জ্বলদর্চি

জঙ্গলমহলের প্রান্তিক শ্রেণীর নারী সমাজ/সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি

পর্ব - ১৭

জঙ্গলমহলের প্রান্তিক শ্রেণীর নারী সমাজ

সূর্যকান্ত মাহাতো

ওরা অপাংক্তেয়। ওরা ব্রাত্য। ওদের নিয়ে কাব্য কবিতা রচিত হয় না। ওদের নিয়ে কারুর তেমন উৎসাহ নেই। ওদের বীরত্ব গাথা রচিত হয় না। ওদের কথা শোনার কারও  আগ্রহ নেই। ধৈর্যও নেই। সেসব নিয়ে ওদেরও আক্ষেপ নেই। এটা ওদের অভ্যাস হয়ে গেছে। নিজেদের মতো করে বেঁচে থাকাটাই ওদের কাছে সব। বিলাসিতা ওদের কাছে স্বপ্ন। বরং লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর উক্তিটিই ওদের মূল মন্ত্র। "আরাম হারাম হ্যা।" সারাদিন মাঠে ঘাটে হাটে পরিশ্রম করেই ওরা দিনাতিপাত করে।

হ্যাঁ, ওরা হল মিনতি, মালতি, ললিতা, শুক্লা, যমুনার মতো জঙ্গলমহলের অন্ত্যজ শ্রেণীর নারী সমাজ। সমগ্র জঙ্গলমহলের ৮০ শতাংশ মহিলা এরাই। চার দেওয়ালে ওরা বন্দি নয়। খোলা আকাশের নিচেই ওদের কর্মব্যস্ত দিন যাপন। পুরুষদের সঙ্গে সমান ভাবে ওরাও কাজ করে চলে। কেমন সেই দিন লিপি?

অনেক বেলা অব্দি ঘুমানোর অভ্যাস নেই ওদের। কাকভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়তে হয়। কারণ ওদের যে অনেক কাজ। ঘরের মরদগুলো বরং গায়ে রোদ না পড়লে উঠে না। কিন্তু ওদের সেটা চলবে না। ঘুম থেকে উঠলেই তো হাজারটা ঘরের কাজ। উঠোনজুড়ে ঝাট দিতে হয়। বাসনগুলো মাজতে হয়। হাঁড়ি কড়াগুলোর পেটে একটা পায়ে ভর দিয়ে অদ্ভুত কায়দায় ঘুরে ঘুরে মাজে। মনে হয় যেন একটা নির্দিষ্ট ছন্দে নাচ করছে।  দূরের নলকূপ থেকে নিয়ে আসতে হয় পানীয় জল। সেই সঙ্গে চলে পোষ্য গোরু ছাগল ভেড়ার পরিচর্যা। তারই ফাঁকে পোড়া কাঠে ফুঁ দিয়ে দিয়ে উনুন ধরাতে হয়। ধোঁয়ার সঙ্গে তখন চলে কান্নার লুকোচুরি খেলা। সবশেষে বসে রান্না। 

ওমা! ভুলেই গেছিলাম। এরই ফাঁকে বাচ্চা ও স্বামীর চা কিংবা জল খাবার বানাতে হয়। কাজ যেন  ফুরোতেই চায় না। ঘরের কাজের কী আর শেষ থাকে! বেলা বাড়তে থাকে। এদিকে পেটের ক্ষুধাও চড়চড় করে ওঠে। মেয়ে বলে আর কত সইবে? ওটাও তো একটা শরীর! সে কি আর কথা শুনে! একটু ফুরসত পেলেই খেতে হয়। সেই সময়টুকু হতে হতেই রোজ ন'টা থেকে দশটা বেজে যায়। সেই রাত আটটাই খেয়েছিল।তারপর সকালের প্রথম খাবার এটা। এ কারণেই কত জনের প্রেশার কমে যাচ্ছে। শরীরে দুর্বলতা। মাথা ঘোরা। মাথা ব্যথা।এমন উপসর্গ তো লেগেই আছে। খায় বলতে  জলে ভেজা মুড়ি, নয় তো রুটি। চা কেউ খায়, কেউ পায় না। বেশির ভাগই খায় ফ্যান-ভাত। অনেকে একে মাড় ভাতও বলে। সঙ্গে আলু সেদ্ধ। কখনো কুমড়ো লাউ কিংবা শুশনি শাকের ভাজা।
সকালের খাবার খেয়েই বেরিয়ে পড়তে হয়। ঘরে থাকলে ওদের সংসার চলে না। কেউ যায় হাটে।কেউ যায় ঘাটে। কেউ যায় মাঠে। সিজন অনুযায়ী চলে শস্য রোপনের কাজ। নয়তো জমির আগাছা পরিষ্কার। নইলে শস্য কাটার কাজ। এই যেমন ধানের চারা ফেলার সময় পুরুষেরা লাঙল করে। আর ওরা জমির ঘাস পরিষ্কার করে। পরে ধানের চারা টেনে টেনে ওরাই জমি থেকে তুলে। এক হাঁটু কাদায় দাঁড়িয়ে সেই চারাগুলো জমিতে লাগায়। একটানা পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টা নুয়ে নুয়ে ওদের কাজ করতে হয়। কোমরটা যন্ত্রণায় কটকট করে। একটা ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে। তবুও ওদের কাজ করে যেতে হয়। খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য। ছোট ছোট শখ পূরণের জন্য। সন্তানের স্বপ্নপূরণের স্বপ্ন দেখার জন্য।

সারাবছরই ক্ষেতে খামারে ওদের কাজ করতে হয়। ধানের চারা লাগানো, আগাছা পরিষ্কার, ধান কাটা, মাথায় করে বয়ে আনা, ঝাড়াই, মাড়াই এসবকিছু তো আছেই। অন্যান্য শস্য যেমন গম সরিষা তিল আলুর মতো ফসলও  লাগানো কুড়োনোর  কাজ করতে হয়। সেইসঙ্গে একাধিক সবজিরও চাষ করে পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। একমাত্র লাঙল করা আর ভারী কাজে কোদাল চালানোর মতো কাজগুলো কেবল পুরুষেরা করে থাকে। বাকি সব কাজই ওদের মতো মেয়েরা করে।

দিনের শেষে ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে বাড়ি ফিরে। স্নান করে সকালের রান্না করা ঠান্ডা ভাত খায়। একটু পরেই উঠোন জুড়ে সন্ধ্যা নামে। তখন তুলসী তলায় ওরা প্রদীপ জ্বালায়। রাতের খাবার বানায়। সকলকে খাইয়ে-দাইয়ে তারপর বিছানায় যাওয়ার সুযোগ মেলে। রাত্রি নটা বাজার আগেই ওরা ঘুমিয়ে পড়ে। কারণ ফের কাকভোরে উঠতে হবে।

কেউ কেউ আবার দিনভর গুনগুন সুরে গান করতে করতে জঙ্গলে পাতা তুলে। পড়শিদের চর্চা করে। কেউ ইট ভাটায় কাঁচা কাঁচা মাটির দলা পাকিয়ে ইট বানায়। কেউ রাজমিস্ত্রির সহযোগিতা করে। কেউ দিনভর শ্রমিকের কাজ করে। কেউ বা পোড়ামাটির দ্রব্য বানায়। তবে ওদের বেশিরভাগটা চাষের কাজেই যুক্ত থাকে।

ওরা স্বল্পশিক্ষিত। ওরা নিরক্ষর। শরীর পরিচর্যা করার সময় ও বিলাসিতা ওদের নেই। ফর্সা চামড়াগুলো রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। ওদের নরম গোলাপি গালগুলোও রোদে পোড়া। সৌন্দর্যের আহামরি ভাব নেই। কেবল সাবান দিয়ে বারবার মুখ ধোয়াটাই ওদের কাছে রূপচর্চা। মাথায় চপচপে নারিকেলের তেল দেওয়াটাই ওদের কাছে বিলাসিতা। খুঁচি করে শাড়ি পরাটাই ওদের কাছে ফ্যাশন। সেটাও আবার সকলের জুটে না। শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, সুগন্ধি তেল ওদের কাছে দুঃস্বপ্ন।

ওরা পুরুষের অধীন নয়। বরং অনেক বেশি স্বাধীন। নিজস্ব মতামত প্রকাশ করতে পারে। সহজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে। স্বামীরা কেবল বকলমে অভিভাবক। ওদের উপর পুরুষতান্ত্রিকতা ফলানো যায় না। কারণ ওরাও পুরুষদের সমকক্ষ হয়ে কাজ করে। বরং পুরুষদের তুলনায় বেশিই। ওরাই পরিবারের মূল চালিকাশক্তি। স্কুলের অভিভাবক সভা কিংবা জনসভাতেও ওরা এখন অংশগ্রহণ করে। জঙ্গলমহলে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি ওরাই। ওদের সংগ্রামী জীবনের সুতোর জালেই অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে। 

কেউ অন্যায় করলে ওরা পাড়া মাথায় করে ঝগড়া করে। আবার দলবদ্ধ ভাবে পরনিন্দা পরচর্চায় সময় কাটায়। ওরা একটু পরশ্রীকাতরও বটে। এ কারণেই বাংলা সিরিয়ালগুলো ওদের অধিক পছন্দের। বিয়ের অনুষ্ঠান কিংবা 'জাওয়া' ও 'করম' পরবের মতো অনুষ্ঠানে ওরাও নেচে ওঠে। কোমর দোলায়। গান করে।

কারও স্বামী মদ খেয়ে বাড়ি ফিরে। বউ পিটিয়ে মাঝে মাঝেই বীরত্ব দেখায়। তবুও স্বামীর মঙ্গল কামনায় সেই ওরাই ব্রত ও উপবাস রাখে। কায়িক পরিশ্রম আর ব্রত রেখে রেখে ওদের শরীরগুলো অপুষ্টিতে ভেঙে পড়ে। গলার হাড়গুলো কঙ্কালের মতো বেরিয়ে থাকে। সংসারের সুখ ও শান্তির জন্য তবু কী দারুণ আত্মত্যাগ! 


ওদের জীবন খুব কষ্টের। এই গ্রীষ্মের প্রচন্ড তাপ প্রবাহেও ওরা একশো দিনের কাজে মাটি কাটছে। মাথায় করে মাটি বইছে। তাই ওরা চায় না ওদের মেয়েরাও ওদের মতোই হোক। তাই ওরা কন্যাদের লেখাপড়া শেখাচ্ছে। আজ জঙ্গলমহলের স্কুলগুলোতে চোখ রাখলেই সেটা চোখে পড়ে। মেয়েদের উপস্থিতি সেখানে ছেলেদের থেকে অনেক বেশি। মাধ্যমিক পরীক্ষাতেও সংখ্যাটা ছেলেদের থেকে অনেক বেশি। এই পরিবর্তনটা ওদের মতো মায়েদের কাছে দারুণ খুশির ও গর্বের।

ওরা নিরক্ষর। তবুও ওরা স্বপ্ন দেখে পরিবর্তনের। একটু একটু করে সেটাও সম্ভব হচ্ছে। জঙ্গলমহলের মেয়েরা তাই একাধিক ক্ষেত্রেই যোগ্য হয়ে উঠছে। নানান জায়গায় তাদের প্রতিভা বিকশিত করছে। ফুটবল, কাবাডি, ভলিবল সহ অন্যান্য খেলাধুলায় জেলা স্তর, রাজ্য স্তর এমনকি দেশের হয়েও নজর কাড়ছে। আন্ডার এইট্টিন ফুটবল প্রতিযোগিতায় ভারতের হয় অনিতা মাহাতো যে পারফর্ম করে চলেছে সেটা একটা মস্ত বড় দৃষ্টান্ত। ওদের পরিবারেই তো অনিতার জন্ম। মাড় ভাত খেয়েই তো তার বেড়ে ওঠা। পছন্দের খেলাকে ধ্যান জ্ঞান করে এমন একটা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারছে এটাই বা কম কিসের! বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষাতেও অনেকে এখন পাস করছে।

কারও কারও মাথায় বংশ কৌলিন্যের ঘোমটা আছে। কারওর সেটা নেই। তবে সকলের মাথাতেই ঘোমটার উপর একটা বোঝা থাকে। সেটা শস্যের বোঝা, নয় তো পাতার বোঝা, কিংবা ঝুড়ি- ঝাঁটি নয় তো কাঠের বোঝা। কখনও আবার একশো দিনের কাজে ঝুড়ি ভর্তি মাটির বোঝা। সেইসঙ্গে সংসারের বোঝা অদৃশ্য ভাবে তো আছেই।

অনেকের চোখে ওরা ব্রাত্য। ওরা রুচিহীন। ওরা অশিক্ষিত। কিন্তু প্রতিভায় ওরা কোনও অংশে কম যায় না। সৃজনশীলতায় ওদেরও জুড়ি মেলা ভার। ওরা হয় তো কবিতায় শব্দ বুনতে পারে না। কিন্তু নকশিকাঁথা বুনে। শাল পাতাগুলো জুড়ে জুড়ে গোলাকার থালা বুনতে পারে। ওরা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে দিয়ে ঠেকা বুনে। কুলা বুনে। আঙিনা জুড়ে আলপনা এঁকে সৃষ্টিগুলো ফুটিয়ে তুলে। দামি তুলি ও রং নেই ওদের হাতে। তবুও দেওয়াল জুড়ে কত সব রঙিন ছবি আঁকতে পারে। জঙ্গলমহলের মাটির বাড়ির দেওয়ালগুলোতে চোখ রাখলেই সেটা দেখা যাবে। দাবা নয়, সাপ-লুডোও নয়, কেবল 'অষ্টা' খেলেই ওরা বুদ্ধিতে বাজিমাত করে দিতে পারে। শীতের মিষ্টি রোদে কিংবা গ্রীষ্মের অলস দুপুরে 'অষ্টা', 'বাঘ- ছাগল' এমন কতসব বুদ্ধিদীপ্ত খেলা খেলে ওরা। হয়তো আবৃত্তি করতে পারে না। কিন্তু ছেলেভুলানো ছড়া বলতে পারে। ছেলেভুলানো গান গাইতে পারে। সংসারের কোথায় কী আছে সেটা ঝরঝর করে মুখস্ত বলে দিতে পারে। ওরা গল্প লিখতে পারে না। কিন্তু কতসব গল্প বলতে পারে। ওরা আধুনিক পুতুল বানাতে পারে না। কিন্তু পোড়ামাটির অসম্ভব সুন্দর সুন্দর জিনিসপত্র বানাতে পারে। সুন্দর সুন্দর পাথরের পাত্র বানাতে পারে।

গোটা জীবনটাই ওদের অনিশ্চয়তায় ভরা। তাই ওরা প্রচন্ড রকমের ধর্মভীরু হয়। সর্বদাই দৈব নির্ভরশীল। ঈশ্বর বিশ্বাসী। মন্দির ও ধর্মস্থানগুলোতে ওদের ভিড় উপচে পড়ে। নানান রকমের কুসংস্কারে বিশ্বাস করে। এই দুর্বলতার কারণে ওদেরকে তাই নানাভাবে ঠকতেও হয়।

ওরা একে অপরের সঙ্গে ঝগড়া করে। আবার একে অন্যের বিপদে ঝাপিয়েও পড়ে। প্রচন্ড আবেগ প্রবন। হ্যাঁ। এমনটাই ওদের জীবন। কত বৈচিত্রে ভরা। সাহিত্য ও সিনেমার কতসব উপাদান আছে ওদের জীবনযাত্রায়। তবুও ওরা তেমন একটা চোখে পড়ে না। সত্যজিৎ মানিক তারাশঙ্কর কিংবা নলিনী বেরা সে সব দেখিয়ে দিলে তখন আমাদের চোখে পড়ে। আজকাল তো সাহিত্য কিংবা চলচ্চিত্র দুটোই অত্যন্ত নগর কেন্দ্রীক হয়ে পড়েছে। অথচ এরাই একদিন স্তব্ধ হয়ে পড়লে, সবকিছুই স্তব্ধ হয়ে পড়বে। ট্রেনের চেন টেনে থামানোর মতোই।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

4 Comments

  1. Replies
    1. এদের ই গর্ভে জন্ম আমাদের। এঁরাই প্রকৃত ভারত মাতা। বর্ণ লাঞ্ছিত সমাজে এরাই নানা নির্যাতনের শিকার। বিকারগ্রস্থ এ শ্রেণী সমাজ। নীতীশ বিশ্বাস। ঐকতান।

      Delete
  2. Very nice description. Thank you

    ReplyDelete