জ্বলদর্চি

মাটিমাখা মহাপ্রাণ। সতেরো/শুভঙ্কর দাস

মাটিমাখা মহাপ্রাণ। সতেরো
শুভঙ্কর দাস 

"যে পারে সে আপনি পারে
পারে সে ফুল ফোটাতে।
সে শুধু চায় নয়ন মেলে
দুটি চোখের কিরণ ফেলে, 
অমনি যেন পূর্ণপ্রাণের
মন্ত্র লাগে বোঁটাতে।
যে পারে সে আপনি পারে,
পারে সে ফুল ফোটাতে। "


গান্ধিজি আসছেন! গান্ধিজি আসছেন!

কলকাতায়... এই মহানগরে...

এই সংবাদ রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করেছে...

একজন আশ্চর্য মানুষ আসছেন! এমন একজন সংগ্রামী যিনি ঢাল-তলোয়ার অথবা বন্দুক ছাড়াই যুদ্ধ জয় করতে পারেন!এমন অদ্ভুত কথা জগতে কেউ শুনেছে? হ্যাঁ, তিনি পরাধীন ভারতবর্ষের লোক।অথচ তাঁর নাম এই মুহূর্তে সারা ভারতবর্ষসহ সেই সুদূর আফ্রিকা পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে!

ভাবতে পারিস কুমার,একজন মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অপমানের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন,কিন্তু অন্যের প্রতি কোনোরকম অস্ত্র না শানিয়ে,প্রতিপক্ষের প্রতি অসূয়া না পোষণ করে... তার নামও দিয়েছেন, সত্যাগ্রহ। বলে উঠলেন গঙ্গাধর।

সত্যাগ্রহ কী স্যর?

জিজ্ঞেস করল হিরন্ময়। 

 বিদ্যালয়ের বাগানে বিকেলে বসে আলোচনা সভা। এই সভায় সারা পৃথিবীর যত মহান মানুষ ও তাঁদের মহতী কর্ম আছে,তা নিয়ে আলোচনা করা হয়। এই আলোচনাসভার আয়োজন করেন কুমারচন্দ্র। তাঁর মনে হয়ছে,শুধু ক্লাসের মধ্যে বসে সিলেবাস আওড়ালে প্রকৃত মানুষ হওয়া যাবে না!তাই আগ্রহী ছাত্রদের নিয়ে এই ধরণের আলোচনা সভা প্রায় বসিয়ে থাকেন। শুধু আলোচনা করেই শেষ নয়, এই সময় চালু হয়ে করা হয়েছে সমবায় ছাত্র ভাণ্ডার। তার কাজকর্মও এই সভার মাধ্যমে পালিত হয়।অর্থাৎ হাতেকলমে মানুষের পাশে থাকার ব্রতপালন শিক্ষা প্রদান করা হয়। আজকের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু গান্ধিজি। হিরন্ময়সহ অন্যান্য ছাত্ররা সেইসব কথা আগ্রহ ভরে শুনছিল।
 
সত্যাগ্রহ মানে সত্য ও অহিংসার পথে চলা।কোনো অবস্থাতে কোনো অসুবিধায় সেই সত্য থেকে আগ্রহ যেন না কমে! লক্ষ্য থেকে যেন না বিচ্যুত হয়! বললেন কুমারচন্দ্র।

আমি বুঝেছি, তার মানে সত্যি কথা বলতে হবে এবং হিংসা করা যাবে না কাউকে।বলে উঠল অপর এক ছাত্র হরিসাধন।

হিরন্ময়, হরিসাধন ও প্রফুল্ল এরা বালিগঞ্জ জগবন্ধু ইনস্টিটিউটের ছাত্র, কিন্তু তারা কুমারস্যরকে এতবেশি মান্য করে যে, তাঁর সঙ্গে থাকতে এবং তাঁর কথা শুনতে ভালোবাসে।
প্রায় বিকেলবেলা বিদ্যালয় ছুটির পর তারা এই আলোচনাসভায় থেকে যায়।

হ্যাঁ, তাই, তবে এর গভীর অর্থ আছে।পরে আবার বুঝিয়ে দেবো।

কুমারচন্দ্র নিজেও অবাক। শুধু  সত্য ও অহিংসা দিয়ে ভয়ংকর শাসকের বিষদাঁত ও ছোবলকে প্রতিহত করা যায়! অথচ মানুষটি তাই করছে।
মানুষটির নামটিও অদ্ভুত! মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি। গান্ধি বলে কোনো টাইটেল হয়, এটাই কুমারচন্দ্র আগে শোনেনি! পরে অভিধান খুলে দেখেছে,গান্ধি শব্দের অর্থ গুজরাটী ভাষায় হল মুদী।
সেই সূদুর গুজরাটে বাড়ি,বিলেতে ব্যারিস্টারি পাশ করে সোজা চলে গেছেন দক্ষিণ আফ্রিকায়,সেখানেই তো এই রকম আশ্চর্য আত্মিক যুদ্ধের সূচনা। 

আচ্ছা, গান্ধীকে দেখতে কেমন? এই প্রশ্ন এলো কুমারচন্দ্রের মনে।

কী জানি ভাই,আমি কি আগে কখনো দেখেছি! তবে তাঁর সম্বন্ধে যা শুনছি,একেবারে সাধারণ মানুষ নন। গঙ্গাধরের উত্তর। 

যিনি মানুষের অন্তরের শক্তি জাগ্রত করেন, তিনি সাধারণ কি হতে পারেন? মৃদু স্বরে বলে উঠলেন কুমারচন্দ্র।

সেই সময় আলোচনায় প্রবেশ করলেন কংগ্রেসী মাস্টারমশাই।তাঁর নাম বিশ্বনাথ জোয়ার্দার ।তিনি এগিয়ে এসে বললেন,সকলে যদি সবকথা ঘরে বসে শুয়ে জেনে যাবে,তাহলে আমরা কী ঘাস ছিঁড়তে সম্মেলনে যাই!

আচমকাই এমন আক্রমণে সকলে একটু অবাক চোখে তাকালেন।
বিশ্বনাথ ঘাসের ওপর বসলেন না,তিনি একটু তফাতে একটি গাছের নিচে বেদী করা ছিল,তাতে বসে পড়লেন।

মানে? একটু বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন গঙ্গাধর। 

মানে আবার কী? আরে বাবা, আপনারা আলোচনা করছ,একজন নামকরা ব্যারিস্টারের সম্বন্ধে, তিনি কি আর আপনাদের মতো এলেবেলে লোক,তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ ইংরেজদের মতো,মাথায় পরে থাকেন মুকুট, যখন হাঁটেন,তখন কম করে দশবারো দাসদাসী সঙ্গে থাকেন,এমন কি থুতু ফেলার জন্য কেউ একজন পাত্র ধরে থাকেন,বুঝলেন ভায়া, এই আগে বাড়িয়ে আলোচনা করাটাই একধরনের মুর্খামি! 

ওহ্, কিন্তু আফ্রিকায় তো লড়েছিলেন দরিদ্র ও নিপীড়িত শ্রমিকদের জন্য লড়েছিলেন। সবাই তাঁকে বলতেন কুলি-ব্যারিস্টার।এবং এইসব শ্রমজীবী মানুষদের সেবার জন্য তিনি প্রাণপাত করেছেন।সহজ কণ্ঠে বলে উঠল,কুমারচন্দ্র। 

এই আপনার না জেনে বকবক করাটা একটা রোগ।আমি রাতদিন কংগ্রেসের সঙ্গে আছি, কংগ্রেসের অ্যাক্টিভ মেম্বার,আমাকেই গাজনের নতুন গল্প শোনাচ্ছেন! 

তাহলে আপনি বলুন,আমরা গান্ধী সম্বন্ধে জানতে চাই? তিনি কীভাবে সত্যাগ্রহের মাধ্যমে এই সব আন্দোলন করছেন? বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন কুমারচন্দ্র। 

কংগ্রেসী মাস্টার ঠোঁটের কোণে একটা ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললেন,ওরে বাবা, এত তাড়াহুড়ো কীসের? সত্যাগ্রহ কী? মাথায় মাখে না গায়ে পরে? এসব জানার দরকার কী? কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে এই ডাক পেয়েছেন গান্ধি, এর জন্যই এতো খবর এতো লোকটোকের আগ্রহ! ঐসব কোথায় কী সত্যাগ্রহ-ট্রহ করেছেন,হাতির মাথা না ব্যাঙের ছাতা,করেছেন, ওসব কিছু-টিছু নয়।সম্মেলনে ডাক পেতে হলে ইংরেজি জানতে হয়, বিলেত ফেরত হতে হয়, ভালো রকম ইংরেজিতে স্পীচ দিতে জানতে হয়,আর মিঃ গান্ধি সেসব ভালোরকম জানেন,তাই এতো নাম,হাঁকডাক!

কিন্তু গান্ধিজির সম্বন্ধে এই ইংরেজিতে কথা বলায় পারদর্শীতা ছাড়া আর কিছু জানেন? জিজ্ঞেস করলেন কুমার চন্দ্র।

কংগ্রেসী মাস্টারমশাই কিছু বলার আগেই গঙ্গাধর বলে উঠলেন,নিশ্চিত জানেন না,তাহলে দয়া করে শুনুন
অহিংসর কতখানি শক্তি গান্ধি তাঁর আন্দোলন দিয়ে বুঝিয়ে দেননি,না অস্ত্র নয়,একমাত্র সেবা দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকায় সবচেয়ে বড় সমস্যা, বর্ণবিদ্বেষ। শুধু গায়ের রঙ কালো বলে ইউরোপীয় শাসকেরা মানুষকে মানুষের মর্যাদা দিত না! তাদেরকে কুকুর-ছাগলের মতো কোনো প্রাণী মনে করত। ফলে গান্ধি সেখানে কালো মানুষের সম্মান রক্ষার জন্য গঠন করলেন নাতাল-ইণ্ডিয়ান কংগ্রেস। সেই কংগ্রেসের সমর্থনে অসংখ্য মানুষ যোগ দিল।তখন ইংরেজ রাজশক্তি এই আন্দোলন বন্ধ করার জন্য প্রচুর মানুষকে গুলি করে হত্যা করে এবং হাজার হাজার মানুষ কারারুদ্ধ হয়।তা সত্বেও গান্ধী অহিংসর পথ থেকে সরে আসেননি,এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর জয় হয়।

সত্যি!  অভিভূত হয়ে যাচ্ছি। হিরন্ময় বলে উঠল। কী আশ্চর্য সাহস!

আরে শোনো, হঠাৎ দক্ষিণ আফ্রিকায় শুরু হল গৃহযুদ্ধ। তার নাম, বুয়র যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ওলন্দাজ ও ইংরেজরা লড়াই করেছে।কিন্তু এই ওলন্দাজরা আসলে প্রকৃত অধিবাসী।গান্ধিজি কোনো পক্ষে যোগ দিলেন না,তিনি গঠন করলেন একটি সেবাদল।তাঁর সেবাদল যুদ্ধক্ষেত্রে ঘুরে ঘুরে আহত সৈনিকদের সেবা করতে লাগলেন।আবার নিজেই একটা অ্যাম্বুলেস টিম তৈরি সৈনিকদের হাসপাতালে আনার ব্যবস্থা করছেন।এর জন্য তাঁকে প্রায় ২৫ মাইল করে হাঁটতে হয়েছে। তাতেও তিনি দমেননি! 
সেই সেবা কোন্ মাত্রা স্পর্শ করেছিল,তার একটি উদাহরণ, যুদ্ধের সময় গোরা সৈন্যদের নিষ্ঠুরতা প্রবল বৃদ্ধি পেত।তাদের বলা হত টমি।একবার বন্দী ওলন্দাজ সৈনিক ও টমিরা একসঙ্গে যাচ্ছে। গান্ধিজি অসুস্থ সৈনিকদের চিকিৎসার জন্য তাদের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছেন, তাঁর হাতে স্টেচার। তার ওপর বাইরে চড়া-রোদ।সকলের তীব্র তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ ।সামনে একটা ঝর্ণা পড়ল।সকলে ভয়ে থমথমে। কে আগে জলপান করবে? বন্দীরা নাকি টমিরা? 
গান্ধী নিজেই এগিয়ে টমিদের জলপান করতে বললেন।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় অত্যাচারী ও নৃশংস টমিরা আহত সৈনিকদের আগে জল খেতে দিল।
এ সবই পরিবর্তন হয়েছিল,গান্ধীর সেবাকার্যের আন্তরিকতা ও পরিশ্রমের ফলে।
আবার শুরু হল জুলু বিদ্রোহ।
সেই সময় জুলু জাতির ওপর অন্যায়ভাবে কর চাপানো হয়। তারা সেই কর দিতে অস্বীকার করায় তাদের ওপর নেমে ভয়ংকর অত্যাচার ও শাসনের মার। ইংরেজ সরকার জুলুদের উচিত শাস্তি দেওয়ার জন্য প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিল জুলনেতাদের। এরপর তাদের বসতিতে আগুন ধরিয়ে দিল। সঙ্গে উপস্থিত হল ইংরেজ মারণবাহিনী। সেই সময় আবার গান্ধিজি তাঁর সেবাদল নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লেন জুলুদের বাঁচাতে।
ভাবতে পারো কুমার,মাইলের পর মাইল জনশূন্য। তার মধ্যে বড় বড় ঘাসের জঙ্গল। তার ভেতর দিয়ে গান্ধী পরম মমতায় সেবা করে চলেছেন জুলুদের। এমন দৃশ্য কল্পনা করে দেখো,একজন মানুষ কীভাবে সেবাকার্যের মাধ্যমে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি ও যুদ্ধবাজদের মনোভাব বদলে দিচ্ছেন।

আপনি এসব জানলেন কী করে? কংগ্রেসী মাস্টারমশাই সন্দেহজনক চাহনিতে জিজ্ঞেস করলেন।

দুটো জায়গা থেকে,এক ইণ্ডিয়ান ওপিনিয়ন পত্রিকা এবং গোপালকৃষ্ণ গোখলের মিটিং থেকে,সেই পত্রিকা সঙ্গে গোখলেই এনে ছিলেন। জানালেন গঙ্গাধর।

ওহ্, আমি জানলাম না,কংগ্রেসের প্রতিটি সম্মেলনে যাই,টাকা দিই,এবং পরের বারে বক্তব্যে সুযোগ পাবো বলে,একটা ইংরেজের স্কুলে ইংরেজি শিখতে শুরু করেছি।অথচ আপনি অকংগ্রেসী লোক,এসব জেনে গেছেন।কী করে হয়?  

আপনার প্রশ্নের উত্তর একমাত্র আপনার নেতারা দিতে পারবে মনে হয়, তবে গান্ধিজি আসছেন,সেই গান্ধিজি, যিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় জুলুদের এবং ভারতবর্ষের চম্পারণে ভাগচাষীদের জমিদারদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন কোনোরকম অস্ত্র না ধরেই! 

সে তো আসছেন,জানি,তবে মিঃ গান্ধির সঙ্গে কী যে কেউ দেখা করতে পারবে?  
বেশ গোঁফ ফুলিয়ে ঘোষণা করলেন কংগ্রেসী মাস্টারমশাই বিশ্বনাথ। তিনি কি আমার-আপনার মতো পায়ে চলা মানুষ,আরে এলে তিনি গর্ভনরের গাড়িতে আসবেন এবং সেই গাড়ির পর্দার রঙ ও পুরুত্ব ভেদ করে যদিবা দর্শন করা সম্ভব হয়, তাহলে তা ভাগ্য। তারপর সরাসরি মিঃ এম কে গান্ধী কংগ্রেসের অফিসে আসবেন তখন আমরাই তাঁকে সংবর্ধনা দেবো।

বাহ্, আপনি এখানকার কর্মসূচি সবই তৈরি করে ফেলেছেন! গঙ্গাধর বলে উঠলেন।

কুমারচন্দ্র শুধু দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে আপনমনে বলে উঠলেন,গান্ধিজিকে একটিবার দর্শন করা যায় না?

সেই কথা শুনে গঙ্গাধর বলে উঠলেন,গান্ধীদর্শন।আরে চিন্তা কী? এই তো আমাদের কংগ্রেসী লোক আছে,উনিই তো ব্যবস্থা করবেন,তাই না?

হ্যাঁ,তা একপ্রকার বলা যায়। বেশ উঁচু গদিআঁটা মঞ্চ, ধবধবে সাদা চাদর,পাশবালিশ, লাল রঙের গালিচা, গোটা চারেক মাইক।ঝাড়-লন্ঠন প্রায় পঞ্চাশটি, তারপর আশেপাশে বারোটি স্কুলঘর নেওয়া হয়েছে, ডেলিগেটসদের জন্য। এবং জানিয়ে রাখি,ডেলিগেটদের থাকার ও খাওয়ানোর দায়িত্ব আমার,তাই কতখানি ব্যস্ততা বুঝতেই পারছেন!
তারপর কংগ্রেসী মাস্টারমশাই জিভে চুক চুক শব্দ করে বলে উঠলেন,আমাকে যদি একমাস আগে বলতেন,তাহলে একটা এন্ট্রি  পাশ জোগাড় করে দিতাম।

কীসের পাশ মাস্টারমশাই? একটু দূর থেকে হাঁটতে হাঁটতে এসে জিজ্ঞেস করলেন মুরলিধর বন্দ্যোপাধ্যায়। বিদ্যালয়ের সেক্রেটারি। 
তিনি আলোচনায় মাঝখানে উপস্থিত হলেন। তিনি খুবই খুশি কুমারচন্দ্রের এই ছাত্রসভার আয়োজন।তাই মাঝেমধ্যেই নিজেই দেখতে চলে আসন। কিন্তু এই নামে কংগ্রেসী করা মাস্টারমশাই পশ্চাতে কলকাঠি করা মুরলীধরের অপছন্দ।বোর্ডের অন্যান্যা সদস্যের কুমারচন্দ্রের বিরুদ্ধে নালিশ করেই যাচ্ছেন। এমনি কি কুমার মাস্টারমশাই এই ছাত্রসভার নামে বিপ্লবাত্মক  কর্মসূচী করছেন,ছাত্রদের মগজধোলাই করে ক্ষেপাচ্ছেন,এইসব অভিযোগ প্রিন্সিপালকেও করেছেন। অথচ নিজের হাতে কুটো নাড়তে পারেন না!
এখন নিজেকে কংগ্রেসের কেউকেটা ভেবে বড় বড় লেকচার দিতে পারলে আর কিছুই চান না!

ও কিছু না,আমরা মানে কংগ্রেসীরা ফিল্ড ওয়ার্ক করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি,মিঃ এম কে গান্ধীকে সংবর্ধনা দেবো,সেই অনুষ্ঠানের এন্ট্রি পাশের কথা...

কথাটি শেষ হতে দিলেন না মুরলীধরবাবু,কীসের অনুষ্ঠান? কংগ্রেসের অনুষ্ঠান তো? তাকে বিপ্লবী নেতা অশ্বিনী কুমার দত্ত কী বলেছিলেন মনে আছে তো? তিন দিনের তামাশা? দারুণ সাজানো গোছানো মঞ্চ, উদ্বোধন জাঁকজমকপূর্ণ। বড় বড় নেতারা ইংরেজি বক্তব্য দিতে একবারে বান ডাকিয়ে দেন।দেশের মানুষ কেউ কিস্যু বুঝতে পারে না,জানতে পারে না,কী যে হচ্ছে!  এই হচ্ছে কংগ্রেস!  
তারপর বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের মতামত আরও ভয়ংকর, তিনি তো কংগ্রেসী দেখলেই খাপ্পা। বলেন, ওতো কিছু বড়লোক ও ব্যারিস্টারের আড্ডাখানা। চোস্ত ইংরেজি বুলি বলে ভিক্ষা চাওয়া,কোনোদিন কোনো অধিবেশনে স্বাধীনতার কথা বলতে পারে না, শুধু কয়েকটা মিউনিসিপ্যালিটি- করপোরেশনে প্রতিনিধি রাখার অনুরোধ, তারপর ওপর আপনারা বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়।গান্ধিজি আসছেন,যে ইচ্ছে করবে তাঁকে দেখতে পারবে এবং দেখা করতে পারবে। 

কংগ্রেসী মাস্টারমশাই বিশ্বনাথ  একেবারে চুপ করে গেলেন।

কুমারচন্দ্রের মুখ আলোকিত হল।তিনি গান্ধিজি নামের মধ্যে দিয়ে একটা যেন পথের আভাস পাচ্ছিলেন।সত্যি তো, মানুষকে আগে ক্ষুধার জন্য অন্ন,মাথার জন্য ছাদ এবং লজ্জানিবারণের জন্য বস্ত্র যথাযথভাবে তুলে ধরতে হবে। অর্থাৎ সেবা। সেবা করতে হবে। তারপর তো স্বাধীনতা? স্বাধীনতা মানে কী অস্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে অস্ত্রধারণ। একে- অপরকে হত্যা ও হিংসা করে সিংহাসনজয়! স্বাধীনতা মানে হল,নিজের অধীনে থেকে কাজ শুরু করা। কিন্তু এই নিজস্বতা আসবে কী করে? আমাদের দেশের কটা মানুষের নিজস্ব সম্মান ও বোধ আছে? কটা মানুষ বোঝে পরাধীনতা আসলে কী? অথবা স্বাধীনতা এলে কী হতে পারে?

সহসা কুমারচন্দ্র তাঁর সেই গ্রাম বাসুদেবপুরে চলে গেলেন মনের চিন্তায়...

তাঁর মনে পড়ল,যখন তিনি জমিদারের গৃহে চাকরের কাজ করতেন,তখন প্রতিদিন একটি গোয়ালা দুধ দুইতে আসত। তার নাম ভগীরথ। বয়স হয়েছে। কোমরটা কুঁজো।সে প্রায় সন্ধ্যা নামার ঠিক মুখে এসে গোয়ালের ঢুকে যেত।
সে একবার বলেছিল কুমারচন্দ্রকে, দাদা,আমি পৃথিবী ভ্রমণ করেছি,জানো কতদূর যাই হেঁটে? একেবারে সেই সাতটা ধু ধু মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে সরকারি ডাকঘরের কাছে যাই,আর একটু গেলেই পৃথিবী শেষ প্রান্ত। সেখানে শুধু সমুদ্র আর সমুদ্র। এই সব জমিজমা এবং সমুদ্র জমিদারের জিনিস,জমিদার ছাড়া এই ভুবন চালাতে পারে কেউ? তুমি খবরদার ডাকঘরের বাইরে যেও না! খুব বিপদ। সমুদ্রের জলে কূলকিনারা পাবে না! একেবারে ডুবে যাবে,ডুবে যাবে!
আবার সন্ধ্যামণি বলে একজন বিধবা একবার কুমারের মায়ের কাছে এসে প্রচণ্ড কান্নায় ভেঙে পড়ে।কারণ তাকে তার বাপ কলকাতায় নিয়ে গিয়ে যাবে! তা শুনে তার চোখ-মুখ এতো ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যায় যে,দাঁতে দাঁতে লেগে যায়,কারণ কলকাতায় নাকি মানুষকে গোরারা বাঘ-ভালুকের সঙ্গে এক খাঁচায় বন্দী করে রাখে!
দুটি-তিনটি গ্রাম পেরিয়ে পুজো সেরে আসা কিশোরমোহন মনে করে এতো দূরে পুজো করে সে যে প্রাণে ফিরতে পারে,এই ঠাকুরের সেবার জোর!
গাঁয়ের বেশির ভাগ মানুষজন গায়ে-গতরে খেটে সুজ্জি ডুবলে প্রদীপ নিভিয়ে শুয়ে পড়ে। কী দেশ? কে দেশ চালাচ্ছে?  জমিদার না মহাজন? গোরা না পল্টন?  এই সব চিন্তাকে রূপকথার গল্পের মতোই মনে করে!।তার ওপর কী একটা কংগ্রেস দল? অথবা গুপ্তসমিতি? এইসব কথা তাদের মাথার চারশো মাইলের মধ্যে আসে না!
ইসমাইল বলে এক তাঁতি একবার কাঁথি পর্যন্ত গিয়ে ভালো সুতো কিনে এনেছিল,সেটাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা।হরিপদ এক চাষা একবার একজন জমিদারের পেয়াদার কানে কামড়ে দিয়েছিল,সেই ঘটনা মহাবিপ্লবের গল্প হয়ে এখনও লোকের মুখে মুখে ঘোরে!
আর রইল জমিদার- মহাজন?
এবার গ্রামে শীতলাপুজোয় বা শিবরাত্রিতে কোন্ যাত্রাদল আসবে? সেই চিন্তায় আকাশ-পাতাল এক করে দিচ্ছে! কখনো ছেলের বিয়ে বা কখনো মেয়ের স্বাদভক্ষণ, এই নিয়ে মেতে আছে।
তারপর বুড়ো চণ্ডীমণ্ডপতলায় বসে বৃদ্ধ মোড়ল হুঁকো টানতে টানতে ভ্রূ কুঁচকে গম্ভীর কণ্ঠে বিচার করছে, বৃহস্পতিবার কী করে তরকারিতে মাছের কাঁটা এলো?
এ যে ঘোর কলিকাল।একটু সতর্ক হয়ে চলতে হবে।
তারপর কাকে গাঁয়েদেশে একঘরে করতে হবে,কার মেয়ের বয়স পেরিয়ে গেলেও বিয়ে হচ্ছে না! কার বিধবা মেয়ে পুকুরঘাটে একটু বেশি সময় পা ঘষেছিল,হারান মুদি ডালের দাম দশ পয়সা বেশি নিল কী করে? এসব জোরজুলুম করা চলবে না,নিচু জাতের রহিম সেখ কোন সাহসে চণ্ডীমণ্ডপে দাওয়ায় বসে ঘাম জুড়ায়?সেইসব নিয়ে আকাশ বিদীর্ণ করছে।

এই হল সমগ্র ভারতবর্ষ। কুমারচন্দ্র নিজের গ্রাম দিয়ে গোটা ভারতবর্ষকে দেখতে পেলেন।এবং বুঝল,এই যে দেশটা পরাধীন এবং পরাধীন হওয়ার ফলে কী ক্ষতি? তা দেশের জনসংখ্যার কজন জানে? অথবা জানতে পারে?
তাঁর গ্রামে তো সেই বিরল কয়েকজনের মধ্যে একজন, যে পড়াশোনার জন্য কলকাতায় এসেছে! সহসা কুমারচন্দ্রের মনে পড়ল  আব্দুল ফকিরের গান, কতদিন লোকটার সঙ্গে দেখা হয় না! কেমন আছে কে জানে? গানটা কিন্তু কুমারচন্দ্র ভোলেননি!

"ওরে অনুমানে ভাবলে মানুষ ধরা যাবে না।
যদি বর্তমানে ধরতে পার,নইলে পারবে না।
সেই মানুষ করছে খেলা
আর সেই মানুষ করছে লীলা
যদি মানুষ দেখে করছ হেলা তবে কিছুই হবে না।
আমি শুনি সাধুজনার কাছে
এই মানুষে সেই মানুষ আছে?
তুমি যুক্তি নাও গে গুরুর কাছে,নইলে পাবে না।
সেই মানুষরূপে নন্দের ঘরে
আর মানুষ রূপে বলির দ্বারে 
সেই মানুষ আছে সব আধারে
পাগলা মন চিনতে পারব না।
দাস রঘুনাথের এই বাসনা
সেই মানুষ করি উপাসনা... "

কুমারচন্দ্র দাঁড়িয়ে স্থির হয়ে ছিলেন। তিনি চিন্তায় মগ্ন।মুরলীধরবাবু হঠাৎ এরকম স্থিতাবস্থা দেখে অবাক।জিজ্ঞেস করলেন, কুমারবাবু কী হল?

সহসা যেন ঘোর ভাঙল কুমারচন্দ্রের। তিনি মুখে শুধু একটি কথা উচ্চারণ করলেন,আমি গান্ধিজিকে দেখতে চাই....

ক্রমশ.....

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments