জ্বলদর্চি

গল্প হলেও সত্যি/শ্রীজিৎ জানা

গল্প হলেও সত্যি

শ্রীজিৎ জানা


ভূত বিশ্বাস করে না যারা সন্তু তাদের দলে। হামেশাই টিফিন আওয়ারে এ নিয়ে অভীকের সঙ্গে তার বাকবিতণ্ডা চলে। ক্লাস নাইনে পড়া দুই বন্ধুর যুক্তি-তক্কো শুনে বাকিরা সব  থ'বনে যায়। অভীক কিছুতেই দমবার পাত্র নয়।  সন্তুকে সে নাগাড়ে প্রশ্ন করতে ছাড়ে না।

--তার মানে প্যারানরমাল সাবজেক্টটাকে তুই কোন পাত্তাই দিচ্ছিস না?

-- উড়িয়ে দিচ্ছি না,  তবে এর মধ্যে কতটা যুক্তি আর কতটা গাঁজাখুরি  আমার কাছে সেটাই দেখবার!

-- ভূত অশরীরী তাকে দেখা যায় না। কিন্তু তার অস্তিত্ব ঠিকই টের পাওয়া যায়।

--দ্যাখ্  ভূত ব্যাপারটই পুরোপুরি ভয়ের কনসেপ্ট থেকে বানানো। নিজেদের মনগড়া চেহারা দেওয়া হয়েছে তাদের। ইয়া বড় বড় দাঁত- নখ,  রক্তাভ চোখ,উল্টোপায়ে তারা হাঁটে, ঘাড় মটকে  রক্ত খায়, কথায় কথায় ভয় দেখায় ইত্যাদি ইত্যাদি নানা আজগুবি বানানো গল্প।

-- ইয়েস ব্রাদার! এক্সজ্যাক্টলি এগুলোই করে থাকে তারা

--- মেনে নিলাম। তাহলে এ ধরনের কয়েকটা ইন্সিডেন্ট বল, যার সাক্ষী তুই বা অন্য কেউ ছিল।

--- কেন তোর সেজ দাদু আর আমাদের গাঁয়ের বোসেদের পোড়ো জমিদার বাড়ি!


ব্যাস এইটুকু। পরের কথাগুলো বলতে যাবার আগেই স্কুলের ঘন্টা বেজে ওঠে। ক্লাসে ফিরে যায় দুজনে। হঠাৎ অভীকের চোখে পড়ে সন্তুর মুখ যেন হাল্কা মেঘের ছায়ায় ঢেকে আছে। স্কুল ছুটির পর সন্তুকে একপ্রকার চেপে ধরে অভীক।

-- কি হয়েছে আজকে তোর?  এভাবে হাল ছেড়ে দেবার তো পাত্র নোস তুই? থেমে গেলি কেন?

---অন্য একদিন ডিবেট কোরবো। আজ থাক।

 বলেই দ্রুত হাঁটা দেয় বাড়ির দিকে।

সন্তু সব কথা বলতে পারেনা অভীককে। এই ছয় সাত মাসে তাদের বাড়ি টা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। গাঁয়ের একমাত্র যৌথ পরিবারের গৌরবময় শিরোপাটা ধুলায় মিশে গেছে আজ।  জমিজমার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে চার দাদুর ছেলেমেয়েদের মধ্যে সে কি গন্ডগোল! হাতাহাতি! গ্রাম সালিশেও কোনো সুরাহা না হওয়ায় ঘটনা গড়িয়েছে আদালতে।আজকাল কেউ কারও মুখ দেখতে চায়না। হাঁড়ি আলাদা,খাওয়া- বসা আলাদা, যে যার দুয়ারের অংশ ঘিরে দিয়েছে চাঁচের বেড়ায়। গন্ডগোলের সময় কাছেই থাকত সন্তু। চেনা মানুষগুলোকে কেমন অচেনা ঠেকতো তার। সব যেন সেজ দাদুর মুখে শোনা বোসদের পুরানো বাড়ির ভূতেদের মত! বড় বড় নখ- দাঁত, চোখ থেকে হিংসার আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছে, পারলে এখনই  এ ওর ঘাড় মটকে দেবে। কান্নায় দৌড়ে পালাতো কাঁসাই পাড়ের শিমুলতলায়। স্বার্থের লোভে, ক্রোধে মানুষের চেহারা যে এমন বীভৎস হয়ে উঠতে পারে সন্তু বিশ্বাস করতে পারেনা! মা'কে কতবার বোঝাতে চেয়েছে সন্তু,
---বাবাকে বলোনা মা, জমিজায়গা নিয়ে বাড়িতে যা হোচ্ছে তা যেন বন্ধ করে।
---তোর বাবার হাতেই কি সব? তাছাড়া কেন ছাড়বে নিজের হকের পাওনা। তুই এসবের মধ্যে নাক গলাবি না।
---বাবা জেঠুদের বিবাদের বিষ কেন ছোটদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে? কেন একে অন্যের সাথে কথা বলতে,মিশতে বাধা দেওয়া হচ্ছে?
----তুই কি কৈফিয়ত চাইছিস? কে শিখিয়েছে এসব বোলতে? আসুক বাড়িতে তোর বাবা।
রাগে মুখ লাল হোয়ে ওঠে সন্তুর।  আর কিছু না বলে ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে চলে যায়।

অভীককে বোঝাতে চায় সন্তু অশরীরী ভূতের চেয়ে রক্তমাংসের মানুষ গুলো অনেক বেশি ক্রূর! অনেক বেশি প্রতিহিংসাপরায়ণ! সমবয়স্ক হলেও অভীক মনে মনে সমীহ করে সন্তুকে। আকার-ইঙ্গিতে সন্তুর কথায় সায় দিয়ে যায় সে। সন্তুর কথা থামে না। তার মতে ভূতেদের স্নেহ-মমতা না থাকাই তো স্বাভাবিক, কিন্তু এই ক'মাসে যে সেজ দাদু তাকে দাদুভাই বলে ডাকে নি, মা যে তাকে অপুদির কাছে ঘেঁষতে দেয়নি, সেটা তো মানুষ নামের প্রাণীদের সাথে কিছুতেই মেলেনা! অভীক বিস্ময় চোখে সন্তুর দিকে তাকায়!
 --জানিস অপু-দি রাতের কোচিং ক্লাসে যায়না ভূতের ভয় নয়, বটতলায় ছেলেগুলোর ভয়ে। পাকুড়দানা গ্রামের ক্লাস টেনের প্রতিমার মুখে অ্যাসিড মেরেছে ভুতে নয়, তার লাভার। সো ফ্রেন্ড ভুতকে ভয় পাস না। এবার থেকে মানুষকে ভয় পেতে শেখ। আর শোন সামনের ভূতচতুর্দশী তে আমি একাই যাচ্ছি বোসদের ভুতুড়ে বাড়িতে।

--- সে কি! কিন্তু কেন!?

--আমি দেখতে চাই ভূত যদি সত্যিই থাকে তারা কতখানি ভয়ঙ্কর! তারা কি মানুষের চেয়েও নিষ্ঠুর! আমি সামনে থেকে দেখতে চাই।
 অভীক বন্ধুকে বাধা দেওয়ার আপ্রান চেষ্টা করে। যতসব ভয়ঙ্কর ঘটনা ওই ভুতুড়ে বাড়ি টা সম্পর্কে সে শুনেছে একনাগাড়ে  সেগুলো সন্তুর কাছে আউড়ে যায়। কিন্তু সন্তু সেসব কথায় কিছুতেই কর্ণপাত করে না।

---অভীকদের বাড়িতে নেমন্তন্ন, ফিরতে রাত হবে। বলেই সন্ধ্যের আগে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছিল সন্তু।  বিকেলের পর থেকেই গাঁয়ের এদিকটায় সাধারণত কেউ আসে না। কয়েক বিঘা জায়গা জুড়ে শুধু বনজঙ্গল! বড় বড় আম খিরিশ কাঁঠাল এমনকি আসুদ ও বটগাছ।  ভেতরটা যে এতটা বীভৎস না এলে সন্তু জানতেই পারতো না। বিশাল বড় দোতালা বাড়ির এখানে ওখানে ধস পড়েছে। রাত নামার অনেক আগেই যেন কালো রাত দলা পাকিয়ে বসে আছে ঘরগুলোর ভেতর। কেমন যেন একটা গা ছমছম করা পরিবেশ! ভয় যে লাগছে না সন্তুর এমনটা নয়। হাতে একখানামাত্র টর্চ সম্বল। সন্তু আন্দাজ করতে পারছে রাত এখন অনেকটাই হবে। নিশ্চয়ই এতক্ষণ বাড়িতে তার খোঁজ পড়ে গেছে। পেটে খিদের আঁচড়কামড় টের পাচ্ছে  সে। কিন্তু তাকে আজ পাত্তা দিতে চায় না।  হঠাৎ দোতালায় ফিসফিসানি কথাবার্তার শব্দ শুনে সন্তর্পনে উঠে যায় সন্তু। কোণের ঘরটার বাইরে দাঁড়িয়ে কতগুলো ছায়া মানুষকে দেখতে পায় সে। তাদের চেহারা স্বাভাবিক মানুষের চেহারার মতো নয় ঠিকই, তবে খুব ভয়ঙ্কর বলা যাবে না। দুপক্ষের মধ্যে তীব্র একটা যে বচসা  বেঁধেছে সন্তু তা  বুঝতে পারে। ভয় চেপে আড়ালে দাঁড়িয়ে তাদের সব কথা শুনতে চায়।  মোটামুটি আন্দাজ করে একজন প্রধানের কাছে দুপক্ষ নিজেদের দাবি পেশ করছে। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে তাদের দলে নিতে চায় না। এই ভূতুড়ে বাড়িতে অন্যদের ঢুকতে দেবে না তারা। প্রধান ভূত জানতে চায় কেন নতুন ভুতেদেরএখানে থাকতে দেবে না! বিরোধী ভূতরা  স্পষ্ট জানায় নতুন ভূত তাদের মতোই হাবেভাবে একইরকম দেখতে হলেও একটা জিনিস তাদের মধ্যে নেই। তাই তারা দলে নেবেনা। প্রধান ভূত সহ নতুন ভূতরা তাদের কোন কারণে দলভুক্ত করা হচ্ছে না তা তীব্র ভাবে জানতে চায়। বিরোধীরা তখন সমস্বরে জানিয়ে দেয়,
-- এ যাবৎ নতুন যত ভূত আসছে তাদের কোনো হৃদযন্ত্র নেই। মানুষ থাকা অবস্থায়ও ছিল কিনা সন্দেহ!  এরা ভূত রাজ্যের সঙ্গে বেমানান। হৃদয়যন্ত্র হীন ভূত সাবেক ভূতরাজ্যের পক্ষে অনিষ্টকারী  তারা শুধু নিজেদের স্বার্থ বোঝে। অন্যদের সাথে নিয়ে চলতে জানেনা, ভালবাসতে জানে না। তাদের মধ্যে মায়া মমতা নেই। 
সন্তু কথাগুলো শুনে অবাক হয়! তার ভয় কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে! কয়েকটা হৃদয়হীন ভূতকে সে নিশ্চিত করে চিনে ফেলেছে। তাদের চেহারার সাথে গ্রামের অনেকের মিল খুঁজে পাচ্ছে সে। হারাধন ঘোষাল মারা গেল গত মাসে। পাড়ার নেতা। ভ্যাম্পায়ারের মতো রক্ত চুষে খেয়েছে অনেকের। ভোটের দু'চার দিন আগে বাড়ি বাড়ি শাসানো থেকে ভাঙচুর এমনকি ভোট লুটের মেইন পান্ডা ছিল ওই ঘোষাল। আর একজন স্বরূপ দিগপতি। বড় অফিসের চাকুরে।  মা-বাবাকে গাঁয়ে ফেলে রেখে শহরে থাকতো। একটা বাইক অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। পাশেই দাঁড়িয়ে অচিন্ত্য নন্দী। বাজারের জায়গা ও দোকানের ভাগাভাগি নিয়ে নিজের দাদাকে লোক লাগিয়ে কুপিয়ে খুন করে। শেষে হাজতে থাকা অবস্থায় গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে যায়। বেশ আরো কয়েকজনকে চিনতে পারছে সন্তু। এদের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে তার বাবা-জেঠু-কাকার চেহারা। তুমুল ঝগড়ার সময় তাদের চেহারাগুলো এদের মতোই ভয়ানক দেখায়।
বিরোধী ভূতেদের দাবী সঙ্গত বলে মনে করে সন্তু। মানুষদের সঙ্গে ওরা থাকলেও,এখানে ওদের ঠাঁই দেওয়া কক্ষনো উচিত নয়। হৃদয়হীনদের কোথাও স্থান নেই। সন্তু ভূতেদের ভাবনাকে শ্রদ্ধা করে। মন থেকে তার ভয় উবে গ্যাছে অনেক আগেই। এক প্রকার ঘোরের মধ্যেই বিরোধীপক্ষের ভূতদের সমর্থন করার জন্য তাদের ভিড়ের দিকে ছুটে যেতে চায়।

সেই মুহূর্তে নিচের থেকে চিৎকারের শব্দ শুনে সন্তুর সম্বিৎ ফেরে। তাকিয়ে দেখে অনেকগুলো টর্চের আলো তার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে এগিয়ে আসছে। কিন্তু সন্তুর পা সেখান থেকে যেন  কিছুতেই নড়ছে না, গলা থেকে আওয়াজ বেরুচ্ছে না। এদিকে ঘরের ছায়া মূর্ত্তিরা  হঠাৎ করে সব উধাও।

ঘুমের ঘোরেই সন্তুর মুখ থেকে একটা শব্দ শুনতে পায় সকলে --তোমরা কারা? ভূত না ভূতমানুষ?

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments