জ্বলদর্চি

পদ্মপাতায় শিমুল-১৭ /সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়


পদ্মপাতায় শিমুল-১৭

সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

সন্ধেবেলা অনেক ছেলে মেয়েরা পড়তে আসত মেজদাদার কাছে। বাড়ির সামনে লাল বারান্দায় চৌকি পাতা থাকত। ছাত্ররা চলে গেলে বটিছোট ভাই আর আমাকে নিয়ে সেখানে পিসীমা বসে নানা রকম গল্প শোনাতেন। কখনো বা বানিয়ে বানিয়ে নিজের মনের মত করে অদ্ভুত ভালো গল্প বলতেন। আমাদেরও মাঝে মাঝে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলতে হতনয়ত পিসিমা আর গল্প শোনাতেন না। যে ভাল গল্প বলতপিসিমা তাকে এক টাকার নোট দিতেন। এই জন্যেই আরও আমরা ভাল ভাল গল্প বলতে চেষ্টা করতাম। আমি তো মাঝে মাঝে ঠাকুরমার ঝুলি থেকে একটু এদিক ওদিক করে বলতাম।

দাদাদের গল্প ছিল মজার। কখনো বা আরশোলাব্যাং এইসব নিয়ে গল্প বলত । পিসিমা কিন্তু বেশ মন দিয়ে সব শুনতেন। গল্প শেষ হবার পর ঘুম আসলে আমরা ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়তাম। আমাদের বাড়ির বাঁদিকে যে বাড়িটা ছিল একটু গলির ভেতর। কারণ সেই গলিটার গা ঘেঁষে ছিল রায় মাসীমাদের পাঁচিল ঘেরা বিশাল বাড়ি। এই বাড়িটা ছিল আমাদের বাড়ির ঠিক সামনে। রায় মাসীমাদের বাড়িটার পেছনে যে জায়গাটুকু পড়ে ছিল সেটাতেই বটীরবন্ধু নিখিলদাদের বাড়ি।

মাসীমামেসোমশাইনীলুদিফুলুদিরবিদা আর ছোটুরা থাকত সেই বাড়িতে। আমাদের বাড়িটার পেছন দিয়ে বেশীর ভাগ যানবাহন চলাচল করত। যানবাহন বলতে গরুর গাড়ি-ই বেশি। ভোর বেলা ঘুম ভাঙত 'হিলিক হিলিকআওয়াজে। আর দল বেঁধে লাইন করে সাঁওতালি মেয়েরা কাজে যেত গান গাইতে গাইতে। ভোরবেলা সূর্য ওঠার আগে এসে এই সাঁওতালি মেয়েরাই সবার বাড়িতে কুঁয়ো থেকে জল তুলে দিয়ে যেত। এই কুঁয়োটাও ছিল এমন যায়গায় যাতে সবার সুবিধা হয় জল নিতে। তার মানে ঠিক সেই ডুমুরগাছটার সামনে। পূর্ণিমার রাতে খুব সুন্দর লাগত বাছুরডোবা। আকাশ থেকে ছিটকে পড়া রাশি রাশি পূর্ণিমার আলো শাল গাছের ফাঁক ফোকর গলিয়ে এসে লাল মাটিতে লুটোপুটি খেলত...আর তার সাথে পিসিমার সব গল্প রাজা-রাণীরভূতেরঠাকুর দেবতার আরও নানারকম গল্প আমাদের মনে একেবারে গেঁথে যেত। আমাদের এই ছোট পিসিমা ছোট্ট খাট্টো মানুষ ছিলেন আর খুউব সুন্দরী ছিলেন। নবদ্বীপের বনেদী হালদার বাড়ির একমাত্র ছেলের বৌ ছিলেন। গায়ের ফর্সা রঙে পূর্ণিমার আলো ঠিকরে পড়ত যেন। চোখগুলো কটা কটা ছিল। পিঠে থাকত একটা বড় কালো কুচকুচে আলগোছে খোঁপা। বয়স জানবার দরকার হয় নি কখনও। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছিল। তাই মাঝে মাঝেই বাবার আদরের ছোট বোন আমাদের কাছে এসে থাকতেন। আর যখন গল্প বলতেন যেন মনে হতসত্যিকারের

একদিন এইরকম গল্প বলছেন পিসিমাসেদিনও পূর্ণিমা কিন্তু আকাশে ছ্যাকড়া ছ্যাকড়া মেঘ। মা আমাদের ছেড়ে স্বর্গে পাড়ি দেবার পর থেকেই সন্ধেবেলায় খুব ভয় পেতাম। খেয়ে হাত ধুতে যেতে হবে বলে রোজ-ই স্কুল থেকে এসে বিকেলে খেয়ে রাত্রে আর খেতাম না। নানারকম বাহানা করতাম। কখনও বলতাম- “পেটে ব্যথা করছে”কখনো বলতাম “গা বমি দিচ্ছে।” পিসিমা আর মেজবৌদির মিষ্টি বকুনির হাত থেকে রেহাইও পেতাম নাতাই খেতেই হত। কোনদিন কোনদিন তো কান্নাও জুড়ে দিতাম ... “খাব না আ আ। পেট কামড়াচ্ছে।” এইরকম একদিন পিসিমা রাতে আমাদের স্কুলের পড়া হয়ে গেলে বললেন, “চল আজ একটা খুব মজার গল্প বলব।”

সেদিন ছিল শনিবার। পরের দিন স্কুল নেই কাজেই গল্প শুরু হল বেশ বড়সড়। সাথে আমার পাড়ার বন্ধুরাদাদাদের বন্ধুরা সব হাজির। আজ সবাই গল্প শুনবে। পাড়া বললে ভুল হবে মনে হত যেন একটাই বিরাট ফ্যামিলির সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। পিসিমা খালি নিখিলদাদের বাড়ির দিকে মুখ করে বসেছিলেন। আর সবাই পিসিমার সামনে বসেছে খালি আমি একেবারে মাঝখানে পিসিমার কোল ঘেঁসে বসা। পিসিমা গল্প আরম্ভ করার খানিক বাদেই বারে বারে নিখিলদাদের বাড়ির দিকে তাকাচ্ছেন আর গল্পটার খেই হারিয়ে ফেলছেন। আমরা তো সবাই পিসিমার মুখের দিকে তাকিয়ে গল্প শুনছি। হঠাত শুনি পিসিমা কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে সুর করে বলছে্নঃ

ভূত ওরে ভূত

পেত্নীও আছে নাকি?

-ছড়াদের দল আছে

কি করবি দেখি!

দাদারা সবাই বিরক্ত হয়ে চেঁচামিচি আরম্ভ করে দিয়েছে। আমার ছোদ্দা বড্ড মজার মানুষ। মাঝে মাঝে মেদিনীপুরিয়া ভাষা বলত। সে বলল পিসীমাঃ “ কি বলিছুঁতুমি এ্যাঁ?” পিসিমা দাদাদের সবাইকে ডাকত “অ-ছড়াদের দল” করে ।

পিসিমার কটা চোখ তখন গোল গোল হয়ে গেছেবললেন: “ওরে অ-ছড়াদের দল...” তোদের পিছনদিকে একবার দেখ তো চেয়ে...বলে নীলুদি ফুলুদিদের বাড়ির দিকে আঙুল দিয়ে দেখালেন। সবাই দেখে একটা সাদা চাদরে মুড়ে কেউ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একেবারে পাঁচিলে ঠেস দিয়ে। আমি তো দেখেই ভূ ঊ ঊ ত করে কেঁপে টেঁপে একসা। সাহসী হিরো দাদারা ছুটে গেল সেইদিকে...কিন্তু কই কেউ নেই তো!...আশ্চর্যএই তো এক্ষুনি ছিল পাঁচিল ঘেঁসে দাঁড়িয়ে। নিমেষে কোথায় গেল?...পাড়ার সবাই এই চেঁচামিচিতে বাড়ির বাইরে এসে গেছেন...কিন্তু আশ্চর্য নীলুদিদের বাড়ির মানুষজনদের এত চেঁচামিচিতেও ঘুম ভাঙ্গে নি। সাহস করে আর ওদের বাড়ির দরজার কাছে কেউ যেতে চাইছে নাকারণ চোর যদি হয় তাহলে হাঁসদাএকরকমের দাঁছুঁড়ে দেবেসে লাগলে আর রক্ষে নেই। আবারজানি না দাদারাও বোধহয় ভয় পেয়েছিল ভূতের।

সবাই গিয়ে একজোট হয়ে ওদের দরজা ধাক্কালো কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। যেন কুম্ভকর্ণের ঘুম। সেদিন আবার নিখিলদারা কেউ আসে নি গল্প শুনতে। মেসোমশাই এসেছিল তাই আর ওরাও আসে নি। এদিকে রাত ও বেড়ে গেছিল গল্প করতে করতে। সবাই যারা জেগে গেছিল তারা বলতে লাগল... “ভূত হলেও হতে পারে”কারণ নীলুদিদের বাড়ির পাশে যে পাঁচিল ছিল তার পেছনে ঘন জঙ্গল আর একটা ঝাঁকড়া ডুমুর গাছ ছিল যেটা এসে পড়েছিল একেবারে পাঁচিলের গা বেয়ে। অনেকবার কাটার জন্য লোক ডাকা হয়েছিলকিন্তু জানা যায় নি কেন কাটা হয় নি গাছটা। ইলেকট্রিক লাইট না আসার আগে অনেকে নাকি রাত্রে ভূত দেখেছেএমনকি ভরদুপুরেও দেখা গেছে। কেউ কেউ নাকি দুপুরে থোকা থোকা ডুমুর পাড়তে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে হাত পা ভেঙ্গেছে। এখনও নাকি লোডশেডিং-এর সময় প্রায়-ই দেখতে পাওয়া যায়...ব্যাস আমার তো দফা রফা...সেই যে পিসিমাকে জাপটে ধরেছি। আর কাঁপা শুরু হয়েছে তার আর শেষ নেই...পিসিমা যত বলে “ওরে সবাই তো আছেভয় কিসেরতোকে কি একা সবার মাঝ থেকে নিয়ে যাবেনাকি?” নিজে কিন্তু মুখে বিড় বিড় করে দুগগা দুগগা নাম জপছেন আর আমাকেও বললেন দুগগা নাম জপ করতে। কাছে আসা তো দূরের কথা। ভূত পালাবে দেখ।”

সবাই নানারকম আলোচনার পর যে যার বাড়ি ফিরে গেল। আমরাও দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। সকাল বেলা চেঁচামিচিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। কি হল আবারনীলুদিদের বাড়িতে নাকি সর্বনাশ হয়ে গেছেগলির দরুন দেখাও যাচ্ছে না ঠিকমতবৌদির শুরু হল গজগজ- “কবে থেকে বলছি ঘোড়াধরায় বাড়ি নাও... শিমুল-এর স্কুল ও কাছেবাসে করে যেতে হবে নাবাবু মন্টুর স্কুল আর তোমার -ও কলেজ কাছে...তা আর কে শোনে। ভাল লাগে না একদম। রোজ রোজ ভূতনয়ত চোর। দেখো আবার কি হল এই সক্কালবেলা।” সবাই হাজির হলেন...আমি আর পিসিমা ছাড়া...

কিকি ব্যাপারকরে সবাই ছুটে জড়ো হলেন সেখানে।

নীলুদিদের রান্নাঘরটা অন্য ঘরগুলো থেকে ছিল একপেশে আলাদা একটা নিমগাছের তলায়। তবে সিমেন্টের -ই ছিল। সবাই দেখে রান্নাঘরের দরজা আটকাঠ খোলাভাতের হাঁড়ি ওলটানোরান্না করা বেশ কিছু মাছ ভাজা ছিলতাও নেই...কিছু হাঁসের ডিম ছিল -তাও নেই। একটা পিঁড়ি পাতা আছে আর তার সামনে সোজা করে রাখা একটা পরিষ্কার কাঁসার থালা। রান্নার বাসন কোসন যেমন ছিল সব তেমনটিই পড়ে আছে তবে খাবার কিচ্ছু নেই। খালি ঘিয়ের শিশি পড়ে আছে। মাসীমা বললেন, “কি ব্যাপার এসব কি হলপিঁড়ি পেতে বসে কেউ খেয়ে আবার থালা মেজে গেছে দেখছি। কাল কি এত ঘুম আমাদের ছিল যেআমরা কোন আওয়াজও পেলাম না একেবারে। রান্নাঘরে বড় তালা ঝুলছিল তাও নেই আশেপাশে।”

ওদের রান্নাঘরে আলো ছিল না। তাই ল্যাম্পো জ্বালাতে হত। তার মানে যেই হোক সে ল্যাম্পো জ্বেলে ভাত ঘি এ মেখে মাছ ভাজা দিয়ে রসিয়ে রসিয়ে খেয়েছে। আর ডিমগুলো নিয়ে গেছে সাথে করে। এরকমটি সবাই আঁচ করলেন। এ নির্ঘাত ছিঁচকে ভূত না হয়ে যায় না সবাই বলে উঠল। ফচকে দাদারা সবাই হো হো করে হেসে উঠল। ছিঁচকে ভূ ঊ ঊ ঊ ত একেবারেই হয় না বরং এ নির্ঘাত ছিঁচকে চোর -ই হবে। ভূত কি ঘি দিয়ে ভাত মেখে মাছ দিয়ে খাবে। খেয়ে সব ধুয়ে যাবে নাকিহঠাত একজন একপাটি হাওয়াই চটি সেফটিপিন লাগানো হাতে করে নিয়ে এলো রান্নাঘরের পেছন দিক থেকে যেখান থেকে বেরিয়ে সোজা রাস্তায় ওঠা যায়।

ইউরেকাপেয়েছি পেয়েছি!”

সবাই তাকিয়ে দেখল কি পেল আবার হারকিউলিস পনতু। দেখে পনতুর হাতে এক পাটি সেপটিপিন লাগানো হাওয়াই চটি। হুম বাবাআমি হলাম গিয়ে পনতুকালকে আমার কথা কেউ শুনছিলে না তো। এই দেখো তোমরা সবাই চোর না ভূত এইসব করছিলে আর আমি আমার কাজ করছিলাম। এইটা পেলাম রান্নাঘরের পেছন থেকে। তার মানে একশ পার্সেন্ট ঠিক যে চোর এসেছিল। কেউ একজন চুরি করতে এসেছিল ঘরের মধ্যে ঘুমের ওষুধ ছড়িয়ে যখন চুরি করে নিয়ে যাবে সেই সময় আমাদের বারান্দায় দেখে বুদ্ধি ঠাউরেছে। আমাদের ভুতের মতন সেজে ভয় দেখিয়েছিল। কারণ পিসিমা ছাড়া আর সবাই ছিলাম ছোট। আমাদের আসতে দেখে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে ঢুকে পড়েছিল তারপর অনেক রাতে খিদে পাওয়াতে রান্নাঘরে যা পেয়েছে তাই চেটেপুটে খেয়ে গেছে... তারপর এই সাহসীদের পাল্লায় পড়ে রান্নাঘরের ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে রেখেছিল...যদি আমরা তখন একটু ভেতরে আসতামঠিক ব্যাটাকে ধরতে পারতাম।

ছোদ্দাদের মধ্যে একজন বলে উঠল: “এই বিলটু-(একটু রোগা প্যাটলাজন্য ধরতে পারলাম না ভূত নামের চোরকে। আমাদের পড়াশুনা করে কি হলো আমাদের লবডঙ্কা দেখিয়ে গেল শেষ পর্যন্ত।”

ইশ!” বড়রা বলে উঠলেন “এই যে মহা সাহসীদের দল। যা:! বাড়ি যা তো। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়েতার নমুনা হলি গিয়ে তোরা। খেয়ে দেয়ে পড়াশুনা কর গে যা। খালি “এই করেঙ্গা তেই করেঙ্গা বাত।” কাজের সময় তখন ল্যাজ গুটিয়ে খালি এ ওকে দোষ দিচ্ছে আর ও তাকে দোষ দিচ্ছে। আমরাও তোদের মতন বয়সে এইরকমই তো ছিলাম। আমরা নয় ভীতু ছিলাম। আর তোরাছিঃ ছিঃ একটা ছিঁচকে চোর ধরতে পারলি না তোরাহ্যাঁরে তোরা কি রেএইবার থেকে ডন বৈঠক মার ফুটবল না খেলে। ফুটবল খেলে মাথাগুলো তোদের সব গোল হয়ে গেছে। ম্যাসলগুলো বাড়াসময় কাজ দেবে।”

চোরভূত-দের ছেড়ে বেচারা ছোদ্দাদের দলটাকে সবাই ঘিরে ধরল। জোর হাসির ধুম-এ সারা পাড়া আরেকবার কেঁপে উঠল। ডুমুরগাছের ভূত ভাবল...মানুষগুলো কি বোকা। পূর্ণিমার রাতে ভূতেরা বেরোয় নাকিভূতেদের আড্ডা তো ঘোর অমাবস্যায়।

আর এই আমিআমি মনে মনে ভাবছিলাম নিশ্চয়-ই নীলুদিদের ভূতে ঘাড় মটকে গেছে। আমি আর পিসিমা তখনও দুগগা দুগগা নাম জপ করে চলেছি। সত্যি বাবাঝাড়গ্রামে যা ছিঁচকে চোরের উপদ্রব ছিল নাতা ভোলার না।

হা হা হা -দারুণ মজার গল্প বললে তো।

(চলবে)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments