জ্বলদর্চি

প্রথম মহিলা বাঙালি-বৈজ্ঞানিক ড: অসীমা চট্টোপাধ্যায় ― ০৩/পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ৫৮


প্রথম মহিলা বাঙালি-বৈজ্ঞানিক ড: অসীমা চট্টোপাধ্যায় ― ০৩

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

(১)
চিত্ত যেথা ভয়শূন্য...

দিনটা ছিল ২৮শে ফেব্রুয়ারি। সাল ১৯২৮। গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে গর্বের দিন। ওইদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালিত অধ্যাপক স্যার সি. ভি. রমন তাঁর ঐতিহাসিক 'রমন এফেক্ট' ঘটনা আবিষ্কার করে বিজ্ঞানীমহলে রীতিমত শোরগোল ফেলে দিয়েছেন। কলকাতার রাজপথে সে কী হইচই! ইংরেজশাসকরা পর্যন্ত নড়েচড়ে বসেছে। শীতঘুম ভেঙে জেগে উঠছে দেশের শিক্ষিত যুবসমাজ। একটি কাঁচের গ্লাসে জল বর্ণহীন, কিন্তু সমুদ্রের জল নীল দেখায় কেন? এমন আজব প্রশ্নের সমাধান করতে গিয়েই নাকি তাঁর 'রমন এফেক্ট' ঘটনার আবিষ্কার। স্যার সি. ভি. রমন-এর এ হেন আবিষ্কারে তৃতীয় বিশ্বের মানুষগুলোর চোখে-মুখে উপচে-পড়া খুশি। ১৯৩০ সালে ফিজিক্সে তাঁর নোবেল পুরস্কার বিজয় তাদের আনন্দে বাড়তি মাত্রা যোগ করে। শুধু প্রথম ভারতীয় নয়, এশিয়ার প্রথম বিজ্ঞানী হিসাবে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কালো-বাদামি চামড়ার মানুষের প্রতিনিধি তিনি। তাঁর নোবেল প্রাপ্তির খুশিতে ১৯৮৭ সাল থেকে প্রতি বছর ২৮শে ফেব্রুয়ারি দিনটি ভারতে 'বিজ্ঞান দিবস' হিসাবে পালিত হয়। 

১৯৩০ সালে স্যার সি. ভি. রমন-এর নোবেল প্রাপ্তির আনন্দে কলকাতার রাজপথে, অলিতে-গলিতে, আড্ডায়, শিক্ষিত মহলে সে কী উন্মাদনা! পরাধীনতার গ্লানি সেদিন খানিকটা স্তিমিত যেন। অত্যাচারী ব্রিটিশদের চোখে চোখ রেখে এক ভারতীয় বৈজ্ঞানিকের এই অসম লড়াই, বিশ্বজোড়া সাফল্য বুঝিয়ে দিল ― উচ্চতর গবেষণায় কোনো অংশে পিছিয়ে নেই ভারতীয়রা, তা সে ব্রিটিশরা যতই অবজ্ঞা-অসহযোগ করুক না কেন! বিজ্ঞান চর্চায় বাংলা তথা বাঙালি চোখে চোখ রেখে লড়াই জারি রেখেছে বহুকাল আগে থেকেই। আর ষোলআনা বাঙালি না হয়েও স্যার সি. ভি. রমন-এর নোবেল জয়ের ভিতটা তৈরি হয়েছে কলকাতায়। সুতরাং কলকাতার আবেগের জয়জয়কার আজ। তা, এ হেন খবরে গা-ছাড়া ভাব কাটিয়ে উঠল তৎকালীন কলকাতার শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা। সকলের ঐকান্তিক ইচ্ছা― নোবেল জয়ী শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের সম্মানে এক বর্ণাঢ্য সংবর্ধনা অনুষ্ঠান আয়োজিত হবে শহরে। 

সে-সংবর্ধনা সভায় গান গাইবে ভবিষ্যতের আরেক তারকা বৈজ্ঞানিক। এ এক আশ্চর্য সমাপতন। কাকতলীয়ও বটে। সেদিন নোবেল জয়ী বৈজ্ঞানিকের সম্মুখে গান গাওয়ার বিরল সৌভাগ্য অর্জন করে বছর তেরোর অসীমা। খুব ছোট থেকে মেয়েটির গানের গলা বেশ ভালো। মিস্টি সুরে গাওয়া তার গান মুগ্ধ করে সবাইকে। তার বাবা-মায়ের সংগীতের দারুণ শখ। মূলত মা-বাবার উদ্যোগে তার গান শেখায় হাতেখড়ি। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরতে ফিরতে বিকেল সেই সাড়ে চারটা কিংবা পাঁচটা। ঘড়িতে যখন কাঁটায় কাঁটায় সন্ধ্যা সাতটা বাজে, গান শুরু হত মেয়েটির। গানের রেওয়াজ চলত বেশ কিছু সময় ধরে। তারপর ক্লাসের পড়াশুনা। এভাবে আনন্দে, মজায় দিনগুলি কাটে কিশোরী মেয়ের।

সালটা ১৯৩২। সে-বছর বেথুন কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশনে উত্তীর্ণ হয় সে। পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য জুটে গেল স্কলারশিপ। বাবা-মায়ের আনন্দ আজ বাধনহারা। মেয়ের সাফল্যে মনে মনে গর্বিত তাঁরা। সামাজিক বেড়াজাল টপকে এ সংগ্রাম-লড়াই অনুপ্রেরণা জোগায় অগণিত অবলা নারীকে। রূপকথা বনে যায় সে-কাহিনী। যদিও অনেক অনেক পথ বাকি এখনও। ম্যাট্রিকুলেশন পাশের পর মেয়েকে বেথুন কলেজে ভর্তি করলেন বাবা-মা। পছন্দের বিষয় অবশ্যই বিজ্ঞান। এই বেথুন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট (আই এস সি) পরীক্ষায় পাশ করে অসীমা। সেটা ১৯৩৪ সাল। পরীক্ষার ফলাফল যথারীতি ঈর্ষণীয়। এবারও মিলে গেল স্কলারশিপ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব লতিফ এবং ফাদার লাফনট স্কলারশিপ পেল সে। এর সঙ্গে হেমপ্রভা বোস স্মারক পদক প্রাপ্তি উপরিপাওনা।
     
আই এস সি পাশ করার পর সমস্যা আরও প্রকট হল। স্নাতক স্তরে পড়াশুনা করতে চায় মেয়েটি। বি এস সি অনার্স। কিন্তু গ্র্যাজুয়েশন পড়বে কোথায়? সম্পূর্ণ মহিলা কলেজ তখন কলকাতায় অমিল। একমাত্র স্কটিশ চার্চ কলেজে মেয়েদের ভর্তির অনুমতি রয়েছে। স্কটিশ চার্চ ব্যতীত কলকাতার অন্য কোনও কলেজে পড়ার অধিকার নেই মেয়েদের। স্কটিশ চার্চ কলেজে বিস্তর সমস্যা। ছেলে আর মেয়ে একসঙ্গে ক্লাস করে। ওদিকে গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে সে। কলেজে ছাত্রদের সঙ্গে ক্লাস করলে সমাজে লোকজন মন্দ কথা রটাবে। কটুক্তি আর কটাক্ষ নিত্যসঙ্গী হবে। বাড়ির বাইরে বের হওয়া তখন দুষ্কর হয়ে উঠবে। হাজার একটা বাধা। সকল প্রতিবন্ধকতা আর সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে স্কটিশ চার্চ কলেজে সেদিন অ্যাডমিশন নেয় সে। মেয়ের উচ্চশিক্ষায় কোনও আপষ নয়। বাবা মায়ের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে মেয়ের পেছনে। বিশেষ করে মা কমলা দেবী সবসময় মেয়ের পাশে দাঁড়িয়েছেন, পড়াশুনা নিয়ে কোনও দিন সমঝোতা করেননি।

ভর্তির সমস্যা মিটল। বিষয় নির্বাচন নিয়ে আরেকপ্রস্থ দোটানায় মেয়ে। কী নিয়ে পড়বে সে? বিজ্ঞানের সকল বিষয়ে তার অবাধ স্বতঃস্ফূর্ত বিচরণ। যদিও রসায়ন শাস্ত্রের প্রতি তার দুর্বলতা-টান সর্বজনবিদিত। অল্প বয়সে বাবার হাত ধরে ভেষজ গাছগাছড়ার প্রতি তার একটা আলাদা আকর্ষণ কাজ করে। মেয়েবেলায় বাবার মুখে শুনে শুনে অগুনতি গাছপালার নাম এবং তাদের গুণাগুণ তার স্মৃতিতে ধরা রয়েছে। গ্রামের বাড়ি গোপীনাথপুরে এখনও দেখতে পাওয়া যায় বাড়ির পাশে ভ্যারাইটি গাছগাছালি। সবই প্রায় ভেষজ গুণাগুণে সমৃদ্ধ। সেগুলোর ওষধি গুণ সম্পর্কে দারুণ ভাবে অবহিত অসীমা। তার ধারণা রসায়ন শাস্ত্রই পারে অবহেলিত ভেষজ উদ্ভিদগুলির উপকারিতা বিশদভাবে খুঁজে বের করতে। শেষমেশ সাত-পাঁচ ভেবে ভেবে কলেজে কেমিস্ট্রি অনার্স-এ ভর্তি মনস্থির করে সে।

কলেজের কেমিস্ট্রি অনার্সে যত স্টুডেন্ট ভর্তি হয়েছে, তাদের মধ্যে একমাত্র ছাত্রী অসীমা। ক্লাসে নজর কাড়ে মেধাবী একলা মেয়েটা। ধন্য মেয়ের অধ্যাবসায়। ভিন্ন ভিন্ন বিষয় জানবার দারুণ কৌতূহল তার। রসায়নে তার বিষয় গভীরতা দেখার মতন। সেজন্য অধ্যাপকের সমীহ আদায় করে নেয় সহজে। গভীর অধ্যাবসায়ে ফল মিলল হাতেনাতে। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে তাক লাগিয়ে দিল সবাইকে। সেবার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বি এস সি পাশ করল সে বিশেষ কৃতিত্ব নিয়ে। জিতল ইউনিভার্সিটির প্রেস্টিজিয়াস 'বাসন্তী দেবী গোল্ড মেডেল'।

(২)
উচ্চ যেথা শির...

'তুই কি বাঙালি, না মাদ্রাজি? তুই কি পড়াশোনা চালিয়ে যাবি?'― এক বর্ষীয়ান অধ্যাপকের নিখাদ রসিকতা। হয়তো তাঁর কথায় ছাত্রীর প্রতি ঈষৎ উদ্বেগমাখা দরদ মিশ্রিত ছিল সেদিন। কারণ গড়পড়তা বাঙালি ঘরের মেয়েরা সচরাচর এতদূর লেখাপড়া করতে আসে না। দুঃসহ কষ্ট সহ্য করে এপর্যন্ত এলেও মাঝপথে আবার হারিয়ে যায়। অভিজ্ঞ প্রফেসরের জহুরী চোখে এমন ভুরি ভুরি উদাহরণ ভেসে ওঠে।
        

সত্তরোর্ধ প্রফেসরের সাবধানী কথা শুনে হতচকিত ছাত্রীটি। কী উত্তর করবে ভেবে কুলকিনারা পায় না। চিন্তিত মনে অধোবদন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। এ হেন অধ্যাপকের ভূবনজোড়া নাম-খ্যাতি। বৈজ্ঞানিক-প্রফেসরের পাণ্ডিত্য আর নতুন নতুন আবিষ্কারে মন্ত্রমুগ্ধ দেশবাসী সমেত গোটা বিশ্বের লোক। তিনি একেবারে মাটির মানুষ। রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে তাঁকে সমীহ করে চলে সবাই। তাঁর কথা বেদবাক্য হিসাবে মনে মনে স্মরণ করে। এ হেন আদর্শ শিক্ষক-বৈজ্ঞানিক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়-এর সুনজরে পড়ে গেল ছাত্রীটি।

ক্লাসে তখন সর্বসাকুল্যে জনা তেরো স্টুডেন্ট। বারো জন ছাত্র আর একমাত্র ছাত্রী অসীমা। বিজ্ঞান কলেজে সকল শিক্ষককে ডেকে এনে ছাত্রী অসীমা মুখোপাধ্যায়কে দেখিয়ে প্রফেসর রায় সেদিন বললেন― 
'ভালো করে যত্ন নেবে, এর যেন কোনও অসুবিধা না হয়।'
       

সালটা ছিল ১৯৩৬। সে-বছর বি এস সি পাশ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে মাস্টার্স কোর্সে অ্যাডমিশন নিয়েছে অসীমা মুখোপাধ্যায়। বিজ্ঞান কলেজে তখন একগুচ্ছ গুণী অধ্যাপকের চাঁদের হাট বসেছে। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র মিত্র, বিজ্ঞানী-প্রফেসর পুলিনবিহারী সরকার, প্রফেসর যোগেন্দ্রচন্দ্র বর্ধন, ড. প্রফুল্ল কুমার বসু প্রমুখ গুণী মাস্টার মশায়দের সান্নিধ্যে বিজ্ঞান কলেজের কেমিস্ট্রি বিভাগ আলোয় আলোকিত। এ হেন তারকার মধ্যমণি কিন্তু একজন। তিনি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। দেশগড়ার একজন প্রকৃত নায়ক, অভ্রান্ত কারিগর। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার দূরে সরিয়ে রেখে শুধুমাত্র তাঁর নিজের হাতে গড়া অগণিত ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা হিসেবে ধরলে সকলের নমস্য তিনি। এ কথা সর্বজনবিদিত ― স্বাধীনতাপূর্ব এবং স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে রসায়ন বিজ্ঞানের প্রাণপুরুষ তিনি। তাঁর সংস্পর্শে কেউ যদি একবার এসে পড়ে, রসায়ন গবেষণায় সে দারুণ ভাবে উদ্বুদ্ধ হবেই হবে। তাকে হাতেকলমে গবেষণার অ-আ-ক-খ পাঠ পড়িয়ে তবেই বিজ্ঞানীর নিস্তার। রসায়ন বিজ্ঞানী হিসাবে ড. অসীমা চট্টোপাধ্যায়ের উঠে আসা এই শ্রদ্ধেয় বর্ষীয়ান শিক্ষকের শক্ত হাত ধরে। তাঁকে অনুসরণ করে সাফল্যের শিখরে বিরাজমান ড. চট্টোপাধ্যায়।

এম এস সি পাঠক্রমে তার বিশেষ ঝোঁক ছিল জৈব রসায়ন। অরগানিক কেমিস্ট্রি ভালো লাগার একটি বড় কারণ বোধহয় ভেষজ গাছগাছড়ার প্রতি তার অশেষ প্রেম। সেজন্য মাস্টার ডিগ্রিতে স্পেশাল পেপার রাখলেন জৈব রসায়ন। ১৯৩৮ সালে যখন রেজাল্ট বের হল, দেখা গেল ইউনিভার্সিটির মধ্যে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় হয়েছেন অসীমা দেবী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রৌপ্য পদক পেয়ে এম এস সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ তিনি। তার কৃতিত্বের মুকুটে যোগ হল আরও একটি পুরস্কার 'যোগমায়া দেবী স্বর্ণপদক'।

তথ্যসূত্র :
●'বারোজন বাঙালি রসায়নবিজ্ঞানী'―ড. রবীন্দ্রনাথ পাত্র
●'অর্ধশত বিজ্ঞানী-কথা'― ড. সন্তোষকুমার ঘোড়ই
●বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, দৈনিক সংবাদপত্র
●উইকিপিডিয়া, সায়েন্টিফিক উইমেন পেজ

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments