জ্বলদর্চি

মাটিমাখা মহাপ্রাণ-১৫/শুভঙ্কর দাস

মাটিমাখা মহাপ্রাণ
পনেরো
শুভঙ্কর দাস 

"এ জগতে সদাই ঘটে ক্ষয়,
ক্ষতি তবু হয় না কোনোমতে
শুকিয়ে-পড়া পুষ্পদলের ধূলি
এ ধরণী যায় যদি বা ভুলি
সেই ধুলারি বিস্মরণের কোলে
নতুন কুসুম দোলে"

কুমারচন্দ্রের শিক্ষকতার কাজ করার প্রথমে একটা কথা মনে হল,সংসার-সমাজের এই দীনহীন  অবস্থা এবং দেশের পরাধীন  অবস্থা রাতারাতি বদল হবে না।কোনো রূপকথার গল্পের মতো একদিন সকাল হলেই সবকিছু সুন্দর ও প্রাচুর্যপূর্ণ হয়ে যাবে না।এর জন্য সুবৃহৎ পরিকল্পনা ও রক্ত-ঘাম ঝরানো পরিশ্রম প্রয়োজন। ইংরেজ রাজশক্তি অসম্ভব ধুরন্ধর ও শক্তিশালী। তাদের বিপুল পরাক্রম ও প্রভাব এই দেশের শিকড় পর্যন্ত চারিয়ে গেছে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ ইংরেজ আমলকেই অপরিবর্তিত ও অমোঘ বলে ভেবে নিয়ে  শ্রদ্ধামিশ্রিত ভয়ের চোখে দেখে। তারা মনে করে ইংরেজ শাসন কোনোদিন কোনোকালে শেষ হবে না। এমন কি এটাই শেষ সত্য বলে বিশ্বাস করে জীবনযাপন করে চলে,ইংরেজ রাজসরকারের  বিরুদ্ধে দাঁড়ানো অথবা কোনো শাসনজনিত নিয়মের সমালোচনা করা এক অলীক কল্পনা অথবা অপরাধ বলে গন্য করে।

তাহলে হাতে কী রইল?
এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে কুমারচন্দ্রের ভেতরটা তোলপাড় করে তুলল।
আবার নিজেই একটা উত্তর তৈরি করলেন।
শুধু নিজেদের ভেতর থেকে শক্তিশালী করে তুলতে হবে। সেই কাজটি শিক্ষকতার মাধ্যমে সত্যি করে তুলবেন কুমারচন্দ্র,তা অনুভব করলেন। তিনি মানুষ গড়ার কারিগর হয়ে উঠতে চান সার্থকভাবে। তাই কুমারচন্দ্র বালিগঞ্জ জগবন্ধু ইনস্টিটিউটে কাজে যোগ দিলেন, অথচ কলকাতায় থাকার কোনো ব্যবস্থা না করেই,অর্থাৎ সেইদিকে তাঁর কোনো চিন্তা ছিল না।
তাঁর একমাত্র পাখির চোখ,দেশের ভবিষ্যৎকে জাগিয়ে তোলা।
শুধু একটাই লক্ষ্য, দেশের মূল শক্তি ছাত্রদলকে সত্যিকারের শক্তিশালী করে তোলা।তাই প্রথম দিনের ক্লাসে তিনি কবি নজরুলের এই কবিতা উদাত্ত কণ্ঠে শোনালেন,

"আমরা শক্তি আমরা বল
আমরা ছাত্রদল
মোদের পায়ের তলায় মুর্ছে তুফান
ঊর্ধ্বে বিমান ঝড়-বাদল
আমরা ছাত্রদল।

মোদের আঁধার রাতে বাধার পথে
যাত্রা নাঙ্গা পায়,
আমরা শক্তমাটি রক্তে রাঙাই
বিষম চলার ঘায়।
যুগে যুগে রক্তে মোদের 
সিক্ত হল পৃথ্বীদল।
আমরা ছাত্রদল।"

বিদ্যালয়ের ছেলেরা বুঝল,তাদের এমন একজন মাস্টারমশাই এসেছেন, তিনি শুধু পড়াতে আসেননি!
তিনি নতুন করে জীবন গড়ার পথ দেখাতে এসেছেন। 
এবং অচিরেই তা সকলের চোখে পড়তে লাগলেন কুমারচন্দ্র।
তারপর একটি ঘটনা রীতিমতো ছাত্রদের মনে আলোড়ন তুলল।
সংস্কৃত সাহিত্যের শিক্ষক শ্যামচাঁদ তর্করত্ন একটি বিষয় নিয়ে ইতিহাসের শিক্ষক অলক বিশ্বাসের সঙ্গে স্টাফরুমে দ্বন্দ্বযুদ্ধ তৈরি হয়।
বিষয়টি হল,মানুষের মধ্যে ঐক্য ও একপ্রাণতা কী করে আনা সম্ভব? 
তাতে সংস্কৃত সাহিত্যের শিক্ষক শ্যামচাঁদের বক্তব্য, একমাত্র ধর্ম আমাদের এক ছাতার তলায় আনতে পারে,ধর্মের সাহায্যে এই দেশের মানুষের নতুন করে বাঁচার পন্থা আবিষ্কার হবে। ধর্মই পারে মানুষের মধ্যে বিভেদ ঘোচাতে।
ইতিহাসের শিক্ষক অলক বিশ্বাসের পাল্টা যুক্তি, ধর্ম?  না অধর্মের চাষ চারিপাশে!ধর্ম চিরকাল রাজতন্ত্রের খুঁটিতে নাড়া বেঁধে রেখেছে। একমাত্র রাজা ও প্রজা এই হল উন্নত সভ্যতার চাবিকাঠি। মাঝখানে কেউ কোনো কলকাঠি করার সুযোগ পাবে না।একদিকে রাজা থাকবে শাসনের মানদণ্ড, অন্যদিকে প্রজারা থাকবে রাজার অনুগামী তথা রাজ্যের অনুগামী।যেমন ইংল্যান্ড, দেখুন তো,সেখানে রাজতন্ত্র কত শক্তিশালী, তাই এতো উন্নত দেশ।আমাদের দেশকেও সেই পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে,অথচ কিছু অসভ্য অশিক্ষিত বদমাইস সেই মহান কাজে বাধা দিচ্ছে মিছিল করে,মিটিং করে, বোম মেরে... ছিঃ
ব্যাস অমনি শ্যামচাঁদ রাগান্বিত কণ্ঠে বলে উঠলেন,হ্যাঁ,ঐ তো পদলেহনকারীর চিন্তা চিরকাল এইরকমই হয়,মানুষের মধ্যে সাম্যতা আনতে গিয়ে মানুষকে একেবারে পায়ের তলায় পিষে মারার অপূর্ব পরিকল্পনা শোনালেন ঐতিহাসিক মাস্টারমশাই।

ওহে ধার্মিক মাস্টার, আপনি ও আপনার ধর্ম তো কম যান না! এই হিন্দু বলে মুসলমান খারাপ, আবার মুসলমান মনে করে হিন্দুই ধর্মনাশের গোঁড়া,সেই সঙ্গে আবার উপস্থিত খ্রেস্টান,মনে নেই সেই এক কবি আছেন,মহাকাব্য লিখে আমাদের ভরিয়ে রেখেছেন,তিনিও তো আপনার হিঁদুআনিকে দূর দূর করে আপনাদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছে!
অন্য শিক্ষকগণ দু'পক্ষকে মৃদুমন্দ হাসি-অঙ্গসঞ্চলনাতে বেশ উত্তাপ সঞ্চার করে চলছিলেন। তাদের মুখেচোখে একটা অদৃশ্য চাহিদা এই, এই ঝগড়াঝাটি বেশ জমাটি হোক। হাতাহাতি হলেও তাতেও কোনো অসুবিধা নেই। 
শ্যামচাঁদ টিকিটিতে গিঁট মেরে আবার সোচ্চার হতে যাচ্ছেন,এমন সময় কুমারচন্দ্র উপস্থিত হলেন।তাঁকে এরা দু'জন খুবই পছন্দ করেন,কারণ এই শিক্ষকতাকালের মধ্যে এই দুজন কুমারচন্দ্রের কাছে কোনো না কোনো সহযোগিতা পেয়েছেন,এমন কি একবার ইতিহাসের মাস্টারমশাইকে এক ইংরেজ পুলিশের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন।
তিনি দুইজন শিক্ষককে অনুরোধ করলেন,এইভাবে তর্ক-বিতর্ক না করে একটিবার তাঁর সঙ্গে আসতে। 
তারপর একটি শ্রেণিকক্ষে দু'জন বাগযুদ্ধের সামিল শিক্ষককে নিয়ে উপস্থিত হলেন।
কুমারচন্দ্র সকল ছাত্রকে বসতে বললেন।
তারপর সুগম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের সামনে একতা ও একপ্রাণতা কী জিনিস তা তুলে ধরব বলে এখানে উপস্থিত হয়েছি।এই ক্লাস থেকে স্টাফরুমের চিৎকার শুনে কুমারচন্দ্র ঝগড়ার মাঝখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। 
তিনি ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বললেন,আচ্ছা, তোমাদের মধ্যে হিন্দু কারা দাঁড়াও।
সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্র দাঁড়িয়ে পড়ল।
তারপর নির্দেশ, এবার যারা মুসলিম, তারা দাঁড়াও।
সাত-আটজন দাঁড়িয়ে পড়ল।
এবার ব্রাহ্মণ যারা,তারা দাঁড়াও।
এবার প্রায় দশবারো জন দাঁড়াল।
সেই সঙ্গে শ্যামচাঁদ তর্করত্ন বুক চিতিয়ে দাঁড়ালেন।এবং চারিপাশে একটা আশিসপ্রদানকারী পুরোহিতের মতো অবলোকন করতে লাগলেন।
তারপর কুমারচন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন,যারা জমিদার বাড়ির সন্তান, তাদের কেউ আজ আছো?
দেখা গেল,দুজন দাঁড়িয়ে পড়ল।
আচ্ছা, খুশি হলাম।সবাই বসে পড়।
আর যদি প্রজার কথা ধরি,এই ক্লাসে আমার দাঁড়ানো উচিত।কারণ আমি অতি দীনহীন পরিবারের সন্তান। দুবেলা দুমুঠো অন্ন সংস্থানের জন্য যাদের কাঠফাটা রোদকে এবং ব্যাঘ্রহিমানীকে চোখ রাঙাতে হতো!
বলেই নিজে দাঁড়ালেন। 
শ্যামচাঁদ এবং অলক দুজনের মুখে তীক্ষ্ণ হাসি।
এরপর কুমারচন্দ্র বলে উঠলেন,দেখলেন তো রাজা-প্রজা ও ধর্মভেদ, সবেই আমাদের কত ফারাক করে দেয়। কত আলাদা করে দেয়। অথচ সেই কতদিন আগে চণ্ডীদাস বলে গেছেন,
শুনহ মানুষ ভাই,সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই"
এবার দেখুন,আচ্ছা, এই ক্লাসে যারা মানুষ অথবা সত্যিকারের মানুষ হতে চাও দাঁড়াও।
সঙ্গে সঙ্গে সকলকেই দাঁড়িয়ে পড়ল।
দৃশ্যটি দেখার মতো হল।
কুমারচন্দ্র হাতজোড় করে সেই বিবাদপরায়ণ দুই শিক্ষককে বলে উঠলেন,এখন মানুষ গড়ার সময়,মানুষ হয়ে ওঠার সময়,এতে কোনো ভেদ নেই, কোনো ফারাক নেই। 
এই দৃশ্য ও কথা শুনে শ্যামচাঁদ তর্করত্ন ক্লাস থেকে গটগট করে বেরিয়ে গেলেন।
ইতিহাসের মাস্টারমশাই অলক বিশ্বাস এগিয়ে এসে কুমারচন্দ্রের হাতে ধরে আবেগমিশ্রিত কণ্ঠে বলে উঠলেন,বাহ্, এরকম সহজ করে কেউ এর আগে বোঝায়নি।আমি আপনার শিক্ষা দেওয়ার পদ্ধতি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
সেই সময় ক্লাসের একটি ছাত্র উঠে এসে কুমারচন্দ্রকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল।বলে উঠল,স্যর,আজ যা উপলব্ধি করলাম,সারাজীবন মনে রাখব।

কী নাম তোমার?

আজ্ঞে,হিরন্ময়।

বাহ্, আচ্ছা,হিরন্ময় কথাটির মানে জানো তো?

ছাত্রটি উত্তর দিল,সোনা দিয়ে তৈরি।

বেশ,তোমার মনকে সোনা দিয়ে তৈরি করো,মানবিকতার সোনা,মনে থাকবে?

হা, স্যর।

এইভাবে কুমারচন্দ্র প্রতিটি দিন বিদ্যালয়ে এক আলোকময় অভিযানের পথ তৈরি করে ছাত্রমহলে ও শিক্ষকদের মধ্যে একটা আশ্চর্য সম্মানের আসন নির্মাণ করতে লাগলেন।

এইভাবে কেটে ছয়মাস।

এই ছয়মাসের মধ্যে একদিনের জন্য ছুটি নেননি কুমারচন্দ্র।
বিদ্যালয়ে একেবারে যথাসময়ের পূর্বে কুমারচন্দ্র উপস্থিত হতেন এবং বিদ্যালয় শেষ হওয়ার পরেও    ছাত্রদের নানারকম ভাবনায় ও কাজে উৎসাহিত করতেন।

 একদিন জগবন্ধু ইনস্টিটিউটের সভাপতি আশুতোষ চৌধুরী উপস্থিত হলেন। তিনি দেখলেন একটি লোক গামছা মাথায় বেঁধে বিদ্যালয়ের বারান্দা পরিষ্কার করছেন,নিজেই ঝাড়ু ধরে পাতা-লতা কাগজটুকরো একটি ডাস্টবিনে ফেলছেন।ডাস্টবিনটির গায়ে লেখা ছিল,পরিষ্কার স্থান,পরিষ্কার মন।
আশুতোষবাবু দেখলেন বিদ্যালয় বসতে কিছুটা সময় দেরি আছে।তিনি আসলে অতি সতর্ক ও কঠোর প্রকৃতির মানুষ।
তাই বিদ্যালয় শুরুর কিছুটা আগে এসেই নিজস্ব বিচারবোধে পর্যবেক্ষণ করে নিচ্ছেন।
তিনি সেই পরিষ্কাররত লোকটির দিকে এগিয়ে গেলেন,বলে উঠলেন,কী ব্যপার? আজ কি আর কোনো ঝাড়ুদার আসেনি? একাই একাজ করছেন কেন? একটু পরে তো স্কুল শুরু হবে!

লোকটি মন দিয়ে কাজ সমাপ্ত করে আশুতোষ চৌধুরীকে নমস্কার জানিয়ে বললেন,আজ্ঞে, এই অপর একজন কাজের লোক সহসা অসুস্থ হয়ে পড়েছে,তাঁকে বাসায় রেখে এসেছি,ডাক্তারও দেখেছে। কিন্তু একজনের অনিচ্ছাকৃত অনুপস্থিতের জন্য এই পবিত্র স্থান অপরিষ্কার থাকবে,তাই কাজটা এগিয়ে রাখছি।

বেশ, তাড়াতাড়ি করে ফেলো।

আজ্ঞে। 

আচ্ছা, বেশ, এই ডাস্টবিনের গায়ে কথাটি খুবই সুন্দর।  তারপর কথা ঘুরিয়ে আশুতোষবাবু জিজ্ঞেস করলেন,আচ্ছা অধ্যক্ষ কি এসেছেন?

না,এবার এসে পড়বেন? আপনি তাঁর রুমে বসুন। 

আচ্ছা,তোমাকে আমার কেমন চেনা চেনা লাগছে,কী নাম তোমার যেন?

উত্তর নেওয়ার আগেই বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ উপস্থিত হলেন এবং সভাপতিকে সুন্দর সকালের সম্ভাষণ জানিয়ে নিজের কক্ষে নিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় শুধু এক ঝলক পরিষ্কাররত লোকটিকে দেখলেন।

আশুতোষ চৌধুরীকে নিয়ে নিজের  কক্ষে আসতেই অধ্যক্ষ আপনমনে বিড়বিড় করে উঠলেন,এই এক অদ্ভুত মাস্টার এসেছে স্কুলে,এমনটি সচারাচর চোখে পড়ে না!

কিছু কি বলছেন? জিজ্ঞেস করলেন আশুতোষবাবু।

উত্তর কিছু নেওয়ার আগেই 
বিদ্যালয়ের প্রার্থনা শুরুর ঘন্টা পড়ল,অধ্যক্ষ সভায় যোগ দিলেন এবং প্রার্থনা শুরু হল।
অধ্যক্ষ দেখলেন,একেবারে সামনের সারিতে কুমারচন্দ্র দাঁড়িয়ে আছেন, অতি সাধারণ মানের ফতুয়া এবং ধূতি পরে। এবং একটু খোঁজ নিলেই দেখা যাবে হয়তো ভাত না খেয়েই কাজে যোগ দিয়েছেন এবং টিফিন পিরিয়ডে বিদ্যালয়ের বাইরের গেটের পাশে এক ঠোঙা মুড়ি জল দিয়ে ভিজিয়ে খেয়ে এসে হাসিমুখে পড়াচ্ছেন।  কেউ এগিয়ে এসে খাওয়াতে চাইলে অথবা বাড়তি কোনো সহযোগিতা করতে চাইলে সদা প্রসন্ন মানুষটি কিছুতেই সেই সাহায্য গ্রহণ করেন না,বরং উল্টে জোর করে কিছু খেতে দিলে তা নিয়ে গিয়ে বালিগঞ্জ রেল স্টেশনের ভিখিরির মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে আসেন। না,শুধু বিলিয়ে দিয়ে আসেন না,কুমারচন্দ্র নিজে গিয়েই তাদের সঙ্গে বসে পড়বেন ধূলায়,আনন্দের সঙ্গে খাবেন এবং আপনজনের মতো কথাবার্তা বলবেন।
অধ্যক্ষ দূর থেকে এসব লক্ষ্য করেছেন এবং মনে মনে অবাক হয়েছেন।তাঁর বিদ্যালয়ে অসংখ্য শিক্ষক এসেছেন, কিন্তু এই মানুষটি একেবারে অন্য ধাতুতে গড়া।আজকে সভাপতির চোখে সেই বিস্ময় অবশ্যই দেখতে পাবেন,কারণ আশুতোষ চৌধুরী উপস্থিত হয়েছেন,কুমারচন্দ্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন বলে।

আপনার বিদ্যালয়ে এই যে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্নতার ওপর জোর দিচ্ছেন,দেখে খুব ভালো লাগল। বিদ্যালয় যে মন্দির, তা স্মরণ রাখা প্রয়োজন। 

অধ্যক্ষ বুঝলেন,নিশ্চয়, সভাপতি বিদ্যালয়ে একটু আগে এসে কুমারচন্দ্রকে দেখেছেন।তিনি শুধু হাসিমুখে বলে উঠলেন,আসলে বিদ্যালয়ের প্রত্যেকে যদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সচেতন হয়,তাহলে এইসব কাজ করতে কোনো অসুবিধা হয় না।

হা,সঠিক বলেছেন।এইভাবে কাজ করতে থাকুন।আচ্ছা,আজ কি একজন ঝাড়ুদার অসুস্থ? 

হা,একজন নয়,দুজনেই।একজন তো অসুস্থ, এবং অপর একজন দেশের বাড়ি চলে গেছে।

দেশের বাড়ি! না, না,সে ফিরেছে,আমি তাকে কাজ করতে দেখেছি। তবে লোকটি দারুণ যত্নশীল এবং মনোযোগী কর্মী।

আশুতোষ চৌধুরী চোখে হালকা হাসি এনে তাকিয়ে থাকলেন অধ্যক্ষের দিকে।অর্থাৎ তিনি সব খবর নিয়ে উপস্থিত। 

অধ্যক্ষ নীরবে চেয়ে রইলেন।

আশুতোষ চৌধুরী বলে উঠলেন,আচ্ছা,এবার কাজের কথায় আসা যাক,আপনি কুমারচন্দ্র জানাকে ডাকুন,যাঁর জন্য এই বিদ্যালয়ে আসা। মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে ভালো করে আলাপ করতে হবে।প্রথম দিন তো শুনেছিলাম সন্ধ্যাবেলায় উপস্থিত হয়েছিলেন,সেদিন তো ভালো করে আলাপই হয়নি!

আচ্ছা, আমি ডেকে পাঠাচ্ছি।

একটু পরেই কুমারচন্দ্র উপস্থিত হতেই আশুতোষ চৌধুরীর চোখ কপালে উঠে গেল। তিনি বিস্ময়ে দেখলেন,সকালের সেই ঝাড়ুদার আসলে একজন শিক্ষক, এবং তিনি কুমারচন্দ্র জানা।
আশুতোষ চৌধুরী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। 
কুমারচন্দ্রের সদা হাস্যময় মুখ।
অধ্যক্ষ বললেন,কুমারবাবু, ইনি বিদ্যালয়ের সভাপতি।আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চান।প্রথমদিন তো আপনার জয়েন্টে উনি বাড়িতে ছিলেন না!তারপর আশুতোষবাবুর দিকে ঘুরে বললেন,আসলে দুইজন গ্রূপ-ডি না থাকার জন্য, এই অবস্থা! আপনি যাকে ঝাড়ুদার ভেবেছিলেন,তিনি তো আমার..

ব্যাস,আর বলতে হবে না,তাই বলি, একজন শিক্ষকের নাম এতো কেন ছড়িয়েছে? কুমারবাবু, আপনাকে তো ধন্যবাদ দিতে হয়, বলে উঠলেন,আশুতোষ চৌধুরী। 

কী বলছেন,স্যর,আমার এই সব কাজ করতে কোনো অসুবিধা হয় না,আমি নিজের হাতে সবকাজ করতে ভালোবাসি। এই বিদ্যালয় শুধু নয়, এই সমাজ ও দেশকে নতুন করে গড়তে হলে আমাদেরকেই সবকিছু নিজের হাতে করতে হবে।

আশুতোষ চৌধুরী আবার অবাক হলেন। এতদিন পরে তিনি একজন সত্যিকারের শিক্ষককে দেখছেন।

তা আপনার জন্য সুখবর আছে।বললেন অধ্যক্ষ।আপনার বাসার ব্যবস্থা এখনও হয়নি? 

মানে? আবার অবাক আশুতোষ চৌধুরী। উনি তাহলে এতদিন কোথায় থেকে কাজ করছেন!

কী বলব,আপনাকে, আমি তো নিজেই জানতাম না,পরে শুনে আমিও অবাক,উনি প্রথম তিনদিন রেল স্টেশনে আশ্রয় নিয়েছিলেন,তারপর একটি আশ্রমের ঘরে ছিলেন এবং এখন বিদ্যালয়ের সুইপার-রুমে রাত কাটান।সবকিছু খুলে বললেন অধ্যক্ষ।

আমার কিন্তু কোনো অসুবিধা হচ্ছে না,অকারণ আপনারা চিন্তা করছেন। কুমারচন্দ্র সহজ কণ্ঠে বলে উঠলেন।

আশুতোষ চৌধুরী এবার বলে উঠলেন,ঠিক আছে,সব বুঝেছি,আগামী মাস থেকে আপনার বেতন দশ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হল।তাতে আশা করছি,আপনি একটি বাসা ভাড়া করতে পারবেন। কী খুব খুশি তো?

কুমারচন্দ্র নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন।

অধ্যক্ষ এবার বললেন,বলুন, কুমারবাবু?এই সুখবর কেমন লাগল?

কুমারচন্দ্র হাসিমুখে বললেন,এই টাকা আমার জন্য বাড়ানোর দরকার নেই, আমি যা বেতন পাই তাতে সংসার ঠিকঠাক চলে যায়,এই বেতন বৃদ্ধি কোনো দরকার নেই। 

মানে? আশুতোষ চৌধুরীর প্রবল কৌতূহলী।বেতন বৃদ্ধিতে আনন্দিত নয়!

আসলে আমার একটি প্রস্তাব ছিল।যদি অনুমোদন করেন।

বলুন?

আমাকে যে টাকা বেশি দিতে চাইছেন,তা যদি বিদ্যালয়ের সমবায় ভাণ্ডারের প্রদান করেন,দারুণ উপকার হয়।

সমবায় ভাণ্ডার?  আশুতোষ চৌধুরী আবার অবাক।

অধ্যক্ষ বুঝিয়ে দিলেন,আসলে সভাপতি মহাশয়,কুমারবাবু ছাত্রদের নিয়ে একটা সমবায় ভাণ্ডার খুলেছেন,তাতে সকলের শ্রমে ও সাহায্যে একটা অর্থ সংগ্রহ হয়,এবং তা থেকে বিদ্যালয়ের৷ যার যা প্রয়োজন, বিশেষ করে গরীব অথচ মেধাবী ছাত্রদের জন্য খরচ করা হয়। সেই ভাণ্ডারের কথাই বলছেন।

হ্যাঁ,এইভাবে ছাত্ররা একটা একতা ও একপ্রাণতার শক্তি অর্জন করবে।একদিন এরাই সমবেত কাজ করার কী সুফল বুঝতে পারবে।দারুণ উৎসাহ নিয়ে বললেন কুমারচন্দ্র।

আশুতোষ চৌধুরী এগিয়ে গিয়ে কুমারচন্দ্রের হাত ধরে বললেন,আপনাকে দেখে আমি অবাক হচ্ছি মাস্টারমশাই,আজ এসেছিলাম,বেতন বৃদ্ধির কথা শুনিয়ে আপনাকে চমকে দেবো,কারণ এত অল্প সময়ে কারও বেতন বাড়ানো সচারাচর হয় না! 
অথচ আমিই চমকে যাচ্ছি, এ কার বেতন বাড়াতে এসেছি আমি,আপনি থাকলে এই বিদ্যালয় উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে।আর কী চাই? কী বলেন অধ্যক্ষ মহাশয়? 

একদম সঠিক।

কুমারচন্দ্র শুধু মৃদু স্বরে বললেন,এবার আমাকে যেতে হবে,ক্লাস আছে।আমাকে ক্ষমা করবেন।

বলেই দরজা পেরিয়ে চলে গেলেন।

অধ্যক্ষ ও আশুতোষ চৌধুরী সেই দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন।
সেইসসময় ক্লাস থেকে সমস্বরে ধ্বনিত হল,

"আপনারে বড়ো বলে,বড়ো সেই নয়
লোকে যারে বড়ো বলে,বড়ো সেই হয়। 
বড়ো হওয়া সংসারেতে কঠিন ব্যাপার
সংসারে সে বড় হয়,বড়ো গুণ যার।
গুণেতে হইলে বড়ো,বড়ো বলে সবে
বড়ো যদি হতে চাও,ছোটো হও তবে।'

ক্রমশ....

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments