জ্বলদর্চি

অশোক মহান্তীর কবিতা : জীবন ভাঙা পথে ঈশ্বরের গান-৬ /দিলীপ মহান্তী

অশোক মহান্তীর কবিতা : জীবন ভাঙা পথে ঈশ্বরের গান

পর্ব-৬

দিলীপ মহান্তী

অশোক মহান্তীর কবিতায় প্রথমেই যে বিষয়টি আমাদের চোখ টেনে নেয় তা হলো তাঁর শব্দ ব্যবহারের মুন্সীয়ানা। শব্দের ওজন বুঝে তাকে সঠিক ভাবে ব্যবহার করতে তিনি সিদ্ধহস্ত। অনেক বড় মাপের শব্দশিল্পী ছিলেন । তার প্রমাণ পংক্তিতে পংক্তিতে ফুটে ওঠে। তিনি অতল নিমগ্ন হয়ে শব্দের প্রতি বিশ্বস্ততা রেখে, শব্দকে ভালোবেসে কবিতা লিখে গেলেন সারাজীবন। এত নিজের মতো করে ঘনিষ্ঠভাবে, শান্তভাবে, একটুও উত্তেজিত না হয়ে,  শিরদাঁড়া সোজা রেখে চারপাশের মানুষের কথা বলে গেলেন, যেসব মানুষরা অনেক ক্ষেত্রেই জটিল,  মেরুদন্ডহী্‌ন, ঈর্ষাপরায়ণ।  এও যেন প্রত্যেকটি মানুষকে একরকমভাবে ছুঁয়ে থাকা, আদর দিয়ে জড়িয়ে থাকা, ভালো রাখতে চাওয়ার ইচ্ছার দিনলিপি। তাই তিনি কবিতায় সবসময় সত্যকথা বলেছেন। নিজস্ব সত্যের জোরে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর কবিতা। সেইসঙ্গে তাঁর কবিতায় রয়েছে প্রখর সমাজ সচেতনতাও, এক গভীর কর্তব্য বোধ আছে। সামাজিক দায় নিয়ে তিনি লিখে যাচ্ছেন একটার পর একটা কবিতা। চারপাশের জীবিকার সন্ধানে হেঁটে চলা মানুষের, জ্বলন্ত মানুষের, বয়ে চলা মানুষের, ছুটে চলা মানুষের,  ভেসে যাওয়া মানুষের, স্বার্থপর মানুষের, ক্ষুধার্ত মানুষের তিনি এক আশ্চর্য দর্শক ও ভাষ্যকার:

'দেখা হয়।
তারপরই দুপুরের কর্মব্যস্ততায় বাসগুলি ছুটে চলে
ছুটে চলে রিক্সা, টেম্পো ঠেলাগাড়ি ঝাড়গ্রাম শহর
দুপুরে পিচের পথে লালধুলো লেগে যায় গায়ে।

অণিমা আড়াল থেকে আর কী দেখেছে?
দেখেছে, সময় দ্রুত সরে যাচ্ছে, বাতাসে উত্তাপ আগুনের
দেখেছে,  কবিতা নয়, উদরান্নে ধুঁকে মরছে প্রতিটি মানুষ
দেখেছে,  ভিখিরি বেশ্যা অর্ধোন্মাদ,  চায়ের দোকানী, কর্মচারী
দেখেছে,  তার্কিক কবি সাহিত্যিক পলিসি হোল্ডার
দেখেছে,  পাশেই কেউ তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

সহসা ভিড়ের মধ্যে দেখা।
শুধু চোখে-চোখে দেখা, কথা হয় না, কথা বলা খুবই অসম্ভব
অথবা সম্ভব ছিল, আজ তার কোন প্রয়োজন নেই, এই বোধে
আমরা যে যার মতো হেঁটে চলে যাই।
রৌদ্র বাড়ে। পথে পথে ওড়ে লালধুলো।'
    (দেখা: দ্বিতীয় সঙ্কেত)

 একাকীত্ব, নির্জনতা, আচ্ছন্নতা, সন্দেহ গড্ডালিকা প্রবাহে মিশে যেতে না পারার যন্ত্রণা নিয়ে নীরব অভিমান ও পাহাড় প্রমাণ ভালোবাসা নিয়ে সবার সঙ্গে থেকেও পুড়তে থাকাই তাঁর কবিতার মনোভূমি। জ্বলতে জ্বলতে পুড়তে জানতেন। আজীবন সেই পুড়ে যাওয়া দগ্ধ হৃদয়ের ভাষ্য রচনা করেছেন। সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন সেই অঙ্গারের স্তূপ:

১.'মাথায় রেখেছি হাত পায়ে হৃৎপিণ্ডের অঞ্জলি।
    তুমি দেবী না রাক্ষসী কে গো, এত রাত্রে ঘুমে ডাক দাও?

    দু'পায়ে ফুটেছে কাঁটা পা ফেলিনি এখনো মাটিতে।

    আজ সারা-জীবনের যা কিছু হিসেব করে দেখি
    বহুবার ভুল হয়েছিলো।
    ঈশ্বর বিশ্বাসে ভুল, খ্যাতি ও সীমায় ভুল
    পরিমিতিবোধে খুব ভুল।

    যার কোনো শেষ নেই সে যদি সময় হয়, তবে
    জীবনকে ভালোবেসে সেও এক ভুল হয়ে গেছে।

     আজ নিজেকে জড়াতে চাই।
    যা-কিছু বিস্তীর্ণ ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও অবমাননায়
    ভেতরে ভেতরে ক্ষয়, তার নীচে এ আমার অবিস্মরণীয় কোনো
    কবিতার পংক্তি কিম্বা প্রেম

   এ আমার ভালোবাসা, একান্ত মানুষ যা পারে।

   আর কিছু শিখিনি কখনো।
   ভালোবাসা ছাড়া আমি আর কিছু শিখিনি কখনো
           (প্রমিতি:অতিবর্তী জাগো)

২. 'শুধুই কবিতা নিয়ে কত হইচই হলো দীর্ঘদিন।
     স্নানঘর, আরও স্নানঘর, আরও আকাশ পেরিয়ে দূরে দূরে
     মৃতস্বজনের সঙ্গে দেখা হলো, কল্পনায়, অস্থায়ী আবেগে।

     এদিকে যে পুড়ে গ্যাছে মাঠ তার খেয়ালই ছিলনা এতদিন।
     তুমি কত ন্যুব্জ হয়ে গ্যাছো।
     তোমার শিশু কি দ্রুত বেড়ে উঠবে?
     গাছহীন আকাশে আকাশে রুক্ষ মাটিতে ধুলায় শুধু বিষ
     অন্নের দাসত্ব। ক্ষোভ।
     আকাশ উজ্জ্বল হবে আরো?

     জীবনকে কুরে খাচ্ছে অসতর্ক ক্ষুধার বিস্তার।
           (মরু: দ্বিতীয় সঙ্কেত)

দুচোখের সামনে প্রস্ফুটিত জগৎকে, পথে পথে ছড়ানো রোদ্দুর ও আকাশকে,  মানুষকে তিনি তুলে আনছেন কিছু বিশ্বাসী শব্দের দ্বারা। অনুভূতির ব্যঞ্জনায়। সেইসব পরিচিত শব্দরা শুধু কালির অক্ষরে আটকে থাকে না, তাকে নিজের মতো করে অনুভব করেন পাঠক। ব্যক্তি অনুভবের সেই বিচ্ছুরণে আলোকিত হন পাঠক, আলোকিত হন কবিও। এক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শব্দ। একেবারে সোজাসুজি ভাষায় কথা বলেন। তৈরি করেন কিছু অলৌকিক বাকপ্রতিমা। আর এভাবেই বাংলা কবিতার ধারা পথে তিনি নির্মাণ করেছেন এক নিজস্ব বাকশৈলী। নিজস্ব পথ। এই তাঁর অহংকার। তাঁর কবিতার শরীরে  লেপ্টে থাকা অজস্র আমির উত্তর। এই নিজস্ব উচ্চারণে তিনি মুগ্ধ করেছেন প্রকৃত কবিতা পাঠককে। উচ্চারণে বা পথে বাঁকবদল হয়েছে বারবার।  তিনি স্বয়ং বদলে  নিয়েছেন। তিনি যাত্রী হিসেবে এক আলোকতীর্থে পৌঁছাতে চেয়েছেন। সেখানে হয়তো তাঁর দ্বিধা দ্বন্দ্বে জড়ানো ভাঙা চোরা মনের সঙ্গে , চির অতৃপ্ত চির ব্যথাদীর্ণ রূপের সঙ্গে, চির অভিসারী হৃদয় পথে আমরাও সঙ্গী হই। আর এভাবেই তাঁর জ্বলন্ত রক্তাক্ত ক্ষত-বিক্ষত অতীত আমাদের ভয়ংকর বর্তমানে এসে হাজির হয়।:
 ১.

                           (১২)
    'দর্পণে কাদের মুখ আঁকা ছিলো? গঙ্গা থেকে নর্মদা কাবেরী
    সমস্ত ভারতবর্ষ ঘুরে দেখি, সে কোথাও নেই। সমগ্ৰ অতীত শুধু
     ফেনপুঞ্জে ভরে আছে আর সারা ভবিষ‍্যময় অন্ধকার, যা ছিল তা
     থাকে না কখনো। কার মুখ ভেসে উঠছে রোদে? আমাকে দেখাও আজ।
     মুক্ত করো। মুক্ত যে রকম ওই নিবিড় আকাশ কিম্বা দিগন্ত পরিধি।
     মুক্ত করো বায়ু। নক্ষত্রের আলো। আর প্রতিটি শিশুর মনে
     যেরকম স্বপ্নেরা স্বাধীন।
                               (১৩)
    বেলা বারোটার পর একথা ভাবার আর অবকাশ নেই।
    ইতিমধ্যে আভা আসে, ক্লান্তি  ও নির্ঘুম আসে, ফিরে আসে অন্নকর্ম, মায়া।
    রঞ্জনা আজও আসবে। দেহে ক্লান্তি, মুখে ছাপ, শ্লথ-পায়ে শিথিল শরীর
    আমিও দশটায় ফিরবো। রাত দশটা। খাওয়া-দাওয়া হবে
     চারদিকে দেওয়াল সেই,  বইপত্র, বিছানা-বালিশ,  কিছু চূর্ণ ভালোবাসা, ঘুম।
    প্রতিদিন এ-কেমন ফেরা? যেখানে নিশ্চিন্তি নেই
    প্রেম নেই,  সরলতা নেই,  কবি কি সেখানে যাবে?
   কবি কি মানুষ?
            (দিনলিপি:আলোক শিশির)

২. খইয়ের ফুল-ছড়ানো পথে
        অন‍্যের কাঁধের উপর শুয়ে
          লোকটা চিরজন্মের মত চলে যাচ্ছে।

     বেঁচে থাকতে কেউ কোনদিন
       ওকে জিগ‍্যেস করেনি
          'ভালো আছো তো?'

     বর্ষার অভিক্ষার দিনগুলিতেও 
        একমুঠো ভাত কেউ এগিয়ে দেয়নি
            ওর মুখের সামনে।

   এখন, মরে গিয়ে দূষণ ছড়াচ্ছে বলেই 
       তৎপর হয়ে উঠেছে সমাজ
          তৎপর হয়ে উঠেছে প্রশাসন

    তাহলে, এই পুড়ে-যাওয়া টুকুর জন‍্যই কী
         লোকটা এতদিন
        সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করত?
         (সমাজবদ্ধ:৪৮বছরের স্বীকারোক্তি)

     ব্যক্তিগত জ্বালাযন্ত্রণার ক্ষত-বিক্ষত হৃদয় নিয়ে বাইরের পৃথিবী থেকে তিনি চোখ ফেরাতেই পারেন না, চারপাশের দহন তাঁকে পোড়ায়, যাবতীয় অসঙ্গতি ও অবিচারের বিরুদ্ধে তিনি কথা বলেন, মানুষের দৈন্যদশা,কর্মহীনতা, শ্রমজীবী মানুষের বেঁচে থাকার সমস্যা,ধর্ম নিয়ে ভেদাভেদ, হিংসা ,যুদ্ধের সর্বনাশা আগুন, সেইসঙ্গে কবিতা নিয়ে রাজনীতি, প্রান্তিক মানুষের ব্যথা এই সমস্ত নিয়ে নীরব অভিমানী হৃদয়ে তিনি শব্দের পর শব্দ গেঁথে মন্ত্র উচ্চারণে অনুভবকে ছড়িয়ে দেন। স্থির থাকেন শব্দের পবিত্রতায়।

    সহজ সরল সাবলীল কথ্য  একটি ভঙ্গি তিনি আয়ত্ত করেছিলেন, যেটা প্রায় ক্ষেত্রেই অতি সরল ভাবলে ভুল হতে পারে। কবিতার শেষ পর্যন্ত এগিয়ে গেলে বাঁক নিতে পারে অনেকটা আর জ্বলে উঠতে পারে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে। তখন আগের বিবৃতিতে পাঠক হৃদয়ে ধাক্কা লাগতে পারে। এটা তাঁর কবিতার রূপ ও রীতির একটা কৌশল। বা একটা স্থির জায়গায় পৌঁছানোর সুপরিকল্পিত অবলম্বন।
সেইসঙ্গে চলতি প্রসঙ্গ ,সহজ সরল ঋজু উচ্চারণ, স্পষ্ট ভাষণও তাঁর কবিতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। মাঝে মাঝে তির্যক বাকভঙ্গিও তিনি নিপুণ ভাবে ব্যবহার করেছেন। সেইসব কবিতাও আশ্চর্য শিল্পসিদ্ধি পেয়েছে। যেমন 'যাত্রী' কবিতার সহজ সরল ভাষার মধ্যে নিহিত আছে গভীর ব্যঞ্জনা ও দার্শনিক প্রত্যয়:

 ' আমরা গান গাইছি, আর গান গাইতে গাইতে গলা ভারি হয়ে আসছে আমাদের।
এক গ্রীষ্ম থেকে আরেক গ্রীষ্মের দিকে তাঁবু উঠিয়েছিল যত মানুষ
এই বর্ষায়, বর্ষার অন্ধকার রাত্রিতেই তাদের কেউ কেউ
ক্লান্ত অকষ্টবন্ধ হয়ে সেই যে ঘুমিয়ে পড়লো, তাদের সাড়া মিলল না কোথাও

এদের অনেকেই আকাঙ্ক্ষিত রাস্তা পার হওয়ার আগেই কাঁটা ঝোপে পা ডুবিয়ে
রক্তস্নান করেছে, কেউ বা নিজেকেই অমূল্য ভাবতে ভাবতে সাফল্যের দোরগোড়ায়
চিৎকার করে ডেকেছে 'দরজাটা আর একটু হাট করে খুলে দাও'।

দরজা খুলে গেছে যতবার ততবারই অবাধ্য হাওয়ায় ভেঙে পড়েছে পাতা সমেত গাছ
গাছের সঙ্গে শেকড়, শেকড়ের সঙ্গে মাটি, আর মাটির মধ্যে শেকড়ভরা জল
 শুধু তোরণটুকু পার হতে বাকি, হুড়মুড় করে আকাশ হামলে পড়েছে মাথায়।
মাথা বাঁচাতে বাঁচাতেই গাছের ছায়া, আকাশের মেঘ, নক্ষত্রের আলো
সব পার হয়ে তারা ছুটে চলেছে অনন্ত অসীম আরো অন্ধকারের দিকে
আরো নিঃসংশয় ছায়ার দিকেই হয়তো-বা।

আর যারা গান থামায়নি, তারা একবার অন্ধ-আকাশের দিকে তাকিয়ে
সমুদ্রভরা জল, আর শস্যময় মাঠের দিকে তাকিয়ে শুধু একবারই
মনে মনে বলে উঠেছিল...এই বর্ষার পর আবার শীত আসবে...
আবার গ্রীষ্ম আসবে...আর বদলে বদলে যেতে থাকবে গান
এক কন্ঠ থেকে আরেক কন্ঠের দিকে গান।
          (যাত্রী: মাটির মন)

 মহৎ সাহিত্যিকরা চিরকালই প্রচলিত প্রথা ও রীতি নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। অশোক মহান্তীর কবিতাতেও বার বার এই বিদ্রোহের কথা বলিষ্ঠ ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে। এজন্য সমকালের অসঙ্গতি ও অসাম্যের গান তাঁর বহু কবিতার বিষয়।  তিনি জানেন একদিন এর পালাবদল ঘটবে। অজস্র ধ্বংসের পথ,  ক্লান্তির প্‌থ, বঞ্চনার ও অমানবিকতার পথ  সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পার হয়ে এক নতুন সূর্যের ভোর আসবে। ‘যাত্রী’ কবিতায় সেই আশাবাদ ভাষা পেয়েছে। এটি শুধু একটি উৎকৃষ্ট কবিতাই নয়, এই কবিতার মাধ্যমে অশোক মহান্তীর কবি বৈশিষ্ট্য জানা যায় এবং কবিত্ব শক্তিরও অগ্নিপরীক্ষা হয়ে যায়।
     এই কবিতায় এক ধরণের বৃক্ষবন্দনা বা  প্রশস্তি আছে। এর সঙ্গে মিশে আছে পৃথিবী বন্দনাও। এই প্রশস্তি ভারতীয় সাহিত্যে প্রায় তিন হাজার বছর ধরে চলে আসছে। আমি বলতে চাইছি বৈদিক সাহিত্যের কথা। ঋগ্ বেদে এই অরণ্য অর্থাৎ বৃক্ষের প্রশস্তি আছে। ভারতের মানুষ অরণ্য অর্থাৎ বৃক্ষকে চিরকাল ভালোবেসে এসেছে। এই ভালোবাসার নিদর্শন যেমন বেদ-সংহিতায় পাওয়া যায় তেমনি রামায়ণ ও মহাভারতেও আছে। অথর্ব বেদের ভূমি-সূক্ত বা পৃথিবী-সূক্ততে পৃথিবীর প্রতি মুগ্ধ ভালোবাসার নদী কানায় কানায় ভরপুর।
    এই কবিতায় পৃথিবীর শস্যশালিনী রূপের বন্দনা্ করা হয়েছে। পৃথিবীর ঋতুপরিক্রমার মাধ্যমে অনেক পথ পরিক্রমার, বৃষ্টি প্রার্থনা ও সূর্যবন্দনার মাধ্যমে সেই উর্বরতার দেশে পৌঁছানো যায়। সেই পথের কষ্ট উঠে এসেছে কবিতায়। না পাওয়ার ব্যর্থতাও আছে। পুরাণ ভেঙে ভেঙে কবিতা এগিয়ে গেছে। প্রকাশিত হয়েছে মানুষের প্রতি ভালোবাসার কথা। কবিতায় ছায়া ফেলেছে মার্কসীয় তত্ত্বও।
   কোনো সময়ের বিশিষ্ট বৈশিষট্যগুলি সাহিত্যে বাস্তবসম্মত রূপায়ণের ওপর মার্কস ও এঙ্গেলস জোর দিয়েছিলেন। তাঁরা মনে করতেন শুধু বর্ণনার যথার্থতা বজায় রাখাই নয়, বর্ণনীয় বিষয়ের প্রতি লেখকের ঐতিহাসিক শোভনদৃষ্টি থাকা প্রয়োজন। ইতিহাস যেমন প্রতিনিয়ত বিবর্তিত হচ্ছে মানবজীবন এবং সাহিত্যও অনুরূপ। দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই ইতিহাস এগিয়ে চলে। নবীন ও প্রাচীন প্রথার দ্বন্দ্ব এবং সেই দ্বন্দ্বের অবসানে নবীনের প্রতিষ্ঠা।
   আলোচ্য কবিতায় দেখি  এক গ্রীষ্ম থেকে  আর এক গ্রীষ্মের দিকে তাঁবু উঠিয়ে নেওয়ার অপেক্ষা শুধু। অনন্ত যাত্রার সামিল হয়েছে যুগ যুগ ব্যাপী যে মানুষের দল, তারা শুধু একে অন্যের হাতে মশাল ধরিয়ে দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার বার্তা দিয়েছে। অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাওয়ার কথা বলেছে। এক কন্ঠ থেকে আরেক কন্ঠে পৌঁছে গেছে গান। জীর্ণ পুরনো থেকে নবীনের কন্ঠে ভর করে এগিয়ে যাচ্ছে গান। এগিয়ে যাচ্ছে স্বপ্ন। 

   আজ হয়তো সামনে কাঁটা-ঝোপ, সামনেই মুখ থুবড়ে পড়েছে হয়তো, হাওয়ায় ভেঙে পড়ছে পাতাসমেত গাছ, গাছের সঙ্গে শেকড়,  শেকড়ের সঙ্গে মাটি, মাটির মধ্যে শেকড়ভরা জল। তবুও মাথাভাঙার সমস্ত আয়োজনের উর্ধ্বেও,  আকাশ ভেঙে পড়ার সমস্ত আক্রমণের বিরুদ্ধেও সমস্ত প্রতিকূলতা, সমস্ত বাধাকে অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছে অনন্ত মানবমিছিল। মশাল হাতে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। আর, এক কন্ঠ থেকে আর এক কন্ঠে এগিয়ে দিচ্ছে জীবনের গান। এই তার যাত্রা।এই তার যাত্রা পথের আনন্দগান। এই তার শিল্পকর্ম। আর সে যাত্রী।
   সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদীদের চোখে দেখা পৃথিবীর সঙ্গেও এই কবিতার বক্তব্য মিলে যায়। গোর্কি বলেছিলেনঃ সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদের লক্ষ্য হচ্ছে প্রাচীন পৃথিবীর টিকে থাকার ও তার ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টার বিরু্দ্ধে সংগ্রাম করা এবং সেই প্রভাবকে সমূলে উৎপাটিত করা।
      ভবিষ্যতের শুভ সম্ভাবনার জন্য প্রসূত আশা যা কিনা সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘পদাতিক’ কাব্যের ‘মে দিনের কবিতা’টিঃ
          চিমনির মুখে শোনো সাইরেন-শঙ্খ,
          গান গায় হাতুড়ি ও কাস্তে,
          তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্য
          জীবনকে চায় ভালোবাসতে। 
এই আশাবাদই মূল। অসংখ্য জীবনের জীবনকে ভালোবাসতে চাওয়ার আশা। ‘যাত্রী’ কবিতাতেও এই আশার কথাই আছে। এবং সেই আশা ধ্বনিত হয়েছে পুরাণ ও ইতিহাস মন্থন করে আশা এক নাবিকের কন্ঠে। যাবতীয় শোষণ, বঞ্চনা, অসা্ম্য, অন্ধকার, অনুর্বরতা, পেরিয়ে যেখানে ফুটে উঠবে আলোর গান। উর্বরতার গান। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো আমরাও দেখতে পাচ্ছিঃ নতুন পৃথিবী, অজস্র মু্‌খ, সীমাহীন ভালোবাসা।
                      (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments