জ্বলদর্চি

গওহরজান - এক বিস্মৃত অধ্যায়- ৪ /দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

গওহরজান - এক বিস্মৃত অধ্যায় 
পর্ব - ৪                                        

দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী      

মলকাজান গওহরকে এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করার চেষ্টা বিভিন্নভাবে করতে লাগলেন। গওহরের তের বৎসরের জন্মদিন খুব ধুমধামের সাথে পালিত করলেন মলকা। সেই অনুষ্ঠানে গওহরের 'নথ উৎরনা' হয়েছিল। বাঈজীদের কাছে 'নথ উৎরানা' অনুষ্ঠানের অর্থ সেই দিন থেকে সেই মেয়েটি স্বাধীনভাবে নাচ-গানকে তার পেশা হিসেবে গ্রহণ করার আনুষ্ঠানিক সম্মতি পেল। বাঈজীদের কোঠা থেকে 'নথ' বাবুর বিজ্ঞাপন দেয়া হতো। এর অর্থ কোন ধনী ব্যক্তি যথেষ্ট পরিমাণে অর্থ নজরানা দিয়ে মেয়েটির আর্থিক দায় দায়িত্ব গ্রহণ করে তার সাথে চুক্তি ভিত্তিক মিলনের অধিকার পাবে। সেই দিনে 'নথ' বাবু মেয়েটির নাকে একটি হীরের নাকছাবি পরিয়ে দিত এবং সেই দিন থেকে সেই মেয়েটি বাঈজী হিসেবে গণ্য হতো। কলকাতার সমস্ত অভিজাত পরিবার ও বাঈজীদের সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হলো যাতে গওহরকে মানসিক বিপর্যয় থেকে মুক্ত করা যায়, কিন্তু সেই অনুষ্ঠান গওহরের জীবনে এক কালো অধ্যায়ের সূচনা করলো। সেই রাত্রে আমন্ত্রিত খয়রাগড়ের লম্পট বৃদ্ধ রাজা মলকাজানের অগোচরে গওহরকে যথেচ্ছভাবে ভোগ করেছিলেন, ফলস্বরুপ তের বৎসরের কিশোরীটি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে যায় এবং পরবর্তীকালে একটি মৃত সন্তান প্রসব করে। খুরশিদের মৃত্যুতে যে মানসিক যন্ত্রণা গওহর পেয়েছিল সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পরিবর্তে সে আরও শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রনার সম্মুখীন হল। নিজের জীবনের সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা তাকে জীবন সম্বন্ধে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলেছিল।                       

গওহরের এই ভীতসন্ত্রস্ত মানসিক অবস্থা থেকে মুক্ত করার জন্য মলকাজান তাকে তার সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাইতে নিয়ে যেতে শুরু করলেন। এই সময়ে মলকাজান দ্বারভাঙ্গা রাজপ্রাসাদ থেকে মহারাজ লক্ষ্ণেশ্বর সিংহের আমন্ত্রণ পেলেন সেখানে যেয়ে অনুষ্ঠান করার জন্য। মলকা স্থির করলেন নিজে না যেয়ে গওহরকে সেখানে পাঠাবেন। রাজদরবারে যেয়ে গওহর তার সুরেলা কন্ঠের মাধ্যমে সকলের মন জয় করলেন এবং সকলেই এই সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ গায়িকাকে বরণ করে নিলেন। মহারাজ নিজে গওহরকে বহু মূল্যবান উপহার দিয়ে তাকে রাজদরবারের সভা গায়িকা হিসেবে নিযুক্ত করলেন। দ্বারভাঙ্গা রাজদরবারে সাফল্যের সাথে অনুষ্ঠানের পরে কলকাতার বিভিন্ন অভিজাত মহল থেকে অনুষ্ঠান করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হল। সেই সময়ে একটি কথা প্রচলিত হয়েছিল 'গওহরকে বিনা মেহফিল, য্যায়সে সৌহরকে বিনা দুলহন' অর্থাৎ গওহর বিনা অনুষ্ঠান যেন বর বিনা কনে। অর্থ, সম্মান সবকিছুই গওহর পেলেন কিন্তু তার মন চাইছিল এমন একজন মানুষকে যে প্রকৃত একনিষ্ঠ প্রেমে তার হৃদয়কে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। কিছুদিনের মধ্যে গওহর সেই রকম এক মানুষের সান্নিধ্য এলেন যে তাকে সত্যসত্যই ভালোবাসত। সেই মানুষটি হলেন বেনারসের বিখ্যাত রাই পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান রাই ছগন। প্রেমের বন্যায় ভেসে যেয়ে মলকার নিষেধ সত্ত্বেও একদিন গওহর ছগণের হাত ধরে বেনারসের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিল। গওহর ছিল একজন সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণা, তার সৌন্দর্য যেন দিন দিন বিকশিত হচ্ছিল। আর্মেনীয় বাবা ও ভারতীয় মায়ের রক্তের সংমিশ্রনে তার দুধে আলতায় গোলা আরক্তিম গায়ের রং, প্রশস্ত কপালে ধনুকের মত বেঁকে আসা একটি বিন্দুতে মিলিত হওয়া ভ্রূযুগল, মাদকতাময় চোখ, একঢাল কালো কোঁকড়ানো চুল, আকর্ষক শারীরিক গঠন পুরুষ মাত্রেই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। 

এক সন্ধ্যায় তাদের অনুষ্ঠানের যোগাযোগকারী ইউসুফ সদ্য যৌবনে পা দেওয়া দুই যুবককে তাদের কোঠাতে নিয়ে এলো। এদের মধ্যে একজন হল বেনারসের বিখ্যাত রাই পরিবার কৃষ্ণদাস রাইয়ের মধ্যম সন্তান ছগন রাই এবং অন্যজন তারই বন্ধু মনোহর। তারা কেবলমাত্র গওহরের সঙ্গীতানুষ্ঠান দেখবে বলে বেনারস থেকে কলকাতায়  এসেছিল। সেই সন্ধ্যায় গওহর অতিথিদের সামনে তার জীবনের সেরা অনুষ্ঠানগুলোর একটি পরিবেশন করলো। কিন্তু প্রেমের পঞ্চশরে বিদ্ধ হলো দুই তরুন-তরুনী - ছগন রাই ও গওহর। অবস্থা এমনই দাঁড়ালো যে ছগনের প্রস্তাবে গওহর এককথায় তার সাথে বেনারসে যেতে রাজী হয়ে গেলো। ছগনের প্রলোভনে এবং প্রেমের ফাঁদে পা দিয়ে গওহর ভুলে গেল তার খ্যাতি, সম্মান, সমস্ত কিছু। মলকাজান যদিও বেনারসে যেতে বাধা দিয়েছিলেন কিন্তু গওহর তাঁর কথা না শুনে ভালোবাসার সঙ্গী ছগনের হাত ধরে বেনারসে চলে গেল। ছগন রাইয়ের পরিবার বেনারসের সম্ভ্রান্ত পরিবার। গওহরকে বেনারসে নিয়ে যাবার পরে ছগণের পরিবারে অশান্তির কালো মেঘ ঘনিয়ে এলো। বিত্তশালী পরিবারের ছেলের হল উভয় সংকট। একদিকে সুন্দরী বাঈজীর সান্নিধ্য অন্যদিকে পরিবারের অগাধ সম্পত্তি ও সম্মান। শেষে ছগন স্থির করলো পরিবারের মতে বিয়ে করে সংসারী হবে যাতে সে পরিবারের অর্থ ও ধনসম্পত্তি থেকে বিচ্যুত না হয় এবং সেইসঙ্গে সে গওহরকেও তার বাগানবাড়িতে রক্ষিতা হিসেবে রেখে দেবে। তার এই ফাঁদে পা না দিয়ে গওহর চার বৎসরের বেনারসের জীবনের ছগনকে ত্যাগ করে কলকাতার পথে পা বাড়ালো। এই ঘটনায় গওহর বুঝতে পারল উচ্চশ্রেণীর এইসব মানুষেরা নিজের আনন্দের জন্য তাদের মত বাঈজীদের সান্নিধ্য কামনা করে ভবিষ্যতের অসংখ্য প্রতিশ্রুতি দেয় এবং তারপরে নিজেদের সম্ভোগ চরিতার্থ করে নিজেদের জীবন থেকে তাদের মত মেয়েদের আমের আঁটির মতো চুসে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।                                       

মলকা জান জানতেন যে মোহের টানে গওহর বেনারস যাচ্ছে অচিরেই তার ভুল ভেঙে যাবে। বেনারস যাবার সময়ে সে জন্য তিনি গওহরকে খুব একটা নিষেধ করেননি। তিনি চেয়েছিলেন গওহর নিজে থেকে জীবনের বাস্তবতা উপলব্ধি করুক। গওহর ফিরে আসার পরে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো, কয়েকদিন খুব মনমরা হয়ে থাকলো। মলকা জান সেই সময়ে গওহরকে বোঝালেন সংগীতের রেওয়াজ করে পুনরায় অনুষ্ঠান শুরু করার জন্য। গওহরকে তিনি সান্তনা দিয়ে বললেন বাঈজীর জীবনে সংগীতই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত সঙ্গী এবং তার জীবনের ক্ষতস্থান পূরণের একমাত্র ওষুধ। সব দিক চিন্তা করে গওহর পুনরায় তানপুরা নিয়ে বসে তার হৃদয়ের যন্ত্রণা ব্যক্ত করলো ভৈরবী রাগের একটি গানের মাধ্যমে -                              

মোরা নাহক লায়ে গবনওয়া রে      
যবসে গয়ি মোরি সুধবুধ লিনি           
বিতি যায়ে যোবনওয়া রে                  
নাহক লায়ে গবনওয়া রে।                

অর্থাৎ সে আমাকে ফেলে চলে গেল এবং তারপর একবারও আমার দিকে ফিরেও দেখলো না, কোন প্রশ্ন করল না, আর আমি এরপরেও তার প্রতীক্ষায় বসে আছি যখন আমার যৌবন অস্ত যাচ্ছে।

কিন্তু এই প্রেমও দীর্ঘ দিন স্থায়ী হল না। মাত্র চার বৎসর পরে একরাশ বঞ্চনা, অভিমান, অপমান মাথায় নিয়ে গওহর কলকাতাতে ফিরে এলো। বেনারসের ঘটনায় তার উপলব্ধি হলো সমাজে একজন বাইজির অবস্থান কোথায়। উচ্চবিত্ত সমাজের মানুষেরা প্রেমের অভিনয় করে নিজেদের আনন্দলাভের জন্য তাদের অসংখ্য প্রতিশ্রুতি দেয় এবং কিছুদিনের মধ্যে সবকিছু আনন্দ, সম্ভোগের পালা শেষ হলে তাদের ছুড়ে ফেলে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। বেনারস যাওয়ার সময় মলকা যদিও নিষেধ করেছিলেন কিন্তু চেয়েছিলেন কৈশোরের প্রেমের ডানায় ভর করে সে জীবনের নিদারুণ অভিজ্ঞতা উপলব্ধি করুক। গওহর ফিরে এসে মায়ের বাধা সত্বেও বেনারসে যাওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতার জন্য মাকে জড়িয়ে পাগলের মত কেঁদেছিলেন এবং নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। এই সময়ে মলকা গওহরকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন বাইজিদের জীবনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত সঙ্গী, হৃদয়ের ক্ষত স্থানের একমাত্র ওষুধ, সঙ্গীত।                                                                                                                                    ক্রমশঃ…….

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments