জ্বলদর্চি

উত্তর আমেরিকা (নেটিভ আমেরিকানদের গল্প)/চিন্ময় দাশ


দূরদেশের লোকগল্প

চতুর খরগোশ—উত্তর আমেরিকা (নেটিভ আমেরিকানদের গল্প)

চিন্ময় দাশ 


ভারি ঠাণ্ডার দেশ। হবে নাই বা কেন? চার দিকেই তো সমুদ্র। সেও আবার সারা বছর পুরু বরফের সাদা চাদরে মোড়া। সূর্যটা যে বছরে ক’দিন দেখা যায়, তার নাই ঠিক। বছরের অধিকাংশ সময়ই মাটি বরফে ঢাকা থাকে। 

সেখানেই একটা গ্রামে থাকে এক খরগোশ। তার মা-বাপ দুজনেই মারা পড়েছে শিকারীর ফাঁদে আটকা পড়ে। বুড়ি ঠাকুমার কাছে থাকে বাচ্চাটা। 

সমস্যা হয়েছে, বাচ্চাটা বেশ ছোট, আর ঠাকুমা বেশ বুড়ো। ফলে, দুজনের খাবার দাবার জোটানো ভারি মুস্কিল হয়ে উঠেছে। সত্যি বলতে কী, সবদিন যে আহার জোটে তাদের, তা কিন্তু নয়।

একদিন হয়েছে কী, খিদেটা যেন একটু বেশিই মালুম হচ্ছে নাতি খরগোশের। সে ঠাকুমাকে জানতে চাইল, নদীর দিকে যাবে কি না। কেননা, বরফ গলা শুরু হয়েছে। আবার জল বইছে নদীতে। দুট-একটা মাছ জুটে গেলে, সকালের জলখাবারটা হয়ে যেত। 

শুনে একটু কেবল হাসল ঠাকুমা খরগোশ। মনে ভাবল, নদীর মাছ কি আর বেয়ে বেয়ে তোর হাতে এসে উঠবে, বাছা? বিশেষ করে তোর মত একটা বাচ্চার হাতে। 

কিন্তু মানা করতেও পারছে না বুড়ি, তার নিজের শরীরে বাত রোগ বাসা বেঁধেছে। খাবার জোটাবার শক্তিটুকুও নাই আর। ফলে আনুমতি দিতেই হয়। মাছ তো পাওয়ার কথাই নয়, তবু কপাল গুণে, অন্য কিছু যদি জুটে যায়। 

নদীর ঠিক কোনখানটাতে গেলে মাছ পেলেও পাওয়া যেতে পারে, তাকে বুঝিয়ে দিল ঠাকুমা। সাথে একটা জাল নিতে বলে দিল। কীভাবে জাল পাততে হয় নদীতে, তাও বুঝিয়ে দিল ভালো করে। নাতির মনে তখন ভারি পুলক। ঠাকুমা তাহলে এতদিনে বুঝেছে যে আর নাতি সাবালক হয়ে উঠেছে। নাতি বেরুতে যাবে, ঠাকুমা ডেকে বলল—যাচ্ছিস তো, কিন্তু আমি ভাবছি, গিয়ে লাভটা কী? ধর, একটা মাছও না হয় পেলি। কিন্তু কী করবো তা দিয়ে? রান্না যে করবো, আগুন তো নাই আমার কছে! 

--মাছটা তো ধরি আগে। আগুনের ব্যবস্থা ঠিক করে ফেলব। কিচ্ছুটি ভেবো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। বেশ ফূর্তির সাথেই বলল কথাগুলো। আসলে, বাচ্চা তো, বরফের দেশে আগুন জ্বালবার কী হয়রাণি, জানেই না সে।

ঝোপঝাড় আর খোলা মাঠের ওপর দিয়ে, জালটাকে বয়ে আনা, যে কী ঝকমারি! কোন রকমে নদীর পাড়ে এসে পৌঁছল নাতি। 

নদীর একটা বাঁকের কথা খুব শোনে সে। সেখানে নাকি ঝাঁক বেঁধে থাকে মাছেরা। ঠিক সেখানেই  পৌঁছে গেল খুঁজে খুঁজে।  ঠাকুমা যেমনটি বুঝিয়ে বলে দিয়েছে, সেইমত জাল পেতে, ঘরে ফিরে এল খরগোশ। 

উত্তেজনায় সারা রাত ঘুমই এল না দু’চোখে। ভোরের আলো ভালো করে ফুটেছে কি ফোটেনি, বেরিয়ে পড়ল খরগোশটা। ছুটতে লাগল পড়ি কি মরি করে।  যেন কুকুর তাড়া করে আসছে পিছনে। মনে একটাই ভাবনা, একটা মাছও কি পাবে না জালে? মাছের কথা ভাবতেই, খিদেটা আরও তীব্র হয়ে উঠল।

কিন্তু ভাগ্য মন্দ নয় নাতির। বরং ভাগ্যদেবী যেন একটু বেশিই প্রসন্ন তার উপর। জালটা মাছে একেবারে ভর্তি। বলতে কি, যেন প্রত্যেকটা ফাঁসে একটা করে মাছ। যেমন পুরুষ্টু, তেমনি রূপোর মত চকচকে মাছগুলো। 

কিন্তু সমস্যা হোল, এত ভারি হয়েছে জালটা, বয়ে নিয়ে যাওয়া দুরুহ ব্যাপার। কোন রকমে, জালের একটা কোনাই কেবল তুলে ধরতে পারছে সে। কী করা যায়, কী করা যায়? ভেবে ভেবে, ফাঁস থেকে ছাড়িয়ে, কয়েকটা মাছ জলেই ছেড়ে দিল। কয়েকটা মাছ পুঁতে দিল বরফে গর্ত খুঁড়ে। পরে এসে তুলে নিয়ে যাওয়া যাবে, এই ভাবনায়। বাকি কাজটা তাতে একটু সোজা হোল তার পক্ষে। গোল করে গুটিয়ে, জাল ঘাড়ে ফেলে বাড়ির পথ ধরল। 

ভালো রকম কষ্টই হয়েছে জালটা বয়ে আনতে। কিন্তু জিরিয়ে নেওয়ার সময় কোথায়? জাল নামিয়ে ঠাকুমাকে বলল- তুমি পরিষ্কার করো মাছগুলো। আমি নদীর ওপারে যাচ্ছি, আগুনের ব্যবস্থা করতে। ওপারের লোকেদের তাঁবুতে আগুন আছে শুনেছি।  

বুক কেঁপে উঠল ঠাকুমার। বলে কী এ ছেলে? প্রাণের ভয় নাই? নদীর ওপারে যারা থাকে, আগুন আছে তাদের কাছে। কিন্তু এই বরফের দেশে, আগুন আবার কেউ কাউকে দেয় না কি? বুক দিয়ে আগলে রাখে সবাই আগুনকে। আগে একবার কয়েকজন লোক গিয়েছিল ওপারে, আগুনের জন্য। কোন রকমে প্রাণ হাতে নিতে ফিরে আসতে পেরেছিল ভাগ্য জোরে। 

তখুনি আবার বুড়ির মনে হোল, কিন্তু এ ছেলে নিশ্চয় যাদু জানে, নইলে অত মাছ ধরে আনল কী করে? সাত-পাঁচ ভেবে আর নিষেধ করল না সে।

নাতি নদীর পাড়ে এসে, খুঁজে দেখতে লাগল, কোনখানে নদীটা সরু। কিন্তু কপাল মন্দ। এমন জায়গা কিন্তু নেইই। নদী এতটাই চওড়া, অতি বড় লম্ফবিদের পক্ষেও কাজটা করা সম্ভব নয়।

কী করা যায়, ভাবতে ভাবতে, এক যাদুগরের কথা মনে পড়ল খরগোশের। কয়েকবার দেখেছে লোকটাকে। নদীর এদিকে এলেই, নদীতে নেমে জল খায় লোকটা। আর, কৃপা কর প্রভু—তিনবার উচ্চারণ করে কথাটা। 

খরগোশ ভাবল, দেখা যাক পরীক্ষা করে। এই ভেবে সেও জলের কিনারায় গিয়ে, 'কৃপা কর প্রভু’ কথাটা তিন বার আউড়ে গেল। কয়েক লহমাই বলতে হয়। জলের মধ্য থেকে ভয়ানক একটা তোলপাড় শুরু হয়েছে যেন।  বিশাল একটা স্তম্ভ পাকিয়ে উঠতে লাগল জল ছাড়িয়ে। তারপর এসে হাজির হয়ে গেল খরগোশটার একেবারে পায়ের কাছে। তাকিয়ে দেখল, গোটা পনের বড় বড় তিমি মাছ ভেসে উঠেছে তার সামনে। 

খরগোশ তিমিগুলোকে বলল—ছোট্ট একটা কাজ করে দাও তো, বাপুরা। নদীর এপার ওপার একটা সাঁকো বানিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ো। আমি ওপারে যাবো। 

মুখের কথা শেষ হতে পেল না। আবার একটা তোলপাড় নদীতে। একেবারে হুকুমের চাকর যেমন, একটা সাঁকো তৈরি কর দাঁড়িয়ে পড়ল মাছগুলো।মাছের পিঠে চেপে এই ব্রফের নদী পেরোতে ভারি আনন্দই হোল তার। মাছগুলোকে ছুটি দিয়ে দিল সে—এবার তোমরা চলে যেতে পারো। অনেক ধন্যবাদ। 

মাছগুলোর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিল খরগোশ। এবার নদীর দিকে মুখ করেই বালির ওপর বসে পড়ল সে। এর পরেই আসল কাজ। কীভাবে সেটা করা যাবে, একটু ভেবে নিতে হবে। 

তখনই ঘটে গেল বিপদটা। পিছনে খানিকটা তফাতে একদল ছেলে খেলাধুলো করছিল। খরগোশ তদের দেখেনি। কিন্তু একটা ছেলে দেখে ফেলেছিল তাকে। সে চুপিসারে এসে, পিছন থেকে খপ করে তার একটা কান ধরে ফেলেছে শক্ত করে। চমকে গিয়ে খরগোশ যত টানাটানি করে, রেহাই হোল না নাছোড়বান্দা ছেলেটার হাত থেকে। 

খরগোশটাকে বুকে আঁকড়ে, হাঁফাতে হাঁফাতে একটা তাঁবুতে এসে ঢুকে পড়ল ছেলেটা। একজন বুড়ি ছিল ভিতরে। সে দেখে বলল—ওই ডেকচিটায় ছুঁড়ে দে ওটাকে। 

খরগোশ তো বুঝে গিয়েছে, আজই মরণ ঘটবে এই বুড়ির হাতে। সে কাকুতি মিনতি করতে লাগল। বুড়ি ঠাকুমার কথা। ঘরে খাবার দানাটুকুও নাই সে কথা। ইনিয়ে বিনিয়ে দুঃখের কথা বলে, মন গলাতে চেষ্টা করল বুড়ির। 

বুড়ি ছেলেটাকে বলল—ডেকচিতে না। ঐদিকের ওই বাক্সটায় ঢুকিয়ে রাখ এখন। এর দুঃখের কাহিনী শুনতে শুনতে, জলটা উনুনে বসিয়ে দিই। জল ফুটে উঠলে, তখন ওটাকে ডেকচিতে ফেলে দেব।

একটা বুড়োও ছিল ভেতরে। সে বলল—নাগো, আগে এটাকে মেরে ফেল বরং। 

সবই কানে যাচ্ছে খরগোশের। সবই শুনতে আর বুঝতে পারছে সে। কিন্তু করবারই বা কী আছে বেচারার? তবুও হাল না ছেড়ে, তাঁবুটায় কোন ফুটো-ফাটা আছে কি না, চোখ চালাতে লাগল। আর, কপাল গুণে দেখতেও পেল ফুটো একটা।

সময় নষ্ট করলে বিপদ বাড়বে। এক মূহুর্তও দেরী নয়। তিড়িং করে দূরন্ত এক লাফ দিয়ে বাক্সের বাইরে এসে পড়ল খরগোশটা। কতকগুলো জ্বালানিকাঠ ডাঁই করে রাখা ছিল। একটা কাঠ তুলে ছুঁড়ে দিল জ্বলন্ত উনুনে। তাতে যা হয় আর কী। আগুনের ফুলকি ঘরময় চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। তাতে একটা হুলুস্থুল কাণ্ড তাঁবুর ভিতর। ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেছে। সেই সুযোগে একটা জ্বলন্ত কাঠের টুকরো তুলে নিয়ে, দৌড়। সে যে কী দৌড়! খরগোশ নিজেও জানত না, তার নিজের পায়ে এত শক্তি আছে। 

খরগোশ আগুন নিয়ে পালাচ্ছে। মেয়ে পুরুষ বাচ্চারা হইহই করে তাড়া করে আসছে পিছনে। প্রাণপনে দৌড়ে নদীর পাড়ে এসে হাজির হোল খরগোশ। এখন আর তিমিগুলোকে ডাকবার ফুরসৎ নাই। মুখে কাঠ কামড়ে ধরা। মন্ত্র আওড়াবে, সে সূযোগও নাই বেচারার। মনে মনে তিনবার বলে গেল—কৃপা কর প্রভু।

কৃপাও করলেন প্রভু। অসম্ভব এক লাফ খরগোশের। লোকগুলোর মুখ হাঁ হয়ে গেছে। মুখে রা সরছে না কারও। সামান্য একটা খরগোশ। লাফ দিয়ে একেবারে আকাশ ছুঁয়ে ফেলছে যেন। চোখ গোল গোল হয়ে গেছে সকলের। 

ধুপ করে ছোট্ট একটা শব্দ। নদীর একেবারে ওপারে গিয়ে পড়েছে খরগোশটা। নীচে পড়েই, প্রথমে তাকাল মুখের জ্বালানি টুকরোটার দিকে। না, আগুনটা নেভেনি। নদীর ওপারে তাকিয়ে দেখল, নিরূপায় হয়ে এদিকেই তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কতকগুলো লোক। নিশ্চিন্ত বাড়ি চলল সে।

বাড়ি পৌঁছেই বলল--কীগো, বলেছিলাম না, আগুন আমি এনে দেব তোমাকে।          

বুড়ির তো মুখে হাসি ধরে না। কিন্তু অবাক গলায় বলল—কিন্তু নদী পার হলি কী করে তুই? 

--কেন? লাফিয়ে। সাঁতরে তো আর নয়। এমন স্বাভাবিক গলায় বলল, যেন একেবারেই সাধারণ একটা ব্যাপার।

ঠাকুমা আর ঘাঁটাতে গেল না নাতিকে। বেশ বুঝতে পারল, এ ছেলে যথেষ্ট পারঙ্গম হয়ে উঠেছে। আর কোন চিন্তা রইল না বুড়ির মাথায়। খাওয়ার ভাবনাটা নেমে গেল ঠাকুমার মাথা থেকে।  


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments