বলে ওঠে কালের আগুন।
এ আগুন কবে নিভবে? লক্ষ লক্ষ ঢেউ এসে ধুয়ে গ্যাছে
পাদপদ্ম শিলা, ধুয়ে নিয়ে চলে গ্যাছে বালি, ঘাস
হরিতকি পাতার মন্দির, আকন্দ ভেরেন্ডা বন, চিতাকাঠ
মাটির কলস, দফায় দফায় সব ধুয়ে নিয়ে গ্যাছে।’
(রঞ্জনার একরাত্রি : আলোক শিশির)
১০.
‘বাড়াতে বাড়াতে আমরা বাড়িয়ে ফেলেছি সেই সুপ্রাচীন মদ
উন্মত্ততা। আজ চারদিকে শুধু অদম্য নিমজ্জমান জল।
আমাদের ঘিরে ধরে রয়েছে উন্মুখ মৃত্যুশিলা, কপাল করোটি।
আমাদের ঘিরে আছে বর্তমান, রূঢ় ভবিষ্যৎ।
কোথায় চলেছি আমরা? প্রশ্ন করি যদি, উত্তর দেবেনা কেউ।
প্রশ্ন করি যদি, এ-জীবন আমৃত্যু সংগ্রাম, নাকি স্বপ্নঘুম?
উত্তর দেবেনা কেউ, উত্তর কি ছিলো কোনোকালে?
তবু প্রেমধারণার কাছে এক অনন্তআগ্রহ রেখে আসি
রেখে আসি নির্জনতা, খন্ড অবসর, আর সমস্ত নারীর জন্য
আর্থ-সামাজিক স্বাধীনতা।স্বাধীনতা, যা তাকে বাড়াবে।’
(দিনলিপিঃ আলোক শিশির)
তাঁর মতো জীবনানন্দ ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সর্বাংশে আত্তীকরণ খুব কম বাঙালি কবিই করতে পেরেছেন। জীবনানন্দের কবিতা বিষয়ক ভাবনা, প্রকৃতি, ইতিহাস, সমকাল, নারী বিষয়ক ভাবনা, মানুষ ও জীবন সম্পর্কিত ভাবনার যোগ্য উত্তরসূরী তিনি। সেই সঙ্গে জীবনানন্দের মহাবিশ্বলোকের উৎস থেকে আসা চেতনার স্পর্শও পাওয়া যায় তাঁর কবিতায়। অন্যদিকে বিভূতিভূষণের মৃত্যু, ঈশ্বর, আত্মা, মানুষ, জীবন ও নারী বিষয়ক চিন্তা ভাবনারও যোগ্য উত্তরসূরী তিনি। আর প্রকৃতি ধ্বংস করে কীভাবে সভ্যতাদর্পী মহাকালের রথের ঘোড়া এগিয়ে চলেছে যার কান্না বিভূতিভূষণের সাহিত্যে গুমরে মরে সেই কান্নার কিছুটা ধ্বনি আমরা অশোক মহান্তীর কবিতাতেও পাই। আর একটা কথা, বিভূতিভূষণের মতো তাঁরও ইতিহাসের প্রতি গভীর আগ্রহ ছিল কিন্তু ইতিহাসের থেকেও বেশি আকর্ষণ ছিল মহাকালচেতনায়। বিভূতিভূষণের ক্ষেত্রে অনেক সময় এই মহাকাল চেতনার ছায়ায় ঢাকা পড়ে গিয়েছিল ইতিহাসচেতনা। অশোক মহান্তীর ক্ষেত্রে সেরকম ঘটেনি। মহাকালচেতনা ও ইতিহাসচেতনা পাশাপাশি এগিয়ে গেছে নিজস্ব পথে, কেউ কাউকে আচ্ছন্ন করেনি। সেই সঙ্গে এই দুই মহান শিল্পী অর্থাৎ জীবনানন্দ ও বিভূতিভূষণ যে চোখে জগৎ জীবন ও সভ্যতাকে দেখতেন সেই ভালোবাসার চোখ অশোক মহান্তীরও ছিল।
১. ' মানুষের শুভবোধ নীল অরণ্যের মত ছড়িয়ে রয়েছে।
মানুষের মৃত্যুচেতনায় তবু কারা যেন জ্বেলেছে আগুন
মস্তিষ্ক প্রসূত। এই লজ্জা মানুষের।
মানুষ অনিষ্ট দীপ জ্বেলে রেখে কোথায় কখন
ঘরে ফিরবে বলে সেই চলে গেছে এখনো ফেরেনি
সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে তার ঘর ভেসেছে কোথাও।
এখন নির্জন গুপ্ত রাত্রি আর অন্ধকারে মহীনের ঘোড়া
ঘাস খায়। চরাচরজুড়ে নামে হিমজ্যোৎস্না মেধাবী আলোয়
ঝাউগাছে পাখি ডাকে।
স্তব্ধতা মানায় যাকে সেই শান্ত মানুষের বেশে
নেমেছে ভৌতিক চাঁদ। চুলে কলঙ্কের কালি, মুখোশে আগুন।
মানুষ মরেছে কত যুগে যুগে হিসেব মেলেনি।
কেই বা হিসেব রাখে? মৃতস্তূপ আবর্জনা সরাতে সরাতে
উঠে আসে হিরোশিমা, নাগাসাকি, ইথিওপিয়ার কোনো গভীর জঙ্গল
বৌদ্ধ স্তূপ, মৃৎমূর্তি।
মানুষ মরেছে আর মানুষই বেঁচেছে বহুবার
বহু যুদ্ধে, প্রাণঘাতী মড়কে মারকে
বহু কষ্টে বহু ভালোবাসা ছুঁয়ে ছুঁয়ে মানুষ বেঁচেছে।
মানুষ বাঁচবেও আরো অনন্ত ব্যাপক কাল অনন্ত ব্যাপক নিরবধি
মহত্তর চৈতন্যের কাছে তার প্রেম শুধু, প্রেমের প্রার্থনা বুকে নিয়ে।'
(মানবিক : আলোক শিশির)
২. 'পৃথিবীর মাটিতে বিছানো এক গভীর আর্তির নাম জাতিসত্তা
বিদ্রোহ, বিপ্লব, বিপ্লবের খুব কাছে মনুষ্যত্ব, প্রেম।
বাতাস ছুঁয়েছে তবু অমলিন ঘাসের চিবুক, বজ্রস্পর্শে ফেটে গেছে এখানের মাটি।
আজ লক্ষ হাত পেতে যদি বা সরাতে চাই ভাঙনের স্রোত বড় হবে।
ফেন নিভ শয্যার উপরে কারা শুয়ে আছো? শুয়ে আছো কে-ই বা মাটিতে?
সকলের জন্য স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা- প্রতিশ্রুতি নিয়ে এই দ্যাখো খেয়েছি আগুন
যত বিষ। আর পরিশ্রান্ত মেঘের মিনারে ঠেস দিয়ে
ওই যারা বসে আছো আগামীতে এ-পৃথিবী মুক্ত হলে ফিরে আসবে বলে
তাদের সবার জন্য বসবাস যোগ্য এক বিস্তীর্ণ পৃথিবী, যুদ্ধসম্ভাবনাহীন।
মা মাটি, উদর খোলো। ঢুকে যাবো অনন্ত আঁধার গর্তে
শিলার আগুনে চাপ চাপ, মাটি হবো, জল হবো
মানুষের আদিম- কামনা সেই ক্ষুধালিপ্ত শস্যবীজ হয়ে
আরবার জন্ম নিতে চাই।
একটি ধানের মতো ফুটে উঠতে চাই আরো শীষের গভীরে।'
(ক্ষুধালিপ্ত শস্যবীজ : আলোক শিশির)
৩. 'এই যে কবিতা-সৃষ্টি এসবই তো সময়ের যুগ-প্রবণতা
কালের অক্ষর-জ্ঞান, নরভুক্ মাটি যাকে নেয় তার স্তব
সে করে বন্দনা। প্রবহমানতা ঘিরে বেঁধে রেখে গেছে
উঁচু বাঁধ, কোনো দিন বন্যা এলে সেখানে দাঁড়াবে।
ঘাস খেয়ে যে-মানুষ বড়ো, যে-মানুষ ভাত খেয়ে বড়ো
যে-মানুষ অর্ধাহারে অনাহারে থেকে থেকে প্রকৃতির
জলে ও হাওয়ায় বড়ো হয়ে উঠে গেছে অনেক উঁচুতে
ওই বাঁধে, তার কাছে সভ্যতা কোথায়?
সভ্যতা জেনেছি এক নাম, এক নির্বিশেষ নাম, সময়ের।
বণিকের হাত থেকে পুঁজি খসে গেলে আরেক বণিক
জন্ম নেয়। যে বণিক উঞ্ছবৃত্তি দালালবৃত্তিতে রত
তারও কপালের ঘাম থেকে অনির্বাণ শিলা জেগে ওঠে
সেই শিলা দুঃস্থতার, সেই শিলা জগতের যেটুকু
অমেয় রস পান করে বসে থাকে বৃকোদর। ...
সমস্ত ধ্বংসের শেষে আরো এক নবীন নির্মাণ থেকে যায়।
পুরোনো কবিতা থেকে যে রকম উঠে আসে প্রাচীন মানুষ
তার প্রেম, পুরোনো গাধার থেকে যেমন বিশ্বাস
কিম্বা লুপ্ত নরতত্ত্ব ফিরে আসে, যে রকম
একটি গাছের বীজে আরো গাছ, একটি নদীর স্রোতে
আরো নদী, আবার অরণ্য, আরো ঘাস, আবার
সংক্রান্ত তুমি বেঁচে থাকো।
(প্রবাহ : আলোক শিশির)
বিশ্বরহস্য অশোক মহান্তীকে চিরকাল ভাবিয়েছে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো তিনিও ঈশ্বরকে খুঁজে বেড়িয়েছেন প্রকৃতির তুলনাহীন সৌন্দর্যের সাগরে। অসীম আকাশের বুকে খেলে বেড়ানো গ্রহ তারা নক্ষত্রের সমারোহ, নীহারিকা পুঞ্জ, পৃথিবীর ঋতুচক্র, দিন রাত্রি, মাস বর্ষ প্রভৃতির বয়ে চলার মধ্যে, পৃথিবীর ফুল ফল ঘাস পাতার মধ্যে ঈশ্বরের হাতের ছোঁয়া লেগে আছে।এই সবকিছুর মধ্যে এক শিল্পীর অদৃশ্য উপস্থিতি অনুভব করেছেন। তাঁর সৃষ্টির রহস্য বুঝতে চেয়েছেন। যাচাই করে নিতে চেয়েছেন ঈশ্বরের রূপ ও স্বরূপ। মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখে গেছেন মহাজাগতিক রহস্য।
জন্মভূমির সৌন্দর্য ও মায়া মুহূর্তের জন্যও ভুলে থাকেননি। আমাদের গ্রামের কাছে সালুকাখাল নামের একটি খাল আছে। আমাদের শৈশব, দৈনন্দিন জীবন, অন্তিম পরিণতি সব কিছুর ওপর এই খালের একটা ভূমিকা আছে। খালের দুপাশের বিস্তৃত ধানজমি থেকে ও আর একটু ওপরে ডুংরি থেকে জল নেমে এসে দুপাশে অনেকগুলি বিস্তৃত ও গভীর খাল সৃষ্টি হয়েছে। পরে জেনেছি ওগুলোর নাম খোয়াই। এত বড় বড় খোয়াই শান্তিনিকেতনেও নেই। খালে সব সময়ই জল থাকে কিন্ত বর্ষাকাল বাদ দিয়ে অন্যসময় ওই খোয়াইগুলিতে জল থাকেনা। রহস্য থাকে।
সেই খাল পেরিয়ে ওপারের সবুজ মাঠে তাঁর সঙ্গে কোনো কোনো বিকেলে দু একবার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেখানে গিয়ে ঘাসের ওপর শুয়ে কখনো তিনি আকাশের দিকে চেয়ে থাকতেন ঘন্টার পর ঘন্টা, কখনো বা দূরে ঘন শালের জঙ্গল যার একটা নাম আছে মালবন সেই মালবনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন। ধীরে ধীর দিনের আলো সরে যেত অন্ধকার গড়াত। সেই তারাভরা আকাশের মধ্যে হয়তো বুঝতে চাইতেন সাতটি তারার তিমিরকে বা ঈশ্বরের সৃষ্টির রহস্যকে হয়তো বা ঈশ্বরকেও।
( ক্রমশ )
1 Comments
অসাধারণ। মুগ্ধ হলাম।
ReplyDeleteক্ষিদে তেরি হলো।
কবি যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন।
আন্তরিক শ্রদ্ধা।