জ্বলদর্চি

দেবস্থানের হাতি ঘোড়া /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি

পর্ব- ১৪

দেবস্থানের হাতি ঘোড়া

সূর্যকান্ত মাহাতো

'গরাম' ঠাকুরের পূজা হচ্ছে। "গরাম" হলেন গ্রাম দেবতা। দেবেনখুড়া কোমর সমান এক জোড়া হাতি ও ঘোড়া এনেছেন। দেবতাকে উৎসর্গ করবেন। এগুলো 'মানত' এর হাতি ঘোড়া। বেশ কিছুদিন আগে তার বড় ছেলেকে চন্দ্রবোড়া সাপে কামড়ে ছিল। তারপর যমে-মানুষে টানাটানি। মেদিনীপুর সদর হাসপাতালে চিকিৎসা চলছিল। দেবেনখুড়া তখন গলায় গামছা জড়িয়ে, এক গলা জলে দাঁড়িয়ে গ্রাম দেবতার কাছে 'মানত' করেছিলেন। ছেলে বেঁচে ফিরলেই একজোড়া হাতি ও ঘোড়া দান করবেন। তাই আজ পুজোয় দেবেনখুড়া এই হাতি ঘোড়া নিয়ে এসেছেন। 'থানে' থরে থরে সাজানো আছে এমন অজস্র মাটির হাতি ঘোড়া।

'থান'। গ্রামের বাইরে অবস্থিত একটি দেবস্থান। গ্রাম দেবতার স্থানকেই বলে 'থান'। কোথাও উন্মুক্ত বা খোলা আকাশের নিচে, কোথাও গাছের তলায় বা ছায়ায়, কোথাও বা ঝোপেঝাড়ে গ্রামদেবতাদের এই থানগুলো অবস্থিত। দেবতার কোনও মূর্তি থাকে না। সিঁদুর মাখানো পাথর, গাছ কিংবা মাটির হাতি ঘোড়াকেই প্রতীক রূপে পূজা করা হয়। 

গ্রামবাসীরা এই গ্রাম দেবতাদের ভয় ও ভক্তি করেন। তার নামে 'মানত' করেন। সর্বদায় তাকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করেন। তাই পশু-পক্ষী যেমন ছাগল, মুরগি, পায়রা ও শুকরও বলি দেওয়া হয়। পুজোর নৈবেদ্য হিসাবে মাটির হাতি ঘোড়াও দান করা হয়।

প্রাক আর্য আদিম জনগোষ্ঠীর ভয় ভক্তির এই দেবতারা সচরাচর গ্রামের ভিতরে থাকে না। গ্রামের বাইরে থেকেই গ্রামকে পাহারা দেন। এবং সুরক্ষিত রাখেন বলেই মনে করা হয়। ব্রাহ্মণ্য বিধানে এই গ্রাম্য দেবতার পূজা একরকম নিষিদ্ধ। একটা সময় এই গ্রাম্য দেবদেবীগুলোর পূজা নিষিদ্ধ করার একটা প্রয়াসও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এই পুজো বন্ধ করা যায়নি। বরং কিছু কিছু গ্রাম্য দেবদেবী যেমন শীতলা, মনসা, চন্ডী, ষষ্ঠী, শ্মশানচারী কালী ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মধ্যে একটু একটু করে স্বীকৃতি লাভ করে নিয়েছে।

গ্রাম দেবতার পুজোর শুরুটা কীভাবে? ভয় থেকে। ভয় থেকেই আসে ভক্তি। শ্রদ্ধা। কিসের ভয়? নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার ভয়। সুরক্ষা বিঘ্নিত হওয়ার ভয়। বিপন্ন হওয়ার ভয়। অর্থাৎ আমরা সংকটের মুখোমুখি হলেই ভয় পাই। কিংবা সংকট আসন্ন ভাবলেও ভয় পাই। ঠিক তখনই মুক্তির উপায় খুঁজি। সে উপায় নিজেরাই আবিষ্কার করতে পারলে ভালো। কিন্তু না পারলে? সে উপায় জানা না থাকলে? তখন আপ্রাণ ভাবে কোন এক দৈবশক্তির স্মরণাপন্ন হতে শুরু করি। না হলে অজানা বিপদটাকেই দেবতার আসনে বসিয়ে ফেলি। তাকেই তখন পূজা করে সন্তুষ্ট রাখার আপ্রাণ প্রচেষ্টা করি। 

জল ঝড় বৃষ্টি নদী-সমুদ্র আগুন পাহাড় প্রভৃতি প্রাকৃতিক শক্তি, চন্দ্র সূর্য পৃথিবী শনি প্রভৃতি জড় নক্ষত্র, বাঘ সিংহ হাতি ঘোড়া গরু সাপ প্রভৃতি জন্তু বা প্রাণীকেউ ভয়ে ও ভক্তিতে পূজা করি। তাদেরকে দেবতার আসনে প্রতিষ্ঠা করি(অলৌকিক নয় লৌকিক: প্রবীর ঘোষ)।

এ প্রসঙ্গে ভবানীপ্রসাদ সাহু বলেছেন, "প্রকৃতির কাছে সে(মানুষ) ছিল শিশুর মতো অসহায়। প্রকৃতি বিজ্ঞান সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিল শিশুর মতোই অপ্রতুল। কিন্তু অনুসন্ধিৎসা ও চিন্তা করার ক্ষমতার অধিকারী। এই অনুসন্ধিৎসাকে তৃপ্ত করতে সে আপাত যুক্তিগ্রাহ্য নানা কল্পনার জন্ম দেয়। প্রাকৃতিক নানা কিছুর পেছনে এক পরম শক্তির কল্পনা করে"(ধর্মের উৎস সন্ধানে: ভবানীপ্রাসাদ সাহু)।

"প্রত্ন মানুষ ভয় করতে শিখেছিল যেমন হিংস্র প্রাণীকে, প্রকৃতির রহস্যকে, পাহাড় পর্বত নদীকে, আকাশকে তেমনি সে ভয় করতে শিখেছিল মৃত্যুকেও।... রোগ বিপদ আপদ মড়ক মন্বন্তর খরা বন্যা বজ্রপাত আসে প্রকৃতির নিয়মেই। প্রত্ন মানুষ তা বুঝতে পারেনি।" এই শক্তিকে তুষ্ট করার চিন্তা বা কল্পনা থেকেই লৌকিক দেবদেবীর পূজা শুরু হয়েছে(রাঢ়ের পূর্ব পুরুষ পূজা: মিহির চৌধুরী কামিল্যা)।

যাই হোক দেবতার উৎস বড় জটিল বিষয়। সে না হয় পরে কখনও আলোচিত হবে। আজকে আমার বিষয় হলো দেবস্থান বা থানের ওই হাতি ঘোড়াগুলো। পথে-প্রান্তরে, গাছের তলায় গ্রাম দেবতার স্থানগুলোতে ছোট বড় অজস্র হাতি ঘোড়ায় ভর্তি। সিঁদুর মেখে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে সেগুলো। কোনও কোনওটা কালের প্রবাহে ভগ্নদশা। তবে দেখেই মনে হবে দারুন এক হস্তশিল্পের নিদর্শন। টেরাকোটার অপূর্ব কারুকার্যময়তা। বীরত্ব যেন ঠিকরে বেরুচ্ছে। জিরাফের মতো দীর্ঘ গ্রীবা যুক্ত ঘোড়াগুলো। দুরন্তপনায় যেন টগবগে। কিন্তু কীভাবে তারা এল এই দেবস্থানে?

পূজারী কে জিজ্ঞেস করলাম, দেবস্থানের সমস্ত হাতি ঘোড়া গুলি কি এভাবেই উৎসর্গীকৃত?

পূজারী মাথা নেড়ে "হ্যাঁ" বললেন।সেইসঙ্গে জানালেন, কেবলমাত্র 'মানত' থেকেই নয়, কেউ কেউ পূজার অর্ঘ্য হিসাবেও ছোট ছোট হাতি ঘোড়া দান করে থাকেন।

"মানত" বা "মানৎ"। শব্দটির আভিধানিক অর্থ --- কোনও বিষয়ে পবিত্র লাভের জন্য দেবতাকে কিছু দেবার মানসিক অঙ্গীকার। কিংবা মনোবাঞ্ছা পূরণের প্রত্যাশায় সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে কোন কিছু উৎসর্গ করার সংকল্প। অর্থাৎ ভেট বা উপঢৌকন।

এই 'মানত' শব্দটা 'ভয়' শব্দটাকে কোথাও যেন দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। ভয় থেকে যে ভক্তি, সেখানে কোনও শর্ত নেই। আছে কেবল নিঃশর্ত ভাবে দেবতাকে পূজা করা আর তুষ্ট রাখার প্রচেষ্টা করা। যেমন প্রাকৃতিক শক্তিকে ভয় পাই বলেই প্রকৃতিকে পূজা করি। তার কু-দৃষ্টি না পড়ার জন্য তাকে তুষ্ট রাখার চেষ্টা করি। ব্যস। এটুকুই।কিন্তু 'মানত' শব্দটা একেবারেই যেন ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে। এখানে একটা শর্ত যেন অদৃশ্য ভাবে আরোপিত। দেবতা যদি আমার মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন তাহলে আমি অমুক অমুক দান করব। অর্থাৎ তুমি আমার ইচ্ছা পূরণ করলে আমি দেব। না হলে দেব না। দেবতা ও ভক্ত যেন পরস্পর একটা বিনিময় সিস্টেমে আবদ্ধ। ভয় নয়, তখন যেন দুজনেই সমান সমান। বরং ভক্তেরা তার থেকেও বেশি। অনেকটাই Give and Take-র মতো। যদি আমাকে দেখো, তবে আমিও দেখবো। 'যদি' শব্দটা দিয়ে দেবতাকে উপেক্ষা করার কিংবা অস্বীকার করার একটা দুঃসাহস কোথাও যেন লুকিয়ে আছে। তাই 'মানত' শব্দটি বড়ই জটিল।

মনে অনেকগুলো প্রশ্ন এসে ভিড় করছে। গ্রাম দেবতাদেরকে কেন মাটির হাতি ঘোড়া দান করা হয়? হাতি ঘোড়া ই বা কেন? অন্য পশু নয় কেন? দেবতা এতে সন্তুষ্টই বা হয় কেন?

উত্তরগুলো খোঁজার জন্য অনেককেই  প্রশ্ন করতে লাগলাম। কিন্তু কেউ এর সঠিক সদুত্তর দিতে পারলেন না। সকলেই নিজেদের মতো করে মনগড়া উত্তর দিলেন। প্রামাণ্য কোনও নথির সন্ধানও তারা বলতে পারলেন না। বরং অনেকেই বললেন, এর কোন প্রামাণ্য নথি আছে বলে তাদের জানা নেই। সবটাই নাকি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা একটা প্রচলিত লোকধর্ম বা প্রথা। কেউ বললেন, অনুসন্ধান করলে হয়তো বা কিছু পাওয়া গেলেও যেতে পারে।

মনটা খচখচ করতেই লাগল। একটা অতৃপ্তি কেমন যেন মনের মধ্যে অশান্তি তৈরি করেই চলেছে।  উত্তর তো মিলছেই না, বরং প্রশ্নমালা আরও বেশি করে ভিড় জমাচ্ছে। তাই গবেষণার জন্য নয়। নিছক মনের কৌতূহল মেটাতেই এদিক-ওদিক অনুসন্ধান করতে লাগলাম নিজেই। কেবল মনকে চলমান অস্থিরতা থেকে কেবল মুক্তি দিতেই। তাই নিজের মতো করে যে টুকু জেনেছি, সেটাই লিখলাম। আপনারা যদি আরও বেশি কিছু জানেন, অবশ্যই জানাবেন। মনের তৃষ্না তা হলে আরও কিছুটা মিটবে।

ঝাড়গ্রামের প্রবীণ লোকসংস্কৃতির গবেষক সুব্রত মুখোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে বলেছেন, 'গরাম থান' এ(দেবস্থান) পোড়ামাটির তৈরি হাতি ঘোড়ার ছোট ছোট "ছলন"(মূর্তি) থাকে। এই গ্রামদেবতা সব শক্তির উৎস ও বিঘ্ন বিনাশক। হাতির বিশালাকৃতি ও অসীম শক্তির কারণে প্রাচীনকাল থেকেই তার উপর দেবত্ব আরোপিত হয়েছে। মানুষের বিশ্বাস, দেবস্থানে হাতি থাকলে গ্রামের কারও কোনও ক্ষতি হবে না।(আনন্দবাজার পত্রিকা: ১০ নভেম্বর, ২০১৯)

মানভূম কলেজের শিক্ষক তথা পুরুলিয়া জেলার গবেষক তপন পাত্র জানান, অনেকে বিশ্বাস করেন ঘোড়ায় চড়ে দেবতা গ্রাম প্রদক্ষিণ করেন। সেই জন্য মাটির ঘোড়া দেওয়ার প্রথা।(আনন্দবাজার পত্রিকা:১৬জানুয়ারী, ২০১৮)

বিশিষ্ট এই দুই গবেষক এর কথায় দুটো প্রধান দিক উঠে এসেছে।
একটি হলো হাতি ও ঘোড়াকে দেবত্ব রূপে পূজা করা। অর্থাৎ হাতি ঘোড়া নিজেই এখানে ঠাকুর বা দেবতা রূপে পূজিত হয়।

অন্য দিকটি হলো হাতি ঘোড়া ওই দেবতাদের বাহন হিসাবে নিবেদিত হয়। অর্থাৎ দেবতারা এই হাতি ঘোড়ার(বাহনের) পিঠে চড়ে গ্রাম প্রদক্ষিণ করবেন। গ্রামকে সুরক্ষিত রাখবেন। 

আগেকার দিনে রাজা ও শাসক ছাড়া অন্য কেউ হাতি ঘোড়া রাখতে পারত না। বাড়িতে হাতি ঘোড়া থাকা মানে বিরাট এক আভিজাত্যের ব্যাপার। হাতি ঘোড়াকে তখন বহু মূল্যবান কিছু বলে ভাবা হত। উপহার হিসাবেও এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ কিছু ছিল না। তাই  রাজাদের মতো এই গ্রাম দেবতারাও হাতি ঘোড়ায় সুসজ্জিত হয়ে আভিজাত্য বজায় রাখবেন এমনটাই চাইতেন ভক্তেরা। কারণ  হাতি ঘোড়ায় সুসজ্জিত রাজা চিরকালই প্রজাদের কাছে ছিলেন দেবতা সমান। ইতিহাস অন্তত সে কথাই বলে।

কিন্তু হাতি ঘোড়াই কেন মানত রাখা হয়? অন্য পশু নয় কেন? এ প্রসঙ্গে "পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি"-র লেখক বিনয় বাবু একটা যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন,"বাঘ ভাল্লুক তৈরি করা আরও কঠিন বলে হয়তো ক্রমে মৃৎশিল্পীরা ছেড়ে দিয়েছেন। যা সহজে তৈরি করা যায়, তাই চালু রয়েছে।"

হাতি ও ঘোড়ার ইতিহাসটা তবে কী! ভারতীয় সভ্যতা নাকি একসময় হাতিরই সভ্যতার ইতিহাস ছিল। হাতির পিঠে চড়ে যুদ্ধ করা, হাতির পিঠে চড়ে শিকারে যাওয়া, হাতির পিঠে চড়ে পথ চলা ও ভ্রমণ, এমনকি হাতির পিঠে চড়েই ব্যবসা বাণিজ্য সব কিছুই হত। আলেকজান্ডারের সঙ্গে ভারতীয়দের যে যুদ্ধ হয়েছিল সে তো একরকম ঘোড়ার সঙ্গে হাতিরই যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে হাতিই পরাজিত হয়েছিল।

জঙ্গলমহলের বিস্তীর্ণ এলাকা ছিল ঘন জঙ্গলে ভরা। বন্য জন্তুর উপদ্রব ছিল পদে পদে। হাতিও তার ব্যতিক্রম ছিল না। ময়ূর ভঞ্জের জঙ্গল থেকে শয়ে শয়ে হাতির দল জঙ্গলমহলে ঢুকে পড়ত। তার বিশাল আকার, দারুণ শক্তি ও ক্ষমতায় জঙ্গলবাসী ভীত হয়ে পড়েছিল। হাতির আক্রমণে কত মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আজও সেই মৃত্যুর ধারা অব্যাহত। মাঝে মাঝেই হাতির হানায় জঙ্গলমহলে কেউ না কেউ মারা যাচ্ছেন। তাই বিশাল বপুর অধিকারী এই প্রাণীটিকেও মানুষ দেবতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

জঙ্গলমহল জুড়ে হাতিকে তাই শুধু হাতি বলেই ডাকা হয় না। তার শেষে "ঠাকুর" শব্দটা জুড়ে দিয়ে তাকে দেবত্বে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। অর্থাৎ "হাতিঠাকুর" বলেই তার নাম নেওয়া হয়। হাতির সঙ্গে এই "ঠাকুর" শব্দটা যেভাবে জুড়ে দেয়া হয়েছে তাতেই বোঝা যায় ভয় ও ভক্তি থেকেই এমনটা ঘটেছে। মৃত হাতিকে এলাকাবাসী সিঁন্দুর মাখিয়ে পুজোও করেন।

প্রতি বছর ৩১ শে অক্টোবর ঝাড়গ্রামের বরাসুলি গ্রামে হাতি মূর্তির পূজা হয়। ১৯৯৮ সালের ৩১ শে অক্টোবর বরাসুলির জঙ্গলে দুটি পুরুষ হাতির প্রবল লড়াই বেধেছিল। ভয়ঙ্কর সেই লড়াইয়ে একটির মৃত্যুও হয়েছিল। তারই স্মৃতিতে গ্রামবাসীরা একটি হাতির মূর্তি নির্মাণ করেন। পরে পরে মূর্তিটি আজ দেবতার আসন লাভ করেছে। ঐদিন বেশ ঘটা করে হাতি ঠাকুরের পূজা হয়। বসে হাতি মেলা।

শুধু ঝাড়গ্রাম নয়, শালবনীতেও হয় হাতির পূজা। পাথরাজুড়ি ও চন্দন কাঠ গ্রামে প্রতিবছর হাতিঠাকুরের পূজা অনুষ্ঠিত হয়। ধুমধাম করে মেলার আয়োজনও বসে।

পশ্চিমবঙ্গের জাতিগত উপাধিও আছে 'হাতি'। হাতি যে "টোটেম" রূপে পূজিত হয় সেটাই তার বড় প্রমাণ।

জঙ্গলমহল বাসীরা হাতি ঠাকুরকে বনভূমির রক্ষক বলেও মনে করেন। হাতির নামে একাধিক গ্রামও আছে। যেমন হাতিবাড়ি, হাতিধরা, হাতিলোট, হাতিগেড়িয়া হাতিপাতা ইত্যাদি।

ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাসে হাতির পরেই এসেছে ঘোড়া। দেবস্থানগুলোতেও তাই। মন্থর গতির হাতি সভ্যতার পরেই একটু একটু করে জায়গা করে নিয়েছে দ্রুতগামী অশ্বসভ্যতা। মাটির ঘোড়া পূজা অনেক আদিম জাতির মধ্যেও দেখা যায়। ১৮৭৫ সালে মেজর হেনভলে বলেছেন, ভিলদের দেবতা স্থানেও মাটির ঘোড়া দেখা গেছে। কোথাও আবার সেই ঘোড়ার সামনে সান্ধ্য প্রদীপ জ্বালা থাকে।

মধ্যভারতীয় আদিবাসীরাও ঘোড়া পূজা করেন। তবে বন্য ঘোড়া জঙ্গলমহলের আদি জন্তু নয়। অনেক পরবর্তীকালে এসেছে। সম্ভবত মুসলমান সময়কালে। পীরস্থান বা ধর্ম ঠাকুরের ঐতিহাসিক সময়-কালের কাছাকাছি। তাই ওই দুই থানে ঘোড়ার একছত্র প্রাধান্য। কয়েকটা হাতি নেহাতই বিক্ষিপ্ত ভাবে দেখা যায়। ঘোড়াকে ধর্ম ঠাকুরের বাহন হিসাবেও মনে করা হয়। সে কারণেও ধর্ম ঠাকুরের থানে ঘোড়াকে 'মানত' করা হয়। তবে আরও একটি কারণ আছে বলে মনে করা হয়, তা হল পীরস্থান বা ধর্ম ঠাকুরের স্থানগুলো বন্য পরিবেশে অবস্থিত নয়। সে কারণেও হাতির মূর্তি বাদ যেতে পারে।

যে সমস্ত স্থান বা থানে গ্রাম দেবতার মূর্তি নেই, সেগুলোতে মাটির ঘোড়াগুলিই প্রতীক রূপে পূজিত হয়। ওরাই তখন দেবতার আসন লাভ করে।

ধর্ম ঠাকুরের বাহন এই ঘোড়াগুলোকে কেউ কেউ মনে করেন আর্যদের ঘোড়া। কেউ বলেন গ্রিকদের ঘোড়া। কেউ বলেন আরবি বা তুর্কিদের ঘোড়া। কেউ আবার বলেন, সূর্য দেবের রথের ঘোড়া।


লোকশিল্পের সঙ্গে লোকধর্মের সম্পর্ক গভীর। এমনটাই মনে করেন বিনয় ঘোষ। মানুষের আচরিত ধর্ম ও কল্পিত ধ্যান-ধারণাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে শিল্পকলা। তিনি মনে করেন এটা শুধু আমাদের দেশে নয় অন্যান্য দেশেও। যেমন বৌদ্ধমূর্তি শিল্প। গৌতম বুদ্ধের ধ্যান মগ্ন রূপ থেকে শুরু করে তার একাধিক ভাবের দেহসৌষ্ঠব গড়ে তুলেছেন শিল্পীরা।

ঠিক সেভাবেই বাঁকুড়া পুরুলিয়াতেও গড়ে উঠেছে হাতি ঘোড়া তৈরীর এই মৃৎশিল্প।পোড়ামাটির হাতি ঘোড়া নির্মাণ শুরু হয়েছিল পূজার উদ্দেশ্যেই। দেবতাদেরকে নিবেদনের উদ্দেশ্যেই। এখনও তাই হয়। বাঁকুড়ার পাঁচমুড়া গ্রাম তো আজও জগৎবিখ্যাত হাতি ঘোড়ার মৃৎ-শিল্পের জন্য। পরবর্তী কালে হাতি ঘোড়ার উপর অদ্ভুত   সৌন্দর্যময় টেরাকোটার কাজ শুরু করেন শিল্পীরা। অপূর্ব হস্ত শিল্পের নিদর্শন হিসাবে হাতি ঘোড়াগুলো আজ দেবস্থানের সঙ্গে সঙ্গে মনুষ্য স্থানেও জায়গা করে নিয়েছে। বিদেশে পর্যন্ত যাচ্ছে। মৃৎশিল্পের এই উৎকর্ষতা সম্ভব হয়েছে লোকধর্মের কারণেই। সেটাই বা কম কিসের।

তথ্যসূত্র: ১) পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি--বিনয় ঘোষ
২) বাঙ্গালীর ইতিহাস-- নীহাররঞ্জন রায়
৩) অলৌকিক নয় লৌকিক-- প্রবীর ঘোষ
৪) রাঢ়ের পূর্বপুরুষ পূজা-- মিহির চৌধুরী কামিল্যা
৫) বাংলার লৌকিক দেবতা-- গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু
৬) ধর্মের উৎস সন্ধানে-- ভবানীপ্রসাদ সাহু

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments