জ্বলদর্চি

গ্রামের শহুরে রূপকথা -১৭/সুরশ্রী ঘোষ সাহা

গ্রামের শহুরে রূপকথা

 সুরশ্রী ঘোষ সাহা

সপ্তদশ পর্ব : পাল্কি

খুটখুট খুটখুট করে ঠুকে ঠুকে অনেকক্ষণ ধরে কাঠের কাজ করছিলেন, আর বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন ভদ্রলোক। আমার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলেন, আমি কেন ওঁর গুমটি দোকান-ঘরের ভিতরে তাকিয়ে আছি। কী দেখছি অমন করে! 

 ঐটুকু দোকান ঘরের ভিতরে একদিকের দেওয়ালে একটা ছবি টাঙানো রয়েছে। আমি সেই ছবিটার দিকেই বহুক্ষণ ধরে তাকিয়ে ছিলাম। শেষমেশ প্রশ্নটা করেই ফেললাম। আচ্ছা, ওটা কি পাল্কির ছবি?

 কালো বুরুশ করা গায়ের রঙ, খেটে খেটে হাতের চামড়ায় শক্ত কড়া পড়ে গেছে। মুখ তুলে আমার দিকে আবার তাকালেন তিনি। তারপর কাজ করতে করতেই মাথা দুলিয়ে 'হ্যাঁ' বললেন।

 আমি আরো প্রশ্রয় পেলাম ওঁর সাড়া পাওয়ায়। বললাম, একটু ভিতরে ঢুকে দেখব কাছ থেকে? অমন একখানা কাঠের দোকানে ঝকঝকে কাচের ফ্রেমে পাল্কির ছবিটা সত্যিই নজর টানার মতো। আমাদের প্রজন্মের কেন, আমার অনেক আগের প্রজন্মের মানুষও ঐ জিনিসটা সামনে থেকে দেখেছে বলে মনে হয় না। ছোট থেকে শুধু বইয়ে পড়েছি আর এমন ছবিতেই দেখেছি।

 উনি ঘাড় নেড়ে ভিতরে ঢুকতে বললেন। দুয়ার ছেড়ে আরো খানিক সরে বসলেন। 

 কাছে গিয়ে দেখলাম ছবির কাচটাই চকচক করছে শুধু। ভিতরের ছবিটা হলুদ হয়ে এসেছে। ছবির কাগজেও ফুটো ফুটো হয়ে গেছে। 

 ভদ্রলোকের খুটখুট হাতের কাজ শেষ হয়েছে। তিনি এবার একটা কাঠের ঠাকুরের সিংহাসনে প্রাইমা লাগাতে বসলেন। নিশ্চয়ই ওটা উনি অর্ডার পেয়ে নিজের হাতে বানিয়েছেন। আজ প্রাইমা লাগিয়ে রোদ দেবেন। তারপর কাল রঙের পোচ লাগিয়ে রোদ খাইয়ে শুকিয়ে উঠলে, ট্রলি করে কাঠের সিংহাসন দুলতে দুলতে পৌঁছে যাবে মালিকের বাড়িতে।

 আমি একটা টুল টেনে ওঁর পাশে গিয়ে বসলাম। সেজদা আমাকে ওখানে 'একটু দাঁড়া, একটা কাজ সেরে আসছি' বলে সেই যে কখন গেছে, এখনো আসার নাম নেই। রোদে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে দাদুর এই দোকানের ছাওয়া অনেক ভাল। 

 ওঁর সাথে গল্প জুড়লাম। জানতে চাইলাম, দাদু, ঐ পাল্কিটা কি আপনাদের ছিল?

 উনি হলুদ হয়ে যাওয়া দাঁত বের করে হাসলেন। তারপর বললেন, ওই জিনিসটা আমার দাদুর আমলের জিনিস। তবে আমাদের নয়। আমরা গরিব মানুষ। আমাদের নিজেদের পাল্কি থাকবে কীভাবে? আমরা হলাম গিয়ে পাল্কি বাহক কাহার সম্প্রদায়ের মানুষ। সামনে যে বাহক দেখতে পাচ্ছ, সেটা আমার বাবা। আমার বাবা, দাদু, তার বাবা সবাই সারাজীবন গ্রামের পথে পাল্কি বহন করেই জীবন চালিয়েছেন। তবে পরের দিকে পাল্কির আর তেমন চল ছিল না। অথচ আগে গ্রামের বড় বড় এম.বি.বি.এস ডাক্তাররা রোগি দেখতে যেত পাল্কি চেপে। বিয়ের বর কনে বিয়ে করতে যেত, আসত বা বিয়ের পর পর বাপের বাড়ি শ্বশুর বাড়ি করত পাল্কিতেই। যারা একটু অবস্থাপন্ন ছিল, তাদের ঘরের পুরুষ-মহিলারা খুচখাচ বেরুতেও পাল্কি চাপতো।বড়লোক জমিদারদের নিজেদের বাড়িতেই পাল্কি রাখা থাকত। সারা বছরের জন্য বাহক পুষতো তারা। 

 মনে মনে বুঝলাম, এখন যেমন বড়লোকদের ড্রাইভার রাখা থাকে। তবে দুটোর মধ্যে ফারাকটা ভাবতেই অবাক হয়ে গেলাম। কত ঐতিহ্যবাহী জিনিস চিরকালের জন্য হারিয়ে গেল সমাজ থেকে। আবার উঠে পাল্কিটার ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে পড়ল, শান্তিনিকেতনের মিউজিয়ামে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহে যে পাল্কিতে চেপে ঘুরতেন সেটা দেখেছিলাম। আর আজ দেখলাম, এক পাল্কি বাহকের ছেলেকে। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। 

 'দোলা হে দোলা, আঁকা বাঁকা পথে মোরা কাঁধে নিয়ে ছুটে যাই রাজা-মহারাজাদের দোলা।' 

 এক পাল্কি বাহকের ছেলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, - পাল্কি কেন উঠে গেল জানো, মা? আমি দু'চোখ ভরা প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। উনি বললেন, একজন কী দু'জন মানুষকে বহন করে নিয়ে যাওয়ার জন্য চারজন কী ছয়জন বাহক লাগত যে। তাই সেই বাহকদের ভাড়া মেটাতে বড়লোকদের গায়ে লাগত। কারণ সেই সময় পথে ঘাটে গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি চলতে শুরু করেছে ... তারও পরে মানুষ টানা তিন চাকার রিক্সা এসে গেল। আরো পরের দিকে তো মোটর গাড়িও চলে এল। 

 আমি জানতে চাইলাম, মোটর গাড়ি তখন গ্রামেগঞ্জে এসে গিয়েছিল? 

 হ্যাঁ, পয়সা ফেলে বড়লোক বাড়িতে ভাড়া করত বৈকি! 

 আমি ছবিটার দিকে তাকিয়ে জানতে চাই, কোন্ কাঠ দিয়ে তখন পাল্কি তৈরি হত?

 সেগুন কাঠ, শিমুল কাঠ, নানা প্রকার কাঠ দিয়েই তৈরি হত। পালকি বহন করার ঐ যে দণ্ডটা দেখছ, ঐ বাঁটটা কী দিয়ে তৈরি হতো, বলো তো? 

 আমি সত্যিই জানি না। তাই কাঁধ ঝাঁকাই। 

 বটগাছের বড় ঝুরি দিয়ে। 

 উত্তরটা শুনে অবাক হয়ে যাই। বট গাছের ঝুড়ি দিয়ে পাল্কির বাঁট! 

 উনি বলতে থাকেন, শেষের দিকে পাল্কি উঠে যেতে আমার বাবা একেবারে কর্মহীন হয়ে গিয়েছিল। তখন মানুষ পূর্বপুরুষ ধরে যে কাজ করে আসতে দেখেছে, তাই করত। তার বাইরে কিছুই ভাবতে পারত না। আমার বাবাও কী করে পেট চালাবে বুঝতে পারত না। রোজ নিয়ম করে কাজ খুঁজতে বেরুতো। শহরের দিক থেকে যেই ডাক আসতো, সঙ্গপাঙ্গো জুটিয়ে ছুটত। কয়েকদিন পর ঘরে ফিরত। পরে শহরের বিয়ে বাড়ির ডাক আসাও বন্ধ হয়ে গেল। শেষে খুচখাচ কাঠের কাজ করতে শুরু করে দিল। আমি ছোট থেকে বাবার এই ভাড়া করা দোকানে এসে বসে থাকতাম। দেখে দেখেই শিখে নিলাম কত কিছু বানাতে। এখন যদিও এই দোকান আর ভাড়ার নয়। আমি পয়সা জমিয়ে কিনে নিয়েছি। বাপ-দাদুদের পাল্কি বাহকের পেশায় তো ঢুকতে পারিনি। পাল্কির ছবির মায়াটা ত্যাগ করতে পারিনি আজও। সাজিয়ে রেখেছি। আমার দাদুর স্মৃতি। থাকুক... 

 মানুষটার চোখটা চিকচিক করে উঠল। 

 আমি জানতে চাইলাম, এটা কী ধরণের পাল্কি? শুনেছি, তখন পাল্কি নাকি অনেকরকমের ছিল? 

 এটা একটা সাধারণ পাল্কি। তবে তখন ধনী জমিদারদের আয়না পাল্কি, ময়ূরপঙ্খী পাল্কিও থাকত। গায়ে তাদের পাখি, পুতুল, লতাপাতার নকশা আর সুন্দর কারুকার্যও করা থাকত। সেইসব পাল্কি করে নতুন বৌয়েরা যখন যেত, পথে ঘাটে মানুষ 'হুনহুনা' 'হুনহুনা' শব্দ শুনে বহু দূর থেকে এসে হাজির হত। নতুন বউয়ের মুখ দেখার জন্য বাচ্চা থেকে বুড়িরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকত। 

 'হুনহুনা' শব্দটার কথা শুনেই বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। রবি ঠাকুরের 'বীরপুরুষ' কবিতার শিশুটির সাহস মনে পড়িয়ে দিল, 'তুমি যাচ্ছ পাল্কিতে মা চড়ে / দরজাদুটো একটুকু ফাঁক করে'.... আহা, যদি আজও এই মেঠো পথে হেঁটে যেতে দেখতাম পাল্কি নিয়ে বাহকেরা এক তালে পা ফেলে 'হুনহুনা', 'হুনহুনা' বলতে বলতে হেঁটে চলেছে... 

 উনি বললেন, 'হুনহুনা' কী এমনিতে বলত! কষ্ট কমাতে বলত, মা। একে অত ভারী কাঠের পাল্কি, তার উপর মানুষ বসিয়ে নিয়ে বাহকরা যখন যেত, তখন কষ্ট দূর করতে আরো কত গান গাইতে গাইতে যেত। নতুন বরবউ নিয়ে গেলে একরকম গান ছিল, আবার গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ, গোয়ালভরা গরু এমন গৃহস্থের দিনযাপনের নানা জিনিস নিয়ে মুখে মুখে কত গান বাঁধত আমার বাপ - দাদু। 

 একটা শুনবে? ব'লে কাঠমিস্ত্রী গুনগুন করলেন তার বাবার এক গান - 

‘বাঁইশ ভরি রাখছি ধান চিড়া খাইবার আশে
সেই ধান কাটিয়া নিল রাজবাড়ির ইঁদুরে রে...
হরি হরি রে, বাইচ্চা ইঁদুরে ঘিরিল আমার বাড়ি রে...’

গান থামতেই দেখি, আমার দাদা এসে হাজির। আমি কাঠের দোকান থেকে বেরিয়ে পড়ি । দাদু, আসছি। আপনার সাথে কথা বলে খুব ভাল লাগল, ব'লে দাদার বাইকে গিয়ে চাপি। 

বাইকটা যত এগিয়ে যেতে থাকে, কাঠের দোকানটা ছোট থেকে ছোট হয়ে বিন্দুতে পরিণত হয়। আমার মনে হতে থাকে, দিনশেষে প্রতিটি পাখিই তো ঘরে ফেরে। আর প্রতিটা মানুষই ফিরে যেতে চায় তার শিকড়ের কাছে, আপন নীড়ে। তেলের যা দাম বেড়েছে, আবার একদিন কি তেমন দিন ফিরে আসবে না? যখন আবার পথেঘাটে 'হুনহুনা' 'হুনহুনা' করে পাল্কিবাহকেরা পাল্কি নিয়ে চলবে! 
                                                                              (ক্রমশ...) 

ছবি:   চয়ন বসু

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments

  1. বাহ্, শুধুই সিনেমায় দেখা আর গল্পে পড়া পাল্কি সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম।❤️❤️❤️

    ReplyDelete