জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে--১৫/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা খান

পর্ব ১৫

দু’দিন থেকে উনি, মানে আমার বর মি, খান বাড়ি ফিরে গেলেন। এই দু’দিন কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। উনি চলে যাওয়ার পর মনটা কেমন উদাস হয়ে গেল। এদিকে দু’দিনেই এই বিয়ের খবর দাবানলের মত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, কতজনের কত আশা ভঙ্গ  হয়েছে, সে খবরও শুনতে পেলাম। তখন সেলফোন ছিল না। যোগাযোগ ব্যবস্থা এত ভাল ছিলনা, তবুও উনি বাড়ি পৌঁছে জানতে পারেন, বিয়ের খবর প্রথমে  কেশপুর বাজারে, সেখান থেকে ওনার বাড়িতে পৌঁছে গেছে। উনি ওনার কাকিমার সঙ্গে এসব কথা শেয়ার করতেন। তাঁর কাছেই এসব খবর জানতে পারেন। কিন্তু কেউ ওনাকে সাহস করে কিছু জিজ্ঞেস করছেন না। তবে বাড়ির পরিবেশ বেশ থমথমে। যখন দেখলেন কেউ কিছু জিজ্ঞেস করছেন না, তখন একদিন রাতে মাকে ঘুম থেকে তুলে কোন পরিস্থিতিতে, কেন লুকিয়ে বিয়ে করেছেন, সব কথা খুলে বলেন। শাশুড়ি মায়ের থেকে শ্বশুরমশাই শুনলেন। তারপর বললেন, আমি বৌমাকে দেখতে যাব, এবং এলেনও। যথাসাধ্য আপ্যায়ন করা হল। আমি গিয়ে সালাম করলাম। উনি আমার হাতে একশ টাকা দিয়ে বললেন, আমি কিছু কিনতে সময় পাইনি, তুমি তোমার পছন্দ মত কিছু কিনে নিও। প্রসঙ্গত জানাই, তখন (১৯৭১)সোনার ভরি ছিল ৩০০ টাকার মত। উনি আমাকে কয়েকটি প্রশ্ন করেন, আমি সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিলাম। শ্বশুরমশাই আমার বুদ্ধি যাচায় করছিলেন। আমার উত্তর শুনে উনি খুব খুশি হন। যাওয়ার সময় বাবাকে বলেন, বেয়াইমশাই আমি আমার বৌমাকে একটিবার বাড়ি নিয়ে যাব, আপনি আপত্তি করবেন না। বাড়ি ফিরে উনি নাকি বলেছিলেন, আমার  বৌমাকে রূপোর গহনা দিয়ে সাজিয়ে আনব। সোনার গহনা বৌমার গায়ের সঙ্গে মিশে যাবে। কথাটি মেজননদের কাছে শুনেছিলাম।
    এদিকে আমাদের বিয়ের সময়ই, ১৯৭১ সালের মার্চমাসে উরদুভাষী পশ্চিম  পাকিস্থানের সঙ্গে বাংলাভাষী পূর্ব পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ছোটকাকা খান সেনাদের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে পরিবার নিয়ে পালিয়ে এলেন  কলকাতায়। মানুষের মধ্যে কী ভীষণ উত্তেজনা। রেডিও ও খবরের কাগজে শুধু  যুদ্ধের খবর ও লাশের ছবি। এই যুদ্ধের কারণ পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা  চায়। চেনাজানা পরিবারের সবাই  চলে এসেছেন এপারে। এই যুদ্ধের ফলাফল কী হতে পারে? তা কারো পক্ষে বলা সম্ভব নয়। ওখানকার ভ্রাম্যমান রেডিও ষ্টেশন  থেকে  সারাদিন দেশাত্ববোধক গান আর মাঝে মাঝে সেখ মুজিবের ভাষণ শোনানো হচ্ছে।আমরা শুনছিও। 
  গ্রীষ্মের ছুটিতে দিনক্ষণ ঠিক করে শ্বশুরমশাই একদিন আমাকে নিতে এলেন। সঙ্গে আমার খুড়শাশুড়ি, এক জা(পিস শাশুড়ির বউমা),বড় ননদ, তিন দেওর। বড় ননদ সাহারুমা দেখতে খুব সুন্দর। আমাদের বিয়ের পরেই  বড়ননদের বিয়ে হয়েছে। আমার দাদারা গিয়েছিল সেই বিয়েতে। বাবা  ভেবেছিলেন বিয়ের মত আমার জন্য শাড়ি-কাপড়, প্রসাধন সামগ্রী ওনারা নিয়ে আসবেন। কিন্তু ওনারা সঙ্গে একটা খালি লেদারের স্যুটকেশ এনেছেন আমার বইপত্র নেওয়ার জন্য। অগত্যা খড়কুশমার বাজার থেকে আমার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও একটি ট্রাঙ্ক কিনে ভরে দেওয়া হল। কয়েকদিন আগে জমি বাঁধা রেখে, সেই টাকা দিয়ে মেদিনীপুরে  সাহাদের দোকান থেকে বাবা হাল্কা ওজনের কিছু গহনা কিনে  এনেছেন। খাওয়া দাওয়ার পর তনু কাকিমা আমার চুল বাঁধতে বসলেন। মেজদি আমাকে সাজিয়ে গহনা পরিয়ে দিল, খেজুর পাতার রঙ্গিন চাটায়ের ওপর বসেছিলাম। খুড়শাশুড়ি গলা থেকে একটা ভারি ধানছড়া হার খুলে চাটায়ের ওপর ছুড়ে দিলেন, আমার পরার জন্য। আমাকে নেওয়ার জন্য ওনারা একটা দুধসাদা গাড়ি এনেছিলেন। সেই গাড়িতে চড়ে শ্বশুরবাড়ি রওনা হওয়ার সময় মা আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদলেন, আমিও কাঁদলাম। মেজদি, তনুকাকিমাও কাঁদছিল। আমার  ভাই মনিকে একটা বড় অ্যালমুনিয়ামের হাড়িভর্তি লাড্ডু দিয়ে আমার সঙ্গে পাঠানো হল। তখন আমার বাসে, ট্যাক্সিতে চড়লে গা গুলোত। ঘণ্টা দুয়ের পথ, প্রায় অর্ধেক পথ যাওয়ার পর আমি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। গাড়ির সবাই আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বাড়ি পৌছাতেই আমার জা আমাকে কোলে করে নামিয়ে একটা ঘরে  নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলেন। কে একজন পাখার বাতাস করছে, কে পায়ে হাত বোলাচ্ছে। ভীষণ লজ্জা লাগছিল। একটু পরে উঠে বসলাম। ফর্সা, লম্বা, লালপাড় সাদাশাড়ি পরা একজন শরবত দিলেন, আমি একটুখানি চুমুক দিয়ে রেখে দিলাম,  অন্যদের কথায় বুঝলাম ইনি আমার শাশুড়িমা। আমি তাঁকে সালাম করলাম।  রাতে দেখা হতে খান সাহেব আমাকে বললেন, আমার কাছে আসছিলে, তাতেও কান্না!
      পরদিন সকালে বাড়িঘর, মানুষজন ,তাদের ভাষা শুনে মনে হল আমি মনে হয় অনেকদুরে, অন্য কোনো রাজ্যে বা দেশে চলে এসেছি। খুড়শ্বশুরের বাড়ি একেবারে লাগোয়া। সকালের নাস্তা ওই বাড়িতেই করলাম। একটু বেলা হতেই নতুন বৌ দেখার জন্য ভিড় জমতে লাগল। আমাকে ঠাই বসে থাকতে হচ্ছে। দুপুরের আগে মেজননদ খিড়কীপুকুরে স্নান করতে নিয়ে গেল। আমি, ১৩ বছর ৬ মাস বয়সের বালিকাবধূ স্থান-কাল-পাত্র ভুলে পুকুরে নেমেই সাঁতরে মাঝপুকুর চলে গেলাম। আমি নতুন বৌ, এটা আমার শ্বশুরবাড়ি, মনেই থাকল না! স্নান সেরে  উঠে দেখি একপায়ের নূপুর পুকুরের জলে পড়ে গেছে। লজ্জা আর ভয়ে ঘরে এলাম। কেউ কিছু বললেন না। এঁদের রান্নাও অন্যরকম। আমার খেতে ভাল লাগছিলনা। আমার স্বভাবগত আগ্রহ নিয়ে শ্বশুরবাড়ির  পরিবার, পাড়া, গ্রাম,  অপার কৌতূহল নিয়ে জানার চেষ্টা করতে লাগলাম। আমার শ্বশুরবাড়ির গ্রাম দোগাছিয়াতে কোনও হিন্দু পরিবারের বাস নেই। এদের সাজ-পোশাক অন্য রকম, অদ্ভুত কায়দায় শাড়ি পরেন, বয়স্ক মহিলারা সায়া-ব্লাউজ পরেন না। বয়স্করা সাদাসাড়িই পরেন। গহনা  পরেন রূপোর। সোনা পরেন শুধু নাকে কানে। নাকে দুটো করে নাকছাবি পরেন অনেকে। অনেকের গলায়, বিশেষকরে বাচ্চামেয়েদের গলায় সোনার তক্তি বা মাদুলি রয়েছে। অনেক পুরুষই ঘরেবাইরে সব জায়গায়  লুঙ্গি পরেন। এঁরা বাংলা ভাষায় কথা বলেন, তবে তা আমাদের মত নয়, ছোটমেসোর সঙ্গে একবার ওনাদের গ্রামের বাড়ি আনন্দপুর গেছলাম। সেখানকার মানুষদের  এই ভাষায় কথা বলতে শুনেছিলাম। এরা অনেক হিন্দি শব্দ ব্যবহার করেন, তবে শুদ্ধ নয়। যেমন- তরকারিকে সালুন, জ্বালানিকে জালুন, জামাকে কুর্তা, তেঁতুলকে আমলি, ভাতের ফ্যানকে বলে আসম, ইত্যাদি। গ্রামের ছেলেরা তেমন একটা স্কুলে যায় না। আর মেয়েদের প্রাইমারি পাশ করলেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। এ সব বিষয় পরে পরে জেনেছি।
    আমার বইপত্র বয়ে নিয়ে আসাই সার হল, পড়তে বসার সময়ই পাই না।  সারাদিন দলকে দল মহিলারা নতুন বৌ দেখতে আসে। গ্রামের মধ্যেই সবাই ছেলেমেয়ের বিয়ে দেওয়া পছন্দ করেন। তাই গোটা গ্রামই আমার শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়। গ্রামেই শাশুড়িমায়ের বাপেরবাড়ি, মাসির বাড়ি, আমার পিসশাশুড়ির বাড়ি। এনারা রোজ একবার আসেন। শুধু গ্রামের আত্মীয় কুটুম্বরাই নয়, তাঁদের বাড়িতে আসা অন্য গ্রামের আত্মীয়রাও বৌ দেখতে আসতেন। তাঁদের সামনে ঘোমটা দিয়ে বসে থাকা কি যে যন্ত্রণার তা আমিই বুঝতাম।
    ওনার স্কুলের শিক্ষকরা নতুন বৌয়ের আগমনে বৌভাত খেতে চেয়েছিলেন,  উনি খাওয়াতেও রাজি ছিলেন। কিন্তু ওনারা বলে বসলেন, খেতে আসবেন না। স্কুলেই খাওয়াতে হবে। ব্যপারটা ওনার কাছে অপমানজনক মনে হয়েছিল। উনি রাজি হন নি। স্কুলের প্রধান্ শিক্ষকের সঙ্গে ওনার কোনদিনই সুসম্পর্ক ছিলনা। তার যথেষ্ট কারণও ছিল।
  আমার নিজের ও খুড়তুতো এক দেওর আমার সঙ্গে পড়ত। সেজদেওর আর  এক ক্লাস ওপরে পড়ত। মেজদেওর পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে চাষবাস দেখাশোনা করে।  দুই দেওর প্রাইমারি স্কুলে পড়ে। ছোটননদ তখনো বুকেরদুধ খায়। বয়স তিন বছর। ন’সেজদেওরের স্কুলে যাওয়ার থেকে ক্ষেতে যাওয়া বেশি পছন্দ ছিল। 
    আমি মাঝে মাঝে সবজি কেটেদি, পরোটা বেলেদি, এর মধ্যে একদিন রান্নাও করেছি। তবে দেওর ননদদের সঙ্গে সন্ধ্যাবেলা ধান পালুইয়ের আড়ালে লুকোচুরি খেলতে খুব ভাল লাগত। আর ভাল লাগত শাশুড়িমায়ের কাছে শুয়ে গল্প শুনতে। গ্রামের আত্মীয়দের বাড়ি থেকে নেমতন্ন আসে, শ্বশুরমশাই কোথাও যেতে দেন না। শুধু দুইপাশে যে খুড়শ্বশুর ও পিসশাশুড়ির বাড়ি, ওইদুটি বাড়িতে যাওয়া নিষেধ ছিলনা। এইদুই বাড়িতে প্রায়দিন নেমতন্ন থাকে। মস্ত বড় বড় মাছের মুড়ো, থালা ভর্তি সেদ্ধ ডিমের ভাজা, আর মুরগি তো থাকতই। আর একটা মজার ব্যপার হল, যাঁদের বাড়ি খেতে যেতাম না, তাঁরা জ্যান্ত মুরগি বাদশাভোগ চাল ইত্যাদি কাঁচাসিধা পাঠিয়ে দিতেন। এভাবেই কোথা দিয়ে যে একমাস কেটে গেল টেরই পেলাম না।
      বাবা আমাকে নিতে এলেন, সঙ্গে নিয়ে এসেছেন একটি স্কুল ম্যাগাজিন।  এতে আমার লেখা কবিতা রয়েছে। আমি খুশি হব ভেবেই বাবা পত্রিকাটি সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। ভাল লাগল ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখে। কিন্তু এই কয়মাসে কবিতা আমাকে ছেড়ে বহুদূর চলে গেছে। আর কোনদিন ফিরবে কিনা জানিনা।

                                            (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments