জ্বলদর্চি

বাংলা বর্ষ -নববর্ষ ও আজকের বাঙালি/তুলসী দাস মাইতি

বাংলা বর্ষ -নববর্ষ ও আজকের বাঙালি

তু ল সী দা স  মা ই তি

 দিন কয়েক আগে আমার এক পরিচিত মানুষ আমায় জিজ্ঞেস করে বসলেন 'বাংলা নববর্ষটা যেন কবে?' একটু হেসে উল্টে বললাম 'কবে মানে?' বললেন 'কত তারিখে?' হেসেই উত্তর দিলাম এপ্রিলের পনেরো। তখন হালকা করে নিলেও বিষয়টা আমাকে বেশ ভাবিয়েছে। বাঙালির নববর্ষ তো তার একান্ত নিজের সংস্কৃতি তবু কেনো ইংরেজি ক্যালেন্ডার দিয়ে দিনটির অবস্থান চিহ্নিত করতে হয় আজকাল? প্রশ্নকর্তা শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত বাঙালি। স্বাভাবিক ভাবেই এ  প্রসঙ্গটি তো ভাবায় আমাদের। বাংলা নববর্ষের যে ধ্রুপদী ঐতিহ্য আছে তাকে কি আমরা ক্রমশ ভুলে যাচ্ছি? তাই কি এই বিভ্রম?  হ্যাঁ আজও বাংলা নববর্ষ  পালিত হয় ঠিকই কিন্তু আন্তরিকতা  যতটা থাকে অভ্যেসের আড়ম্বর তার থেকে বেশি থাকে।  কোথাও বা নতুন বছরের  বরণ অনেকটাই দায়সারা!

গত দুই বছরের  কথা অবশ্য  ভিন্ন। এমন একটা দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে আমরা গেছি যে নতুন বছর  উৎসবহীন বিষণ্ণতায় ভরে উঠেছে। কিন্তু অন্য বছরগুলোতেই কোন সংস্কৃতি দ্বারাই বা আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্যকে তুলে ধরি?

বৈশাখে রবীন্দ্রনাথের জন্ম। বৈশাখে বুদ্ধদেবেরও জন্ম। বাংলা নতুন বছরকে একটা সময়ে এও বড়ো মাত্রা দিয়েছে। রবি-ঘরানা আধুনিক ভারতের বাঙালি সংস্কৃতির সবচেয়ে শক্তিশালী ঘরানা এও তো সত্য।  তিনিও বাংলা নববর্ষকে বরণ করে গেছে উচ্চ আঙ্গিকে। এই পথেও ঠিকঠাক চলেছে কয়েক দশক ধরে। দিনটি পালনের নানান আঙ্গিক বাঙালির শিরায় রন্ধ্রে প্রবল বেগে বয়ে যাচ্ছিল বেশ। কিন্তু কিছুকাল হলো এই ভাবাবেগ একটু কমে এসেছে। থাকলেও তার ভেতরে সৌন্দর্য অল্প।  বলা বাহুল্য, কৃত্রিমতা যদি কোনো সংস্কৃতিকে আবৃত করে ফেলে তাহলে আনন্দটাও স্থূল অনুভূতির ভেতরে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। এই অবতারণার মধ্যেই বাংলা বছর ও তার নববর্ষ নিয়ে ভাবনার অবকাশ নির্মিত হয়ে যায়।

প্রকৃত প্রস্তাবে, এই ভাবনার জট আরো গভীরে মিশে আছে। নববর্ষ কী, নববর্ষ কেন? বাঙালির সামাজিক ইতিহাস ও তার নিজস্বতা এখানে কীভাবে সম্পৃক্ত তা বাঙালি ভুলতে বসেছে একথা  সত্যি।

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, আচার্য যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি, সুকুমার সেন সহ অনেকেই বাংলার নববর্ষের ইতিহাসকে আমাদের সামনে এনেছেন। তাদের সূত্র ধরেই বাঙালির নববর্ষ বিষয়ে কয়েকটি কথা বলতে চাই। আসলে বাঙালির সংস্কৃতির  ইতিহাস সব সময় তার ঋতুচক্র ও কৃষির ওপর নির্ভর করেই বেশি করে নির্মিত। বর্ষ শব্দটিও তেমনই একটা  অর্থ বহন করে। ' বর্ষ' শব্দটি এসেছে  বৃষ ধাতু থেকে যার অর্থ বর্ষন করা। বৃষ্টিকাল। ফসলের জন্য বৃষ্টি। শব্দটির আর একটা অর্থ ছিল বর্ষ অর্থাৎ বর্ষণপ্রাপ্ত ভূমি ,কৃষিজাত ভূমি এলাকা। পূরাণের  'ভারতবর্ষ ' নাম তেমন ভাবেই এসেছে। এই অর্থগুলিকে আশ্রয় করেই বর্ষ শব্দ অর্থবিস্তার করে হয় কৃষির জন্য এক বৃষ্টিকাল থেকে আর  পরের বছর আর এক বৃষ্টিকাল। তবে ইতিহাস থেকে আমরা এও জানতে পারি পুরাণে বর্ষ শুরু হতো শীতকালে। আশীর্বাদ করা হতো 'একশ শীতকাল বেঁচে থাক  'এইভাবে। আমরা যখন নবান্ন অনুষ্ঠান করি নতুন ধান্যে তখন বর্ষ শুরু হতো মনে করা হয়। 

কোথাও বলা হয়ে থাকে বর্ষ থেকে বৎসর কথাটি এসেছে একটা  ঘটনা থেকেই। প্রাচীনকালে শস্য বলতে শুধু কৃষি নয়, গো-পালনকেও   ধরা হতো।বৎসর মানে বাছুর । গাভীদের গর্ভবতী হওয়া থেকে  দুগ্ধ প্রদান পর্যন্ত যে সময়কাল তাকে বর্ষ মেনে নেওয়া হতো।

ভারতবর্ষে জ্যোতির্বিদ্যা চর্চা শুরুর কাল থেকে নতুন একটা বিষয়কে সামনে আনা হয়,আনুমানিক  প্রথম সহস্রাব্দে থেকেই বলা হয় বসন্ত বিষুবসংক্রান্তি ধরেই বর্ষ বিভাগের শুরু হবে।তাই বৈশাখ থেকেই বর্ষের সূচনা। তবে অনুষ্ঠান বা বরণের চল ছিল না।বিদায়ের অনুষ্ঠান ছিল। যেমন  আসামের বিহু উৎসব আর বঙ্গের চড়ক উৎসব ছাতু পরব- এ সব বর্ষ শেষের অনুষ্ঠান। বর্ষসূচনা অনুষ্ঠানে কিভাবে এলো বাংলায় তা বলার আগে কয়েকটি কথা বলে নেওয়া জরুরি। 
আগেইবলেছি  কৃষি সভ্যতার নানান ইতিহাস লুকিয়ে আছে বর্ষ শব্দের নানান অর্থ বিন্যাসে।তবে কৃষিজাত সম্পদ বপন থেকে শস্য গোলাজাত করণ এই পর্যায়ে এক বর্ষে অনেকগুলি আনন্দ উৎসব এর  চল ছিল।ভাদ্র তিথিতে  ভাদালি,পুষ্যতিথি তে পৌষালী এবং বর্ষশেষে  চৈতালি।এছাড়াও বসন্তের শুরুতে শিকার উৎসব ছিল যার নাম চাঁচরি।পরে যা হোলি উৎসব এবং অঞ্চল ভেদে দোল উৎসব।

বর্ষবরণের উৎসব কোথাও ছিল না বলেই মনে করা হয়।কিন্তু দীর্ঘকাল মুসলমান সস্কৃতি এদেশে প্রভাব বিস্তার করে। আর খাজনা প্রদানের নানা পদ্ধতি বর্ষের নানা সময়ে নির্দিষ্ট ছিল। এবং বছর শেষে সালতামামী।অর্থাৎ কর বা অন্য কিছু সবটুকু পরিশোধের ব্যবস্থা।
পরেরদিন  অর্থাৎ বর্ষের প্রথম দিন নওরোজ অর্থাৎ নতুন দিন । এই উপলক্ষে উৎসব ও নতুন খাতা।নতুন খাতায় নাম লিখে পরের বছরের জন্য প্রস্তুতি।প্রজারা উপঢৌকন মিষ্টান্ন ইত্যাদি পেতেন।

আরো পরে এইসবের নানান পরিবর্তন। নতুন বছরের প্রথম দিনেই হালখাতা কে  বাঙালিরা অক্ষয় তৃতীযা, কেউ বুদ্ধ পূর্ণিমায় নিয়ে গেলেন।
পঞ্জিকা , তিথিনির্ণয় প্রভৃতি অনেক বিষয় এসবের যুগে যুগে যুক্ত হয়েছে।

একটা বিষয় বলা জরুরি। আমরা জানি দুই রকম মতের বাংলা ক্যালেন্ডার আছে।
এক. সূর্যসিদ্ধান্ত।
 দুই.  দৃকসিদ্ধান্ত।
সূর্যসিদ্ধান্ত অনুযায়ী দিন গণনা বেশি বাঙালি করে থাকে। কিন্তু জ্যোতির্বিদ্যা মতে এই পদ্ধতি অপেক্ষাকৃত কম নির্ভুল। দৃকসিদ্ধান্ত মত অনুযায়ী দিন গণনা অনেকটা নির্ভুল। এই মতভেদের কারণেই আমরা 'আনন্দবাজার পত্রিকা'য় অনেকসময়ই  বাংলা তারিখ ভিন্ন দেখি।
বিষয়টি সম্পর্কে পন্ডিতদের আরো স্পষ্ট করে দেওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। আপামর বাঙালির কাছে তাহলে একটা যথাযথ ধারণাও তৈরি হবে।

যাই হোক, বাঙালি জাতি তার স্বাতন্ত্র্য যদি ভুলে যায় তাহলে তার সংস্কৃতিরই সমূহ ক্ষতি। বহু ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক উপাদানও টিকে থাকবে না। কৃষি উৎসবের অন্তরে বাংলা নববর্ষের যে বীজ নিহিত আছে তা দূরে ঠেলে দিলে বাঙালি তার নিজস্বতা ভুলে যাবে। অবলুপ্ত হবে বাংলা বছরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা  তার নিজস্ব কৃষিকেন্দ্রিক লোকউৎসবগুলি। এমনিতেই  পাশ্চাত্য সংস্কৃতির গ্রাস অবলুপ্ত হয়েছে বহু কিছু। যা বাংলার নিজস্ব। বাঙালি সত্তার একান্ত নিজের।

তবে রবীন্দ্রনাথ, আমাদের কবি বাংলা বছরকে বাঁচিয়ে রাখলেন 'বর্ষবিদায়'ও 'বর্ষবরণ' দুটি অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। কিন্তু দুটি অনুষ্ঠানই বেশি মাত্রায় প্রাতিষ্ঠানিক। তাতে কিন্তু  কৃষি উৎসবের মহিমা ম্লান। বাঙালির নিজস্ব মহিমা এই প্রকার বরণ পর্যায়ে একটা আনুষ্ঠানিক তাৎপর্য সংযোজন করেও কিছুটা সীমাবদ্ধ!
বৃহত্তর বাঙালি জাতি একেবারেই আমাদের মতো করে নতুন বছরের ঐতিহ্য বহনের ক্ষেত্রভূমি পাচ্ছে কই? 

আসুন ভাবি। ভাবিয়ে তুলি।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments