জ্বলদর্চি

গওহরজান - এক বিস্মৃত অধ্যায়- ৫/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

গওহরজান - এক বিস্মৃত অধ্যায় 
পর্ব - ৫                             

দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী     

মায়ের উপদেশ মত গওহর পুনরায় সংগীতে মনোনিবেশ করল। এরপর শুরু হল গওহরের পুরোপুরি সাংগীতিক জীবন, যে সময়ে ভারতবর্ষে বেশ কয়েকজন শিল্পী উদয় হয়েছিলেন। এরা হলেন আগ্রার মলকাজান ও জোহরা বাঈ, এলাহাবাদের জানকী বাঈ, চিলবিলার মলকাজান, কলকাতার কৃষ্ণভামিনী, বেনারসের হুসনা বাঈ ও মউজুদ্দিন, লক্ষ্ণৌয়ের গণপত রাও বা ভাইয়া সাহেব প্রভৃতি। এদের প্রত্যেকের সাথে গওহরের সুস্থ প্রতিযোগিতা হতো এবং গওহরের একটি মস্ত গুন ছিল বয়সে ছোট হলেও যে কোন গুণী শিল্পীর কাছ থেকে ভালো জিনিসের শিক্ষা গ্রহণ করার। আগ্রাওয়ালী মলকা জানের  দরাজ গলায় ঠুমরী গান গাওয়ার নতুন ধরনের শৈলী বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। গওহরের মতো তারও ধ্রুপদ, খেয়াল থেকে শুরু করে তথাকথিত রাগপ্রধান গান ও হোরি, চৈতি, কাজরী ইত্যাদি লোক উৎসবের গান, টপ্পা, গজল প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের গানে গভীর দক্ষতা ছিল। আবার আগ্রার জোহরা বাঈয়ের, যিনি গওহরের সাথে লক্ষ্ণৌয়ে বিনদাদিন মহারাজের কাছে তালিম নিয়েছিলেন, তার খেয়াল গাইবার গায়কী সেই সময়ের সেরা বলে বিবেচিত হতো এবং একটি রাগের রূপ একটি নির্দিষ্ট আঙ্গিকে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে সুন্দরভাবে পরিবেশন করতে পারতেন। 

বেনারসে থাকাকালীন গওহরজানের বন্ধু ছিলেন এলাহাবাদের জানকী বাঈ। গওহরের মত জানকীও গীত রচনা এবং পরিবেশনায় দক্ষ ছিলেন এবং সংস্কৃত, উর্দু, ফারসি ও ইংরেজি ভাষা জানতেন। এছাড়াও গণপতরাও বা ভাইয়াসাহেব হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতকে নতুন দিশা দেখিয়েছিলেন। ঠুমরী গানের ক্ষেত্রে তিনি এমন এক গায়কীর ধারা সৃষ্টি করেছিলেন যা সকলের হৃদয় জয় করেছিল। যদিও সেই সময়ে ঠুমরী গানকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হতো না উপরন্তু রীতিমত খারাপ বা নীচু চোখে দেখা হতো। গুরুগম্ভীর খেয়াল বা ধ্রুপদের তুলনায় ঠুমরী গান বেশ হালকা বা অগভীর বলে মনে হতো।  এছাড়াও শাস্ত্রীয় সংগীত গাইবার সময় হারমোনিয়ামের ব্যবহারের প্রচলন করার একক কৃতিত্ব ছিল ভাইয়া সাহেবের। বিভিন্ন দরবারে অনুষ্ঠান করার জন্য তিনি তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের ঠুমরী গান গাওয়ার এবং হারমোনিয়ামে সঙ্গত করার তালিম দেওয়ার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। এছাড়াও বেনারসের মওজুদ্দিন ছিলেন সেই সময়ের বিখ্যাত খেয়াল ও ঠুমরী গায়ক। কলকাতার তাঁর একটি অনুষ্ঠানে গাওয়া খেয়াল ও ঠুমরী গান শুনে সেই সময়ের বিখ্যাত সঙ্গীত বোদ্ধা অধ্যাপক ডিপি মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন 'ভারতে তাঁর মত ঠুমরী গায়ক আর আসেনি। আমি গওহরজান, মলকাজান, শ্যামলাল ক্ষেত্রী, গিরিজা বাবু এবং আরো অনেক শিল্পীদের চোখে জল দেখেছি যখন একটি সহজ ভৈরবী রাগে মইজুদ্দিন তার নিজস্ব গায়কিতে ঠুমরী গান পরিবেশনা শুরু করেছিলেন'।

গওহরজান তাঁর সমসাময়িক কোন শিল্পীর কাছে প্রশিক্ষণ নিতে কুন্ঠা বোধ করতেন না। সেই সম্বন্ধে কয়েকটি ঘটনার কথা পাঠকের জ্ঞাতার্থে উল্লেখ করছি। সেইসময়ে সমসাময়িক শিল্পীরা যদিও পেশাগতভাবে একে অপরকে ঈর্ষা করতেন কিন্তু তাঁদের মধ্যে এক সুস্থ প্রতিযোগিতা ছিল যার ফলে প্রত্যেক শিল্পীই বিভিন্ন অনুষ্ঠানগুলি দেখার সুযোগ হাতছাড়া করতেন না। প্রয়োজনবোধে তাঁরা অন্যের ভালোটুকু নিজেদের গায়কীতে আত্মস্থ করার চেষ্টা করতেন। শেঠ দুলিচাঁদ তখনকার দিনে কলকাতার বিত্তবান মাড়োয়ারী ব্যাবসায়ী ছিলেন এবং সংগীতের একজন বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। দেশের বিভিন্ন অংশের খ্যাতনামা শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মাঝে মাঝে তিনি সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। একবার এক অনুষ্ঠানে ঠুমরী গানের বিখ্যাত শিল্পী ভাইয়া গণপতরাও একজন আনকোরা শিল্পীকে নিয়ে এসেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কলকাতার অপর একজন ব্যবসায়ী ও সঙ্গীত পৃষ্ঠপোষক শ্যামলাল ক্ষেত্রী, গয়ার সোনিজী, গোয়ালিয়রের বশির খান, পাঞ্জাবের গফুর খান, কলকাতার পন্ডিত গিরিজা শংকর চক্রবর্তী, উস্তাদ বাদল খান, বাহাদুর খান, আগ্রার মলকাজান, কলকাতার কৃষ্টোভামিনীদেবী এবং গওহরজান। সেই আনকোরা শিল্পী বেনারসের মউজুদ্দিন ভাইয়া গণপতরাওয়ের হারমোনিয়ামের সঙ্গতে যে ঠুমরী গান গেয়েছিলেন তা আগের সব শিল্পীদের গায়কীকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। শ্রোতারা তাঁর গান শুনে এতই আনন্দিত হয়েছিলেন যে ভোর রাত্রি পর্যন্ত তাকে গান গাইতে হয়েছিল। আসরের শেষে গওহরজান ভাইয়া গণপতরাও ও মউজুদ্দিনের পায়ে পড়ে গিয়েছিলেন এবং তাঁদেরকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁরা যেন তাদের কাছে গওহরকে সঙ্গীতের তালিম দেন। তাঁরাও সানন্দে গওহরের অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন। 

গওহরের একটি মস্ত গুনছিল মুক্ত হৃদয়। নিজে বিখ্যাত শিল্পী হওয়া সত্ত্বেও প্রকৃত গুণীর কাছে সংগীত সংক্রান্ত প্রতিটি নতুন চিন্তা ভাবনা গ্রহণ করার ঐকান্তিক ইচ্ছা। কলকাতাতে আসা সমস্ত বড় বড় উস্তাদদের অনুষ্ঠানে থেকে নতুন ধরনের গায়কী রীতি ও নতুন রাগের পরীক্ষা দেখতেন এবং তিনি সব সময়েই তা আত্মস্থ করার চেষ্টা করতেন অথবা সেই শিল্পীর কাছে অনুরোধ করতেন তাঁকে শিষ্যা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য। যার ফলে গওহর জীবনে বহু উস্তাদের শিষ্যা হয়েছিলেন। তিনি কোন বাঁধাধরা নিয়মের নিগড়ে সংগীতকে বন্ধ করে রাখার বিরোধী ছিলেন। তিনি মনে করতেন সুস্থ আদান প্রদান এবং গায়কীর সংমিশ্রণ একজন শিল্পীর গায়কি রীতি গঠনের ক্ষেত্রে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এবং একান্ত প্রয়োজন। তাঁর সমসাময়িক কোন শিল্পীর কাছে প্রশিক্ষণ নিতে কুন্ঠা বোধ করতেন না। গওহরের এই বহুমুখী প্রশিক্ষণ তাঁকে দেশের সংগীত মঞ্চে দীর্ঘদিন যাবৎ রাজত্ব করতে সাহায্য করেছিল।                             

আবার অনেক সময়ে এই সমস্ত উস্তাদেরা নারী শিল্পীদের প্রতি খারাপ ইচ্ছা পোষণ করতেন। এই সমস্ত উস্তাদেরা ভাবতেন নারী মাত্রই ভোগের সামগ্রী। পাতিয়ালা ঘরানার একজন বিখ্যাত উস্তাদ কালে খান, যিনি কিংবদন্তি শিল্পী উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খানের কাকা ও গুরু। এই প্রবন্ধের প্রথমে আমরা তাঁকে দেখতে পাই যাঁর কাছে কলকাতার অনুষ্ঠানে পর্যুদস্ত হয়ে বেনজির বাই দশ বৎসর প্রশিক্ষণ নিয়ে বিখ্যাত শিল্পী রূপে আত্মপ্রকাশ করে গওহরজানের অপমানের শোধ তুলেছিলেন। অত্যন্ত প্রতিভাবান এই উস্তাদ একটু খ্যাপাটে ধরনের ছিলেন, কিন্তু হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সপ্তকে গান গাওয়ার সময় তাঁর কণ্ঠস্বরে ফলসেটোর প্রয়োজন হতো না। তিনি নিজের আসল কণ্ঠস্বরের নিটোল ভাব বজায় রাখতেন। অনুষ্ঠান শুরুর পূর্বে তিনি তৈলাক্ত পুরী ও রাবড়ি গলা পর্যন্ত খেয়েও সফলভাবে সংগীত পরিবেশন করতে পারতেন। বিভিন্ন ধরনের তান পরিবেশনে তার দক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত। 
                                                                                                                                                                       
একবার কলকাতার এক অনুষ্ঠানে কালে খানের জটিল হলক তান থেকে শুরু করে সরল সপাট তানের বিস্তারের অবিশ্বাস্য উপস্থাপনায় উপনীত হওয়া দেখে গওহর তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। কলকাতায় যেহেতু তাঁর থাকার কোন জায়গা ছিল না সেজন্য গওহর তাঁর নিজস্ব বাসভবন 'গওহর বিল্ডিং' এ থাকতে দিয়েছিলেন। কিন্তু গওহরের মতো একজন অপূর্ব সুন্দরী বাঈজীর সান্নিধ্য কালে খানের অন্তরে দুরভিসন্ধির জন্ম দিয়েছিল। একদিন শিক্ষাদানের শেষে তিনি গওহরকে কাছে টেনে বলেছিলেন 'তুম মেরা দিল ভর দো অউর ম্যাঁয় তুমহে দিল ভর কে গানা শিখায়ুঙ্গা'। তাঁর মতো একজন নামী উস্তাদের কাছ থেকে এরকম অশালীন প্রস্তাব পাওয়া মাত্র গওহর বিস্মিত হয়ে তাঁকে তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছিলেন এবং ভবিষ্যতেও যেন তিনি তার মুখ আর কোনদিন গহরের কাছে না দেখান। গওহরের আত্মসম্মানবোধ খুব বেশি ছিল।       
                                                             ক্রমশঃ…….

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments