জ্বলদর্চি

গ্রামের শহুরে রূপকথা -১৬/সুরশ্রী ঘোষ সাহা

গ্রামের শহুরে রূপকথা 

সুরশ্রী ঘোষ সাহা 

ষষ্ঠদশ পর্ব : ধর্মীয় বিশ্বাস

একবার মহেশ্বরবাটি গ্রামে একটা বিরাট বড় হনুমানজির মূর্তি কে বা কারা পুকুর পারের পুরনো বট গাছের নিচে বসিয়ে রেখে গিয়েছিল। হয়ত, বাড়িতে পুজো করবে বলে কিনে এনেছিল, তারপর কোন বিপদ আপদ ঘটায় বাধা পড়ে পুজোটা বন্ধ হয়ে যায়। আর হনুমানজির স্থান হয় গাছের নিচে। তারপর বহু দিন ঐভাবেই হনুমানজি এক হাতে গন্ধমাদন পর্বত আর অন্য হাতে গদা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। বর্ষায় বৃষ্টিতে ভেজেন। গ্রীষ্মে গায়ে রোদ্দুর মাখেন। পথচলতি মানুষ মূর্তির দিকে তাকিয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে নমস্কার করে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যায়। 

 হঠাৎ একবার গিয়ে দেখি, হনুমানজির মূর্তিটাকে ঘিরে কবে যেন একটা মন্দির গড়ে উঠেছে। ঠাকুরের গায়ে নতুন রঙ হয়েছে। সন্ধ্যায় ঘন্টা বাজিয়ে পুজো চলছে। প্রথমে শুধু প্রতি মঙ্গলবার করে পুজো শুরু হত। তারপর মঙ্গলবারের সাথে শনিবারটাও যোগ হয়। 

 চিরকালই বেশিরভাগ গ্রামেগঞ্জে রামায়ণ - মহাভারত পাঠ হত। যাত্রাপালাতেও রামায়ণ - মহাভারতের নানা কাহিনি অভিনয় হত। মঞ্চে হাতে গদা নিয়ে বালি সুগ্রীব হনুমান সেজে যাত্রা নাটকের অভিনেতারা নকল উঁচু ঠোঁট এঁকে এধার-ওধার লাফিয়ে বেড়াত। আর হাততালির পর হাততালি কুড়াত। গ্রামে গ্রামে হিন্দুরা রাম ও বজরঙ্গবলির ভক্ত হত খুব। এই হনুমানজির মন্দিরেও দেখলাম খুব ধুমধাম করে টক দই আর লাড্ডু দিয়ে পুজো চলছে। গ্রামের সকল ঘরের মানুষজন সন্ধ্যাবেলাটা ঐ মন্দিরে ভিড় করে হাজির হচ্ছে। বউয়েরা বসে থেকে পুজো দ্যাখে। মাইকের সামনে হনুমানজির পাঁচালি পড়া হয়। তারপর সবাই কপালে কমলা সিঁদুরের টিপ পরে প্রসাদ মুখে দিয়ে বিদায় নেয়। 

 গ্রামের পুরনো রাধাকৃষ্ণের পোড়া মাটির মন্দিরেও পুজো হয় প্রতি সপ্তাহে। যে মন্দির কবে কোন্ কালে নাট মন্দিরের আদলে গড়ে উঠেছিল, এখনকার মানুষজন বলতে পারে না। মন্দিরের গায়ে সেই আদিকালেই খোদিত হয়েছিল, নানা নর-নারী ও পশুদের শিল্প ভাস্কর্যের কারুকার্য। মন্দির এখন প্রায় ভগ্নপ্রায়। তবুও তার দেওয়ালে যুবক-যুবতীদের নামের আদ্যক্ষর প্লাস চিহ্ন দিয়ে খোদিত হয়ে আরো শৈল্পিক মাত্রা বাড়ানোর চেষ্টা হয়েছে। পুজো শেষে এই মন্দিরের বাইরে আজও হরির লুঠ দেওয়া হয়। তবে বাচ্চাদের মধ্যে সেই লুঠের বাতাসা কুড়নোর হুড়োহুড়িটা আর নেই। 


 গ্রামের এক প্রবীণ ব্যক্তি স্বপ্নাদেশ পেয়ে কালী মন্দির স্থাপন করে ছিলেন এক সময়। বিরাট সেই মন্দির। ধীরে ধীরে সেটাও খুব জাগ্রত তারামায়ের মন্দির হয়ে উঠল। যাদের বাড়ির মানুষরা মারা গেল, তাদের নামের সাথে জন্মসাল-মৃত্যুসাল খোদাই করে ফলকনামা করা হল, মন্দিরের মেঝেতে - সিঁড়িতে। দেবীর কাছে মানুষ মানত রাখতে শুরু করল। আর তা পূরণ হলে দেবীর সোনার চোখ, মুকুট, জিভ গড়ে উঠতে থাকল। গ্রামের মানুষদের ঈশ্বরে ভক্তি চিরকালই বেশি। গ্রামের বহু মনসা গাছে, বট -অশ্বত্থ গাছে মানতের ধাগা বা ঢিল বাঁধা দেখতে পাওয়া যায় আজও। কে কবে সেই গাছে প্রথম ঢিল বেঁধেছিল, সেটা কেউ জানে না। তবে এখন গাছের পাতার চেয়ে লাল সুতো কিংবা লাল কাপড়ে বাঁধা ঢিল বেশি চোখে পড়ে। 

 জেঠুর বাড়িতে জেঠু হঠাৎ শুরু করল রাস উৎসব পালন। দুর্গা পুজোর পরে জগদ্ধাত্রী পুজোর সময় কার্তিক মাসে এই রাস উৎসব হয়। জেঠু আগে ছোট করে শুরু করেছিল। এখন ছেলেরা আরো ধুমধাম করে পালন করে। নদীয়া থেকে, বর্ধমান থেকে কীর্তনের দলকে ভাড়া করে আনা হয়। একদল যায় আর একদল গাড়ি ভাড়া করে তাদের হারমনিয়াম, খোল-করতাল, তবলা ও বাকি সব বাদ্যযন্ত্র নিয়ে হাজির হয়। সারা রাত ধরে গ্রামের বহু মানুষ ত্রিপলের প্যান্ডেলের নিচে বসে শ্রীকৃষ্ণ-রাধিকার প্রেমের নানা লীলা কথাকাহিনি শোনে। প্রেম পর্যায়ের রসের কথা শুনে নতুন বিবাহ করে শ্বশুর বাড়ি আসা বউটা লজ্জা পায়। আবার মাথুর পর্যায়ে রাধার দুঃখ-বেদনা শুনে মা-কাকিমারা কাঁদে। জল ভরা চোখে দু-হাত উপরে তুলে হরির নামের জয়গান করে ওঠে। বোঝা যায় না, মাথা ঢাকা প্যান্ডেলের বাইরে তখন ঘোর রাত্রি নেমেছে। আকাশ থেকে কুয়াশার চাদর নেমে এসেছে ধানক্ষেতের মাথায়। পূর্ণিমার বিরাট চাঁদটা দীঘির জলে পড়ে গিয়েছে, আর হাল্কা হাল্কা দুলছে। শরীরে কার্তিক মাসের গ্রামের শীতও অনুভব করে না মানুষগুলো। কীসের যেন এক ঘোরে কেটে যায় সারা রাত। ভোরবেলা কয়েক ঘন্টার বিশ্রাম নিয়ে আবার এসে বসে। 

 তিনদিন ধরে এমনইভাবে রাধাকৃষ্ণের নাম সংকীর্তন চলতে থাকে। শেষ দিন সকালে বাড়ির কোন সদস্য চৈতন্যের প্রতিভূ হয়ে কপালে চন্দনের তিলক কেটে খালি গায়ে হাল্কা হলুদ বর্ণের চাদর ঝুলিয়ে, ধুতি পরে একেবারে গৌর নিতাই সেজে ওঠে। তারপর হাতে ভিক্ষার থালা, কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে চৈতন্যকে ঘিরে বাড়ির প্রায় সকল সদস্যরা ঢাকবাদক - খঞ্জনিবাদক নিয়ে গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে নগর পরিভ্রমন ক'রে মাধুকরী অর্জন করে। মাটির ঘর, খড়ের ছাউনির কিংবা পাকা একতলা-দুইতলা বাড়ির থেকে মানুষরা বেরিয়ে আসে হাত জোড় করে। চৈতন্যরূপী ছেলেটিকে পায়ে হাত দিয়ে কিংবা মাটিতে সাষ্টাঙ্গে শুয়ে প্রণাম করে। আতপ চাল, আলু, মুলো, বেগুন ঘর থেকে এনে গৌরাঙ্গের ব্যাগে ভরে দেয়। বাড়ি ফেরার পর সেই অর্জিত ভিক্ষান্ন রান্না করে ঠাকুরকে সেবা দেওয়া হয়। তারপর সেই মহাপ্রভুর ভোগ-প্রসাদ মুখে দিয়ে বাড়ির সকল লোক উপোস ভঙ্গ করে। তিনদিন ধরে টানা গোটা গ্রাম ঝেঁটিয়ে এসে নিমন্ত্রণ খায়। সবচেয়ে অবাক হবার বিষয় হল এই যে, কাউকেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিমন্ত্রণ করে আসা হয় না। অতিথি নিজের থেকে আসে, আনন্দ করে বসে, নামগান শুনে হাসে - কাঁদে - ভক্তিবিহ্বল হয়ে কীর্তন দলের পায়ে লুটিয়ে পড়ে, ওখানেই খাওয়া দাওয়া করে ও বিদায় নেয়। আমাদের শহরের মানুষজন হয়ত এমন বিনা নিমন্ত্রণে কোথাও কোনদিন যায়নি। অন্ন গ্রহণ করা তো অনেক দূরের ব্যাপার। 

 একেক বছর বাড়ির একেক সদস্য চৈতন্য সেজে ওঠে। কখনো কোন শিশুকে যেমন সাজতে দেখি। কখনো দেখি, আমার জাঠতুতো কোন দাদাকে। যে পেশায় সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট মিলিটারি অফিসার কিংবা কলকাতা লালবাজারের পুলিশ। মনে মনে ভাবি, কোন শহুরে মানুষ হয়ত তার ইগোর জায়গা থেকে এমন গ্রাম ঘুরে ঘুরে মাধুকরী অর্জন করতে পারবে না। ধর্মীয় বিশ্বাস থাকলেও তার আত্মাভিমানের জায়গা থেকে কোথাও যেন আটকে যাবে। এইখানেই গ্রামের একটি ছেলে তার বংশপরাম্পরায় পাওয়া ধর্মীয় বিশ্বাস ও প্রভুভক্তির জায়গা থেকে এগিয়ে আছে শত-পা আগে। 

 আজও গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখতে পাই, প্রতিদিন বাড়ি থেকে অফিস বেরুনোর সময় দাদারা গুরুজনদের প্রণাম করে বের হয়। এখনও দাদার সামনে ছোট ভাই মাথা নিচু করে সম্ভ্রম নিয়ে কথা বলে। ডাক্তার দেখাতে গিয়ে ছোটজনকে যদি ডাক্তার প্রশ্ন করে, কোন নেশা-টেশা আছে নাকি, সত্যি কথা বলুন? দাদার সামনে ছোট ভাই লজ্জায় লাল হয়ে যায়। যারা দু'জনেই বয়সে মধ্য চল্লিশ পেরিয়ে গেছে। তবু শহুরে কায়দা রপ্ত করে এক গেলাসের ইয়ার হয়ে ওঠেনি। 

 একে অপরকে সম্মান দেওয়া ও শ্রদ্ধা দেওয়ায় কোন পরিবর্তনের হাওয়া ঢুকে পড়েনি গ্রামের বাতাবরণে। সেখানে পরিষ্কার আকাশের নীল রং চুরি করে যেমন চিল ডানা মেলে উড়ে যায়। তেমনি গাছের সবুজকে ভালবেসে মানুষের মনও চিরসবুজ হয়ে থাকে। কারুর মধ্যেই অহঙ্কারের বেগুনী রঙ প্রবেশ করতে পারে না। 

 শৈশবে গ্রাম থেকে যখন শহরে ফিরতাম, আমার হাতে জেঠু - জেঠিমারা দু'টাকা - পাঁচটাকা তুলে দিত। বলত, লজেন্স খাস। সারা পথ কল্পনা করতে করতে ফিরতাম ঐ টাকা দিয়ে কী কী কিনব। কখনো জমিয়ে রাখতাম। কখনো লালুভুলু, কারেন্ট নুন, মৌরিলজেন্স কিনে খরচ করে দিতাম। গ্রামের সেই চিরকালীন নিয়ম আজও আছে। আজ আমার ছেলেকে তার মামা-মামীরা হাতে গুঁজে দেয়, পঞ্চাশ-একশোর নোট। আজ সেও স্বপ্ন দেখতে দেখতে বাড়ি ফেরে স্পাইডার ম্যানের ছবি দেওয়া খেলনা কিনবে!নাকি সুইগিতে অর্ডার দিয়ে কিছু কিনে খাবে!
                                                                        ‌‌   (ক্রমশ...) 

ছবি: লেখিকা

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments