জ্বলদর্চি

অশোক মহান্তীর কবিতা : জীবন ভাঙা পথে ঈশ্বরের গান-৭/দিলীপ মহান্তী

অশোক মহান্তীর কবিতা : জীবন ভাঙা পথে ঈশ্বরের গান 

দিলীপ মহান্তী


।৭।

আজ সারাদিন শুধু তোমার কথা
ভাবলাম, অশোক।

তোমার কথা খুব বেশি কিছু না।
শালবন, উনুনের ধোঁয়া আর ঈশ্বর সন্ধান।

আর সবকিছু নিয়ে একটা কবিতা গড়ে তোলা-
একটা নৈঃশব্দ্য-
তুমি একটু আগে চলে গেলে অশোক।
    (আজ সারাদিন: কালীকৃষ্ণ গুহ)

        কবি  অশোক মহান্তীর মৃত্যুতে এক অগ্রজ কবির এই হল  উপলব্ধি ও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। যে প্রতিক্রিয়াতে শুধু শব্দের ওপর ভর করে তাঁর সারাজীবনের অনুভব ও মননের মধু বেরিয়ে এসেছে। পরে এই অনুভবকে একটু দীর্ঘায়িত করে এই কবি   একটি নামী পত্রিকায় লিখেছিলেন তবে আমার মতে তার দরকার ছিল না। কয়েকটি শব্দ ও চিত্রকল্পে তিনি  কবি অশোক মহান্তীকে যতটা চিনেছেন তা হল পরিপূর্ণ চেনা। আর এটি প্রকৃত কবিতা। শালবন এখানে অরণ্য-শহর ঝাড়গ্রাম অর্থাৎ প্রকৃতি। অশোক মহান্তীর জীবনে প্রকৃতির একটা বিরাট ভূমিকা আছে। উনুনের ধোঁয়া হল তাঁর জীবন ও জীবিকা। যা অনবরত পুড়ছে।
আর তিনি ছিলেন ঈশ্বর সন্ধানী ও কবিতা কর্মী। সবকিছু নিয়ে তিনি কবিতা নির্মাণ করতে চাইতেন। জীবন ও কবিতা   একাকার। আর তাঁর ছিল অসীম নীরবতা...
         এইসব কিছু ছেড়ে একজন কবির চিরদিনের জন্য চলে যাওয়া। এটুকু কথার মধ্যেই মাপা শব্দের মধ্যে অশোক মহান্তীর জীবনী লেখা হয়ে গেল। আর এটি লিখলেন ষাটের অন্যতম প্রধান কবি কালীকৃষ্ণ গুহ।
         সব কিছু নিয়ে কবিতা গড়ে তোলার যে পথ সে পথে শব্দই তাঁর অবলম্বন ও শক্তি। জীবন ভেঙে ভেঙে যে পথ গড়ে উঠছে সেখানে শুনতে পাওয়া যাচ্ছে ঈশ্বরের গান। এই জন্য তাঁর চেতনা জুড়ে শব্দকে নিয়ে যে অনুভব তার স্বীকারোক্তি:

   'রোজ ভোরে উঠে প্রথমে একটা শ্মশানকে তুলি হাতে
   হররোজ গাঁথি শব্দের মালা প্রচণ্ড অভিঘাতে
   শব্দ এখন কোলের বালিশ গরম পানীয় জল
   শব্দ এখন গান্ডীবধারী   পার্থের কোপানল
   শব্দ এখন হাতের ময়লা উনুনে চাপানো ভাত
   শব্দে নিয়ত কিনে নিতে পারি
     সোনায় বাঁধানো রাত।
       ( শব্দ-সংসার: আবহ সকাল)

       এরকম কথা তিনি বলেছেন ' আবহ সকাল' পর্যায়েই । শব্দের ক্ষমতায় ও ঐশ্বর্যে তিনি পৃথিবীর যাবতীয় সুখ দুঃখকে জাগিয়ে দিতে পারেন। যেমন রচনা করতে পারেন শ্মশান তেমনি পানীয় জল থেকে উনুনে চাপানো ভাতও। এমনকি গান্ডীবও। সবই শব্দময়। শব্দের সাহায‍্যে সোনায় বাঁধানো রাতও কিনে নিতে পারেন। তাঁর ধারণা ছিল কবিতা দিয়ে সমগ্ৰ ভুবনের মানুষকে কেনা যায়, কেনা যায় ঈশ্বরকে। সহস্র কোটি নক্ষত্র তারাকেও কেনা যায়: 
 
 ১.   'এম্নিভাবে ঘুরে দাঁড়াতে দাঁড়াতে অকস্মাৎ কবিতার পদধ্বনি শোনা যায়।
        এবং মুহূর্তের মধ্যে অশেষ যন্ত্রণারও একটা ইতি
           প্রস্তর ভাস্কর্যের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে পড়ে
        আমার দিনগুলিকে তখন আর উত্তাল মনে হয় না
            অর্থহীনও নয়
        বরঞ্চ তদপেক্ষা জীবনকেই অধিকতর শ্রেয় মনে হয়
        ইচ্ছা হয়, লক্ষ জন্ম ধরে শুধু কবিতা লিখতে লিখতেই
        এই মাটিতে ফিরে ফিরে আসব,
        কবিতার মাদকতায় আমার বিশ্বাস নেই
        আমি জানি, কবিতা একটা অন্তহীন সুর এবং ভালোবাসা
        কবিতা দিয়ে সমগ্র ভুবনের তাবৎ মানুষকে কেনা যায়,
        কেনা যায় ঈশ্বরকে, সহস্র কোটি নক্ষত্র ও তারাকে
        কবিতার পদধ্বনির সঙ্গে যেন অনন্ত বিশ্বযাত্রার
        এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ কিশোর উদ্বেলিত আনন্দে করতালি দিয়ে
        ক্রমশ সামনে পিছনে ভীরু পায়চারি করতে থাকে।'
                   ( পদধ্বনি: আবহ সকাল)


২.  ‘স্নান করে পরিশুদ্ধ হল সে
    তারপর নির্জন ঘরে আগুনের পাশে উলঙ্গ শুয়ে পড়ল, যেন নদী
    বুকের ভেতর চলমান হৃৎপিন্ড উঠছে নামছে
    সঞ্চালন হচ্ছে অবিরত রক্তস্রোতের
    রক্তস্রোত থেমে যাওয়ার অপর নাম মৃত্যু
    এবং উলঙ্গ শরীর আগুনে পোড়ানোর নাম সাধনা

    সাধনার কোন্ অর্থকে সে গোচরে আনতে সক্ষম হয়েছে জানি না 
  কিন্তু তার মেদবহুল বপুতে অতীন্দ্রিয়ের কোনো কোনো ক্রীড়া
        সে অনুভব করতে পারত
  দীর্ঘ চৌষট্টি বয়ঃক্রমে তার দৈহিক পরিবর্তন নেই
  জাগতিক দৃশ্যপট বদলের সে তোয়াক্কা করে না
        এমনকি রঙ্গময়ী প্রকৃতির জন্য
  তার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই, অথবা অনড় আক্ষেপ
  সে পরিশুদ্ধ হয়    এই তার বিশ্বাস
  সে অপসৃয়মান বিপদ সীমায় বাড়-বাড়ন্ত নতুন দিনালোককে
  সে আগুনের পাশে শুয়ে পড়ে যেন স্থির সৌন্দর্য অথবা নদী।’
       ( অথবা নদী: আবহ সকাল)
    তিনি জানেন রক্তস্রোত থেমে যাওয়ার অপর নাম মৃত্যু এবং উলঙ্গ শরীর আগুনে পোড়ানোর নাম সাধনা। মৃত্যু ও সাধনা তাঁর চোখে পরিপূরক। একটা প্রশ্ন আমাদের মনে জাগে, তিনি কি সাধনার পথে মৃত্যুতে পৌঁছাতে চেয়েছিলেন নাকি মৃত্যু পরবর্তী সাধনা ও সেইজগৎ তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল বেশি। তার প্রমাণও তিনি জীবনে রেখে গেছেন। তিনি আকৃষ্ট হয়েছেন আত্মাতত্ত্বে। প্রজন্মের পর প্রজন্মে বয়ে চলা সেই জীবন তত্ত্বে। জীবাত্মা ও পরমাত্মার ধ্যানেই তিনি নিমগ্ন ছিলেন।

‘এই দ্যাখো, আগুন খেলাম  পায়ে নোখে করতলে চোখে ও তন্ত্রীতে
আগুনের শিখা উড়ছে  ধোঁয়া উড়ছে  মুহ্যমন ছাই
এই দ্যাখো আগুন খেলাম  খেলাম আগুন  ওঁ স্বাহা

যজ্ঞের তুরঙ্গ নিয়ে এইবার তুমি যাও মালব্য ও গান্ধারপ্রদেশে
দ্যাখো পথ  দীর্ঘ যেন জলের গভীরে স্রোত সমুদ্রাভিমুখী
একদা এখানে ভল্ল বর্শা ও ত্রিশূল  অস্ত্রাগারে সৈন্য ছিল
                        লক্ষ পঞ্চাশৎ
তারপর কালক্রমে ডুবে গেছে চাঁদ  ভোরের পৃথিবী বায়ুহীন
দৃশ্যান্তরে চলে গেছে দুঃখার্ত প্রজারা

তাদের রক্তের সুরে অদ্যাবধি কথা বলে অনেক মানুষ
একটি শিশুর চোখে ছাতিম ছায়ার ম্লান বিষণ্ণ বিকেল
সে দ্রুত দক্ষিণ দিকে চলে যায়  দক্ষিণে দাক্ষিণ্য পাবে
                       এই তার আশা
তাকে কোন অন্ধকারে ডাকো তুমি?
দ্যখো তরুমূলে সূর্য উলঙ্গ দাঁড়িয়ে উপকূলে চেয়ে দেখছে
         কবেকার রক্তাপ্লুত শিলায় করোটি
তাকে কেন হিংস্রতায় ডাকো?
সে দ্রুত দক্ষিণ দিকে চলে যায় ছাতিম ছায়ায় ম্লান বিষণ্ণ বিকেলে।
    ( প্রজন্ম: আবহ সকাল )

অশোক মহান্তীর কবিতার পংক্তিতে পংক্তিতে ভাসিয়ে দেওয়া মৃত্যুরসের গন্ধ আমাদের নিয়ে যায় জীবনের অপ্রত্যাশিত, অমোঘ মাধুর্যের কাছাকাছি। দেয় বিষাদরূপ অমৃতের স্পর্শ।
তাঁর প্রত্যেকটি কবিতার বইয়ের পাতায় পাতায় এবং অন্য পত্রিকাতেও ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য কবিতায় তাই এত মৃত্যুর ছায়া। মৃত্যুবোধ তাঁর কবিতার অন্যতম দর্শন। মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষা কবিদের অন্যতম প্রিয় বিষয়। মৃত্যু না চাইলেও, মৃত্যু সমন্ধে প্রচন্ড ভয় থাকলেও, তাঁরা মৃত্যুর কথা লেখেন। এ যেন এক অন্য ধরনের বিলাসিতা। আর মৃত্যুর কাছাকাছি এসে নিজের অচেতনে লিখে ফেলেন অনেক মৃত্যুবোধের কবিতা, কিন্তু মৃত্যু যে খুব কাছে এটা বোধহয় জানেন বা জানেন না। এ যেন ঘুমিয়ে পড়া। যে ঘুম কখনো ভাঙে না। কিন্তু তিনি জেগে থাকেন তাঁর লেখার মধ্যে আর অজস্র পাঠকের বুকে। জন্ম, মৃত্যু, জীবন সম্পর্কে অশোক মহান্তীর নিজস্ব দর্শন আছে:

জন্ম
জন্ম কাকে বলে?
জীবন-পাত্রের জল জীবনে গড়ালে।

মৃত্যু
মৃত্যু কাকে বলে?
ঘুমের ভেতরে যদি ঘুম যায় টলে।

জীবন
জীবন মানে কি?
দুদিকেই অনন্তশূন্যতা জেনে সাধ্যমত উড়ে যাওয়া একটি পাখির।
(তিনটি প্রশ্নোত্তর)

        মৃত্যু সম্পর্কে যেমন তার গভীর আগ্রহ তেমনই আত্মা ও পরলোকতত্ত্ব সম্বন্ধেও তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। আত্মা অবিনাশী এই ধারণাতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। বৃহদারণ্যকে জনকসভায় মহর্ষির আত্মা-তত্ত্বের ব্যাখ্যা বা অশরীরী আত্মার বিচরণ সম্পর্কে ব্রম্ভসূত্রের কথা সব কিছুতেই তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল। এর ফলে তিনি প্লানচেটে আত্মা- আবাহনে সচেষ্ট হয়েছিলেন। বহুবার তিনি এই চেষ্টা করেছিলেন। অনেক মৃত মানুষকে তিনি এই প্লানচেটে আবাহন করেছিলেন, এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও।

         তাঁর আগে অনেক কবি সাহিত্যিকই এই প্লানচেটে আত্মা-আবাহন করতে চেয়েছেন। যাঁদের নাম করতে হয় তাঁরা হলেন: দীনবন্ধু মিত্র, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শিবচন্দ্র বিদ্যারত্ন, শিশির কুমার ঘোষ এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই প্লানচেট মিডিয়মে বার বার বসেছেন।
        ঈশ্বর সন্ধানই তাঁর জীবন জিজ্ঞাসার মূল অবলম্বন। যদিও তিনি নিজেকে নাস্তিক বলেই মানেন। তাঁর অর্থাৎ নাস্তিকের ঈশ্বর সন্ধানেই সারাজীবন কেটেছে। একসময় যখন তিনি বয়সে তরুণ, সবে যৌবনকাল উপস্থিত এমন সময় ঈশ্বরের সন্ধানে অন্য এক ঈশ্বরসন্ধানীর সঙ্গে হিমালয়ে তপস্যা করতে বেরিয়ে পড়েছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়নি। ‘আবহ সকাল’ পর্যায় থেকেই এই সন্ধানের রূপ ও স্বরূপ বোঝা যায়:

      ‘মানুষের ভালোবাসা ঘর বাঁধতে বলে
   ঈশ্বরের ভালোবাসা ভেঙ্গে দেয় ঘর

   আমি দোটানার মধ্যে বহুদিন একইরকম যন্ত্রণাকে ভুলে যাই
   বহুদিন যন্ত্রণা আমাকে অবসাদে ক্লান্ত করে…
                        ক্লান্ত করে…
         আমি শুধু ঘরে বাইরে ছোটাছুটি করি

   আগুন লেগেছে ঘরে    আগুন লেগেছে দেহে
   আগুন লেগেছে শিশ্ন আমার উদরে

   মানুষের ভালোবাসা ঘর
   ঈশ্বরের ভালোবাসা শূন্যস্থান নির্ণয় আঘর
   আমি দোটানার মধ্যে বহুদিন এককে দ্বিগুণ করে ফেলি
    ( দু-টান: আবহ সকাল)

২.  ‘মুখখানি তার নিপাট ছড়িয়ে গেছে বিশ্বময় কাকে যেন ভালোবেসে বেসে
    সে জানে সর্বদা করুণ কাতর নেত্রে কেউ তার দিকে চেয়ে রয়
    এবং সে কামনা ও কাম্য কর্মফলে কখনো স্ববাস ছেড়ে
            প্রবাসের দিকে রাখে মুখ

   কোথাও নিষ্পত্তি নেই, অনন্ত আকাশ হয়ে ভালোবাসা পথ ভাঙে
                 কতদূরে মানুষেরা হেঁটে যেতে পারে
   বিজনে নির্জনে কিংবা জনতায় সাগরে পর্বতে
   যেখানে যেখানে তারা ঘর বাঁধে, সেখানে সে আগে ভাগে বসে থাকে স্থির
   মুখখানি ঊজ্জ্বল আগুন যেন, দাহ কিংবা নয়ন আরাম
   নিপাট ছড়িয়ে যায় বিশ্বময়  কাকে যেন ভালোবেসে বেসে
        ( ঈশ্বরের মুখ: আবহ সকাল )

জীবিকার সূত্রেই তিনি অনেক মানুষের মুখ দেখেছেন। হয়তো ঈশ্বরও দেখেছেন। সমগ্র মহাভারত দেখেছেন। মহাভারতই তাকে আন্দোলিত করেছিল বেশি। 'কুরুক্ষেত্রের শ্বেতপত্র', উত্তর কুরুক্ষেত্র' 'রাষ্ট্রনীতি' তাঁর অসাধারণ সৃষ্টি। 'কুরুক্ষেত্রের শ্বেতপত্র' দীর্ঘ কবিতা, উদ্ধৃতি দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু 'উত্তর কুরুক্ষেত্র' উদ্ধৃত না করলে তাঁর শক্তির পরিচয় দেওয়া অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। যেখানে অন্ধ পিতা ধৃতরাষ্ট্রের রাজ্য শাসনের কিছু ছবি ও বিলাপ আছে। এই ভয়ংকর দুঃসময়ের প্রেক্ষাপটে এই কবিতাটি পাঠ করা জরুরি:

আঠারো দিনের যুদ্ধ পরিণতি পেয়েছে উনিশে
ভীষ্ম নেই, দ্রোণ নেই, কর্ণ, কৃপাচার্য কেউ নেই,
বুক শুধু জ্বলে গেছে বিষে
মানবহৃদয় হায়!কী প্রচন্ড কালো হে সঞ্জয়।

দ্বৈপায়নে জল কতখানি?
পাথরে আড়াল আছে জানি।
শত্রুপক্ষ বিভ্রান্ত হবে তো?
সে কোথায়, অন্ধ রাজরানী?

শোনো হে সঞ্জয়, সাংবাদিক
পরিস্থিতি ভালো আছে তো হে?
দ্যাখো, আমি হেরে যেতে পারি
কিন্তু এত সহজে ছাড়বো না।

এ-মুকুট এখনো আমারই
প্রশাসন আজও আজ্ঞাবহ
সে কোথায় অন্ধ রাজরানী?
সঞ্জয় কোথায় গেলে শোনো-

প্রাসাদে নির্বিঘ্নে আমি আছি
ও যেন জল ছেড়ে না ওঠে
শত্রুকে বিশ্বাস করা দায়
বলো ওকে ভয় নেই কোনো।

সংবিধান এখনো আমারই
আমি পুনঃ অভিষিক্ত হবো
বলে দাও- রাজকর্মচারী
এ-কথাটা মনে রাখে যেন।

জোট-শক্তি এখনো আমার
ধনাঢ্যরা আমার পক্ষেই
সে কোথায় অন্ধ রাজরানী
দুর্যোধন হ্রদে লুকিয়েছে।

হায়, হায়, মানবহৃদয়
কী প্রচন্ড কালো হে সঞ্জয়।
     (উত্তর কুরুক্ষেত্র':৪৮বছরের স্বীকারোক্তি)

      তাঁর মৃত্যুর কিছু আগে তিনি অন্য এক ঈশ্বরসন্ধানীর সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। ঝাড়গ্রামের মনোরম পরিবেশে তাঁদের একটি আশ্রম আছে। সেই আশ্রমে তিনি মাঝে মাঝে যেতেন। বাঁকুড়ার অমর কাননেও তাঁদর আশ্রম আছে। ওঁরা একটি সুন্দর পত্রিকা প্রকাশ করতেন সেখানে অশোকদা লিখতেন। আমাকেও লিখতে বলেছিলেন। আমিও লেখার ইচ্ছা প্রকাশ  করেছিলাম। অন্য অনেকের মতো আমারও মনে হয়েছিল এরপর তাঁর লেখা অন্যদিকে মোড় নেবে। তাঁর লেখায় আধ্যাত্মিকতার স্রোত বইবে। কিন্তু তার কয়েকমাসের মধ্যেই তাঁর হঠাৎ মৃত্যু। বাংলা কবিতার ধারায় এক শক্তিশালী কবির কলমে আধ্যাত্মিকতার চরম নির্যাস বেরিয়ে এলনা। বঞ্চিত হল বাঙালি পাঠককূল। যদিও তাঁর জীবন থেকে উঠে আসা ঈশ্বর ভাবনার স্বরূপ তাঁর কিছু কবিতায় আমরা আগেই পেয়েছি:

১. ঈশ্বর ছিলেন কিনা, জানিনা তা, শোনা যায় ঈশ্বর ছিলেন।
      ঈশ্বর আছেন কিনা , জানিনা তা , শোনা যায় ঈশ্বর আছেন।

     ঈশ্বর কি শুরু,নাকি শেষ,আমি জানিনা তা,লোকে বলে ঈশ্বর অপার।
     ঈশ্বর কি একা,নাকি সকলের ,লোকে বলে ঈশ্বর একার।

    যদি বলো, ঈশ্বর আছেন কিনা, আমার মনে হয়, আমি তবে বলি সাধ্যমত।
    ঈশ্বর আছেন, কিন্তু আজ তিনি পরমানু, যন্ত্রক্ষতে ভীষণ আহত।
         ( আহত ঈশ্বর: মাটির মন )

 ২. তবে কি নাস্তিক তুমি?
     হয়তো তা না হতেও পারে। আর সেভাবে ভাবিনি কোনদিন।
     তবে ঈশ্বরকে দেখেছি কখনো তিনি ভাতের হাঁড়ির মধ্যে অবাধে ফুটছেন
     আর কখনো বা চৈত্রের বাতাস হয়ে ঝরিয়ে দিচ্ছেন যত পাতা
      ঠিক তত ফুল হয়ে হেসে উঠছেন যেন বাকল ফাটিয়ে।
     আমি তাতেই বিশ্বাস করি ভগবান নিয়মে আছেন। তিনিই নিয়ম হয়তো।
         (কাঠগড়ায়: দ্বিতীয় সঙ্কেত)

 ৩. 'তুমি যদি বন্ধু হতে ,একান্ত ঈশ্বর হতে তবে, বুঝতে পারতে
        মনের গোপনে কত ফেনা পুঞ্জ পুঞ্জ জমেছে অনেককাল।
        অনেক গোধুলি নদী পেরিয়ে এসেছি আজও বিশ্রাম মেলেনি
       মেটেনি মনের ক্ষুধা, হৃদরোগ নিরাময় হয়নি কিছুই।

        এইসব মুখে ঢের পান্ডুরোগ ছড়িয়ে রয়েছে।
         চোখ দুটি আনত -ঈষৎ-বক্র-ক্ষুব্ধ- ক্রর,নীল শাদা দাগে ভর্তি জামা।
         এ বরফ কখন শুকোবে?

         মলিন ধুলোর পায়ে আবার এসেছি যদি ক্ষান্তি পাই
         ভালোবাসা পাই।
         প্রসারিত হাত নেবে আসে।
             (প্রসারিত হাত: দ্বিতীয় সঙ্কেত)
     তাঁর ঈশ্বর সন্ধান, তাঁর আধ্যাত্মিকতা তাঁর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা আলোর আভায় কেউ কেউ মুগ্ধ হয়েছিলেন। আকৃষ্ট হয়েছিলেন আরও বেশি। এই সময়ে খুবই ক্লিশে শব্দ তবু বলি অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁকে সামনে রেখেই নিজ আধ্যাত্মিকতার রূপকে প্রকাশ করেছেন কেউ। যেমন তাঁর সময়ের বিশিষ্ট কবি রণজিৎ দাশ নিজেই লিখছেন: ‘মেদিনীপুরে থাকাকালীনই আমি ‘অলৌকিক চা পরব’ নামক একটি দীর্ঘ কবিতা দীর্ঘদিন ধরে লিখি। যেটি পরে একটি সাময়িকপত্রে প্রকাশিত হয়। কবিতাটির বিষয় ছিল জেন-দর্শন-ভিত্তিক – জাপানের সুবিখ্যাত চা-পানের অনুষ্ঠানটির জেন-ধর্মীয় ভাবরূপটিকে ধরার চেষ্টা ছিল তাতে। এই কবিতাটি লেখার সময় আমি, আমাদের সময়ের প্রেক্ষিতে একজন জেন-সাধুর মানসিকতাকে অনুধাবন করার জন্য, সচেতনভাবে অশোকের কথা ভাবতাম। এভাবে, কবিতাটির নির্মাণে, নিজের অজান্তেই, অশোক একটা ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।’

        চেনাজানা মানুষ, আত্মীয়-স্বজন, সংসার, বন্ধুবান্ধব, প্রিয় নারী, দৈনন্দিন জীবন, সাহিত্যের জগতের নোংরামি, কদর্যতা যতই তাঁকে আহত করেছে ততই তাঁর শিল্প নির্ভরতা বেড়েছে। ততই তাঁর কবিতা অনেক বেশি ঈশ্বর ও প্রকৃতি নির্ভর হয়েছে। ততই তিনি ঈশ্বরকে খুঁজে বেড়িয়েছেন তাঁর সৃষ্টি ও নিজের সৃষ্টির মধ্যে। কখনো ক্রোধের আগুনে জ্বলে বলে ওঠেন:
   ‘ ঈশ্বর না থাকলে জীবনের ভারসাম্য নষ্ট হয়
   অথচ ঈশ্বর নেই এ কথাই আজ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে জগৎ জুড়ে
   মানুষের ক্রোধ এবং লিপ্সার সঙ্গে ঈশ্বরের অস্তিত্বের কোন সঙ্গতি নেই
   ভাবলেই হিম হয়ে আসে আমার বুক
   আমার রক্তে দাবানলের আগুন জ্বলতে থাকে
   …      …     …
   সারা বিশ্বজুড়ে হে অর্বাচীন ঈশ্বর
   আমি পায়ের ছাপ রেখে গেলাম
   তুমি পূজা কর আমাকে।’
      ( পূজা: আবহ সকাল )
   
                             ( ক্রমশ )

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments