জ্বলদর্চি

গওহরজান - এক বিস্মৃত অধ্যায়- ৬ /দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

গওহরজান - এক বিস্মৃত অধ্যায় 
পর্ব - ৬                               

দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী 
   
তবে কালে খানের ঘটনাটি সেই সময় কালে হিন্দুস্তানি সংগীত শিক্ষার জগতে একটি সাধারণ ও প্রত্যাশিত ঘটনা ছিল। প্রখ্যাত গায়িকা বেগম আখতারের মত কিংবদন্তি গায়িকাও তাঁর লেখনীতে উল্লেখ করেছেন শিল্পী ও ছাত্রীদের প্রতি পুরুষ উস্তাদদের শারীরিক নিগ্রহ ও শারীরিক ঘনিষ্ঠতা প্রার্থনা করা। বাঈজী ছাত্রীদের প্রতি উস্তাদদের অমনোযোগের সাথে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যাপারটির সাথে এই বিশেষ দিকটির যোগ ছিল। উস্তাদদের এই মনোভাবের বিষয়টি মির্জা হাদি রুসওয়া তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস 'উমরাও জান'-এ তুলে ধরেছেন যা হিন্দি সিনেমা জগতের একটি বিখ্যাত চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছিল ১৯৮১ সালে। 
হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের পরিবেশনা এবং প্রবহমানতার ক্ষেত্রে যেখানে লিঙ্গ ও সামাজিক পরিচয় ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত, সেই সময়ে গওহরজান ও অন্যান্য বিখ্যাত মহিলা শিল্পীরা সমস্ত প্রকার বাধা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে নিজেরাও যেমন অসামান্য সাফল্য লাভ করেছিলেন অনুরূপভাবে নবীন শিক্ষার্থীদের তারা খোলা মনে প্রশিক্ষণ দিতেন। যার ফলে উদীয়মান মহিলা সঙ্গীত শিল্পীরা বিশেষতঃ যারা ঠুমরী ও গজল গান গাইতেন তাদের একটি প্রজন্ম গওহরজানকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন এবং তাঁকে নিজেদের আদর্শ হিসেবে দেখতেন। 

  এই প্রসঙ্গে সেই সময়ের কয়েকজন শিশু শিল্পী যারা গওহরের শিক্ষা ও অনুপ্রেরণায় পরবর্তীকালে সংগীতজগতের দিকপাল শিল্পীতে পরিণত হয়েছিলেন। তাদের কয়েকজনের নাম এখানে উল্লেখ করছি। এঁরা হলেন বেগম আখতার, সিদ্ধেশ্বরী দেবী, মিস ইন্দুবালা ও অনাথ নাথ বোস প্রভৃতি। গওহরজানের এক প্রশিক্ষণ ক্লাসে বেগম আখতার, যার বাল্যকালের নাম ছিল বিবি, তার মায়ের সাথে এসে গুনগুন করে গান গাইছিলেন। তাঁর স্বচ্ছ ও পরিষ্কার গায়কী গওহরের খুব ভাল লেগেছিল এবং তিনি ভবিষ্যৎবাণী করে বলেছিলেন উপযুক্ত শিক্ষা পেলে এই মেয়ে একদিন 'মলকা-এ-গজল' বা গজলের রানী হয়ে উঠবে। তাঁর ভবিষ্যৎ বাণী ভবিষ্যতে অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছিল। গওহরের ভবিষ্যৎবাণী ছোট্ট বিবির কাছে বিরাট অনুপ্রেরণা হয়েছিল এবং সারা জীবন তিনি গর্বের সাথে গওহরজানের কথা উল্লেখ করতেন। তিনি গওহরের সারেঙ্গী বাদক ইমদাদ খানকে গুরু করে তালিম নিয়েছিলেন। অসামান্য সুন্দরী এই বেগম আখতার প্রথম জীবনে ষোল বছর বয়সে হিন্দি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য বোম্বেতে কিছুদিন থেকে কয়েকটি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিলেন, কিন্তু গওহরজান ও আগ্রাওয়ালি মলকাজানের সংগীতের খ্যাতি ও সম্মান তাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল সঙ্গীতে মনোনিবেশ করতে এবং হিন্দি চলচ্চিত্র জগতকে বিদায় জানিয়ে ফিরে এসেছিলেন। ভবিষ্যতে তিনি যে ভারতের এক নম্বর গজল গায়িকা ছিলেন সে কথা উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না।       

অনুরূপভাবে গওহরজানের গানে অনুপ্রাণিত হয়ে বেনারসের সিদ্ধেশ্বরী দেবী একজন কিংবদন্তী শিল্পীতে পরিণত হয়েছিলেন। বাইশ বছর বয়সে কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে গান গাইতে এসে তিনি অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন কারণ সেখানে অতীতের গওহরজান, আগ্রা ওয়ালী মলকাজান, মউজুদ্দিনের মতো শিল্পীরা অনুষ্ঠান করেছিলেন।  তাঁর অনুষ্ঠানের শেষে সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত উস্তাদ ফৈয়াজ খান সিদ্ধেশ্বরী দেবীর গান শুনে মন্তব্য করেছিলেন 'বাদ গওহরজান অউর মলকাজানকে ইয়ে শহরা তেলে হি শহর হ্যায়, তুম ঠুমরী কি  রানী হ্যায়' অর্থাৎ গওহরজান ও মলকাজানের সংগীতের দ্যুতির মত এই শহরে তুমিও দ্যুতি ছড়াবে। সেই অনুষ্ঠানের শেষে সিদ্ধেশ্বরী দেবী এক সঙ্গীত সমালোচকের কাছে মন্তব্য করেছিলেন "গওহরজান ও মলকাজান আমার কাছে আকাশের তারার মত উজ্জল। ছোটবেলায় তাঁদের গানের রেকর্ড শুনেছিলাম আমার প্রতিবেশীদের কাছে। শৈশবে যে ব্যাপারটি অসম্ভব মনে হয়েছিল কিন্তু তাঁরাই আমার সঙ্গীতশিল্পী হয়ে ওঠার গভীর অনুপ্রেরণা"।                                                                      
                                                               
আরেকটি বছর পাঁচেকের বাচ্চা মেয়ে অমৃতসর থেকে তার মা রাজবালা দেবীর সাথে কলকাতাতে এসেছিল। তার জীবন ও ছিল গওহরের মতো। গওহরের মাকে যেমন তার বাবা রবার্ট সন্দেহের বশবর্তী হয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন বাল্যকালে, ঠিক তেমনি রাজবালা ও তার মেয়ে ইন্দুকে তার বাবা মতিলাল বোস সন্দেহের বশবর্তী হয়ে বাল্য বয়সে বাড়ী থেকে বের করে দিয়েছিলেন। গওহরের মা মলকাজান যেমন জীবনধারণের জন্য সংগীতকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন অনুরূপভাবে ইন্দুর মা রাজবালা দেবীও  কলকাতায় এসে জীবনকৃষ্ণ ঘোষ নামে এক ধনী ব্যক্তির আশ্রয়ে থেকে সংগীতকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। ইন্দু প্রথমে নার্সিংয়ের ট্রেনিং নিয়েছিলেন কিন্তু নার্সিংয়ের পেশা তার ভাল না লাগায় সংগীতের প্রতি মনোনিবেশ করেন। পন্ডিত গৌরীশংকর মিশ্র ও তার ভাই কালী প্রসাদের কাছে প্রথমে তালিম নিতে শুরু করেন। তার বারো বৎসর বয়সে ইন্দু একটি অনুষ্ঠানে গান গাইতে বসেছিল যেখানে গওহরজান উপস্থিত ছিলেন। একটি গান গাওয়ার পরে তার গান গওহরের ভালোলাগায় আরও কয়েকটি গান গাইতে তিনি অনুরোধ করেন। অনুষ্ঠানের শেষে গওহর পণ্ডিত গৌরীশংকর মিশ্রকে অনুরোধ করেছিলেন তিনি যেন এই মেয়েটিকে তার কাছে পাঠান প্রশিক্ষণের জন্য। পণ্ডিতজী রাজী হলেন এবং তার কাছে ইন্দুকে পাঠালেন যদিও তাঁর ভাই কালী প্রসাদের এই ব্যাপারে আপত্তি ছিল। গওহরের কাছেই কিশোরী ইন্দুর 'নাড়াবাঁধা' বা গ্রন্থিবন্ধন  অনুষ্ঠানের দিনে গওহর খুশিতে একশ' লাড্ডু বিতরন করেছিলেন। গওহর যখন বাইরে অনুষ্ঠান করতে যেতেন ফিরে এসে ইন্দুকে পুনরায় ডেকে নিয়ে এসে তালিম দিতেন। 

  গওহর শুধু যে তাকে সঙ্গীতের তালিম দিতেন তাই নয় উপরন্তু কিছু মূল্যবান আদব-কায়দা যেমন কিভাবে মঞ্চে অনুষ্ঠান পরিবেশন করতে হবে তার রীতিনীতি, মঞ্চে অনুষ্ঠান পরিবেশনকালীন সাজসজ্জা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দিয়েছিলেন যা ইন্দু চিরকাল মনে রেখেছিলেন। এই ইন্দুই পরবর্তীকালে মিস ইন্দুবালা নামে ভারতের সংগীত জগতের বিখ্যাত শিল্পী রূপে পরিগণিত হয়েছিলেন। তার ব্যক্তিগত ডায়েরীতে গওহরজানের গভীর অন্তর্দশনের কথা লিখেছিলেন যাঁকে ইন্দু অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন এবং তার গুণমুগ্ধ ছিলেন ও ভালোবাসতেন। তার ডায়েরীতে আরো লিখেছিলেন গওহরজানের বিভিন্ন ভাষায় দক্ষতা ও কাব্য রচনায় পারদর্শিতার কথা এবং দুঃখ প্রকাশ করে লিখেছিলেন তার প্রাপ্য সন্মান তেমনভাবে কোনদিন পাননি। ইন্দুবালা লিখেছিলেন আরো একজন ছাত্র গওহরের কাছে সংগীত শিক্ষা গ্রহণ করতেন যার নাম ছিল অনাথনাথ বোস। তার আদি বাড়ি ছিল পূর্ববঙ্গে এবং সঙ্গীতের জন্যই সেই পনেরো বছরের ছেলেটি কলকাতাতে চলে এসেছিল। ছাত্র-ছাত্রীদের সংগীতের তাল কাটলে বা সুর ভুল হলে গওহর তাদের কোনরূপ তিরস্কার না করে কেবলমাত্র দুচোখের একটি চোখের ভ্রু উপরের দিকে তুলে তাকালেই ছাত্রছাত্রীরা বুঝতে পারত যে তারা ভুল করেছে। এর পরে তারা নিজেরা ভুল সংশোধন করতে না পারলে গওহর নিজেই গানটি গেয়ে দেখিয়ে দিতেন গাইবার সঠিক পন্থা। গওহরের সাথে একত্রে কাটানোর সুবাদে ইন্দুবালা উপলব্ধি করেছিলেন যে গওহর একজন অসাধারণ প্রতিভাবান শিল্পী কিন্তু খুব কম লোকই তার প্রকৃত মূল্য অনুধাবন করতে পেরেছেন। 
              ক্রমশঃ…….

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments