জ্বলদর্চি

চিরকুটে রাশিয়া : ট্রেন / বিজন সাহা

চিরকুটে রাশিয়া 

ট্রেন / বিজন সাহা 


ট্রেনের প্রতি আমার বরাবরই এক ধরণের দুর্বলতা আছে। আমাদের এলাকায় ট্রেন নেই। প্রথম ট্রেনের সাথে পরিচয় ছবিতে। পরে মির্জাপুর মামা বাড়ি যেতে রাস্তায় ট্রেন দেখি। প্রথম ট্রেনে চড়ি ১৯৬৯ সালে কোলকাতা বেড়াতে গেলে। সেটা ছিল বনগাঁ থেকে শিয়ালদা। তারপর বোকারো, হিন্দ মোটর, গুপ্তিপাড়া, বহরমপুর – অনেক জায়গায়ই ট্রেনে যাতায়াত দাদা, দাদু, মামা, মাসীদের ওখানে। সব সময়ই মনে পশ্ন জাগত ট্রেন কীভাবে ঘোরায়। এমনকি এখনও মনে মনে ট্রেন ঘুরছে সেটা কল্পনা করে শিহরিত হই। সোভিয়েত ইউনিয়নে এসে ট্রেনের সাথে নতুন করে বন্ধুত্ব হয়। ট্রেন মানেই লম্বা জার্নি। অনেক অনেক বন্ধু বান্ধব। কয়েকদিন ব্যাপি বাংলাদেশী ছাত্রছাত্রীদের মিলন মেলা। এমনকি এখনও বাড়ির পাশ দিয়ে যখন ট্রেন যায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি। কী এক শিশুসুলভ আনন্দ পেয়ে বসে আমাকে। আজ সেই ট্রেন নিয়েই কিছু গল্প করব জীবনের পাতা থেকে। 

  ১৯৬৯ সাল। প্রথম বারের মত গেলাম ইন্ডিয়া। কিছুদিন বেহালায় দাদাদের ওখানে থেকে গেলাম দাদু বাড়ি – কোতরং। সেখান থেকে যাব পুরী। দাদুর বাসার ভাড়া থাকতেন রাম মামা। খুব আদর করতেন আমাকে। আমার তখন সবে ৫ বছর চলছে। ঠিক হল দুপুরের ট্রেনে আমরা পুরী যাব। রাম মামা দোকান থেকে এসে আমাকে কোলে করে নিয়ে যাবেন হিন্দমোটর স্টেশনে। কোন কারণে মামা আসতে পারেননি। আমিও যাব না। কী করা? দাদু একটু বকাবকি করলেও শেষ পর্যন্ত হার মানলেন। আমরা রওনা হলাম পরের ট্রেনে। রাস্তায় এক জায়গায় ব্ল্যাক আউট। যে ট্রেনে আমাদের যাবার কথা ছিল সেটার কয়েকটা বগি উল্টে গেছে। অনেক হতাহত। ঐ ট্রেনে আমরা থাকলে হতাহতের মধ্য থাকতাম কিনা জানি না, তবে সবাই বলছিল আমার জন্য বড় বাঁচা বেঁচে গেছে। সেই সময়ে ট্রেনগুলি চলত কয়লায়। মনে আছে ১৯৭২ সালে যখন গয়া আর কাশী যাই, যখন কয়লায় চোখমুখ কালো হয়ে যেত। প্রথম কিছুটা সময় সে সব জার্নি আনন্দের হলেও পরে বিরক্তিকর লাগত। তখন প্রায়ই ইছু লোকজন এসে আমাদের সীটের নীচে ব্যাগ ভর্তি চাল রেখে যেত। পরে শুনেছি তখন ভারতে খাদ্য ঘাটতি ছিল বলে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে চাল গম ইত্যাদির চোরাচালান হত। 

  ১৯৮৩ সালে মস্কো আসার পর প্রথম লম্বা জার্নি ছিল মিনস্কে ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে। মস্কো থেকে জনা পঞ্চাশ বাংলাদেশি হৈ হুল্লোড় করতে করতে গেছিলাম ছাত্র সংগঠনের সম্মেলনে। তবে সে বছর সামারেই যাই  কাজাখস্তান নির্মাণ দলে কাজ করতে। সে ছিল সাড়ে তিন দিনের জার্নি। ঐ সময় বিদেশিরা সাধারণত বিশেষ কম্পারটমেন্টে গেলেও এবার আমরা গেছিলাম খোলা ট্রেনে। সেখানেই প্রথম পরিচয় সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিন্ন জগতের সাথে যখন কোন কোন স্টেশনে কেউ কেউ খোলামেলা ছবি বিক্রি করতে আসে। এরপর অবশ্য ট্রেনে প্রচুর জার্নি করেছি। গিয়েছি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন শহরে। তবে সে সবই ছিল আনন্দ উল্লাসে ভরা। বিশেষ করে খারকভ, লেনিনগ্রাদ, কিয়েভ, কিশিনেভ হয়ে ওদেসা – এসব জার্নি ভোলার মত নয়। এ সবই ছিল ছাত্র সংগঠনের সম্মেলনে যোগ দেবার জন্য। ফলে আমাদের ওয়াগনটা ছোটখাটো এক বাংলাদেশে পরিণত হত।   

  ১৯৮৯ সালে মাস্টার্স শেষ করে দেশে গেলাম বেড়াতে। তারপর কোলকাতা, দাদাদের সাথে দেখা করতে। এবার বাবা সাথে। এটাই বাবার সাথে আমার একমাত্র বড় জার্নি। এটা ছিল অন্ধ আর খোঁড়ার ভ্রমনের মত। বাবা  গত শতকের বিশ ও তিরিশের দশকে কোলকাতায় পড়াশুনা করেছেন। প্রতিটি রাস্তাঘাট তাঁর ভালো জানা। তবে আশি বছর বয়সে আগের সেই শক্তি আর নেই। এদিকে আমার তখন ২৫ চলছে। তবে জানি না কিছুই। তাই বাবা পথ দেখান, আমি তাঁকে নিয়ে যাই। কোলকাতা থেকে আমরা গেলাম বহরমপুর মাসি ও মামার সাথে দেখা করতে। সাথে বউদি। ফেরার পথে রানাঘাটে ট্রেন বদলাতে হল। বাবা ডায়াবেটিকসের রোগী। কিন্তু অনেক খুঁজেও ওয়াশ রুম না পেয়ে ফিরে এসেছেন। এসে দেখি কামড়ায় হৈচৈ। কী ব্যাপার? বউদি কেন পুরুষদের কামড়ায় উঠেছে। আসলে পুরুষ আর মহিলাদের আলাদা কামড়ার কথা অনেক দিন রাশিয়ায় থেকে ভুলেই গেছিলাম। যাহোক, ঠিক হল বউদি দাঁড়িয়ে যাবেন। তখন বাবা বললেন বাথরুমের কথা। তিনি সবে মাত্র ট্রেনের অন্য দিক থেকে নেমে বসেছেন, ট্রেন ছেড়ে দিল। উল্টো দিকের প্ল্যাটফর্ম থেকে লোকজন হায় হায় করে উঠল। আমি হাত বাড়িয়ে কীভাবে যে বাবাকে টেনে তুললাম নিজেই বলতে পারব না। তবে ট্রেনে আমার এ ধরণের ঘটনা এখানেই শেষ নয়। 

  ১৯৯০ সালে গেলাম তুরস্ক। তখন রাশিয়ায় প্রায় প্রত্যেকেই সিংগাপুর, তুরস্ক এসব দেশে গিয়ে কোন কিছু কিনে এনে এখানে বিক্রি করত। আমার ধার দেনা প্রচুর। বন্ধুদের কথায় তাই ইস্তাম্বুল যাওয়া। সে গল্প পরে এক সময় করব। বিভিন্ন কারণে মস্কো থেকে আমি একাই গেলাম, ট্রেনে দেখা কিছু নাইজেরিয়ান ছেলের সাথে। দীর্ঘ জার্নি। আমার কম্পারটমেন্টে এরা ছাড়া আরও ছিল জন নামে এক অস্ট্রেলিয়ান ভদ্রলোক। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। ও মস্কো বেড়াতে এসেছিলো। গল্পে গল্পে চললাম। ওর কাছেই প্রথম শুনি বাহাই ধর্ম আর বাহাউল্লাহর কথা। বেশ কিছু লিফলেট দিয়েছিল ও। পরে ২০১৪ সালে যখন দিল্লির লোটাস টেম্পলে যাই, জনের কথা মনে পড়েছিল। আমি এমনকি দু এক ঘন্টার কোন জার্নিতে গেলেও সাথে বই নিয়ে যাই। সেই যাত্রায় আমার সাথে ছিল বিভুতি ভূষণের রচনা সমগ্র। ঐ ট্রেনে চলতে চলতেই পড়েছিলাম অপুর কোলকাতা যাওয়ার কাহিনী। শুধু কি তাই, আপ ডাউনের ঐ কয় দিনে পুরো বইটাই শেষ করে ফেলেছিলাম। 

  ২০০৫ সাল। আগস্টের শেষ বা সেপ্টেম্বরের শুরু। মনিকার তখন ১১ বছর বয়েস। একা একাই অনেক জায়গায় যায়। একদিন বলল 
- পাপা, আমি অরিগামি শিখব। আজ ওদের একটা অনুষ্ঠান আছে। চল যাই। 

  ক্রিস্টিনার তখন ৭ আর সেভার আড়াই। ওদের নিয়ে রওনা হলাম। সাথে আনাতলি লিজা, ইউরা আর ভানিয়াকে নিয়ে। লিজা মনিকার সমবয়সী, বন্ধু। ইউরা সেভার চেয়ে বছর খানেকের বড়, ভানিয়া বছর খানেকের ছোট। সবাই হাঁটছি। সেভা আমার সাইকেল বসা। ঠিক রেল লাইনের কাছে এসে দেখি আনাতলি ভানিয়াকে নিয়ে বেশ পেছনে পড়ে গেছ। বাচ্চারা ওদের অপেক্ষা করছে। আমিও দাঁড়ালাম। তাকিয়ে আছি ওদের দিকে। হঠাৎ দেখি ট্রেন আসছে আর সেভা এর মধ্যে  সাইকেল থেকে নেমে ট্রেনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। মনিকা আর ক্রিস্টিনাকে বললাম চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে, কেননা ওকে ধরতে গেলে যদি দৌড়ুতে শুরু করে। সময় যেন থমেক গেছে। ট্রেন চলে যাচ্ছে, সেভাও একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে। তারপর একসময় নিজেই দাঁড়িয়ে পড়ল। ট্রেন যখন চলে গেল, এক মুখ হাসি নিয়ে দৌড়ে এসে আমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। জানি না, কত লম্বা ছিলও এই সময়টা। তবে স্মৃতিতে সারা জীবনের জন্যই দাগ কেটে গেছে। 

  এর কিছুদিন পরের কথা। আমরা সুইমিং পুলে যাই সাঁতার কাটতে। মনিকা, লিজা আর ক্রিস্টিনা। আমি যাই ওদের নিয়ে। একদিন যাচ্ছি। পথেই রেল লাইন, সাথেই হাইওয়ে। অর্থাৎ পর পর দুটো রাস্তা পার হতে হবে। শীত কাল। অন্ধকার হয়ে গেছে। আমি ওদের নিয়ে রাস্তা পার হতে গেলে হঠাৎ আলোতে চোখ ধাধিয়ে গেল। ভাবলাম গাড়ি আসছে। আমরা রেল লাইনের উপর দাঁড়িয়ে রইলাম গাড়ি চলে গেলে রাস্তা পার হব বলে। তখন তারস্বরে হুইসেল বেজে উঠল। বাঁদিকে তাকিয়ে দেখি ট্রেন আসছে। লাফাও বলেই তিন জনকে নিয়ে রাস্তায়  ঝাঁপিয়ে পড়লাম। হুইসেল দিতে দিতে ট্রেনটা বেরিয়ে গেল আমাদের পাশ দিয়ে। 

  ২০১৯ সালে অনেক দিন পরে পিটারসবারগ গেলাম একটা কনফারেন্সে। আমার আপ ডাউন টিকেট কেনা ছিল। মাঝ পথে আমার স্ত্রী এসে যোগ দিল আমার সাথে। কনফারেন্স শেষ একদিন সারাদিন ঘুরলাম আমরা বন্ধু পল্লবের সাথে। পিটারহফ, কন্দস্ত্রাত ইত্যাদি। সন্ধ্যার দিকে আমার স্ত্রীকে মস্কোর বাসে উঠিয়ে দিয়ে আমরা দুজন গেলাম কোথাও বসে আড্ডা দিতে। যখন ঘড়ির দিকে চোখ পড়ল, ট্রেন ছাড়তে মাত্র মিনিট কুড়ি বাকি। আমরা বেশ দূরে। পল্লব কিভাবে কিভাবে যেন আমাকে স্টেশনে নিয়ে এলো। কোন এক চোরা গলি দিয়ে কিভাবে যে ট্রেনের ওখানে চলে এলাম কিচ্ছু মনে নেই। ট্রেন অলরেডি ছেড়ে দেবে, ঠিক তখনই আমাকে দেখে হাত বাড়িয়ে তুলে নিলেন শেষ বগির ভদ্রমহিলা। আমাকে হাঁপাতে দেখে বললেন, একটু বসে তারপর যাও নিজের কম্পারটমেন্টের দিকে। 

  গত আগস্টে ভোলগায় যাচ্ছি সাঁতার কাটতে। রিল্যাক্স মুড। এখানেও পরপর রেললাইন আর হাইওয়ে ক্রস করতে হবে। এখন সামার। গাছ গাছালি দিয়ে সব ঢাকা। আনমনে রেল লাইন ক্রস করছি। হুইসেল। মাত্র মিটার কুড়ি দূরে ধেয়ে আসছে রেলগাড়ি। লাফিয়ে পার হয়ে গেলাম রেললাইন। ভাগ্যিস হাইওয়েতে কোন গাড়ি ছিল না। তবে ট্রেনটা যেভাবে চিৎকার করতে করতে চলে গেলে, মনে হয় খুব ভয় পেয়ে গেছিল।  

দুবনা, ২৮ এপ্রিল ২০২২

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments