গ্রামের শহুরে রূপকথা
পঞ্চদশ পর্ব : হৃদয়পুরের মাটি
সুরশ্রী ঘোষ সাহা
'না, না আমি যামু না। কোত্থাও যামু না আমি। তোরা আমারে এহানে ফেলে রাইখ্যাই যা। আমার মরা বাপ-মায়ের কত স্মৃতি ছড়ানো। আমি যাব না দ্যাশ থাইক্যা'।
'ও ঠাকুমা কী বলছ তুমি, কোথায় যাবে না। রোজ রোজ ঘুমের মধ্যে কী যে চ্যাঁচাও বুঝি না।'
আমি অন্য পাশ ফিরে শুই। ঠাকুমা সাদা আঁচল দিয়ে চোখ মোছে। আর নাক টেনে সর্দি গেলে।
সকালে উঠে বাবা-মায়ের কাছে বলতে থাকি, কালও বুড়ি রাতে চেঁচিয়ে ছিল। ধুর্, আমি শোব না এবার থেকে। বাবাকে বোলো, ঠাকুমার সাথে শুতে।
বিকেলে ঠাকুমাকে যখন জিজ্ঞেস করি, 'ঠাকুমা, আজ দুপুরে কী খেয়েছ, বলো তো?' ঠাকুমা বলতে পারে না। আমার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলতে থাকে - সেদিন সন্ধ্যায় তোর ঠাকুরদা রোগী দেইখ্যা এসে বলল, 'মনি, খুব শোল মাসের ঝোল খাইতে ইস্যা করসে। কাল এট্টু করবা নাকি!' আমি বললাম, 'শোল মাস কি চাইলেই পাওয়া যায়?' অথচ, খানিক বাদে যেই না বড় পোলাটাকে নিয়া পুকুরঘাটে বাসন ধুতে গেলাম, দেখি কিনা, একখান কী যেন সড়সড় করতাসে হাঁড়ির পাশটাতে। পোলাটাকে বললাম, দ্যাখ তো, সাপ আইল নাকি? পোলাটা দুইবারের চেষ্টায় ধইরা ফেলল, একখান কত্ত বড় শোল মাস। তারপর সেটাকে ভাল কইরা রাইধ্যা রাতেই খাওয়া হইল।
মা রাতে ঠাকুমাকে খাইয়ে দিয়ে অন্য কাজে ব্যস্ত। তারপরও ঠাকুমা চেঁচিয়ে যায়, 'অ বৌমা, আমারে খেতে দিবা না?'
মা রান্নাঘর থেকে চেঁচায়, 'উফ্, আবার ভুলে গেছে। তোমার মাকে এবার ডাক্তার দেখাও।'
বাবা চুপ করে থাকে।
ডাক্তার জেঠু এসে বলেন, 'এটা ডিমেনশিয়া। এই বয়সে হয়। ভয়ের কিছু নেই, স্বাভাবিক।'
ঠাকুমা, ডাক্তারের হাত ধরে কেঁদে ফেলে। বলে, —'সুবলের বাপও ডাক্তার সিলো, জানো? কত নামডাক - পসার সিলো আমাগো দ্যাশে। অথচ, ওহান থাইক্যা ভারতে পাইল্যা আইস্যা আর তার কোন পরিচয় নাই, কিস্যু নাই। কেউ চেনে না তারে।'
বাবা লজ্জা পায়। বলে, 'কিছু মনে করবেন না, মা আজকাল সবসময় নিজের পুরনো জীবনের কথাই বেশি বলে।' ডাক্তার চলে গেলে ঠাকুমা বিড়বিড় করে, ওরা আমাগো বাসায় আগুন লাগায়ে দিল। মাটির দোতলা ঘর, টিনের ছাউনি দাউদাউ করে জ্বলতে থাকল। আমরা পালিয়ে পিছনের খালে গিয়া বসলাম। খালে তখন পানি নাই। শুকনা। বড় বৌমার ছোট মাইয়াটা কোলে চিৎকার কইরা কাঁদসে। আমরা উনিশ কুড়ি লোক লুইক্যা আসি। আমার খুসশ্বশুর বলল, মাইয়াটার গলা টিপ্যা দাও। ওর জন্য সব মরুম নাকি!
ঠাকুমা এমনইভাবে দিনরাত বকর বকর করতে থাকে। আমরা শুনি না। মা বিরক্ত হয়। বাবা চুপ করাবার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না।
ঠাকুমা বলে চলে — কত বড় উঠোন সিলো আমাগো। এক কোণে সিলো কাসারি ঘর। মা মনসার স্বপ্ন পাইয়া উঠোনে মন্দির বানাই সিলো আমার শ্বশুর। বিজয় গুপ্তের মনসা পাঁচালি পড়তাম রোজ়। একমাস টানা পড়তাম পাঁচালি বইখান। গ্রামের সব ঘরের হিন্দু মা-বউরা চইল্যা আইত। ঘোমটা টাইন্যা সুর কইরা দুলে দুলে গলা মিলাত। শেষদিন যেদিন পড়া হইত সেদিন ফল মিষ্টি দিয়া বড় কইরা পূজা হইত। পাঁঠাবলি হইত। কত দূর-দূরের গ্রাম থিক্যা লোক আইত।
মা আড়চোখে তাকায়। বলে, 'ঘোমটা টাইন্যা' কেন বলছে, বুঝছিস না? আমাকে শোনাচ্ছে।'
আমি মাকে থামাই, 'উফ্ মা, তুমি সবকিছুর মধ্যেই নিজেকে জড়িয়ে নাও। মোটেই...'
ঠাকুমা আজকাল কানে শোনেও কম। পাশে বসে থাকা আমাদের কথা কানে ঢোকে না। নিজের ঘোরে বকবক করে...
প্রতি বছর জোড়া কার্তিক পূজা হত আমাগো দ্যাশের ভিটায়। আমি মন্ত্র পাইসিলাম। যেদিন পাইল্যা আইলাম, ব্যাগে কইরা দুইখান কার্তিক নিয়া আইসিলাম। ইখান আইস্যা রিফিউজি তকমা জুটল। পূজা বন্ধ হইয়া গেল। কত জায়গা ভাড়া থাকসি। পূজা হয় নাই। এহন তোদের ঘরে একখান আর তোর জ্যাঠার ঘরে একখান রয়েসে। আমার তো আর ক্ষমতা নাই। তোরা যদ্দিন পারস, পূজা করস।'
মা দেখি বিড়বিড় করছে। মায়ের যে কার্তিক ভক্তি একেবারেই নেই, তা আমি জানি। ঐ ঠাকুমা যদ্দিন আছে, তদ্দিন...
আমাগো তিনখান সুপারি বাগান সিলো, জানস। এক-একখান বাগানে হাজ়ার খানেক সুপারি গাস সিলো। কত পূর্বপুরুষ ধইরা সুপারি - নারকেলের ব্যবসা সিলো তো। যখন লোক আইস্যা পাড়তো, উঠানখান দেইখ্যা যেন মনে হইত, কমলা চাদর পাইত্যা রাখা হইসে।
মা কাজ করতে করতে হাসে। হয়ত, মায়ের এইসব কিছুই বিশ্বাস হয় না। কিন্তু আমি বুঝি, ঠাকুমা মিথ্যা বলার আর স্বপ্ন দেখার বয়স পেরিয়ে গেছে। ঠাকুমা সেই পুরনো জীবনকে দিনরাত ছবির মতন চোখের সামনে দেখতে পায়। রেডিও জকির মতো একা একা ঠাকুমা বলেই চলে —
আমাগো বাড়ির সাথে তিন-চার বিঘা মজা পুকুর সিলো, যাকে আমরা বলতাম, আঁধি। পদ্মার ইলিশ আর সমুদ্দুরের মাস বাদে সব মাস সিলো সেই পুকুরে। হিন্দু-মুসলমান সব আইস্যা সেই পুকুরের মাস ধরতো। তহন মানুষ বড় বিশ্বাসী সিলো। যা মাস উঠতো, অর্ধেক দিয়া যাইত আমাগো। কই, মাগুর, বোয়াল, শিঙি, শোল, জিয়ল...
'অ বাবু, আমারে কাল জিয়ল খাওয়াইবি নাকি!'
মাছের নাম করতে করতে ঠাকুমা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, মাছ খাবে বলে। অথচ ঠাকুরদা মারা যাবার পর থেকে ঠাকুমা মাছ খায় না, ছেড়ে দিয়েছে। ঠাকুমার যে সত্যি বিকার হচ্ছে আমরা বুঝতে পারি প্রতিক্ষণেই।
শান্ত করলাম -
'তোমার বাবু কই? সে এখনো অফিস থেকে ফেরেনি। তুমি এখন একটু ঘুমিয়ে পড়ো দেখি। আর বকবক কোরো না।'
ঠাকুমা শোনে না।
বলে চলে -
বর্ষায় আমাগো উঠানের ভিতর ঢুইক্যা আসত আঁধির জল। কিলবিল করতো কই মাসের ঝাঁক। খালুই করে পোলাগুলো মাস ধরতো। তারপর দীঘির মুখে বাঁশের 'চাঁই' পেতে রাখত, একদিক থেকে মাস ঢুইক্যা আর বেরুতে পারত না, হ্যা হ্যা হ্যা হ্যা...
খলখল করে বাচ্চাদের মতন ফোকলা মুখে ঠাকুমা হাসে।
আমাগো বাড়ির উঠোনে একখান কাঠ বাদাম গাস ছিল, জানস? লাল লাল কাঠ বাদাম মাটিতে পড়তো। ছেলেগুলান কুইড়্যা আইন্যা, ফাইট্যা খাইত। আঁধির পাশে পাড় বাঁধানো কত বড় পুকুর সিলো। আর পুকুরের সাথে আঁধি খাল দিয়া জোড়া সিলো। আমরা পুকুরের জল খাইতাম। কত ফুল গাস করসিলাম পুকুরের চারপাশে। তালগাস, আমগাস, বৈঁচিফল কত গাস সিলো, আহা ....
এই একটু আগেই কথা বলতে বলতে যে মানুষটা হাসছিল। এখন আবার দেখি, গাছের শোকে কাঁদছে।
জমিদার বাড়িতে আমরা কত কত হিঁদু প্রাণ বাঁচাতে লুকাইছিলাম। জানলার খড়খড়ি খুইল্যা দেখলাম, হিঁদুদের বেরিয়ে আসতে বলসে ওরা। বলসে, কিস্যু করবা না। হাত মিলাইবে শুধু। ওদের বিশ্বাস করে, কত হিঁদু বাইরে গেল। আর ঐ পিশাচগুলান পায়ে ঘুঙুর বাইঁধ্যা নাচতে নাচতে জবাই করি দিল। আমার পরান কাকাও তাদের মধ্যে সিলো। কত কইরা বারণ করসিলাম, কাকা, তুমি শুনলা না...
বর্ষার নিশ্চুপ বৃষ্টির মতো ঠাকুমার দু'চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি, মাও আঁচল দিয়ে চোখ মুছছে।
মা ঠাকুমাকে প্রশ্ন করে, 'আপনারা কীভাবে এলেন এপার বাংলায়, মা?'
ঠাকুমা শুনতে পায় না। আমি কানের মধ্যে মুখ ঠেকিয়ে চেঁচাই।
-'এলে কীভাবে?'
বরিশাল থিকা স্টিমারে খুলনা আইলাম। তারপর খুলনা থিকা ট্রেনে কইরা বনগাঁ। আবার বনগাঁ থিকা ট্রেনে শিয়ালদা স্টেশনে আইস্যা রিফিউজি নাম জুটল। সরকার থিকা আমাগো খিচুড়ি খাইতে দিত। আমার গলায় ঐ খিচুড়ি আজও আইটা আছে।
ঠাকুমা গলায় আঙুল ঢোকায়। যেন সেই খিচুড়ি ঠাকুমা বমি করে বের দিতে চায়। আমরা আটকাই।
'ঠাকুমা, ঠাকুমা করছো কী?'
মা ঠাকুমাকে ডাক্তারের প্রেসকাইব করা ঘুমের বড়িটা খাইয়ে দেয়। আমাকে বলে, 'আলোটা নিবিয়ে দে, মিমি। একটু ঘুমাক। বাঁচার জন্য পালিয়ে এসেছিল মানুষটা। কিন্তু নিজের অতীতের কাছ থেকে পালাতে পারল না জীবনভর' ।।
(বরিশালের বাঙাল ভাষায় 'ছ', 'স' উচ্চারিত হয়, খালুই -বাঁশের ঝোলানো ঝুড়ি)
(ক্রমশ...)
ছবি: লেখিকা
0 Comments