জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৮০

 ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা - ৮০

সম্পাদকীয়,
'ও ময়ূরী, ও ময়ূরী,/ তোমায় আমি বলছি সরি।' না না আমি 'সরি' বলছি না। আমাদের হয়ে সুদীপ আঙ্কেলের তোলা ছবির ময়ূরটাকে সরি বলছে  তোমাদের ছোট্ট বন্ধু সুহেনা। কেন? আরে আমরা বড়োরা তো এই ময়ূরের পেখম ছিঁড়ে নিয়ে মেলায় বিক্রি করছি কিনছি। তাই শুনে সুহেনার খুব খারাপ লেগেছ। তাই সরি বলছে। ছবির এই ময়ূরটার বাড়ি কোথায় জানো? পুরুলিয়া। যেখানে রাঙা পলাশের সারি সেজে ওঠে বসন্তের আদরে, ঠিক অনুভব যে ছবিটা এঁকেছে সেটার মতো। ময়ূর ছাড়াও বাসবদত্তা আন্টির লেখায় আজ পেলিকান, ফ্লেমিংগোর গল্প শুনে নেব, ছবিও দেখে নেব। হ্যাঁ, ময়ূরের মতো এদের পেখম নেই বটে তবে ওড়ার জন্য দুটো ডানা তো আছে। কি মজা না? এই পাখিদের নিয়ে অসাধারণ একটা বই পড়েছিলাম, নাম - বিহঙ্গ বাসনা। লেখক - নারায়ণ সান্যাল। আজ পীযূষ আঙ্কেল এনার কথা তোমাদের বলেছেন। পাখির ছবি তো দেখলে, ফুলেরও। এবার তবে গল্প শোনো, চাঁদের গল্প। গৌতম আঙ্কেল চাঁদের দেশের রূপকথার গল্প বলেছেন ছড়ায়। গল্প এখানেই কিন্তু শেষ নয়। যে মানুষটি গল্প শুরু করলে আর থামেন না, আজ সেই রাঙাপিসির গল্প নিয়ে হাজির শ্রীকান্ত আঙ্কেল। রাঙাপিসিকে ভুললে নাকি! জানতাম, বলবে তা কখনো হয়? রাঙাপিসি তো হিরের নাকছাবির গল্প বলেছেন, ওদিকে তৃষ্ণা আন্টির গল্পে জগোপিসি কি করেছেন জানো? শুনলে হেসেই মরবে, কাকেদের মারতে গুলতি বানিয়েছে। তারপর? তারপর জানতে গেলে পড়ে নাও বাকিটা। পড়ার কথায় মনে পড়ে গেল বইদিবসে বই পড়েছো তো? কি বই পড়লে লিখে পাঠিও কিন্তু। এসো আরো বই পড়ি, ভালো  বই পড়ি। --- মৌসুমী ঘোষ।

ধারাবাহিক উপন্যাস
জয়াবতীর জয়যাত্রা
দ্বাদশ পর্ব
তৃষ্ণা বসাক
 
১৬
 
সেদিন এইসব নিয়েই কেটে গেল। পরের দিন সকালে পড়তে গিয়ে  জয়াবতী বলে ‘আস্তাবলে রাতে পাহারার কতাটা আবার তালেগোলে ভুলে যাবেন না সেনমশাই’
পুণ্যি এবার রেগে বলে ‘তুই থামবি? সব তাতে সর্দারি। তুই ঘোড়াটা নিয়ে ঘরে রাখ না,’
জয়াবতী অমনি বলে ‘ঠিক বলেচিস। সেনমশাই, আমাদের ঘরে না হোক, অন্দরের উটোনেই রেকে দিন ঘোড়াটা। ওখানে তো পবন লেঠেল এমনিই রাতপাহারা দ্যায়’
সেনমশাই দেখলেন কথাটার যুক্তি আছে। তিনি বললেন ‘সেই ভালো , অন্দরের উঠোনেই থাকুক ঘোড়া’
এ কথা ঠাকমার কানে যেতে তিনি বেঁকে বসলেন ‘ককখনো না, আমার তুলসীমঞ্চ ওখানে,  সাত ঘট উজিয়ে আসা ঘোড়া ওখানে থাকবে? রাম রাম’
ঠাকুমা শুধু না, খুড়িমাও দেখা গেল ঘোড়া এখানে রাখার বিপক্ষে। শুধু জগোপিসি মত দিল। একদিনেই  জগোপিসি আমূল পালটে গেছে। ওদের সব কিছুতেই সায় দিচ্ছে সে। এমনকি একটা গুলতিও বানিয়ে দিয়েছে জয়াবতীকে। দিয়েছে অবশ্য নিজের দরকারে। আমসত্ত্ব, বড়ি বানিয়ে রোদে শুকুত দ্যায় জগোপিসি। কাগেরা তক্কে তক্কে থাকে। কাগেদের শায়েস্তা করার জন্যেই গুলতি বানিয়েছে পিসি, কিন্তু নিজের টিপ নেই। তাই জয়াবতীকে গছিয়ে দিয়েছে। দিয়ে বলেছে ‘তুই তো পেয়াদার বাবা, চোর ডাকাত ধরে বেড়াস, তুই এটা রাখ। আর সকালের দিকে কাগ তাড়াস খেয়াল করে।’
যে কারণেই দিক, গুলতিটা পেয়ে খুব সুবিধেই হয়েছে জয়াবতীর। সে কাগ তাড়ানোই হোক আর গাছের আম পাড়াই হোক। সবচে বড় কথা, কাছে একটা অস্তর থাকা ভালো, বুকে বল আসে। সে রাতে বালিশের নিচে গুলতিটা নিয়ে ঘুমোয়, সারাদিন গুলতিটা তার কোমরে গোঁজা থাকে।
 
পুণ্যি সেদিন ফিক করে হেসে বললে ‘তুই দেকালি বটে গঙ্গাজল!এবার রণপা নিয়ে রঘু ডাকাতের দলে ভিড়ে গেলেই হয়। কোতায় মানুষকে বাঁচাবার জন্যে কবরেজি শিকচিস, তা না, গুলতি নিয়ে ঘোরা’
জয়া ক্ষেপে গিয়ে বলেছে ‘যা বুজিস না, তা নিয়ে কতা বলতে আসিস না। মা দুগগার দশ হাতে কটা অস্তর বল দিকি? তেনাকে তো বলতে যাস না, মা তুমিও রঘু ডাকাতের দলে ভিড়ে যাও, উল্টে ফুল বেলপাতা দিয়ে পুজো করিস। অস্তর মানে  বুকের সাহস। এ দেকলে এমনিই লোকে ভয় পায়, কাউকে মারার দরকার হয় না। আর এটা এমন কি বল দিকি। শাড়ির পাড় ছিঁড়ে বানিয়েচে। চামড়া দিলে কত মজবুত হত’
‘তুই অবাক করলি গঙ্গাজল! বেধবা মানুষ  চামড়া ছোঁবে?’
‘আহহা কাশী থেকে পণ্ডিত এলেন বড়, আর গায়ে যেটা লাগানো আচে, এটাও তো চামড়া, না কি? নাকি বেধবাদের শুধু হাড় আর মাস থাকে শরীরে? চামড়া থাকে না?’
‘বড্ড এঁড়ে তক্ক করিস বাপু’
রাগ করে পাশ ফিরে শোয় পুণ্যি। এমনই তার ঘুম পেয়েছে বেজায়। আজও মাঠে খুব ছোটাছুটি করেছে তিনজনে মিলে।
জয়ারও ঘুম পেয়েছিল। সেও ঘুমিয়ে পড়ল একটু পরেই। কিন্তু খানিক রাতে তার ঘুম ভেঙে গেল। কেমন একটা অদ্ভুত আওয়াজ হচ্ছে না? একটু চুপ করে কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করল জয়াবতী। কেউ যেন ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। মানুষ এত জোরে নিঃশ্বাস নেয় নাকি? পর ক্ষণেই ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সে তড়াক করে ওঠে। এ তো ঘোড়ার নিঃশ্বাসের আওয়াজ। কদিন ধরে ঘোড়াটাকে খুঁটিয়ে দেখছে সে, ঘুমের সময় তো এত জোরে নিঃশ্বাস ফেলে না ঘোড়াটা। এত রাতে জাগার কারণ কি? পুণ্যিকে ডাকতে গিয়েও ডাকে না সে। 
উঠেই নানান প্রশ্ন করবে। আর ভয়ও পাবে। যা ভীতু। জয়াবতী পা টিপে টিপে উঠে দরজার খিল খোলে।আকাশে তখন নখের মতন তৃতীয়ার চাঁদ, তাতে আলোর চেয়ে অন্ধকার বেশি। উঠোনের এক কোণে   পবন, যার জাগার কথা,  একপাশে গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে, আর ঘোড়াটা দাঁড়িয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে।কিন্তু কেন? জয়া হঠাৎ দেখতে পেল, একটা রোগা কালো মত লোক ঘোড়ার খাওয়ার মেজলায় কী একটা মিশিয়ে সুট করে পাঁচিলের দিকে যাচ্ছে। অন্ধকারেও জয়া চিনতে পারে তাকে। এই তো হারান, যাকে প্যাকাটি বলেছে রামতারক কবরেজের চর। তারমানে আগেরবার এই হারানই বিষ দিয়ে ঘোড়াটাকে মেরেছিল। প্যাকাটি তাহলে মিথ্যে বলেনি। জয়া দেখল লোকটা পাঁচিল বেয়ে উঠছে একটা দড়ি বেয়ে বেয়ে, দড়িটার মাঝে মাঝে সিঁড়ির মত গাঁট।  পালিয়ে গেলে তো প্রমাণ করাই যাবে না এই বিষ মিশিয়েছে। জয়া বিদ্যুতগতিতে ছুটে ঘোড়ার মেজলা দূরে সরিয়ে দ্যায় আর লোকটাকে টিপ করে গুলতি ছোঁড়ে। লোকটা আঁক করে চিৎকার করে উঠোনে পড়ে যায়, আর সেই চিৎকারে শুধু পবনের ঘুম ভেঙে যায়, তাই নয়, সব ঘরের দরজা খুলে যায়। সেনমশাই, খুড়িমা, ঠাকুমা, প্যাকাটি, জগোপিসি সবাই বেরিয়ে আসে, আর হ্যাঁ ঘুমকাতুরে পুণ্যিও। সে এসে প্রথমেই জয়াবতীকে জড়িয়ে ধরে বলে ‘ধন্যি বটে তুই গঙ্গাজল। গুলতি দিয়েই ঘোড়াচোর ঘায়েল করে ফেললি? তোর কোতাও লাগেনি তো?’ সবাই এত অবাক যে প্রথমে কেউ কোন কথাই বলতে পারছিল না।। রামতারক কবরেজের পেটে পেটে এত। কেউ ভাবতেই পারে না। দেখা গেল ঘোড়া মারতে এসেছিল রামতারক কবরেজের চাকর হারান! কি লজ্জার কতা মাগো!
সেনমশাই জয়ার মাথায় হাত দিয়ে বলেন ‘মাগো, তোমার জন্যেই এত ভালো ঘোড়াটা প্রাণে বাঁচল।’
জয়া তাড়াতাড়ি করে বলে ওঠে ‘আমি আর কী করলুম সেনমশাই। সব কিছুই তো করল প্যাঁকাটি। ওই তো প্রথম দিন থেকেই বলছিল, রামতারক কবরেজের ভারি হিংসে আপনার ঘোড়ার ওপর’
জয়ার কথায় পানুর মুখে ভারি মিঠে একটা হাসি খেলে যায়। এই প্রথম ওর মনে হয়, মেয়েগুলো খারাপ না, তাদের বাড়ি যতদিন ইচ্ছে থাকুক। (ক্রমশ)


চাঁদের মায়াবী রাত
গৌতম বাড়ই


গভীর রাতে উল্কি ফোটে চাঁদের গায়ে 
চাঁদের মা বুড়ি কাঁপছিল যে থরথরি।
কে যায় মেঘের যানে চুপটি করে পায়ে 
চরকা ফেলে বুড়িমা বলে - ও হরি! হরি! 

হরির কাজল টানা জলভরা দু  চোখে
চাঁদের দেশে আলো তবু জলকে নাই।
গোলক থেকে অবাক হয় যে লোকে
ওখানে গিয়ে সবুজ পাহাড়ও না পাই । 

আদুরে চাঁদের বানানো কতই গল্প 
মেঘের বাড়ি মেঘযান চাঁদের পড়শী
বনের পাখি ময়না কাহিনী তার কল্প
সবই যেত দেখা হারিয়েছে সে আরশী। 

আরশী মানেই যাদুনগরের সাতকাহন
আরশী মানেই নিজেকে যায় যে দেখা।
আরশী মানেই ছুটন্ত ঘোড়ার সাতবাহন
আরশী মানেই এখন চুপটি করে একা।


হিরের নাকছাবি  
শ্রীকান্ত অধিকারী 

আসলে যার হয় সেই জানে। সামনে বসে আছে বেশ কজন। তাদের চোখগুলো সব মার্বেলের মত। তার দিকে তাক করে। এই বুঝি গুলি বেরোনোর মত বেরিয়ে আসবে। আর এ একেবারে কোনো সূচ টুচ নয় –পিস্তল। যার নাম শুনেই বুক দুরদুর করে, সেই সাক্ষাৎ যম চোখের সামনে তার দিকে উঁচিয়ে। হোক না কান-নাক ফোঁড়া পিস্তল। ছোটো ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে নাক ফুলিয়ে ফুঁপিয়ে বলে, ‘আমাকে কিন্তু সোনার নাকছাবি দিতে হবে। নইলে আমি নাক ফুটো করবো না। আর নাকছাবিও পরব না।’ ছোটোর কান্নামেশা আবদারে বাড়ির সবাই একসঙ্গে হেসে উঠে।  
-‘বালাই ষাট! তুই সোনার নাকছাবি কেন পরবি, তোকে তো হিরে দেব রে। তুই যে 
আমাদের হিরের টুকরো।’ পাশেই বসেছিল রাঙাপিসি। জড়িয়ে ধরে আদর করে বলে,‘নাক ফুটো না করলে হিরের নাকছাবি পরবি কেমন করে। নে নে আয় দেখি।’ রাঙাপিসি ছোটোকে কোলে  বসিয়ে নিয়ে বিউটিশিয়ানকে বলে, ‘নে এবার ফায়ারিং না কী সব করবি বলছিস করে দে।’ 
ছোটো ভয়ে রাঙাপিসিকে আরো জোরে জাপটে ধরে।  
রাঙাপিসি যেদিন থেকে এসেছে সেদিন থেকে বাবার কান পাকিয়ে দেয়,-- ‘একজন কান ফোঁড়ওলাকে নিয়ে আসিস কেন, মেয়েটার নাকের লতিগুলো মোটা হয়ে যাবে তখন ফুঁড়তে যে কষ্ট হবে সে খেয়াল রাখিস?’ কিন্তু তাতেও যখন কোনও কান নাক ফোঁড়ানিকে বাবা নিয়ে এলো না তখন নিজেই কোত্থেকে এক বিউটিশিয়ানকে ধরে বেঁধে নিয়ে আসে। কার কাছে শুনেছে আগেকার দিনের মত আর সূচ ফোটাতে হয় না, পিস্তল দিয়ে এক টিপ দিলেই হল। কোনো রকম কষ্টই হয় না। তারপর তো এই অবস্থা। তবে কখন কান দুটো ফুঁড়ে ছিল ছোটোর আর খেয়াল নেই।
পাশে সেই কথাগুলো চুপ করে শুনছিল আর ফিকফিক করে হাসছিল মেনকা আন্টি। হাতে পিস্তল। ওই  দিয়ে সে নাক ফুঁড়বে। সে একেবারে হাওমাও করে ওঠে।–‘বলে, ‘হিরে ! বাবগো মা গো তোমাকে হিরে দেবে! হিরের দাম কত জানো।’ বেশ বড় বড় চোখ করে ছোটর দিকে তাকিয়ে থাকে।  
--‘হিরে তো আকাশ থেকে পড়ে। বৃষ্টির মত পড়ে।’ছোটো গলা উঁচিয়ে বলে। 
আন্টি হাসি হাসি মুখে বলে,-‘তাই বুঝি। তাহলে ত একদিন ঝুঁড়ি নিয়ে কুড়োতে যেতে হবে।’ 
--‘না গো আন্টি হেসো না। সত্যি সত্যি আকাশ থেকে দানা দানা হিরে পড়ে। শুধু কুড়োলেই হয়।’ 
মেনকা আন্টিকে সঞ্জয় বোঝায়, ‘আমরা যে গ্রহে বাস করি, সেই রকম আরও গ্রহ ছড়িয়ে আছে ওই ওপরে,--আকাশে। তারা সব নিজের নিজের পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই রকম গ্রহ হল নেপচুন,শনি, ইউরেনাস,বৃহস্পতি। এরা সব আমাদের পৃথিবী থেকে অনেক অনেক দূরে। কেবল ছোট্ট একটা এল ই ডি লাইটের মত লাগে, নেপচুন তো আরো অনেক দূরে থাকে। তাই তার আলো দেখতে পাই না।মানুষ সেখানে যেতেই পারে না। কিন্তু সেখানে এমনি এমনি আমাদের মত আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়ে না, হয় অ্যাসিড না হয় তো এই হিরে। পড়েই যায়।--ক্লাসে ম্যাডাম বলেছেন।’ 
এতক্ষণ মেনকা আন্টি,ওর মা এমন ভাবে মন দিয়ে শুনছিল যেন পারলে এক্ষুনি ছুটে গিয়ে আম কুড়োনোর মত এক ঝুড়ি হিরে কুড়িয়ে আনে। রাঙাপিসিও সঞ্জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ওর নেপচুন গ্রহে হিরের বৃষ্টি খসার গল্প শুনছিল। 
--‘আমিও দেখেছি। আকাশ থেকে হিরে পড়তে। রাঙাপিসি মাথা দুলিয়ে বলে, ওরে তোদের ঐ নেপচুন বৃহস্পতির কাছে যেতে হবে না এই পৃথিবীই বা কম কীসের! কখনো কখনো বৃষ্টি পড়ার মত হিরে পড়ে। ওহ! সে এক অভিজ্ঞতা। তখন তোদের এই মাটিতে জন্মই হয় নি।’
রাঙাপিসি পা দুটো এক বার ছড়িয়ে দিয়ে আবার ভাঁজ করে নেয়। তারপর সাধারণ কথা  বলার মত বলতে থাকে তার আকাশ থেকে হিরে পড়ার গল্প।--সেবার গরমটা যেন তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। বর্ষাও যে খুব ভালো মানে টানা মাসকে মাস হয়েছিল তা নয়। মোটামুটি সেপ্টেম্বর মাস ঢুকতে না ঢুকতে উত্তুরে হাওয়া বইতে শুরু করে। শোবার সময় হালকা চাদর নিয়ে শুতে হয়। ঘুমের ঘোরে গায়ে ঢাকা নিলে বেশ ঘুমটা গাঢ় হয়। এমন দিনে বাবা ঘোষণা করল, দু এক দিনের মধ্যেই উল্কাপাত হবে। দেখে মনে হবে ঝুড়ি ঝুড়ি হিরক খণ্ড কেউ যেন ছুঁড়ছে। 
মা বলল,‘তাতে আর কি। এ তো নতুন কথা কিছু নয়। ও মাঝে মাঝে এমনি এমনি পড়ে। হামেশাই পড়ে। সাঁ করে আকাশের এ কোণ থেকে সে কোণ বরাবর চলে যায় চোখের নিমেষে। মনে মনে সে সময় কত ইচ্ছা প্রকাশ করেছি। চোখ বন্ধ করে বলেছি,-কাল যেন স্কুল ছুটি হয়ে যায় কিংবা অঙ্কের জীতেন স্যার যেন না আসে। আমার বন্ধু বীথির জ্বর যেন শিগগির ভালো হয়ে যায়।’ 
বাবা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, ‘না না সে সব চুটকো চাটকা নয়, একেবারে অঝোর ধারায় বৃষ্টি। দিনে রাতে সব সময়। তবে দিনে ত দেখতে পাবে না। রাতেই ফাঁকা জায়গা থেকে দেখা যাবে। এই দ্যাখো পেপারে কী বলেছে,--আগুনের রোশনাইয়ের মত ফুলঝুরি হয়ে ঝরে পড়বে।’  
সেদিন তবু ব্যাপারটা কেউ তেমন ভাবে গুরুত্ব না দিলেও বাবা কিন্তু সন্ধে হতে না হতেই আমাদের সবাইকে --মা ছোটোপিসি কাকিমা দাদু ঠানদি আর সব পাড়াতুতো বারো জন ভাই বোনকে পাল পুকুরের খোলা মাঠে নিয়ে গিয়ে হাজির। সার দিয়ে বসে আমরা সব ভাই বোনে। তাকিয়ে আছি ঘাড় উঁচু করে পুব আকাশের দিকে। এই বুঝি আকাশ থেকে ফুলঝুরির রোশনাই ঝরে পড়ছে। 
ততক্ষণে চারপাশ থেকে হালকা শিরশিরে বাতাস গায়ে এসে লাগছে। খেয়াল করি নি কখন একটা জমাট অন্ধকার আমাদের ঘিরে ধরেছে। চারপাশে কিচ্ছু দেখা যায় না। শুধু মনে হচ্ছে পেছনে আমাদের গ্রাম আর সামনে শুধু ধান ক্ষেত। ক্ষেত আর ক্ষেত। শরতের শিশির ভেজা সন্ধেই মন প্রাণ ভরে নিঃশব্দে উৎকন্ঠাই আছি সেই অলৌকিক কিছু একটা দেখার। 
কিন্তু তার দেখা নেই। এক এক সময় আমরা ছেলেমেয়েরা নিস্তব্ধতা ভেঙে কলরব করে  উঠছি। মা কাকিমারা নিজেদের মধ্যে চাপাস্বরে কিছু একটা বলে হাসাহাসি করছে। ঠানদি আর দাদুকে দেখলাম একজায়গায় চুপ করে আকাশের দিকে চেয়ে। ছেলে যখন বলেছে নিশ্চয় সে রকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মাঝে একবার গম্ভীর গলায় ধমকে ওঠে, ‘মহাজাগতিক ব্যাপার স্যাপার চাক্ষুস করাও কম সৌভাগ্যের না বুঝলে। একটু ধৈর্য টৈর্যও ধরতে হয়।’ 
মনে পড়ল তখন আমরা আরো ছোট, হ্যালির ধুমকেতু বলে একটা ধূমকেতু অনেক দিন দক্ষিণপূর্ব আকাশে দেখা গেছিল। শোনা যায় এই ধূমকেতূ পঁচাত্তর বছর পর পর আকাশে দেখা যায়। আবার হয়তো সেই একষট্টি বাষট্টি সালে দেখা যাবে। আহা সে এক বিস্ময়!  
বলতে বলতে হঠাৎ পাশে আমাদের ভাই বোনরা কোলাহল করে ওঠে। চমকে তাকিয়ে দেখি সামনে তিরের মত ছুটে আসছে একটা অগ্নি স্ফুলিঙ্গ। কিছুক্ষণ আকাশের মাঝে থাকার পর মাটির কাছাকাছি এসে মিলিয়ে যাচ্ছে। তারপর একটা। আবার একটা। আবার আবার ! দেখতে দেখতে আকাশ রোশনাইয়ে ভরে যায়। ওহ সে কি আলোর ফুলকি ! আমরা সবাই নির্বাক। গায়ে শিহরণ। লোমগুলো খাড়া! এভাবে কতক্ষণ চলেছিল কে জানে , হয়তো সারা রাত সারা দিন! এক সময় মা গায়ে হাত দিতেই চমকে উঠি। বলে –‘চল। অনেক রাত হয়ে গেল।’ 
সঞ্জয় অবাক হয়ে ওর পিসিমার মুখের দিকে তাকিয়ে। সেও তখন হিরের ফুলকি দেখছে।–এ রকমও হয়!  ঠিক তখনি ‘ঊ মা-গো’ বলে চিৎকার করে ওঠে ছোটো। ততক্ষণে মেনকা আন্টি ছোটোর নাকে হিরের নাকছাবি পরিয়ে ফেলেছে। ছোটোর মুখখানা তখন দেখে কে! একদিকে হাসি অন্যদিকে কান্না, একমুখে যন্ত্রণা অন্যমুখে আনন্দে কুন্দ ফুল। দুয়ে মিলে সে এক অন্য রকম মুখ। ... তোমরা যারা প্রথম নাক ফুঁড়ে হিরের নাকছাবি পরবে তখন না হয় নিজের মুখটা নিজেই দেখে নিও। কি বল!


আমার দুঃখ
সুহেনা মন্ডল
পঞ্চম শ্রেণী
জি ডি গোয়েঙ্কা পাবলিক স্কুল, দক্ষিণেশ্বর, নর্থ কোলকাতা

ও ময়ূরী, ও ময়ূরী,
তোমায় আমি বলছি সরি।
তোমার বাবাকে ধরে নিয়ে,
দুষ্টু লোক ছোটে পড়িমরি।
বাজারে পেলাম একটা
পেখম নক্সা করা শাড়ি,
আর একটা আকর্ষনীয়
পেখম লাগানো ঘুড়ি।
জানো, আজকাল কত
পেখম হয় চুরি।
পেখম বেচে টাকা আর টাকা
টাকা ঝুড়ি ঝুড়ি।
তাই,ও ময়ূরী, ও ময়ূরী,
তোমায় আমি বলছি সরি।


স্মরণীয়
(নারায়ণ সান্যাল)
কলমে - পীযূষ প্রতিহার


আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য লেখক নারায়ণ সান্যাল। নিত্যনতুন বিষয় নির্বাচন ও তৎসম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ ও সরেজমিন প্রত্যক্ষ করে রচনা করেছেন একের পর এক কালজয়ী উপন্যাস। গল্পের প্লটের অভিনবত্বে ও তার উপস্থাপনায় নারায়ণ সান্যালের জুড়ি মেলা ভার। তিনি ১৯২৪ সালের ২৬এপ্রিল নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন চিত্তসুখ সান্যাল ও মা ছিলেন বসন্তলতা সান্যাল। তাঁর আদি নিবাস কৃষ্ণনগর হলেও তিনি পড়াশোনা শেষ করেন কলকাতায়। আসানসোল ই. আই. আর. বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন তিনি। স্কুলের খাতায় নাম ছিল নারায়ণদাস সান্যাল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি. এস.সি. পাশ করেন তিনি। ১৯৪৮ সালে শিবপুরের বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বি. ই. পাশ করেন তিনি। নারায়ণ সান্যাল ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার ফেলো ছিলেন। তিনি তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্ট থেকে। পরে তিনি ন্যাশনাল বিল্ডিং অর্গানাইজেশনেও কাজ করেছিলেন কিছুদিন। ১৯৮২ সালে তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন।
    নারায়ণ সান্যালের লেখালেখির বিপুল সম্ভার থেকে কয়েকটি লেখার কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে 'বিশ্বাসঘাতক' উপন্যাসের নাম। হিরোশিমা ও নাগাসাকি তে পরমাণু বোমা নিক্ষেপের পটভূমিতে রচিত এই উপন্যাসে এসেছে বিশ্বের বিখ্যাত সব বিজ্ঞানীর কথা। বাস্তব ও কল্পনার মিশেলে রচিত এই উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের সম্পদ। তাঁর কল্পবিজ্ঞানের গল্পগুলির মধ্যে 'নক্ষত্রলোকের দেবতাত্মা' উল্লেখযোগ্য। আমাদের পরিচিত জগতের বাইরে যে আমাদের চেয়েও উন্নততর জীবেরা রয়েছে সেই সম্ভাবনা নিয়ে এগিয়েছে গল্প। এই বিষয়বস্তু নির্বাচনে তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছেন এরিক ভন দানিকেন এর দ্বারা। এছাড়াও তাঁর জনপ্রিয় রচনা হল - বকুলতলা পি এল ক্যাম্প এবং দন্ডক শবরি। দন্ডকারণ্য অঞ্চলে চাকুরি করার সময়ে লেখা এই উপন্যাস দুটি পাঠকমহলে তাঁকে বিপুল জনপ্রিয়তা দেয়। এছাড়াও তাঁর বহু বিচিত্র ধরণের লেখার বিষয়বস্তু হিসেবে এসেছে প্রাণীজগত, বিজ্ঞান, স্থাপত্য ও ভাস্কর্য, সামাজিক, ঐতিহাসিক ইত্যাদি। গোয়েন্দা সাহিত্যের 'কাঁটা সিরিজ' তাঁর আরেকটি বিখ্যাত রচনা। এই গোয়েন্দা পি কে বাসু চরিত্রটি তিনি সৃষ্টি করেছেন স্ট্যানলি গার্ডনারের প্যারি ম্যাসনের আদলে। 'বিশুপালবধ উপসংহার' গোয়েন্দা কাহিনীটি তিনি লিখেছেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ কাহিনী 'বিশুপালবধ' অবলম্বনে। আর্থার সি ক্লার্কের 'এ স্পেস ওডিসি' থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে মঙ্গল গ্রহে অভিযান নিয়ে লেখা আরেকটি জনপ্রিয় রচনা হল 'হ্যালের যন্ত্র-না'। শিশু কিশোরদের জন্য বেশ কিছু সুখপাঠ্য গ্রন্থ রয়েছে তাঁর। কিশোর সাহিত্যে 'শার্লক হেবো', 'অরিগ্যামি', 'ডিসনিল্যান্ড', 'নাক উঁচু', 'হাতি আর হাতি' বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। নারায়ণ সান্যালের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল - 'হে হংসবলাকা', 'তিমি তিমিঙ্গিল', 'আবার যদি ইচ্ছে করো', 'রূপমঞ্জরী'(তিন খণ্ড), 'না মানুষের পাঁচালী', 'ভারতীয় ভাষ্কর্যে মিথুন', 'অশ্লীলতার দায়ে', 'আজি হতে শতবর্ষ আগে', 'আজি হতে শতবর্ষ পরে', 'আমি নেতাজীকে দেখেছি', 'আমি রাসবিহারীকে দেখেছি' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
    তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য নানা পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ১৯৯৯ সালে তাঁর লেখা 'অপরূপা অজন্তা'র জন্য পেয়েছেন রবীন্দ্র পুরস্কার। ঐতিহাসিক উপন্যাস 'রূপমঞ্জরী'(৩ খণ্ড) র জন্য বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছেন ২০০০ সালে। এছাড়াও তাঁর 'সত্যকাম' উপন্যাসের জন্য বেঙ্গল ফিল্ম সাংবাদিকদের থেকে পেয়েছেন সেরা চলচ্চিত্র গল্প লেখকের সম্মান। 
     ৭ ই ফেব্রুয়ারী ২০০৫ এই জনপ্রিয় সাহিত্যিকের জীবনাবসান হয়।


ধারাবাহিক ভ্রমণ
চলো যাই
(পাখিদের কাছে)
বাসবদত্তা কদম


পর্ব ৯

পেলিকান এক অসম্ভব ভালো সাঁতারু আর শিকারি পাখি। অবশ্যই বিশাল পাখিও বটে। আমাদের বাংলায় এর নাম গগন বেড়। আকাশে উড়ন্ত পেলিকান গগন বেড়ই বটে, একাই একেকজন প্রায় তিন মিটার জায়গা নিয়ে নেয়। এদের কেউ সাদা, কেউ খানিক খয়েরী, অথবা পাটকিলে কিন্তু এদের সকলেরই ঠোঁটের নীচের অংশে একখানা বিশাল থলি আছে। পেলিকানদের এই মাছ রাখার থলি নিয়ে কথা হচ্ছিল আগের পর্বে। খপাৎ করে মাছ ধরে ঠোঁটের থলিতে রেখে দিল, মাছের সাধ্য কি পালায়! ফরফর করতে পারে বটে কিন্তু পালানোর কোনো চান্স নেই। সে থলি এতটাই বড় যে প্রায় দশ লিটার বা তার থেকেও কিছুটা বেশি জল ভরে রাখা যায়। মনে করো একখানা ছোট বালতির কাছাকাছি। এরপর মনের মত পরিমান মাছ সংগ্রহ করা হয়ে গেলে দুই ঠোঁট বন্ধ করে জল ফেলে দেবে দুই ঠোঁটের মধ্যে দিয়ে, আর মাছগুলো গপাং করে পেটে ঝপাং।
পেলিকানরাও আবার সেই বেশ কয়েক রকমের আছে। অস্ট্রেলিয়ান পেলিকান, আমেরিকান পেলিকান, খয়েরী বা পাটকিলে পেলিকান, গোলাপি পিঠের আফ্রিকান পেলিকান, স্পট বিলড (Spot billed) পেলিকান এবং আরো বেশ কয়েক রকম। 
কিন্তু যে সমস্ত পাখিরা উড়ে মাইলের পর মাইল যায় খাদ্য এবং বাসভূমির সন্ধানে, তাদের মধ্যে পেলিকানরাই সম্ভবত সব থেকে বড় পাখি। আরেকটি অদ্ভুত ব্যাপার এদের শরীরের ভিতরে বিভিন্ন জায়গায় চামড়ার নীচে আছে বেশ কিছু হাওয়া ভরে রাখা যায় এমন প্রকোষ্ঠ। এই প্রকোষ্ঠগুলি সম্ভবত এদের সাহায্য করে বিশাল শরীরখানা নিয়ে সাঁই সাঁই উড়তে।
ছোট শক্ত পোক্ত দুখানা পা, পায়ের আঙুল হাঁসেদের মত জোড়া, গলা বেশ লম্বা আর অদ্ভুত দুখানা বিশাল বড় ঠোঁটের মালিক এরা। এমন অদ্ভুত চোয়ালের গঠন যাতে নীচের ঠোঁটের সাথে যুক্ত চামড়ার থলিতে যখন মাছ ধরা পড়বে সে মাছ যেন বেরিয়ে যেতে না পারে। জিভ খুব ছোট যাতে বড় মাছ গিলে খেতেও কোনো অসুবিধা না হয়। 
এরাও সেই কর্ডাটা পর্বের পক্ষী শ্রেণী র পেলিকানডি(Pelecanidae) পরিবারের সদস্য। মাছ এদের প্রধান খাদ্য হলেও ছোট খাটো ব্যাঙ, সাপ, জলজ প্রাণী এমনকি পাখির ছানা পেলেও এরা খায়না এমন নয়। 
পেলিকান ছানাদের ডিম ফুটে বের হতে সময় লাগে প্রায় এক মাস। 
আমরা যে সমস্ত পেলিকানদের দেখা পেলাম, তার মধ্যে বেশ কিছু ছিল স্পট বিলড পেলিকান। আর কিছু খয়েরী বা বাদামী পেলিকান। এদের বাসা দেখলাম গাছের ওপর। তবে সব পেলিকান গাছের ওপরে বাসা বানায় না। মাটিতে, অর্থাৎ জলাশয়ের আশেপাশেও বাসা বানায়। এই স্পট বিলড পেলিকানদের পাশেই ছিল রঙ্গিলা বক বা মানিকজোড়দের বাসা।
পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো পাখিদের মধ্যে যে সমস্ত পাখিদের নাম উঠে আসে তার মধ্যে এই পেলিকানরা অন্যতম। বেশ কয়েক লক্ষ বছর ধরে এরা পৃথিবীর বুকে টিঁকে আছে। তবে যথেচ্ছ রাসায়নিক পোকা মারার ওষুধ, ডিডিটি ইত্যাদি ফসলে স্প্রে করার ফলে সে বিষ জলেও ছড়িয়ে যায়। তার থেকে বহু পেলিকান মারাও যায়।  
পেলিকানরাও দেখলাম বেশ দলবেঁধে বাস করে। দলবেঁধেই গাছের ওপর গল্প করছে। গা পরিষ্কার করছে। জলে নামছে মাছ শিকার করতে। আর ছোট পাখিরা তখন একটু দূরে সরে যাচ্ছে। অমন বড় পাখিকে ভয় পাবেনা এটা কি হয়! ঠিক যেমন জঙ্গলে হাতি বের হোলে অন্য জন্তু জানোয়ার খানিকটা দূরে দূরে সরে তাদের জায়গা করে দেয়।
ভেদানথাঙ্গল দেখা শেষ করে বের হওয়া তো গেলো কিন্তু এই পাখিদের কিচিরমিচির রয়ে গেল মাথার মধ্যে। এর মধ্যে আরো যেখানে যেখানে পাখি আসে কাছাকাছি সে সব জায়গায় ঘুরলাম। এর মধ্যে তামিলনাড়ু অন্ধ্রের সীমানায় শ্রীহরিকোটার পাশে বিশাল জলাশয়, চেন্নাই এর থেকে মহাবলিপুরম যাবার পথে মুথুকাড়ু লেক। চেন্নাই কর্পোরেশনের সীমানায় পাল্লিকারনি মার্শ ল্যাণ্ড বা জলাভূমি এসবই দেখা হয়ে গেছে। বলা যায় যে সমস্ত পাখির নাম আমি আগের পর্বগুলোতে করেছি তাদেরই আবার দেখেছি। দেখতে ভালো লাগলেও মন তো চাইছে নতুন কিছু। 
এরমধ্যে একদিন যাচ্ছি পন্ডিচেরী। চেন্নাইয়ের কাছেই ছোট্ট এক রাজ্য। দূরত্ব মাত্র ১৫০ কিলোমিটার। চলো যাই পন্ডিচেরী। 
যেতে যেতে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে আলু পরোটা খাওয়া হলো। সে সবই বাড়ি থেকে বানিয়ে নিয়ে গেছিলাম। নাহলে ওখানে তো ধূ ধূ প্রান্তর। কিসের দোকান, কিসের কি? খেয়ে দেয়ে হাত ধুচ্ছি আবার গাড়িতে উঠতে হবে। আমাদের সবার চোখ আটকে গেছে রাস্তার উল্টোদিকে। ফ্লেমিংগো। লালচে গলা নীলচে জলে ডুবিয়ে তারা মাছ খুঁজে চলেছে। আমি তো লাফিয়ে উঠেছি। চিড়িয়াখানায় ছাড়া এমন খোলা আকাশের নীচে, মুক্ত হাজার হাজার ফ্লেমিংগো তোমরা কখনো দেখেছ কি না জানি না। আমি দেখিনি। তখন তাড়াতাড়ি ক্যামেরা বার করো। রাস্তা ক্রশ করো। সে রাস্তায় ভয়ানক স্পিডে দৈত্যের মতো লরি আর দূরপাল্লার বাসেরা চলে। কোনোরকমে তো রাস্তা পার হওয়া গেল। ওমা সামনে দেখি খাড়াই বালিয়াড়ি নেমেছে ঝপাং নীচে। এবার কি হবে তাহলে(ক্রমশঃ)

পাঠপ্রতিক্রিয়া
(জ্বলদর্চি ছোটোবেলা ৭৯ পড়ে দোলনচাঁপা তিওয়ারী যা লিখলেন) 

জ্বলদচি পত্রিকাটির আমি একজন একনিষ্ঠ পাঠক। অনেকদিন ধরেই এই পত্রিকাটি পড়ি। এবারের ছোটবেলা বিশেষ সংখ্য 79 . এই সংখ্যাটি পড়ে আমার ভীষণ ভালো লাগলো। এখানে তৃষ্ণা বসাকের "জয়াবতীর  জয় যাত্রা' র "একাদশ পর্বটি যেমন আছে সেরকম আবার সপ্তম শ্রেণীর স্নেহা দাসের এক সুন্দর মনোরম গ্রাম্য চিত্র আমরা পেয়েছি, মা কিশোর মনের এক সুন্দর দিক কেই প্রকাশ করে। লেখক সন্দীপ রায়ের "ছুঁয়ে আসা স্মৃতি" পড়তে পড়তে আমিও আমার ছোটবেলায় ফিরে যাচ্ছিলাম। সুদীপ্তা আদিত্যর "শিরিনবাড়ি" কবিতাটিও এক চিত্রকল্পের সৃষ্টি করে। আর বোন অনামিকার লেখা তো বরাবরই বেশ ভালো গুগোল-গাগিনের  মায়ের মত আমার মাও ছিলেন, তিনি ওই ভাবেই আমাদের শিক্ষা দিতেন, সবাইকে সমানভাবে দেখার। প্রবাহনীল দাসের "বড়বাবুর মনের কথা" গল্পটি পড়ে মনে হবে না যে কোন সপ্তম শ্রেণির ছাত্রের লেখা,  তার হাত বেশ মজবুত এবং উক্ত হাতের লেখা বলেই মনে হয়।  ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কে স্মরণ করে পীযূষ প্রতিহারী লেখাটি পড়ে ও বেশ ভালো লাগলো এক লহমায় যেনো আমি মহেঞ্জোদারো - হরপ্পা তে চলে গেছিলাম। আর বাসব দত্তা মহাশয়ার "চলো যাই" লেখাটি থেকে রাঙা মানিকজোড় পাখির কথা বিশেষভাবে জানলাম। এক কথায় বলা যেতে পারে ছোটদের জন্য এটি একটি অনবদ্য প্রত্রিকা , সকলের পড়া উচিত।

আরও পড়ুন 

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments