জ্বলদর্চি

গাজন /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব - ১৫
গাজন

ভাস্করব্রত পতি

প্রবল ধর্মীয় ভাবাবেগকে পাথেয় করে সুপ্রাচীন কাল থেকেই শিব এবং ধর্মঠাকুর এর নামে হয়ে থাকে দু'ধরনের গাজন। তবে ধর্মের গাজনের চেয়ে শিবের গাজন ধারে, ভারে এবং জনপ্রিয়তায় বহুলাংশে এগিয়ে। 'গাজন’ শব্দে রয়েছে ‘গাঁ’ বা ‘গ্রাম’ এবং ‘জন’ বা ‘জনসাধারণ'। মোট কথা গাঁয়ের জনসাধারণের উৎসব। তারাপদ সাঁতরা ‘গাজন’কে ব্যাখ্যা করেছেন বাংলার প্রকৃত গণ উৎসব হিসেবে। ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ পত্রিকায় (১৩১৮) হরিদাস পালিত লিখেছেন “জনগণের চীৎকার, বিপুল বাদ্যোদমে গর্জন, তাই বোধ হয় উৎসব কালক্রমে গাজন নামে অভিহিত হইয়া থাকিবে।”

গাজনের মূল উপাসক 'ভক্তা'রা হলেন শিবের অনুচর। যাঁরা কিনা অনার্য ভারতীয়। অর্থাৎ শিবের গাজন হল অনার্যদের একটি উৎসব। বিবাহের বরযাত্রী হয়ে তাঁদের পালন করতে হয় নানা উপচার এবং লোকাচার। ঢাকের বাদ্যি, শিঙার শব্দ সহ জন কল্লোলের যে ‘গর্জন’ উৎপত্তি হয় এই উৎসবে, তাই-ই কালে এবং কালোত্তরে পরিবর্তিত হয়ে নামকরণ হয়েছে ‘গাজন’। 
গর্জন (সংস্কৃত শব্দ) > গজ্জন (প্রাকৃত শব্দ) > গাজন (বাংলা শব্দ)। 

নিম্নবঙ্গে এই গাজনকে বলে ‘দেলপুজো’। মূলত আদিম কৌম সমাজের জাদুক্রিয়ামূলক অনুষ্ঠান হিসেবে সমাদৃত। বাংলার উৎসবের সিলেবাসে সর্ববৃহৎ এবং সর্বজনপ্রিয় লোক উৎসব হিসেবে খ্যাত এই "গাজন"। উত্তরবঙ্গের গাজন পরিচিত ‘গম্ভীরা’ নামে। শিবের আর এক নাম ‘গম্ভীর’। আসলে মন্দিরের মধ্যে যে চৌবাচ্চার মতো কূপ থাকে তাইই ‘গম্ভীর’। তার মধ্যে শিবের অধিষ্ঠান। আবার এই বাংলায় ধর্মঠাকুরের আসন রূপে ব্যবহৃত হয় গামার কাঠ বা গম্ভীরা কাঠের তক্তা। ওড়িয়া ভাষায় ‘গম্ভীরা’ শব্দের অর্থ হল ‘ক্ষুদ্র নির্জন কক্ষ'। তাই শিবমন্দির হল ‘গম্ভীরা'। ধর্মের অনুশাসনে উৎপত্তি পাওয়া এই সংস্কৃতি তথা গম্ভীরা কালক্রমে হয়ে উঠেছে লোকায়ত মাধ্যম। গবেষক হরিদাস পালিত এ প্রসঙ্গে মত দিয়েছেন “চৈত্রমাসের শেষে যে শিবোৎসব ও চড়ক পূজা হইয়া থাকে, তাহার চলতি নাম শিবের গাজন। এই শিবের গাজনই নামান্তর প্রাপ্ত হইয়া মালদহে গম্ভীরা নামে খ্যাত হইয়াছে।”

গম্ভীরার মতোই সমতুল্য ‘বোলান’ গান। বোলান অর্থাৎ কথা বলা। উত্তর দেওয়া। চৈত্রমাসে কৃষিজীবী মানুষের শিবকেন্দ্রিক তর্জা গানই হয়েছে বোলান। গাজনের অন্যতম পরিপূরক হল 'বোলান'। রাঢ় বঙ্গে চৈত্র অবসানে বোলান উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে উঠে গ্রামগুলি। রণপা বোলান, রঙপাঁচালি বোলান, পোড়ো বোলান, পালাবন্দী, সাঁওতেলে এবং ডাক বোলান—এইসব ‘বোলান’-এ মাতোয়ারা হয় বাংলার মানুষ। প্রবন্ধকার সুরেন মুখোপাধ্যায় বোলানের চরিত্র এঁকেছেন এভাবে “বোলানে গ্রামীণ জীবনের সহজ সরল প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। এই ছবি নগরজীবন থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এক সময় ধর্মকে ভিত্তি করে বোলানের জন্ম হলেও এখন এটি আগেকার রীতি অতিক্রম করে। অনায়াসে বৃহত্তর সমাজ জীবনের প্রশস্ত ও বিস্তীর্ণ প্রান্তরে প্রবেশ করেছে।” গাজন উৎসবের সাথে গম্ভীরা, খেস্যাগান, বোলান গান, গোষ্ঠ উৎসবের সংস্পর্শ রয়েছে। গাজন গানও বাংলার সংস্কৃতিতে যথেষ্ট সমাদৃত। ড. শ্যামল বেরা জানান, “গাজনতলার গান বলতে সঙের গানকে বোঝায়, কিন্তু সঙের গান মানে গাজনতলার গান নয়।” নিদারুন কৃচ্ছসাধন এবং নিজ নিজ জীবনীশক্তির জোরে আজও টিকে রয়েছে বাংলার গাজনে সম্পৃক্ত এইসব লোকগান ও লোকনাট্যের ধারা।

দক্ষিণবঙ্গে গাজনের একটি অন্যতম অঙ্গ হল চৈত্র সংক্রান্তির 'চড়ক'। গাজনের সবচেয়ে জনপ্রিয় লোকাচার। তবে 'চক্র' শব্দ থেকে ‘চড়ক’-এর উৎপত্তি হয়েছে বলে মতামত দিয়েছেন রামকমল সেন। ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ গ্রন্থে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় চড়কের অর্থ বিন্যাস করতে গিয়ে বলেছেন, 
চড়ক–(সং-চক্র) > (স্বরাগমে) চক্র > (বর্ণ বিপর্যয়ে) চরক > ফারসি চরখ্— চক্র ঘূর্ণ
আবার ‘বিশ্বকোষ’ গ্রন্থে নগেন্দ্রনাথ বসু এই ‘চড়ক’ শব্দকে দেশজ শব্দ চড়া বা আরোহন করার থেকে উৎপত্তি হয়েছে বলে ব্যাখ্যা করেন। 

গাজন উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু শিব। যিনি কিনা ভারতের শষ্যদেবতা হিসেবে উপাসিত। মূলত বাংলার কৃষিজীবী এবং শ্রমিক শ্রেণির মানুষজনই এই শিবোৎসবের পৃষ্ঠপোষক। এই উৎসবে কোনও জাতের কড়াকড়ি নেই। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র সবারই অধিকার গাজন উৎসবে জড়িয়ে পড়ার। প্রচলিত আছে, রাজা বাণ জনগণের মধ্যে ঐক্য এবং সম্প্রীতি স্থাপনের লক্ষ্যে প্রচলন করেছিলেন গাজন উৎসব। গ্রামবাংলার আপামর জনগণের গণদেবতা রূপে স্বীকৃতি পায় শিব। শিব যেমন অল্পেই সন্তুষ্ট তথা ‘আশুতোষ’, তেমনি গ্রামাঞ্চলের মানুষও অল্পেই সন্তুষ্ট থাকতে চায়। গাজন উৎসবের উৎপত্তির সাথে এই ভাবনা বিবেচনা করা দরকার। গ্রামবাংলার মানুষের চিরন্তন জীবনচর্চা তাই আবর্তিত হয় ‘আশুতোষ’কে ঘিরে থাকা সংস্কৃতি এবং লোক উৎসব গাজনকে সঙ্গী করে। 

চৈত্র শেষের এই উৎসব আসলে শিবের বিবাহোৎসব। নীলকন্ঠ শিবের সাথে নীল পরমেশ্বরী বা চণ্ডিকার বিবাহে শিবের অনুগামীরা ছিল ভূত, প্রেত, দত্যি, দানবের দল। পৌরাণিক কাহিনী সে কথাই বলে। বিবাহ অনুষ্ঠান সর্বদাই আনন্দজনক। হিন্দুদের বিশ্বাস শিবের জন্ম শ্রাবণ মাসে। আর বিবাহ হয়েছিল চৈত্রের শেষে। তাই চৈত্র হল ‘মধুমাস'। সেই মধুমাসে শিবের বিবাহকে স্মরণ করেই প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় গাজন উৎসব। যদিও কোথাও কোথাও বৈশাখ মাসেও গাজন আয়োজিত হয়। তা পরিচিত 'বৈশাখী গাজন' নামে।

প্রথম দিন প্রাতঃকালে সূর্য ওঠার সময় মাগুর মাছ কেটে মঙ্গলঘট স্থাপন করা হয়। ঢাক, ঝাঁঝ, কাঁসি সহযোগে শুরু হয় গাজনের প্রথম কাজ। তবে তার আগের দিন রাতে ঢাক বাজিয়ে এই মেলার সাথে যুক্ত অন্যান্য গ্রামের বর্ষীয়ান এবং প্রথিতযশা ব্যক্তির বাড়িতে গিয়ে মাল্যদান করা হয়। বিশেষ ধরণের এই মালা অবশ্য সচরাচর দেখা যায় না। কাঁড়োর গাছ এবং গাঁদা ফুল দিয়ে এই মালা তৈরি হয়।

এবার যেদিন মাগুর মাছ কাটা হল সেদিন থেকেই এসে যান শিবভক্তরা। তাঁদের বলা হয় ‘ভক্তা’। সম্পূর্ণ নতুন পোশাক পরতে হয় তাঁদের। গলায় থাকে মঙ্গলসূত্র এবং গায়ে সাদা কাপড় ও গামছা। গেঞ্জিও পরেন অনেকে। আর মহিলারা নতুন শাড়ি পরেন। একে বলে 'উতরি নেওয়া'।

যাই হোক, প্রথম দিন বিকাল ৪টা থেকে ১৬ জন সন্ন্যাসী বা ভক্তা স্নান করেন। আচার্য পুরোহিত সমস্ত শিবের নামে সেবা ডাকাবেন সেই সন্ন্যাসীদের। এই ১৬ জন সন্ন্যাসী তথা ‘ষোড়ো সন্ন্যাসী'-ই গাজন পরিচালনা করেন। একে বলে ‘গাজন ভাটা’। সেবা ডাকার পর সন্ন্যাসীরা করেন সূর্য পূজা, সূর্য প্রদক্ষিণ, মন্দির প্রদক্ষিণ, ঝুলন বা হিন্দোল, বেতচালা, মাথাচালা নিয়মগুলি। সন্ধ্যায় হয় সন্ধ্যারতি। এদিন মন্দিরের পুরোহিতের বাড়িতে হয় ‘ভোগমুদা'। সন্ন্যাসীরা তাতে অংশ নেন। পুরোহিতের বাড়ি থেকে ঐ ভোগ কোনো রকম কথা না বলে মন্দিরে নিয়ে এসে এবং ভোর রাতে ভোগ ফুটিয়ে মহাদেবকে দেখিয়ে ভোগ ভাসানো হয় জলে। তখন আচার্য পুরোহিত ভোগ ডাকাবেন। আর সন্ন্যাসীরা উপস্থিত থাকবে। রাত ৩-৩০-এ এই ক্রিয়াকর্মটি অনুষ্ঠিত হয়। ভোগ ভাসাবে মন্দিরের পুরোহিত। এ প্রসঙ্গে জানানো প্রয়োজন, ‘ভোগমুদা’ য় সন্ন্যাসীরা গিয়ে সেবন করেন দুধ, সাবু, নানারকম ফল ইত্যাদি। খাওয়ার সময় কেউ কথা বলেন না।

দ্বিতীয় দিন হয় ‘রাজভোগ’। আর এই রাজভোগের দায়িত্ব পড়ে গ্রামের পরিচালন কমিটির সম্পাদকের বাড়িতে। এখানে ভোগমুদা হয়। সন্ন্যাসীদের গামছা ও দক্ষিণা দিয়ে সম্মান দেওয়া হয়। ভোগমুদার বাকি নিয়ম আগের মতোই। বিকেলে হয় গাজন ভাটা।

তৃতীয় দিন সন্ন্যাসীদের ভোগমুদা হয় অন্য কোনো গ্রামের সম্পন্ন পরিবারে। বছরের পর বছর ধরে চলে আসে এই নিয়ম কানুন। সন্ধ্যায় তা হয় আগের মতো নিয়মানুসারেই। এদিন সকাল ৮ টায় মন্দিরের সন্ন্যাসীরা যান অন্য অঞ্চলের গ্রামের শিব মন্দিরে। সেখানে গিয়ে সেখানকার শিব মন্দির প্রাঙ্গণে সেখানকার সন্ন্যাসীদের সাথে গাজনের নানা কৃত্যানুষ্ঠান প্রদর্শন করেন। বেতচালা, মাথাচালা, ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘মাড়ো ঘাঁটা'। কথ্য বাংলায় শিব মন্দিরকে বলা হয় ‘মাড়ো’ বা ‘থান’। আসলে এই ‘মাড়ো ঘাঁটা’র পিছনে লুকিয়ে আছে এক বিশেষ উদ্দেশ্য। মানুষে মানুষে সদ্ভাব, শান্তি এবং প্রীতির সম্পর্ক বজায় রাখতে এই রীতির উদ্ভব। দলাদলি দূর করে মানুষে মানুষে মিলনের সেতু রচনায় গাজন উৎসব ব্যাপৃত তা এ থেকেই প্রমাণিত। তবে আগে বিভিন্ন মন্দিরে অন্যান্য বহু মন্দির থেকে ‘মাড়ো ঘাঁটা’য় অংশ নিতে সন্ন্যাসীরা আসতেন। এখন সেসব রীতিনীতি বন্ধ। ঐদিন বিকেলে একই রীতিতে ১৬ সন্ন্যাসী সূর্য পূজা থেকে শুরু করে বেতচালা পর্যন্ত যাবতীয় নিয়মনীতি পালন করেন। এরপর তাঁরা যান নির্ধারিত সম্পন্ন পরিবার থেকে ভোগমুদা নিতে।

চতুর্থদিন সকালে চিরাচরিত সম্প্রীতি বজায় রাখতে পাল্টা ঐ মন্দিরের ভক্তারা আবার আসেন প্রথমে মাড়ো ঘাঁটতে যাওয়া সন্ন্যাসীদের শিব মন্দিরে। একইরকম ভাবে তাঁরাও একসাথে এখানে তাঁদের কৃত্যানুষ্ঠান প্রদর্শন করেন। বিকেলে আগের মতো উপচার পালনের পর সন্ধ্যায় সন্ন্যাসীরা ভোগমুদা নিতে যান আবারও অন্য এক সম্পদশালী পরিবারে। এ প্রসঙ্গে জানানো দরকার, ভোগমুদা নিতে গিয়ে সন্ন্যাসীরা সেখানেও নানা কসরৎ দেখান। আর সবার মঙ্গলের জন্য তথা শান্তির জন্য ‘সেবা ডাকা' হয়।

পঞ্চম দিন অবশ্য কারও বাড়িতে ‘ভোগমুদা’ হয় না। মন্দিরেই ভোগমুদা হয়। একে বলে 'কুঁড়েভোগ'। ঐ ভোগ জলে না ভাসিয়ে মাটিতে পুঁতে দিতে হয়। কোনও মানসিক ভক্তাকে তা দেখানো হয় না। কেবলমাত্র ষোড়ো সন্ন্যাসীরই তা দেখার অধিকার আছে। মেলায় জাঁকজমক বাড়ে এদিন থেকেই। মূল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়। এদিনের মূল উপাচার হল ‘বঁটি ঝাঁপ’, 'কাঁটা ঝাঁপ', 'জিভ ফোঁড়', 'বান ফোঁড়', 'রজ্জু ফোঁড়' ইত্যাদি। মন্দিরের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয় 'কুঁড়েভোগ'। বিকেলে প্রথমে পালিত হয় 'মানিকচুরি'। যিনি ‘মানিক’ হন তাঁকে সামনে রেখে সন্ন্যাসীরা মন্দির প্রদক্ষিণ করেন ঢাকের তালে তালে। সবার সামনে দুজন সন্ন্যাসী ধরে থাকে বিশাল লম্বা ‘আলম বাঁশ'। মোট তিনটি বাঁশ (তরল) প্রয়োজন গাজনের জন্য। বাঁশগুলির প্রতিটির দৈর্ঘ্য ১৬ হাত। এর মধ্যে একটিকে বলে ‘জাগাই বাঁশ’। একে মন্দির থেকে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হয় না। বাকি দুটির একটিকে বলে ‘আলম বাঁশ’ এবং অন্যটিকে বলে ‘উদ্বোধনী বাঁশ'।

মানিকের হাতে মুষ্ঠিবদ্ধ অবস্থায় থাকে পঞ্চফল ও বেত। গলায় জবাফুলের মালা। গায়ে মাখানো থাকে রক্তচন্দন। বেতটি দুহাতে মাথায় ধারণ করে থাকে মানিক। মন্দির প্রদক্ষিণের মাঝেই মানিক গিয়ে ঝাঁপ দেন কোনও এক বনের মধ্যে কাঁটাগাছের জঙ্গলে। সেখান থেকে পরে বাকি সন্ন্যাসীরা গিয়ে তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন মন্দিরে। একেই বলা হয় 'মানিকচুরি'। 

মানিকচুরির পর হয় 'বঁটি ঝাঁপ'। প্রায় ১৬ ফুট উচুঁ মাচা থেকে নির্দিষ্ট দু'জন সন্ন্যাসী ঝাঁপ মারেন নিচে থাকা বঁটির ওপর। এই বঁটির দুপাশে মুখ থাকে। মোট ৬টি বঁটি। এই বঁটিগুলিকে বলা হয় ‘মঙ্গলসূত্রের বঁটি’। কোথাও কোথাও এই সময় কালীনাচ, আগুনঝাঁপ, পাতা ভক্তা, ঢেঁকি ঘুরানো, শিবদুর্গার নাচ অনুষ্ঠিত হয়। এগুলো এখন প্রায় হারিয়ে গিয়েছে চড়ক গাজনের লৌকিক উপচার থেকে।

অতীতের ‘সঙ নাচ’-এর অন্যরূপ হিসেবে ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ও আয়োজিত হয় কিছু যায়গায়। নানা সাজে সেজে এখনও চড়কের সময় সঙ নাচ হয় বহু মন্দিরে। বাংলার অন্যতম এই লোকাচারটি অবশ্য আজও টিকে আছে ঐতিহ্যের উদাহরণ হয়ে। সঙ নাচের সাথে গানের ব্যবহারও আছে। প্রাবন্ধিক বীরেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় 'বাংলাদেশের সঙ প্রসঙ্গে' বইতে সেইসব হারিয়ে যাওয়া সঙের কথা লিখেছেন। 

ষষ্ঠ দিনে হয় ‘নীল পূজা'। নীলকন্ঠ শিবের আরাধনা। ‘নীলের ব্রত’ পালন করেন মহিলারা। শিবের মতো স্বামী পাওয়ার আশায় তাঁরা শিবের মাথায় জল ঢালেন। আর শিবের নামে করেন 'নীলের ব্রত’। যেহেতু শিব পরিচিত ‘নীলকন্ঠ’ নামে, তাই এই বাংলার গাজনকে ‘নীলপুজো' ও বলা হয়। দক্ষিণবঙ্গে যা নীলপূজা, তাইই উত্তরবঙ্গে তথা মালদহ জেলায় ‘গম্ভীরা’। একে সংস্কৃতে বলা হয় ‘কালার্করুদ্রপূজা’। অর্থাৎ কাল সদৃশ ভীষণ অর্ক বা সূর্যের পুজো।

শিব হল কৃষির অতি সাধারণ এক গেঁয়ো দেবতা। গ্রামের মহিলাদের প্রার্থনা তাঁদের স্বামী হোক শিবের মতো অতি সাধারণ লোক। অর্থাৎ উচ্চাকাঙ্ক্ষী নয়, বেশি পাওয়ার লোভ নয়, মোটামুটি দিনে দু'বেলা ভাত দেওয়ার ক্ষমতাধর মানুষই হোক তাঁদের জীবনসঙ্গী। এ আসলে আপামর বাঙালি সমাজের গ্রামীণ মহিলাদের মনের অব্যক্ত প্রার্থনা। ‘নীলের ব্রত’ আসলে উদ্ঘাটন করেছে সেই আপাত সত্যটিকেই।

নীলের ব্রততে শিবের মাথায় জল ঢালতে আসেন হাজার হাজার মহিলা ও পুরুষ। তাঁরা জল ঢালেন মূল শিবকুণ্ডতে এবং সূর্য অর্ঘ্যতে। তবে প্রথমে মন্দিরের ১৬ জন সন্ন্যাসী জল ঢালার পর মানসিক ভক্তা এবং বাকিরা জল ঢালার অনুমতি পান। এদিন সন্ধ্যায় সকলের মঙ্গলের জন্য মন্দিরে ধুনা পুড়ানো হয়। এই নিয়ম কেবল এদিনই হয়। আচার্য পুরোহিত সেবা ডেকে ধুনা পোড়ান। 

এদিন রাতে একটি বিশেষ উপচার পালিত হয়। নীলের ব্রতে যাঁরা দুধ নিয়ে আসেন তা রেখে দেওয়া হয় একটি বড় পাত্রতে। ঐ দুধ রাত্রি ৯ টার সময় মন্দিরের গর্ভগৃহে শিবের মাথায় ঢালা হয়। তা ‘নেতনালা’ দিয়ে গিয়ে পড়ে শিবকুণ্ডতে। যখন দুধ নেতনালা দিয়ে গড়িয়ে শিবকুণ্ডতে যায় তখন ঐ দুধ সংগ্রহ করে রাখা হয় বড় হাঁড়িতে। নতুন গামছা দিয়ে তা বাঁধা হয়। সোনা বা তামার পয়সা দিয়ে সিল করা হয়। একে বলে 'ভাঁড়ার ধরা’। এই হাঁড়িটিকে এরপর মন্দিরে নিয়ে গিয়ে রাখা হয়। সেটি ১লা বৈশাখ ১৬ জন সন্ন্যাসীর ‘উতরি' খোলার দিন প্রসাদ হিসেবে দেওয়া হয়। এছাড়া ১২ টি গ্রামেই তা বিতরণ করার রেওয়াজ রয়েছে।

এরপরই নেতনালা দিয়ে ছাড়া হয় মাগুর মাছ। তখন নেতনালার ‘আমিষ জল’ খেয়ে সন্ন্যাসীরা ব্রত মুক্ত হন। এরপর তাঁরা মন্দিরের পুকুরঘাটে গিয়ে ঐ মাগুরমাছটি তিনবার দেখে পুকুরের জলে ছেড়ে দেয়। এরপর সন্ন্যাসীরা মন্দিরে গিয়ে 'মেল ঘর' দেখে প্রণাম করে। এখানে প্রসাদ গ্রহণ করে বাড়িতে গিয়ে খাওয়া দাওয়া করে। সন্ন্যাসী থাকাকালীন ভক্তারা নিজের থুতুটুকুও খায়না, সহবাস করে না, বাড়িতে থাকে না। মন্দিরেই রাত কাটান। নানা কৃচ্ছ্বসাধন করে তাঁরা।

সংক্রান্তির আগের দিন নীলপূজাতে চড়কগাছ পূজা করা হয়। পান সুপারী দিয়ে ‘পাট ভক্তা’ ও ‘দেউলা ভক্তা'' প্রণাম করে আসে পুকুরে। সন্ধ্যা ৬ টা নাগাদ এই উপচারটি পালিত হয়। পরের দিনই চড়ক সংক্রান্তি। সন্ন্যাসীরা যে ধুনাচুরটি ব্যবহার করেন তাকে বলা হয় ‘দণ্ড সামাই’। প্রতিদিন রাতে পাঁচ ভোগ পর্যন্ত (রাত দুটায়) সন্ন্যাসীদের নাভি সেঁকা হয়। তারপর ভোগমুদার ভোগ ভাসানো হয়। সারাদিনে সন্ন্যাসীরা দু’বার খেতে পারেন। কাঁচকলা, ঘি, আতপ চাল, আলু দিয়ে তাঁরা তৈরি করেন হব্যিষান্ন। তেলহীন এবং লবণ ছাড়া খাবার খান। খাওয়ার সময় কথা বলা চলবে না। নাম ধরে ডাকা চলবে না।

শোনা যায়, রাজা বল্লাল সেন নিজে বৌদ্ধতান্ত্রিক ধর্মে অনুরক্ত থেকেও চড়ক সংক্রান্তির সাথে যুক্ত করেছিলেন ধর্মপ্রাণ মহিলাদের জন্য নীলার্ক দেবের পূজাকে। শিবের আরেক নাম ‘নীলার্ক’। গাজনের এই উৎসবে গ্রামীণ মহিলাদের একাত্মীভূত হওয়া সেই শুরু। গাজন হয়ে উঠলো সবার উৎসব। গবেষক চিন্তামণি চট্টোপাধ্যায়ের উক্তি— “কতদিন হতে চড়ক পূজা আমাদের দেশে প্রবর্তিত তাহা নির্ণয় করা কঠিন। তবে এ দেশে যে পূজাপদ্ধতি বিরাজমান, বিশ্লেষণ করিয়া দেখিলে তাহার অন্তরালে বৌদ্ধ প্রভাব যে সমধিক পরিমাণে বিদ্যমান, তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই।”

যাইহোক, চৈত্রের শেষদিন ভোর চারটেতে সন্ন্যাসীরা পালন করেন ভিন্ন স্বাদের লোকাচার। ‘আকন ঘর’ পোড়ানো হয়। বর কনে সেজে এই ঘর পোড়ানো হয়। দেউলা ভক্তা সাজেন বর এবং পাট ভক্তা সাজেন বউ। খড়, পাতা দিয়ে ছোট্ট ঘুপচি ঘর তৈরি হয়। সেখানে থাকে বেদী। এই বেদীর ওপর রাখা থাকে বিচাকলার ‘গর্ভ মোচা’। এখানে একটি মাগুর মাছ কাটা হয়। এখান থেকে এসে বর কনে চড়ক গাছের কাছে প্রণাম করে ‘মাগন’-এ বের হয়। ‘মাগন' অর্থাৎ মাগা বা চাওয়া। ১২টি গ্রামের বিশিষ্টদের বাড়িতে গিয়ে তাঁরা চাল, ডাল, টাকা সংগ্রহ করেন। সকালেই মাগনের কাজ শেষ হয়ে যায়। 

চড়কের দিন বিকেলে প্রথমে ‘ঘাইপূজা’ হয়। তারপর কাঁটা পূজা হয়। কাঁটাকে বলা হয় ‘কালবুথ’। তারপর হয় গাছ পূজা। শালকাঠের তৈরি চড়কগাছ। সন্ধ্যে নাগাদ পিঠফোঁড়া হয়। এক শ্রেণির মানুষ পিঠফোঁড় করে চড়ক গাছে বন বন করে ঘোরেন। অনেক যায়গায় পিঠে গামছা বেঁধে ঘোরা হয়। 

গাজনে ‘চড়ক’ ঘোরা একটি অতি পালনীয় অঙ্গ। চৈত্রের শেষ দিনে দণ্ডায়মান একটি দীর্ঘ শালগাছের গুঁড়িতে চক্রাকারে ঘোরে ভক্তরা। একে বলে ‘গাছ জাগানো”। এই শালগাছকে বলে ‘গজারি’। যা কিনা শিবের অন্য নাম। আর চক্রাকারে ঘোরা তথা 'চক্র' শব্দ থেকে এসেছে ‘চড়ক'। প্রাচীনকাল থেকেই সংক্রান্তিতে সূর্য পূজার রীতি রয়েছে। দ্বাদশ রাশিতে চক্রাকারে আবর্তনের শেষ পর্বে সূর্যের প্রবেশ ঘটে মীন রাশিতে। তেমনি চৈত্রের শেষ দিন তথা সংক্রান্তিতে সূর্যের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ অয়ন বা যাত্রা শুরু হয়ে থাকে। ‘চড়ক’ তথা ‘চক্র পথে আবর্তন' আসলে সেই মুহূর্তে সূর্যের দ্বাদশ রাশির চক্রপথে আবর্তনের সূচনার প্রতীক মাত্র। চড়ক শুরুর আগে গাজনের ভক্তারা নিয়োজিত হন নানা লৌকিক উপচারে। গাজনে শিবের আরাধনা হলেও চড়কে কিন্তু সূর্যপূজার রীতি। সব মিলিয়ে বাংলার গাজন উৎসবের প্রতি ছত্রে লুকিয়ে রয়েছে একটা লোকায়ত ভাবনার মিশেল।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments