জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে--১৬/ রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান
পর্ব  ১৬ 

নিজের গ্রামে, নিজেদের বাড়িতে (বুঝে উঠতে পারছিলাম না, কোন বাড়িটা নিজের?নাকি একটাও নয়?) ফিরে স্কুল যাওয়া শুরু করলাম। এই ক’মাসে জীবনটা ওলটপালট হয়ে গেছে।পড়াতে মন বসাতে পারছি না। কিন্তু স্কুল ফ্যাইনাল পাশ তো করতেই হবে। চেষ্টা করছি পড়ায় মনোনিবেশ করার। উনি প্রায় প্রত্যেক মাসেই আসেন। বিকেলে আমরা জঙ্গলে কিম্বা নদীর ধারে বেড়াতে যায়, জলের স্রোতের দিকে তাকিয়ে নানারকম গল্প করি। ভবিষ্যতের নানান পরিকল্পনা করি। উনি এরই মাঝে মাঝে চিঠি লিখে সতর্ক করেন, পাপুকে(ছোটভাই) নিয়ে সারাক্ষণ  ব্যস্ত থেকোনা, মন দিয়ে পড়াশোনা করব। হ্যাঁ, এই ভাইকে কোলেপিঠে করে আমিই বড় করে ছিলাম, তাকে খাওয়ানো, ন্যাপি পরিষ্কার করা, ঘুম পাড়ানো, ওষুধ খাওয়ানো, কোলে নিয়ে বেড়ানো, সবিই আমি করতাম। যে কারণে লম্বা ছুটির দিনগুলোতে যখন শ্বশুরবাড়ি এসে থাকতাম, তখন ছোট ভাইটির জন্য ভীষণ মন খারাপ হত।
    এদিকে পাকিস্তানে মুক্তিযুদ্ধ চলছেই। একদিন খবরে শুনলাম রোশেনারা নামে  এক তরুণী বুকে মাইন বেঁধে  খান সেনাদের ট্যাঙ্কের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। নিজের নামের সঙ্গে মিল থাকায় মনে মনে খুব গর্ব অনুভব  করেছিলাম।  আমার ছোটকাকা তখন কুষ্টিয়ার সাব জজ ছিলেন। কুষ্টিয়ার সরকারি বাসভবনে প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা ছোটকাকা ও সেইসময়ের আওয়ামী লিগের এমপি জনাব আজিজুর রহমান আক্কাস যৌথভাবে উড়িয়ে ছিলেন। কুষ্টিয়াতে মুক্তিযোদ্ধারা ৪০০ জন খানসেনাকে মেরে ফেলেন। তারপর আরও খান সেনারা আসতে থাকে। ছোটকাকা তখন সবাইকে নিয়ে কুষ্টিয়ার মহকুমা মেহেরপুর চলে আসেন। পাক সেনারা মেহেরপুর রওনা দিলে ১৮ মার্চ কাকারা সবাই হৃদয়পুর সীমান্ত দিয়ে ভারতে, মানে পশ্চিমবাংলায় প্রবেশ করেন। যুদ্ধের পুরো সময়টা কাকা সপরিবারে পশ্চিমবাংলাতেই ছিলেন। এইসময় ছোটকাকা প্রবাসী সরকারের ‘জোনাল অ্যাডমিনিসট্রেটিভ অফিসার’ হিসেবে সারা পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থী শিবিরের দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন। কাকার অফিস ছিল বারাসতে, থাকতেন নারকেল ডাঙ্গার সেই আড়তে। বড় ও মেজ, বাবলুদা, রমুদা থাকত ওদের দিদিমার কাছে কৃষ্ণপুরে। আর ছোট কাকিমা ছোট দুই ছেলেকে নিয়ে থাকতেন মেদিনীপুরে বড়দির বাড়িতে, মানে আমার সেজকাকিমার কাছে। এই মাসগুলো ছেলেদের নিয়ে কাকা কাকিমার খুব কষ্টে কেটেছিল। ওখানে বড় পোস্টে ছিলেন, অনেক টাকা মাইনে পেতেন। আর এই সময়ের দিনগুলো কীভাবে কাটিয়ে ছিলেন, তা যারা ভুক্তভোগী তারায় জানেন।
    ছোটকাকা ‘ই পি সি এস’ পরীক্ষার মাধ্যমে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে প্রবেশ করে ছিলেন। তিনি ব্যক্তি জীবনে অতন্ত্য সত, বিনয়ী ও কর্মে উৎসাহী ছিলেন। পাকিস্তান রেডিওর ‘এ’ গ্রেডের রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ছিলেন। কিন্তু  কোনদিনও নামাজ, রোজা বন্ধ করেননি। পাক সেনাদের ছোঁড়া রকেটে কাকার বাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। তার আগে ওরা সমস্ত লুট করে নিয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার অপরাধে পাকিস্তান সরকার কাকার যাবতজীবন কারাদণ্ডের এবং সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছিল। রাজশাহীতে কাকার একটা বাড়ি ছিল। পাক আর্মিরা সেই বাড়িতে আগুন লাগাতে এসে দ্যাখে, ওই বাড়িতে একটি ‘সমাজ কল্যাণ’ দপ্তর আছে।
      এদেশে থাকা কালে ছোটকাকা দুবার গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন। একবার ছোটছেলে রাজুকে নিয়ে, আর একবার দুর্গাপুজোর সময় সেজছেলে নীলকে সঙ্গে নিয়ে। সেইসময় বড়দির শাশুড়িমা মারা যান। মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে বড়দির মেজ দেওর ও জুনুদি (সেজ কাকার বড়মেয়ে বড়দির মেজ জা জুনুদি) এসে  দেখলেন নদীতে বন্যা, জুনুদির পক্ষে জাওয়া অসম্ভব।হুসেন জামাইবাবু জুনুদিকে আমাদের বাড়িতে রেখে একাই ভেদুয়া, মানে নিজেদের বাড়ি গেলেন। খান সাহেবও  এসেছিলেন, পুজো কয়দিন কেটে গেলেই আমাকে ওনাদের বাড়ি নিয়ে যাবেন। অষ্টমীর দিন থেকে আরও বৃষ্টি বাড়তে লাগল। বৃষ্টি থামার পর একাদশীর দিন গরুরগাড়ি ভাড়া করে, তাতে চড়ে ছোটকাকা আমি জুনুদি, নীল খান সাহেব গড়বেতা রওনা হলাম। বড়দা ও আরও কে কে যেন সাইকেলে আমাদের সঙ্গে  চলল।মাঝ রাস্তায় একটা চাতাল ভেঙ্গে গ্যাছে, গরুরগাড়ি যেতে পারবেনা। গড়বেতার দিক থেকে আসা দুটি রিক্সাও সাওয়ারি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পার হতে পাচ্ছে না। অগত্যা কোনো রকমে চাতাল পার হয়ে সাওয়ারি বদল করে সেই দুটি রিক্সা আমাদের নিয়ে গড়বেতা রওনা দিল। বাস খুব কম চলছে, ট্যাক্সি ভাড়া করে আমরা মেদিনীপুর পৌঁছে ছোটকাকা, জুনুদিরা মিয়াবাজারে সেজকাকার বাড়ি গেলেন। খান সাহেব আর একটি ট্যাক্সি ভাড়া করলেন আমাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য।তখন মেদিনীপুর থেকে আমার শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার(১২ মাইল) ট্যাক্সি ভাড়া ছিল ১০ টাকা।
    তখন মেজমাসির তালাক হয়নি। অন্যান্য আত্মীয়দের সঙ্গে মাসির যোগাযোগ ছিল। কেন মামাবাড়ি গেছলাম মনে নেই। সেইসময় আমাকে সাথে নিয়ে মেজমাসি পাঠান মহল্লায় এক এক আত্মীয়ের বাড়ি গেছলেন। তাঁদের বাড়ির মেয়েও পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছেন।তারপর থেকে নাকি কেঁদেই চলেছেন। আমিও দেখলাম, ভদ্রমহিলা মেঝেতে শুয়ে কাঁদছেন। তাঁর ঘরবাড়ি, সমস্ত জিনিস, পাকসেনারা জ্বালিয়ে দিয়েছে।
    ছোটকাকা দেশ ছাড়ার সময় শুধুমাত্র রাজশাহীর বাড়ির দলিল আর কাকিমার গহনাগুলি সঙ্গে নিতে পেরেছিলেন।  দীর্ঘ ন’মাস যুদ্ধের পর পাক সেনারা আত্মসমর্পণ করে। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। যদিও বাংলাদেশে স্বাধীনতা দিবস পালিত হয় ২৬ মার্চ। এর কারণ ২৬ মার্চ রাত ১.৩০ মিনিটে খান সেনারা শেখ মুজিবর রহমানকে গ্রেফতার করে, তার কিছুক্ষণ আগেই শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। আর সেদিন থেকেই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। শেষ হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর। মুজিবর রহমান কারাগার মুক্তি পান ১৯৭২ এর ১০ জানুয়ারি। ১২ জানুয়ারি তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যে ভাষণ দেন, তা রেডিওতে রিলে করার জন্য কলকাতা থেকে সংবাদ পাঠক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় গিয়েছিলেন।তাঁর বর্ণনা ও কণ্ঠস্বর আজও কানে বাজে।এভাবেই পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ স্থান করে নেয়। এরপর শুরু হয় শরণার্থীদের আপনদেশে আপনঘরে ফেরার পালা।  ছোটকাকারা মুক্তি যোদ্ধাদের গাড়িতে করে দেশে ফিরেছিলেন ১৯৭২ এর ১ জানুয়ারি। ২১ বছর ধরে সাজানো সংসারের কিছুই ছিল না। ছিল ভাঙাচোরা বাড়ির খাঁচাখানি।
     
 
      খান সাহেব ১৯৭৭ সালে ডব্লিউ বি সি এস অফিসার হিসেবে প্রথম পোস্টিং পেয়েছিলেন পশ্চিম দিনাজপুরের সদর শহর বালুরঘাটে। ১৯৭৯ সালে আমাদের বালুরঘাট নিয়ে যান। এই শহরে তখন কোনো মুসলিম দের বাস ছিলনা। তবে বাড়ি ছিল, যেগুলি হয় বিনিময় করে বা বিতাড়িত হয়ে বাড়ির মালিক সপরিবারে ওপারে চলে গেছেন। তাঁরা কিছুতেই মুসলিমদের বাড়িভাড়া দিতে রাজি নন। খান সাহেব খাদিমপুরে একটি বাড়িভাড়া নিয়েছিলেন, বাড়িটাতে অনেক  অসুবিধা থাকায় পদমর্যাদার প্রভাব খাটিয়ে সাহেব কাছারির একটি বাড়িতে উঠে যাই। এই বাড়িটাও খুব একটা ভালো নয়, যদিও বাড়ির মালিকের নাম ছিল ভালবাসা বোস। তবে পাড়ার মানুষজন খুব ভাল ছিলেন। আমাকে, আমার ছেলেমেয়েকে খুব ভালবাসতেন, স্নেহ করতেন।                                     
    ১৯৭৯ সালেও এখানকার মানুষের মনে ৭১ এর মুক্তি যুদ্ধের স্মৃতি অমলিন ছিল।  সেইসময়ের কিছু টুকরো টুকরো ঘটনা শুনে শিহরিত হয়েছিলাম। শহরের বিভিন্ন জায়গায় রিফিউজিদের ক্যাম্প হয়েছিল।আমাদের পাশেই ছন্দাদিরা ভাড়া থাক্তেন।তিনিই একদিন বলছিলেন, জানো বেবি, রোজ সকালে দেখতাম লুঙ্গিপরা ছেলেগুলো বন্দুক কাঁধে যুদ্ধে যাচ্ছে, পরদিন আর তাদের দেখতে পেতাম না, সেদিন নতুন ছেলেরা যাচ্ছে। ক্যাম্পে ছেলের মৃতদেহ শোয়ানো আছে, মা ইট পেতে ভাত রান্না করছে। পাকসেনারা যখন একের পর এক বাড়িতে আগুন ধরাচ্ছে, তখন এক ভীত সন্ত্রস্ত মা দোলনা থেকে বাচ্চাকে তুলে নিয়ে বাঁচার জন্য দৌড়ে কিছুদুর যাওয়ার পর খেয়াল করেন তিনি বাচ্চা নয়, বালিশ তুলে নিয়ে এসেছেন। পিছন ফিরে তাকিয়ে দ্যাখেন, তাদের বাড়িখানা দাউ দাউ করে জ্বলছে।

                                            ক্রমশ

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments