জ্বলদর্চি

সুন্দরবনের বিদ্যাসাগর : বাদাবনের মানুষের মন, মুখ ও মুখোশের গপ্পো /রাকেশ সিংহ দেব

সুন্দরবনের বিদ্যাসাগর : বাদাবনের মানুষের মন, মুখ ও মুখোশের গপ্পো

রাকেশ সিংহ দেব


পরিচালক – কোরক মুর্মু
অভিনয় – ঋদ্ধি সেন, ঊষসী রায়, সুদীপ ধারা, শংকর দেবনাথ, রুপাঞ্জনা মিত্র, কাবেরী বসু, প্রতীক দত্ত, দোয়েল নন্দী, কৌশিক কর, সজল মণ্ডল।

মুক্তি - ১১ মার্চ ২০২২। 'হইচই' ওটিটি প্ল্যাটফর্ম।

রেটিং - 3/5


জলে কুমীর, ডাঙ্গায় বাঘ, গাছে সাপ - এই হলো এককথায় সুন্দরবনের বর্ণনা। সুন্দরবনের প্রতিকূল দুর্গমতা ও এখানকার বাসিন্দাদের কষ্টকর জীবন বোঝাতে এই উপমার ব্যবহার করা হয়। রাজধানী কলকাতা থেকে মাত্র দু ঘন্টার পথ হলেও সুন্দরবন যেন আজও মূল ভূখন্ড থেকে আলোকবর্ষ দূরের কোনও জায়গা। বার বার সাইক্লোনের ছোবল খেয়ে খবরের শিরোনামে আসে আর সুন্দরবনে ভীড় বাড়ে স্বেচ্ছাসেবীদের। এর মধ্যে চলে কতো ঘোটালা। ত্রাণ, সাহায্য অর্থ সব নিয়ন্ত্রিত হয় কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের দ্বারা। তাদের পকেট গরম হয় আর অসহায় সাধারণ মানুষ থেকে যায় সেই তিমিরেই। এই হচ্ছে 'হইচই' প্ল্যাটফর্মের নতুন সিরিজ ‘সুন্দরবনের বিদ্যাসাগর’-এর সারমর্ম। অর্কদীপ নাথের লেখা কাহিনীকে ছ’টি পর্বে সাজিয়েছেন পরিচালক কোরক মুর্মু। তাতে বিদ্যাসাগর ওরফে কিংকরের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ঋদ্ধি সেন । 
কিংকরের সূত্র ধরেই পুরো কাহিনি এগোয়। ২৬ সেপ্টেম্বর জন্ম পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের। একই দিনে জন্ম কিংকরের। সেই থেকেই তার অস্তিত্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বিদ্যাসাগরের নাম। বাবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও অবাস্তব স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে যার জীবন আজন্ম এক অদৃশ্য জাঁতাকলে পেষাই হয়ে চলেছে। প্রথাগত শিক্ষার দৌড়ে তেমন একটা ভাল ফল করতে পারেনি কিংকর। তেমন ‘স্মার্ট’ও নয় সে। গ্র্যাজুয়েশন পাশ করে সরকারি ভলান্টিয়ার হয়ে সুন্দরবনের অন্যতম বিধবাপল্লী কুমীরখালিতে যায় কিংকর। সেখানে বিধবাদের নিয়ে 'সুন্দরী বাহিনী' তৈরি করতে হবে তাকে। যাদের কাজ হবে সুন্দরবনের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে যোগদান করে তা সম্পূর্ণ করা। গ্রামে গিয়েই পার্বতীর (ঊষসী রায়) সঙ্গে দেখা হয় কিংকরের। পেয়ে যায় কালুয়া (সুদীপ ধারা), হাফিজকে। কাজ করতে করতেই পার্বতীর প্রেমে পড়ে কিংকর। তবে বিধবাদের উন্নয়নের জন্য তার কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, ষড়যন্ত্রকারীরা। গ্রামের বিধবাদের নিয়ে ব্যবসার ছক কষতে থাকে তারা। স্থানীয় স্কুলের প্রিন্সিপাল কল্যাণী, গ্রামপ্রধান রাধারাণী এবং স্থানীয় মস্তান মাখনকে সঙ্গে নিয়ে কুমিরখালিকে লোকদেখানো হেরিটেজ ভিলেজে পরিণত করতে চান, যেখানে সামাজিক কাজকর্মের অছিলায় চলবে বিলাসবহুল রিসর্টের ব্যবসা। গ্রামের বিধবাদের স্বনির্ভর করে তোলার নামে পরিণত করা হবে এসকর্টে।

 কুমিরখালিতে এসে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করে কিংকর। হাফিজ, কালুয়া, পার্বতী দের সঙ্গে নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় কিংকর। এই কুচক্রীদের ষড়যন্ত্রের সমস্ত বিপদ কাটিয়ে কি নিজের কাজে সাফল্য পাবে কিংকর? পার্বতীর সঙ্গে তার সম্পর্ক কি পরিনতি পাবে? এই সমস্ত উত্তর পেতে দেখতে হবে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। 'হইচই'- এ মুক্তিপ্রাপ্ত নতুন সিরিজ 'সুন্দরবনের বিদ্যাসাগর'। এই সিরিজে হিংসা - ষড়যন্ত্র, সহজ- সরল প্রেম সহ ভিন্ন স্বাদ পাবেন দর্শকরা। তবে প্রথম থেকেই দর্শকরা মিস করবেন সুন্দরবনের বুনো গন্ধ। সুন্দরবন নামটা শুনলেই মন ম্যানগ্রোভ ম্যনগ্রোভ করে ওঠে, তবে সেসব এখানে নেই। জঙ্গল পরিবেশের উপস্থাপনার বদলে গ্রামের পরিবেশ বেশি দেখানো হয়েছে।  'হইচই'- এ মুক্তি পাওয়া  'মন্দার' ওয়েবসিরিজে সাগরপাড়ের গেইলপুরের পরিবেশ যেমন নিজেই একটি চরিত্র হয়ে উঠেছিল এখানে পরিচালক সুন্দরবনকে সেইভাবে উপস্থাপন করেননি। ঋদ্ধি সেন চরিত্রের দাবি মেনে বরাবরের মতো ভালো অভিনয় করেছেন। সহজ সরল কিছুটা হাবাগোবা কিংকরের চরিত্রে প্রাণ দিয়েছেন। বাংলা টেলিভিশনের জনপ্রিয় অভিনেত্রী ঊষসী রায় নিজের ইমেজ ভেঙে গ্রাম্য বিধবা পার্বতী হয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। ‘মন্দার’ সিরিজে নজর কেড়েছিলেন সুদীপ ধারা। এখানে তিনি পার্শ্বচরিত্র হয়েই থেকে গিয়েছেন।

 খল চরিত্রে বরাবরের মতোই নজর কাড়লেন রূপাঞ্জনা মিত্র এবং শংকর দেবনাথ। শংকর দেবনাথের সাবলীল ম্যানারিজম ও অভিনয়ে যেন সুন্দরবনের সোঁদা মাটির গন্ধ বেশি করে পাওয়া গেল। গৌরব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গীত সুন্দর। অর্ক চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘সুন্দরী বাহিনীর গান’ সুর এবং কথার জন্য মনে দাগ কেটে যায়। গল্পের অভিনব বিষয়বস্তু ছাড়াও টানটান চিত্রনাট্যের জন্য বাহবা পাবেন অর্কদীপ নাথ। কথায় কথায় যৌন সুড়সুড়ি দেওয়া অস্বস্তিকর রমকম বা ঢিমেতালের খাজা গোয়েন্দা গল্পের একঘেয়ে ছক ভেঙে বাংলা ওয়েব সিরিজ পা বাড়াচ্ছে সুন্দরবনের অজ পল্লী প্রকৃতির দিকে। সুন্দরবনের টিপিক্যাল বাঘ, কুমির, ভূত প্রভৃতির রোমাঞ্চ ঠুসে না দিয়ে সোজাসাপটা ভাবে তুলে ধরবার চেষ্টা করা হচ্ছে সেখানকার স্থানীয় মানুষের বাস্তব সমস্যা, দর্শকদের প্রাপ্তি হিসেবে এই বা কম কি। সুন্দরবনের বিধবাদের কাহিনী এর আগে এভাবে সিনেমা বা সিরিজে দেখা গিয়েছে বলে মনে পড়ে না। সেই দিকে বিষয়বস্তুকে সাধুবাদ জানানো যায়। সপরিবারে দেখে ফেলুন এই সিরিজটি। 

রেটিং

5 - অসাধারণ 
4 - বেশ ভালো 
3 - ভালো 
2 - দেখতে পারেন
1 - না দেখলেও চলবে

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments