জ্বলদর্চি

"পুরাতন হে" /বুবু সীমা চট্টোপাধ্যায়

"পুরাতন হে"

বুবু সীমা চট্টোপাধ্যায়

তুমি চলে যাবার সময় হলেই দেখেছি
তোমার চুলচেরা বিচার করা হয়,
চাওয়া পাওয়ার অঙ্ক কষে একটা লম্বা লিস্টি বানিয়ে বলি 'যাবেই যখন যাবার আগে নিজের যা কিছু মন্দ সব ঝোলায় পুরে নাও তো দেখি।'
ঘরবার সাফসুতরো করতে হবে যে এবার। 
অথচ তুমি যখন জীবনের সাথে জড়িয়েবড়িয়ে রইলে, তখন প্রথম দিন থেকেই তোমাকে নিয়ে আদিখ্যেতা তো কম করিনি। বাড়বাড়ন্ত লকডাউনেও বৈশাখের প্রখর রৌদ্রে খোলা ছাতে গিয়ে জীবন্ত ফোনকলে প্রিয়জনদের রবিগান শোনাতে একটুও ক্লেশ হয় নি। হয়তো তখন পাড়ার রবিকাকা বেসরকারী চাকরিটা খুইয়ে সদ্য নুনে ভাতে আঙুল ডুবিয়েছে।
তাছাড়া তুমিই বলো শ্রাবণের মেঘে আঁকিবুকি কাটতে গিয়েছি কতবার একলা ছাতে,
একবারও কি ভেবেছি কার বুক চিরে যাচ্ছে ভরা বর্ষায়! এমন কি দাঁতে দাঁত চেপে ডুবসাঁতার দিচ্ছি যখন ভয়ংকর ঝড়ের রাতে, তখনও,
তখনও কিন্তু খুব কষ্ট হচ্ছে বলে তুমি তো মাঝপথে ছেড়ে পালাও নি।
তুমি তো পারতে বিমর্ষ পূজার প্যান্ডেলে হাজির হয়ে একটা মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে চিৎকার করে বলতে-
"হাঁপিয়ে উঠেছি এই কয়'মাসেই, আমাকে বিদায় দাও,!" নাহ্!  বরং তুমি শিখিয়ে দিয়েছো প্রতিনিয়ত কি ভাবে টিকে থাকতে হয়,
কিভাবে ঝড়কে বুকে নিয়ে রাত কাটাতে হয়,
নইলে তো কবেই পৌষের পরে বৈশাখ চলে আসতো মুখটি নামিয়ে। 
কিন্তু সেটি হবার জো নেই যে,
তুমি কাজে অবহেলা করো নি কখনো। 
আমরা কিন্তু তো এসব করেই থাকি তাই না? 
যা কিছু ভালো না লাগা, যা কিছু মনোমত নয়,
যা কিছু না পসন্দ-
তাকে দূরে ঠেলে পালাতে।
যেমন ধরো কুমুদিনীদিদি বুক থেকে ভালোবাসাটাকে উপড়ে হাতে নিয়ে শো-অফ করতে পারলো না বলেই না আজ বঞ্চিত সব কিছু থেকে!
সারাদিন ভুতের বেগার খাটে আর মেঝেতে স্বপ্নকে কোলবালিস বানিয়ে ঘুমায়। 
কুমুদিদি রোজ ভোরবেলা উঠে 
ফুল তোলার সময় মনে মনে পূজা সেরে নেয়!
এর কোনো অন্যথা হয় না। 
আসলে ফুল তোলার সময় থেকেই যে পূজা
শুরু হয়ে যায় তা কি আমরা কুমুদিদির মতো করে বুঝেছি?
বোকারা পূজায় বসতে পারে না বলে সরিয়ে রেখেছি তাকে সবসময়।
আসলে আমরা বুঝতেই পারি না বোকা কুমুদিদির
তোলা প্রতিটি ফুলই পূজারফুল,
বাকি সব দেখনদারি। 
তুমি তো হিসেবে এককণাও ভুল করোনা কখনও কোনোদিন।
ঠিক দিনে আসো, আবার ঠিক দিনে চলেও যাও।
একটি মূহূর্তকেও বেশি নাও না,
আবার দাও'ও না। আমরা তবুও শিখিনি।
তোমার কোনো আদিখ্যেতা নেই, 
তোমার কোনো আলিস্যি নেই,
তোমার কোনো পিছুটানও নেই,
তোমার দুহাতে গুঁজে দিলাম
আমাদের যা কিছু অন্যায়, যা কিছু ভ্রান্তি 
"যাও যাও নিয়ে যাও সব-'
তুমি চলে যাচ্ছো, তোমার ফিরে তাকাবার কোনো
দায় নেই, তুমি নির্বিকার। তুমি একটু একটু করে মিলিয়ে যাচ্ছো যখন আমরা প্রদীপের আলোয় চৈতি বিকেলে আকাঙ্ক্ষার লিস্টি বানাচ্ছি তখন। 
তুমি মিলিয়ে যেতে যেতেই পলকেই ভরাট হয়ে যাচ্ছে  তোমার শূন্যতা। তুমি ছেড়ে চলে যাবার আগে যা কিছু আমাদের সৃষ্টি ভুলভ্রান্তি তোমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে প্রাণের ঠাকুরের সুর গুনগুনিয়ে উঠি-
"এসো হে বৈশাখ এসো এসো.."
তুমি খুব সন্তর্পণে যা কিছু ভালোমন্দের রেশ নতুনের মুঠোয় পুরে দিয়ে একটা নিখুঁত মুন্সিয়ানায় মিলিয়ে যাও।
আসলেই কিছু যে নিয়ে যাওয়া যায় না!
পথের পাশেই পড়ে থাকে তোমার সম্বছরের ঝোলা,
তা আমরা বছরের পর বছর তোমাকে দেখেও শিখিনি। তোমার তো আর ফিরে আসার তাগিদ নেই, তুমি নির্ভার।
শঙ্খধ্বনিতে জাগে আবার নতুন সকাল
আমরা মেতে উঠি নতুনের আনন্দে, ভেসে যাই সময়ের থেকে সময়ে, একটা অজানা অচেনা 
বছরের সাথে লগ্ন হই। নতুনবছর তার ঝোলা থেকে একে একে সব বের করে আবার আমাদের খেলনাবাড়ি সাজিয়ে দেয়! রোদ, বৃষ্টি, শীত, বসন্তে
অভাবে, আনন্দে, নাই বা নস্তির খেলায় মত্ত হই।  
অথচ দ্যাখো এই অমূল্য সময়টুকু আমাদের অত্যন্ত প্রিয় হলেও আমরা আমাদের ভুলভ্রান্তির ফেঁসোগুলো রিপু করতে বসি না।
সন তারিখের গায়ে খুব যত্নে বসিয়ে দি'
আমাদের অপার মহিমা,পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। 
তোমার যাবার দিনে যা কিছু সুন্দর তার সবকিছু দুহাতে আগলাতে গিয়ে দেখি-
মন্দের গালে ভালোর চুমুটুকু লেগে রয়েছে অবলীলায়।
তুমি বৈশাখের সোনালী রোদ্দুরে সব আশঙ্কা খান খান করে শিখিয়ে গেলে-

            "" মনেরে আজ কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
       সত্যেরে লও সহজে।
             কেউ বা তোমায় ভালোবাসে
                  কেউ বা বাসতে পারে না যে,
             কেউ বিকিয়ে আছে, কেউ বা
                  সিকি পয়সা ধারে না যে,
             কতকটা যে স্বভাব তাদের
                  কতকটা বা তোমারো ভাই,
             কতকটা এ ভবের গতিক--
                  সবার তরে নহে সবাই।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments