জ্বলদর্চি

মাটিমাখা মহাপ্রাণ-১৬/শুভঙ্কর দাস

মাটিমাখা মহাপ্রাণ
 ষোলো
শুভঙ্কর দাস 

"যত তাপস বালক
শিশিরসুস্নিগ্ধ যেন তরুণ আলোক,
ভক্তি-অশ্রু-ধৌত যেন নম পুণ্যচ্ছটা,
প্রাতঃস্নাত স্নিগ্ধচ্ছবি আর্দ্রসিক্তজটা
শুচিশোভা সৌম্যমূর্তি"

মহানগরের ও মফস্বলের মধ্যে একটা প্রধান পার্থক্য হল জীবনযাপনের জৌলুশ ও জাঁকজমকতা। যারা মহানগরে বসবাস করে,তারা এই চমকপ্রদ ও আগ্রাসী রূপটি দিক সহজে বুঝতে পারবে না!কারণ তারা বসবাস করতে করতে এই দেখার চোখটি মরে যায়!
কিন্তু মফস্বল থেকে যদি কেউ মহানগরে যায়,তার চোখে এই পরিবর্তন ও চাকচিক্য চোখে পড়ে।অনেকের তো চোখ ধাঁধিয়ে যায়! অনেকে মহানগরীর চলন-বলন এনং ঠাটবাটে এতোখানিই মোহিত হয়ে পড়ে যে,পরে সে আর নিজের দেশগাঁয়ে ফিরতে চায় না! কেউ কেউ প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর নিজের গ্রামজীবনকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে। এবং মহানগরের এই রঙচঙে জৌলুশস্রোতে গা ভাসানোকে জীবনের পরমার্থ মনে করে।
ঠিক এইখানে ব্যতিক্রমী কুমারচন্দ্র। তিনি কোনোদিন ভোলেননি মেদিনীপুরের বাসুদেবপুর নামে এক অজপাড়াগাঁ থেকে কলকাতায় পড়তে এসেছেন।তিনি সবার সামনে জোর গলায় পরিচয় দেন,আমি এক হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান,দুবেলা দুমুঠো খাবার জোগাড় করতেই মুখের রক্ত তুলতে হত, আমার প্রিয় দাদাদের দয়ায় আমি এখানে পড়াশোনা করতে পারছি, তা না হলে আমাকেও অন্যের বাড়িতে চাকরের কাজ করতে হত!

এবং এসব কুমারচন্দ্রের কথার কথা ছিল না!
তিনি কোনোদিন পয়সা খরচ করে কোথাও যাতায়াত করতেন না,সর্বদা হেঁটে সর্বত্র যেতেন। রাত্রিবাস অথবা খাওয়া-পরার ব্যাপারে যতটুকু প্রয়োজন, তার বাইরে এক আনা খরচকে তিনি পাপ বলে ভাবতেন।

একবার গঙ্গাধর  আড়ালে ডেকে কুমারচন্দ্রকে বলেছিল,ভাই, এইসব সোজা কথা অতি সহজভাবে বলিস না,মনে রাখিস, সোজা কথা সোজা মানুষদের জন্য, আমরা কিন্তু সোজাসাপটা মানুষদের মধ্যে থাকি না,এখানে বড্ড জটিলতা ও প্যাঁচ, তাই কেউ তোর দুর্বলতা জেনে নিয়ে তোকে বিপদে-আপদে  ব্যঙ্গবিদ্রূপ করবে এবং জনে জনে তোর কষ্টকর জীবনের কথা হাসতে হাসতে বলে বেড়াবে।তোকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভাববে।

এসব শুনে কুমার হেসেছিলেন।
তিনি সেদিন গঙ্গাধরকে যা বলেছিলেন,তা শুনে গঙ্গাধর অবাক হয়ে গিয়েছিল।কুমারচন্দ্র বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে বলে উঠলেন,ভাই,আমি ধুলোর মতো হতে চাই,মাড়িয়ে যাক,থুতু ফেলুক,কিন্তু আমি তো জানি,সেই ধুলোতে জল ঢেলে কখনো মূর্তি, কখনো শস্য ফলানো যায়!
এই বিশ্বাস আমার কোনোদিন হারাবে না!

বলতে বলতে কুমারচন্দ্রের চোখে জল এসে গিয়েছিল। 

গঙ্গাধর বন্ধুর কথা শুনে তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল। মনে মনে সে বুঝছিল,এই অজপাড়াগাঁয়ের সামান্য ছেলেটি তার সঙ্গে পড়ে বটে,সকলেই পড়াশোনা করে মানুষ হতে এসেছে, এই ছেলেটি মানুষ করতে এসেছে। 

বিদ্যালয়ের পড়ানোর কাজেও তাই। কুমারচন্দ্র সে ক্লাসে হোক বা ক্লাসের বাইরে যা করতেন,একাগ্র চিত্তে করতেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল এই পরাধীন ভারতবর্ষের জন্য এমন একটা ভবিষ্যৎ নির্মাণ করা যা,একদিন স্বাধীন দেশের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে।
ছুটি হওয়ার পর সকলেই পড়ি-মরি করে গৃহে ফেরার জন্য অধীর ও আগ্রহী। কিন্তু ছুটির পরও কুমারচন্দ্র বিদ্যালয় পরিত্যাগ করতেন না।
তিনি বিদ্যালয়ের সামনের প্রশস্ত স্থানে মাটি কুপিয়ে ফুলের গাছ লাগান,রোপিত গাছগুলোর পরিচর্যা করেন এবং নিজের হাতে বাঁশের বাখরি দিয়ে বেড়া বাঁধেন।এতে কিছু উৎসাহী ছাত্ররাও হাত লাগায়।
একবার একজন শিক্ষক এসে বাগানের কাছে দাঁড়ালেন। তখন একটা ঘটনা ঘটল।

তা ঘটল ছাত্রদের সামনে।হিরন্ময় খুবই মেধাবী ও চিন্তাশীল ছাত্র। সে কুমার স্যরকে প্রচন্ড শ্রদ্ধাভক্তি করে। তার স্যরের মতো
এমন স্পষ্টবক্তা মানুষ এর আগে দেখেনি হিরন্ময়। সে বাংলা ক্লাসের জন্য অধীর আগ্রহে বসে থাকে,কারণ এই ক্লাস নেবেন কুমার স্যর। ক্লাসে শুধু সিলেবাস নির্ভর নয়, তিনি সিলেবাসের বাইরে এমন সব ঘটনা, এমন সব মহান মানুষের কথা তুলে ধরতেন,তা শুনে অন্তর আলো হয়ে যায়।
একদিন এসে বললেন,তোমরা এটা জেনে রেখো,জন্ম ও জন্মের পরিচয় মানুষকে বড় করে না,করে তার কর্ম।তাই গীতায় সবচেয়ে বেশি যে যোগকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তা হল কর্ম।
ভাবতে পারো,এই পৃথিবীর মনুষ্যসভ্যতাকে যাঁরা প্রকৃত শিক্ষা দিয়েছেন,তাঁরা সকলেই রাখাল ছিল,কেউ গরু, কেউ বা মেষ চরাত।

ছাত্ররা তো অবাক।এমন হতে পারে?

কুমারচন্দ্র বলে চললেন,বৃন্দাবনের মাঠে যিনি গরু চরাতেন,তিনি কুরুক্ষেত্রে গীতার মতো উপদেশ দিয়েছিলেন।আরবের বালিতে যিনি মেষ চরাতেন,তিনি ইসলামের মতো ভ্রাতৃত্ববোধের ধর্ম স্থাপন করেছিলেন,আবার জেরুজালেমের তৃনভূমিতে যিনি মেষ চরিয়েছেন,তিনি জন্ম দিলেন একটি ক্ষমার ধর্ম,খ্রিস্টধর্ম।
তাহলে ভাবো,পৃথিবীর সবচেয়ে তথাকথিত অশিক্ষিত, দরিদ্র ও অতি সাধারণ ঘরের মানুষ কীভাবে কর্মের মাধ্যমে দেবতায় পরিণত হয়েছেন।আসলে কী জানো? পৃথিবীর সবচেয়ে বিস্ময়কর গ্রন্থ মানুষ,তা যে ভালো করে পড়তে জানে,তার মতো পড়ুয়া আর হয় না!

এইসব কথা ছাত্রদের অভিভূত করে দিয়েছিল।তারা কোনোদিন এইভাবে ভাবতেই শেখেনি!

এরপর সেই ঘটনাটি।

সেই শিক্ষক পুরো ঘটনাটি দেখে বলে উঠলেন,এটা কী হচ্ছে কুমারবাবু? আপনি নিজে মাঠে-ঘাটে কাজ করতে ভালোবাসেন, সেসব ঠিক আছে,কারণ শুনেছি,আপনি আগে কোনো জমিদারের বাড়িতে রাখালগিরি করতেন।তাই বলে এইসব কচিকাঁচাদের ধুলোকাদা মাখানো কি ঠিক?জানেন? এরা কোন পরিবারের সন্তান? 

কুমারচন্দ্র নীরব।তিনি নিজের কাজ করে যাচ্ছিলেন। তাঁর এখন চিন্তার কারণ,একটি অপরাজিতা ফুলের গাছ,যা কোনো কারণে শুকিয়ে যাচ্ছে! 
তিনি তার গোড়ায় মাটি দিতে ব্যস্ত। 

জ্ঞানদাতা মাস্টারমশাই একটু বিরক্ত হলেন,এবার বেশ উঁচু কণ্ঠে বলে উঠলেন,আপনি নিজেকে কী ভাবেন কুমারবাবু? মনে রাখবেন, আমি কংগ্রেস করি,আমি বক্তব্য শুনি,কীভাবে দেশ গড়তে হবে,সব জানি,কত টাকা চাঁদা দিই জানেন?

কুমারচন্দ্র একবার তাকালেন সেই কংগ্রেসী মাস্টারমশাইয়ের দিকে।এই মাস্টারের মুখে তিনি অসংখ্য বার কংগ্রেস নামটি শুনেছেন এবং দেওয়ালে কংগ্রেসের পোস্টারও পড়েছেন। কিন্তু এখন বাগানচর্চায় কংগ্রেস কী করবে? এটা তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না!
তারপর হিরন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,হিরু,যে গাছগুলোতে জল  দেওয়া হয়নি,দিয়ে দাও।

অবশ্যই মাস্টারমশাই, বলে হিরন্ময় একটা ঝারিতে জল ভরতে গেল।

সেই কংগ্রেসী মাস্টার এবার দারুণ উত্তেজিত, আপনি জানেন, কাকে জল দেওয়ার মতো সামান্য কাজ করাচ্ছেন? হিরন্ময় আমাদের বিদ্যালয়ের সেক্রেটারি মুরলীধর বন্দ্যোপাধ্যায়ের একমাত্র ছেলে।আপনি কি এই সব জুয়েল ছাত্রকে আপনার মতো চাকর বানাতে চাইছেন? তাকে দিয়ে জল বওয়ার কাজ করাচ্ছেন? কাকে দিয়ে কোন্ কাজ করানো হয়,এটা মনে রাখুন।

ওহ্ আচ্ছা,মনে রাখব,এইটুকু বলে কুমারচন্দ্র বেড়ার একটি বাখারি শক্ত করে দড়ি দিয়ে বাঁধলেন।

কিন্তু আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না!

বলুন?

এইভাবে বাচ্চাদের খাটিয়ে আপনি কী প্রমাণ করতে চান?

আমি শুধু বাচ্চাদের শেখাতে চাইছিলাম, বইয়ের পাতায় লেখা আছে,গাছে ফুল ফোটে,এটা সত্যি সত্যি হয় কি না?

এ আবার কী ছেলেমানুষী কথা?

বলতে পারেন,আসলে আমার একটা কথা সবসময় মনে হয়,যারা  শুধু বইয়ের পাতায় সমাজ চেনে,দেশ চেনে,দেশের মানুষ চেনে,তাদের শিক্ষা সম্পূর্ণ নয়, হাতে মাটি মেখে দেশ চিনতে হবে,পথে নেমে মানুষ চিনতে হবে।

তার মানে আপনি বলতে চান,আমরা দেশের মাটি চিনি না! জানেন কংগ্রেস এবার অধিবেশনে কী বলেছে...

কথাটা শেষ হল না,তার আগেই অপর একটি কণ্ঠ ভেসে এলো

অধিবেশনে তো অনেক বড় বড় কথা হয়,তাও আবার উচ্চজ্ঞানীদের চোস্ত ইংরেজিতে, আপনি কি সবকিছু বোঝেন? মনে হয় তো বোঝেন না,অথচ এই মানুষটি কিন্তু বাংলায় বলছেন,যে মাটি হাতে না মাখলে মানুষ বা দেশ চেনা যায় না,সেটা কি বোঝা যাচ্ছে? 

তারপর কুমারচন্দ্রের দিকে ঘুরে বলে উঠলেন,

বাহ্, এই জন্য আপনাকে এতো ভালো লাগে কুমারবাবু,এমন করে কজন বোঝে এবং বোঝাতে পারে,এই কথাগুলো কংগ্রেসী মাস্টারমশাইের পাশ থেকে কথাগুলো এলো।
সকলে মুখ তুলে দেখলেন,বিদ্যালয়ের সেক্রেটারি মুরলীধর বন্দ্যোপাধ্যায় এসে দাঁড়িয়েছেন।
তাঁকে দেখেই কংগ্রেসী মাস্টারমশাই একটু সংকুচিত হয়ে পড়লেন।
তাঁর দিকে তাকিয়ে মুরলিধর জিজ্ঞেস করলেন, আপনাকে যে দায়িত্ব দিয়েছিলাম,সেটি কি সম্পন্ন করতে পেরেছেন?

আজ্ঞে,আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।এখনও এই ব্যাপারে  মানুষকে বোঝানো কঠিন।

মানে?

আসলে মেয়েরা বাড়ির বাইরে স্কুলে আসবে,এটা এখনও বাড়ির অন্যরা ঠিকঠাক মেনে নিতে পারছে না,আমি বলেছিলাম,পাশের বাড়ির হরনাথকে,সে তো একেবারে হাঁকিয়ে দিল,বললে, ওরে বাবারে,এ দেশে বিদ্যসাগরী শয়তানগুলো কবে যে দূর হবে, সেই সময়ের অপেক্ষায় আছি।

তা আপনার বিধবা বোনের তো পিঠোপিঠি দুটি মেয়ে, তাদের বয়সও দশের নিচে,তাদের কী হল?

আসলে আমি চাইলে তো হবে না,আমার গিন্নির একটু সেকেলে,তাই বোনটি আমার আশ্রয়ে থাকলেও, বাড়িতে তাদের থাকা-খাওয়া  নিয়ে রোজ অশান্তি, তার ওপর পড়াশোনার কথা বললে,গিন্নির মেজাজ সপ্তমে চড়ে যাবে!

বাহ্, আপনি তো কংগ্রেস করেন,সদস্য চাঁদাও দেন,তা আপনার নেতারা তো স্ত্রীশিক্ষার ব্যাপক প্রচার ও উন্নতি চায়,আপনাকে যদি প্রস্তাব দেয়,তখন কী করবেন? গিন্নির ভয়ে গর্তে লুকিয়ে পড়বেন!

আসলে আমি তো চেষ্টা করছিলাম,তা পারিনি সত্য, কিন্তু অন্যায় দেখলে চুপ থাকি না, এই কুমারবাবুর বাচ্চাদের জোর করে খাটানোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছিলাম 

দারুণ প্রতিবাদ? জীবনে গাছ লাগিয়েছেন?

মানে? এ তো মালির কাজ,আমার গৃহে দুজন মালি আছে।

বুঝেছি,নিজের হাতে গাছ লাগিয়ে ফুল যেদিন ফোটাতে পারবেন,সেদিন বুঝবেন কংগ্রেস করার কী প্রয়োজনীয়তা? 

যাঃ বাবা,ফুল ফোটানোর সঙ্গে দেশ উদ্ধারের কী সম্পর্ক?

তা সম্পর্ক এখনই আপনাকে বোঝাব? এখন যান,আবার স্কুল ছুটির পর দেরি হলে আবার আপনার গিন্নি তেলে-বেগুনে...

কথাটা শোনা মাত্র কংগ্রেসী মাস্টারমশাই এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না! তাঁর সহসা যেন মনে হল,ফুল ফোটানোর চেয়ে গিন্নির হুল সামলানো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। 

কাজ করতে করতে সব শুনছিলেন কুমারচন্দ্র। তিনি এবার এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন মুরলিধরের সামনে। 

আপনি যদি আমাকে দায়িত্ব দেন,তাহলে কালই চারটে মেয়েকে জোগাড় করে দিতে পারি! তবে?

তবে?

একটু অসুবিধায় আছি

বলুন? খুলে বলুন?

আমি তাদের যথারীতি পড়াতে শুরু করেছি,শুধু একটু খাওয়ার ব্যবস্থা যদি করা যেত! ওরা রেলস্টেশনের গায়ে ঝুপড়িতে থাকে,ভালো করে খেতে পায় না! কিন্তু জানেন ওদের কী পড়াশোনার কী অদম্য ইচ্ছে। 

তা তো হল?  কিন্তু আপনি যদি সরাসরি সহযোগিতা না করেন,তাহলে কী করে সম্ভব বলুন?

মেয়েদের একটা স্কুল খুব দরকার, আপনি যদি তা স্থাপন করেন,তাহলে আমার বিদ্যালয়ের বেতন নেব না,সবটা এই কাজে দিয়ে দেবো। মেয়েদের কী কষ্ট, মুখে বলে বোঝাতে পারব না!একদিন রেলস্টেশনে গিয়ে দেখি,চারটি মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে ছোটটি অনুপস্থিত। ভাবলাম,শরীর খারাপ হয়েছে নিশ্চিত, তাই তার বাড়িতে ছুটে গেলাম।সে রেলস্টেশন থেকে একটু দূরে ভাঙা সাঁকোরটার কাছে থাকে।গিয়ে দেখি,তার বিধবা মা চট-ঘেরা দাওয়ায় বসে আছে,মাথায় হাত,দুজন লোককে সেই ছোট মেয়েটিকে চেপে ধরে আছে,তারা তাকে নিয়ে যাবে। সে কিছুতেই মাকে ছেড়ে যাবে না।কারণ সন্ধান করে জানলাম,তার মা ঐ লোকগুলোর কাছে টাকা ধার করেছিল,তাই শোধ করতে না পারার জন্য, তারা মেয়েটাকে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য, মেয়েটি দেখতে শুনতে ভালো, ভালো বিক্রির দাম পাবে!
ভাবতে পারেন,এ কি রামমোহনের  দেশ? বিদ্যাসাগরের মাটি?

তারপর? মুরলিধর করুণস্বরে জিজ্ঞেস করলেন।

তারপর আমার কাছে কিছু টাকা দিয়ে মেয়েটা উদ্ধার করি।পরে মিটিয়ে দেবো এই প্রতিশ্রুতিতে তারা চলে গেলো,তারপর তার মা যা বলল, তা শুনে আমার সেদিন মনে হল,এই দেশের অবস্থা কবে বদলাবে? কে বদলাবে?

মানে? কী বলল?

তার মা আমার দিকে সজল চক্ষুতে চেঁচিয়ে উঠে বলল,মাস্টারমশাই পড়ার চেয়ে দুটো খেতে দিতে পারতেন, তাহলে আপনার পা ধুইয়ে দিতাম,এই যে মেয়েটি আমার দুদিন শুধু মুড়ি খেয়ে আছে,মা হয়ে ভাত দিতে পারিনি! অথচ গাঁয়ে এককালে কত সুখে ছিলাম,হঠাৎ যুদ্ধের কথায় সব এলোমেলো হয়ে গেল!
আমি কী আর করতে পারি! নীরবে চলে এলাম,সেই মেয়েটিকে মাঝেমধ্যে রান্না করে ভাত-ডাল খাওয়ানোর চেষ্টা করি।

সেই সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আবহাওয়া চলছে।অনেকেই মনে করেছিল,যুদ্ধের বাজারে ভালো রোজগারপাতি করে অভাব মেটানো যাবে।সেই রকম পরিকল্পনায় ভিটেমাটি ছেড়ে মহানগরে এসেছিল ভাগ্য বদলাতে।কিন্তু মহানগরের কংক্রিট ও কঠোর দেওয়ালের ধাক্কায় তারা এই অবস্থায় পৌঁছে গেছিল।পুরুষটি অসহায় স্ত্রী ও কন্যাকে রেখে যা গেছে, আর ফিরে আসেনি! 

মুরলিধর অবাক হলেন।
মুখে বললেন,আপনাকে যত দেখি,বুঝলেন,কেমন আশ্চর্য লাগে,আগে আপনার সঙ্গে দেখা হল না কেন?
আমি সব ব্যবস্থা করব,আপনি চলুন?

কোথায় যাব? প্রশ্ন করলেন কুমারচন্দ্র।

বালিকাবিদ্যালয় স্থাপন করতে হলে তো একসঙ্গে কাজ করতে হবে,তাই আজ থেকে আপনি আমার নিজের একটি বাগানবাড়িতে থাকবেন।সেই স্থান নির্জন এবং সাধনার জন্য অতি উত্তম।  থাকা-খাওয়া-দাওয়ার দায়িত্ব আমার,সেইখানে বসেই পরিকল্পনা করে নেব বালিকাদের জন্য বিদ্যালয় কীভাবে চালু করা যায়?

আপনার বাগানবাড়িতে থাকব? তা কী করে হয়?  আমি তো...

কেন হবে না,তাহলে আমার কাজ করতে সুবিধা হবে।

এমনি এমনি এইভাবে সুবিধা নেওয়ার আমি পক্ষপাতী নেই,আমাকে ক্ষমা করবেন,আমি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য যেমন বলবেন,তাই করব।

এমনি এমনি কেন করবেন? আমি কি জানি না,আপনার আত্মসম্মানকামী মানুষকে আমি ভালো করে চিনি তো! 
তারপর হিরন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, 

এসো হিরন্ময়, তোমার মাস্টারমশাইয়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করো,এঁর সঙ্গে থাকলে সত্যিকারের শিক্ষালাভ তুমি করতে পারবে।

হিরন্ময় বাগান থেকে বেরিয়ে এসে প্রণাম করল।

কুমারচন্দ্র তাঁর প্রিয় ছাত্রটির মুখের দিকে তাকিয়ে মাথায় হাত রেখে বলে উঠলেন,সত্যিকারের মানুষ হতে হবে,মনে রেখো....

ক্রমশ....

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments