জ্বলদর্চি

পশ্চিম আফ্রিকা (মরক্কো)-র লোকগল্প / চিন্ময় দাশ


দূরদেশের লোকগল্প – পশ্চিম আফ্রিকা (মরক্কো)

চোরের উপর বাটপাড়ি 

চিন্ময় দাশ


একবার একটা কাঠবেড়ালির মনে হোল, গম চাষ করলে কেমন হয়? সারা বছর খাবারের জন্য গাছে গাছে হন্যে হয়ে ছুটে বেড়াতে হয় না। সারা বছরের খাবার ঘরেই মজুত থাকবে তখন। 

সবচেয়ে বড় কথা হোল, নিজের একটা খেত হবে তাহলে, এটা কম গর্বের কথা না কি। সবাই দেখবে তাকিয়ে তাকিয়ে।  

খোঁজাখুঁজি করে ছোট একফালি জমি পাওয়া গেল। নদীও একটা আছে পাশেই। সেচের অসুবিধা হবে না। 

কিন্তু চাষবাস মানেই নিয়মিত দেখভাল। নিয়মিত খেতে যাওয়া আসা। এদিকে কাঠবেড়ালির বাসা তো সেই উঁচু গাছের মাথায়। কত আর ওঠানামা করা যায়? 

মাথা খাটিয়ে, গাছের উপর দিয়েই একটা রাস্তা বানিয়ে নিল সে। 

এ গাছের মাথা থেকে ও গাছের মাথা। তার পর পরের গাছে। এইভাবে সুন্দর সোজা একটা রাস্তা পেয়ে গেল সে। আর চিন্তা নাই কোন। মাটি তৈরি করে, বীজ বুনে দেওয়া হোল।  

দেখতে দেখতে গমের শিষ বেরুল। একদিন বাদামি রঙ ধরতেও শুরু করল শিষগুলোতে। আনন্দের সীমা নাই কাঠবেড়ালির। ক’দিন বাদেই ফসল উঠবে ঘরে। তার পর? তার আবার পর কী?  সারা বছর নিশ্চিন্ত। খাবারের কোন ভাবনাই থাকবে না আর।

এদিকে হয়েছে কী, গমের জমিটার কাছাকাছি থাকে এক মাকড়সা। নিয়মিত একটা কাঠবেড়ালিকে গাছের মাথা বেয়ে বেয়ে আসা-যাওয়া করতে দেখে, মনে খটকা লাগল তার। একদিন চুপিসাড়ে কাঠবেড়ালিটার পেছন পেছন গিয়ে, গমের খেতটা দেখে ফেলল সে।

আহা, কী আনন্দ, কী আনন্দ! ঘরের পাশেই আস্ত একখানা পাকা গমের খেত! এমন মওকা জীবনে দু’বার আসে না।

ঘরে ফিরেই ক’জন পাড়াপড়শিকে জড়ো করে ফেলল মাকড়সা। খবর শুনে সবাই ভারি খুশি। কাঠবেড়ালি ফসল কাটা শুরু করবার আগেই, পুরো ফসল ঘরে তুলে ফেলতে হবে। এমন সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না।

মাকড়সা বলল—না বন্ধুগণ, কাটার কাজ শুরু করবার আগে, একটা রাস্তা বানিয়ে ফেলতে হবে। 

সবাই অবাক—রাস্তা লাগবে কেন? আমরা মাকড়সা। যেখান দিয়ে পা ফেলব, সেটাই আমাদের রাস্তা।

--ব্যাপারটা অত সোজা নয় হে। পরের জিনিষ ঘরে তুলবো। হাতে একটা জুতসই প্রমাণ রেখে দিতে হবে। তোমরা পরে দেখতে পাবে, রাস্তাটা কত জরুরি। এখন যা বলছি , শোন। বাদবিতণ্ডা পরে করা যাবে।

সেই মত, মাকড়সাদের গোটা পাড়া লেগে গেল গমের খেত পর্যন্ত রাস্তা বানাতে। দেখতে দেখতে সুন্দর একটা খোলামখুচির রাস্তা গড়ে উঠল, তাদের বাসা থেকে গমের খেত পর্যন্ত। 

এদিকে হয়েছে কী, গম সবে পাকতে শুরু করেছে দেখে, ক’দিন মাঠে আসেনি কাঠবেড়ালি। ভেবে রেখেছে, ভালো করে পেকে গেলে, গিয়ে কেটে নিয়ে আসবে। 

সেই মতো দিন কয় বাদে মাঠে এসে, চোখ কপালে উঠে গেল তার। আদ্ধেক মাঠ সাফ। বাকিটাও একদল মাকড়সা  কেটে নিয়ে যাছে। 

--আরে, আরে, করছোটা কী? কাঠবেড়ালি চেঁচিয়ে উঠল।

মাকড়সা বলল—কেনহে, চোখে কি কম দেখো না কি? গম কাটছি।

কাঠবেড়ালি বলল—সেটাই তো বলছি। আমার খেতের গম, তোমরা কাটছো কোন আক্কেলে?

--তোমার খেত? এই খেতটা আবার তোমার হোল কবে থেকে? তাছাড়া, তুমি বেপাড়ার লোক। খেতটা তোমার হোলই বা কী করে? 

জোর বিবাদ শুরু হয়ে গেল। কেউই পিছু হটতে রাজি নয়। বাদবিতণ্ডাই চলতে লাগল। ফয়সালায় আসা গেল না কিছুতেই। তখন মাকড়সা বলল—শোন বাপু, ঝগড়াঝাটি করে মিটবে না এ বিবাদ। তার চেয়ে বিচারকের কাছে যাওয়াই ভালো। সে যা রায় দেবে, মাথা পেতে নেব দু’পক্ষই।

কাঠবেড়ালি এক কথায় রাজি। বিচারক নিশ্চয় ন্যায্য ফয়সালা করবে।

খরগোশ হল সেই এলাকার মোড়ল। সবাই গিয়ে হাজির হোল তার কাছে। কিন্তু অবস্থার কোন পরিবর্তন হোল না তাতে। দু’পক্ষের কেউই এক কদম পিছু হটতে রাজি নয়। দু’পক্ষেরই এক কথা। খেত বানিয়ে ফসল ফলিয়েছে সে।

নাস্তানাবুদ অবস্থা মোড়লের। তখন মাকড়সা বলল—আমি একটা কথা বলি মোড়ল। এখানে চেঁচামেচি না করে, বিবাদের জায়গাটাতেই যাওয়া যাক না কেন। চোখে দেখে, বিচার করতে সুবিধা হবে। দরকার পড়লে, সাক্ষী-সাবুদও জুটে যাবে সেখানে।

মোড়লেরও মনে ধরল কথাটা। কাঠবেড়ালিও আপত্তি করল না। দল বেঁধে সবাই এসে হাজির হোল গমের জমিতে। সোরগোল দেখে, আরও কজন পশুপাখিও এসে জুটে গিয়েছে।

খরগোশ বলল—এ তো দেখছি, আদ্ধেক গম কাটা হয়ে গেছে। এখন আবার বিবাদ কীসের? 

মাকড়সা তাড়াতাড়ি বলে উঠল—তাহলে আর বলছিটা কী। আমাদের তৈরি করা জমি। আমরা ফসল বুনেছি। আমাদের পাকা ফসল আমরাই কাটছি। হঠাত এখন কাজের মাঝখানে হাজির হয়ে, কাঠবেড়ালি  বলতে শুরু করেছে, এই জমি ফসল সব না কি তার। কেমন মস্করা, তুমিই বলো মোড়ল। 

মোড়ল কাঠবেড়ালিকে বলল—কীহে, তোমার বলবার আছে কিছু? 

--অবশ্যই আছে। মাকড়সা যা বলেছে, ডাহা মিথ্যা কথা। জমি আমিই বানিয়েছি। ফসল বুনেছি। সেচ দিয়েছি ফসলে। এখন আমার পাকা ফসল কী করে ওরা দাবি করে?

মোড়ল বলল—কাটার কাজ শুরু হতেই বাধা দাওনি কেন? 

কাঠবেড়ালি বলল—আমি জানব কেমন করে, ওরা আগে ভাগে এসে ফসল চুরি করছে? 

কথায় আছে না—চোরের মায়ের বড় গলা। মাকড়সা তেড়ে উঠে বলল—চুরি শব্দটা মুখেও আনবে না, এই শেষ বলে দিলাম। নইলে কুরুক্ষেত্র কাণ্ড হয়ে যাবে কিন্তু। খরগোশ শান্ত শিষ্ট জীব। হুজ্জুতি মারামারি তার একেবারে পছন্দ নয়। সে থামিয়ে দিয়ে বলল—গোলমাল থামাও। আলোচনাতেই বিবাদ মেটাতে হবে। 

মাকড়সা আগ বাড়িয়ে বলে উঠল—ভালো কথা বলেছ তুমি। ওকে জিজ্ঞেস করো তো, খেতটা যদি ওর হয়, ও আসা যাওয়া করে কোন পথে? 

কাঠবেড়ালি জবাব দিল—কেন, আমি তো গাছের উপর দিয়ে দিয়ে আসি। তাতে হোলটা কী? 

মাকড়সারা এসেছে পাড়াশুদ্ধ সবাই। তারা হো-হো করে হেসে উঠল—গাছের উপর দিয়ে রাস্তা! বেকুব বানাতে চাও সবাইকে? 

মোড়ল জানতে চাইল—তা, তোমরা জমিতে আসো কীভাবে? 

মাকড়সার মুখে এবার হাসি। এটাই চাইছিল সে। বলে উঠল—কীভাবে আবার? যেভাবে এখন তুমিও এলে এখানে। এই রাস্তা ধরেই জমিতে আসা যাওয়া করি আমরা। কত মেহনত করে বানানো হয়েছে রাস্তাটা। পাড়ার সবাই মিলে গতর খাটিয়েছি। তবেই না রাস্তাটা গড়ে উঠেছে। 

এতক্ষণ খেয়ালই করেনি কেউ। এখন তাকিয়ে দেখল, খোলামখুচি দিয়ে বানানো সুন্দর একটা রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে আছে তারা সকলে। 

মোড়ল কাঠবেড়ালিকে জানতে চাইল—রাস্তাটা কি তুমি বানিয়েছো?

--না। আমি এই রাস্তা বানাইনি। কাঠবেড়ালির সোজা সরল জবাব। 

মোড়ল রায় দিয়ে দিল-- তাহলে তো মিটেই গেল বিবাদ। খেত যে বানিয়েছে, রাস্তাটা তারই করার কথা। রাস্তা যারা বানিয়েছে, ফসলও কাটছে তারাই। এর মধ্যে তোমার দাবি আসে কী করে?

বিচার শেষ। মুখ গোমড়া করে ঘরে ফিরে গেল কাঠবেড়ালি 

মাকড়সাদের মহা আনন্দ। মামলা জিতে গিয়েছে তারা। দল বেঁধে আবার লেগে গেল গম কাটবার কাজে।

সব ফসল জড়ো  করে বড় একখানা আঁটি বাঁধা হোল। হাটের দিন, সেই আঁটি নিয়ে মাকড়সারা দল বেঁধে চলল গম বিক্রি করতে।

এদিকে হয়েছে কী, এবার মঞ্চে এসে উদয় হোল একটা দাঁড়কাক। গাছের মাথাটিতে তার বাসা। সবই দেখেছে বুড়ো কাকটা। কাঠবেড়ালির জমি তৈরি, ফসল বোনা, সেচের কাজ, সবই সে দেখেছে। মাকড়সাদের উদয় হয়ে রাস্তা বানানো, পরের পাকা ফসল কেটে নেওয়া-- তার চোখে পড়েছে সব কিছু। 

মোড়লকে সাথে নিয়ে যেদিন সবাই জমিতে এল, একটা নীচু ডালে বসে, সবই দেখেছে আর শুনেছে কাকটা। এবার তার মনে হোল, মাকড়সাদের খেলা শেষ। এবার আমার মওকা। 

মাকড়সারা যখন বোঝা ঠেলে ঠেলে হাটে চলেছে, পাড়ার চারজন সাকরেদকে নিয়ে কাকেরা উড়ে উড়ে চলেছে মাথার উপর দিয়ে। 

হাটে পৌঁছোতে খানিকটা পথ বাকি, হঠাত করে সোঁসোঁ বাতাস আর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এসে গেল। তাড়াতাড়ি গমের আঁটি রাস্তার একধারে রেখে, মাকড়সারা দৌড় লাগালো মাথা গুঁজবার ঠাঁই খুঁজতে।

অমনি ঝুপ করে নেমে এল কাকগুলো। সবাই বড় বড় ডানা মেলে বসে রইল গমের আঁটির ওপর। 

এক সময় বৃষ্টি ধরে যেতে, মাকড়াসারা এসে হাজির। কাককে এভাবে ডানা মেলে বসে থাকতে দেখে, মাকড়সার ভারি আনন্দ হোল। সে খুশি খুশি মুখ করে বলল—অনেক ধন্যবাদ তোমাদের। বৃষ্টির হাত থেকে আমাদের ফসল বাঁচাবার জন্য, আমরা তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ। 

কাকের গলা সবাই চেনে। সে কা-কা করে তেড়ে উঠল—তোমাদের ফসল! কৃতজ্ঞতা! মানেটা কী এসবের? মাকড়সা বলল—আমাদের মানে, আমাদের ফসল। বৃষ্টি আসছে দেখে, এখানে ফেলে, মাথা বাঁচাতে গিয়েছিলাম। তোমরা এসে জুটলে কেন?

হা-হা করে হেসে উঠল বুড়ো কাকটা—ফসল নিজের হলে, কেউ এভাবে ফেলে পালায় নাকি? মেহনতের ফসলের চেয়ে, মাথা বড় হয় নাকি চাষীর? বেকুব পেয়েছ আমাকে? 

মাকড়সার মুখে জবাব নাই। কাক বলল—কেটে পড় এখান থেকে। নইলে খরগোশের কাছে যেতে হবে। মোড়ল এসে বলুক নিজের চোখে সব দেখেশুনে। তখন কিন্তু ভারি বেইজ্জত হতে হবে, এটা মাথায় রেখো। কী করবে ভেবে দ্যাখো। এদিক আমাদের হাটের বেলা বয়ে যাচ্ছে। 

মাকড়সা বুঝে গেল, ব্যাপার আদৌ সুবিধার নয়। কাঠবেড়ালিকে ঠকিয়ে বোকা বানানো গেছে। কাক কিন্তু এবার বেইজ্জত করেই ছাড়বে। তার চেয়ে, মানে মানে সরে পড়াই ভালো। 

কথা না বাড়িয়ে, মাকড়সাগুলো সরে পড়ল গমের আঁটি ছেড়ে। কা-কা করে টিটকিরি দিতে লাগল কাকের দল।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments