কবিতা অ্যাভিনিউ
পর্ব ১৪
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন
আল মাহমুদ
কবি আল মাহমুদের কবিতায় গ্রামীণ নিসর্গ এবং নারীর উন্মুক্ত সৌন্দর্য প্রতিভাত হয়েছে শক্তিময় শব্দের আশ্লেষে।আগের পর্বে এসব আলোচিত হয়েছে।মৃত্তিকাসংলগ্ন লোকায়ত শব্দকে আধুনিক উপলব্ধির আলোকে তিনি আরোও মসৃণ এবং ঐশ্বর্যময় করে তুললেন। স্পন্দিত আবেগের বিশুদ্ধ উচ্চারণ, নিসর্গচেতনা, এবং মানবতাই হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতার আত্মা। কারও প্রতিধ্বনি নয়,শব্দের সংস্কার নয়, আনখশির স্বকীয়তার মধ্য দিয়ে নির্মাণ করেছেন তাঁর শব্দভূমি।এর পাশাপাশি সাম্যবাদী চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর কবিতায়।
‘শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে কিরাতের উঠিয়াছে হাত
হিয়েনসাঙের দেশে শান্তি নামে দেখো প্রিয়তমা,
এশিয়ায় যারা আনে কর্মজীবী সাম্যের দাওয়াত
তাদের পোশাকে এসো এঁটে দিই বীরের তকোমা।
আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন
পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণীর উচ্ছেদ
এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ’
এই মানবতার কথা, প্রেমের কথা তাঁর কবিতায় এসেছে অনিবার্যভাবে।অস্তিত্বের সংগ্রামে বাইরের সঙ্গে ভিতরের সংঘাত এবং তা থেকে উত্তরণের অমোঘ আশ্রয় সামাজিক এবং নান্দনিক ভাষার দ্যোতনায় পেয়েছে ভিন্ন এক মসৃণতা। মূলত বস্তুগত এবং দ্বান্দ্বিক সমাজ প্রক্রিয়ার উপর ভিত্তি করেই নির্মিত হয় ইতিহাস, তৈরি হয় বৈপ্লবিক ফর্ম। সাম্যবাদী অর্থনৈতিক বুনিয়াদের উপর পরম স্বস্তির মন্ত্রে শ্রেনির উচ্ছেদ তিনি চেয়েছেন। তাঁর ইতিহাসচেতনা, সমাজ আগ্রহের বিভিন্ন বিষয় কবিতাকে ভিন্ন এক রূপ ও বিভায় বিকশিত করেছে-
১
নিসর্গের গ্রন্থ থেকে আশৈশব শিখেছি এ–পড়া
প্রেমকেও ভেদ করে সর্বভেদী সবুজের মূল,
চিরস্থায়ী লোকালয় কোন যুগে হয়নি তো গড়া
পারেনি ইজিপ্ট, গ্রীস,সেরাসিন শিল্পীর আঙুল।
২
কালের রেঁদার টানে সর্বশিল্প করে থর থর
৩
মাৎস্যন্যায়ে সায় নেই,আমি কৌম সমাজের লোক
সরল সাম্যের ধ্বনি তুলি নারী তোমার নগরে,
কোনো সামন্তের নামে কোনোদিন রচিনি শোলোক
৪
নদীর চরের প্রতি জলে-খাওয়া ডাঙার কিষাণ
যেমন প্রতিষ্ঠা করে বাজখাই অধিকার তার,
তোমার মস্তকে তেমনি তুলে আছি ন্যায়ের নিশান
দয়া ও দাবিতে দৃঢ় দীপ্তবর্ণ পতাকা আমার,
৫
আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে
হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।
নদীর কাছে গিয়েছিলাম, আছে তোমার কাছে?
হাত দিও না আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে।
কবিতাকে মৃত্তিকালগ্ন পরিচিত বলয়ের ভেতর স্থাপন করে তিনি তাঁকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবেই
" কবিতা চরের পাখি, কুড়োনো হাঁসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস
ম্লানমুখ বউটির দড়ি ছেঁড়া হারানো বাছুর
গোপন চিঠির প্যাডে নীলখামে সাজানো অক্ষর
কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুল খোলা আয়েশা আক্তার ( কবিতা এখন )"
তাঁর কবিতা তাই মাটির আবর্তে বেড়ে ওঠা সপ্রাণ শেকড় ।স্বতস্ফুর্ত ভাবে যা জীবন থেকে উঠে এসেছে। কোথাও আরোপিত কৃত্রিমতা নেই।চেতনা ও পরিবেশের মধ্যে সম্পর্কের প্রশ্নে , নান্দনিকতার প্রশ্নে কবিতাকে অন্বেষণ করেছেন তিনি, স্মৃতির ভেতর, সত্তার ভেতর।
" পিঠার মতো হলুদ মাখা চাঁদ
যেন নরম কলাতায় মোড়া
পোড়া মাটির টুকরো পাত্রকে
স্মৃতি কি ফের লাগাতে পারে জোড়া ? "
জীবনের মৌল ভূমিকে খুঁজে পেয়েছেন বলেই তিনি অপরাজেয়।
" পরাজিত নই নারী পরাজিত হয় না কবিরা
দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা উপশিরা "
তিনি পরাজিত নন বরং স্বমহিমায় বাংলা কবিতার এক অপরাজিত সম্রাট।বাস্তবের মাটিতে পা রেখে প্রকৃত স্বাধীনতা,মানবতা এবং সংগ্রামী উত্তরাধিকারের বিশ্বাস নিয়ে তিনি স্বপ্ন বুনেছেন। আত্মপ্রতিকৃতির উপর ফুটে উঠেছে জ্যামিতিক রেখার তীক্ষ্ণতা। কবিতাগুলির শব্দবোধ এবং ভাষার চলনে প্রসারিত রশ্মিরেখার অপূর্ব চিহ্নটুকু ফুটে ওঠে।
১
হয়তো বা স্বপ্ন ছিল। ঘুমঘোরে মিথ্যার ম্যাজিক
আমাকে দেখিয়েছিল বাষ্পরুদ্ধ চেহারা তোমার।
পাখির বিলাপে ভরা ঘোরলাগা গ্রামের কুটিরে
একটি বালক শুধু শুনেছিল নদীর রোদন।
এখন সে পাড়ি দেয় সপ্তসিন্ধু, দশদিকে চোখ
মায়ার কাজলে ভেজা দৃষ্টি তার ক্লান্তির রুমালে
মুছে নিয়ে ঘরে এসে দেখে কেউই অপেক্ষায় নেই।
২
তার কোন দেশ নেই। নিরুপায় ভিসার বিপাকে
কালেভদ্রে উড়ে আসা শুষ্ক এক নদীর কিনারে।
দাঁড়াও পথিকবর, পত্রহীন অশ্বত্থের শাখা
নড়ে উঠে বোঝায় সে অতিথির অনাত্মীয় নয়।
যদিও চুড়োয় এক শকুনি নিজেই
নিজের পালক ছিঁড়ে উদরের অনল নিভায়।
৩
আর নয় প্রেম, দাও দয়া
আরোগ্যের গন্ধে ভরা হাত
নিঃসীম আকাশে শ্বেত বয়া
ছোঁয় যেন আমার বরাত।
ভাগ্যেরও অদৃশ্যে বসে যিনি
ঠিক রাখে আত্মার বাদাম
আমি ঠিক চিনি বা না চিনি
তারই প্রতি অজস্র সালাম।
৪
আমি তোমাকে কতবার বলেছি আমি বৃক্ষের
মতো অনড় নই
তুমি যতবার ফিরে এসেছ ততবারই ভেবেছ
আমি কদমবৃক্ষ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকব
কিন্তু এখন দেখ আমি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকলেও
হয়ে গিয়েছি বৃক্ষের অধিক এক কম্পমান সত্তা
বাঁশি বাজিয়ে ফুঁ ধরেছি আর চতুর্দিক থেকে
কেঁদে উঠছে রাধারা
আমি কি বলেছিলাম ঘর ভেঙে আমার কাছে
এসো
আমি কি বলেছিলাম যমুনায় কলস ভাসিয়ে সিক্ত অঙ্গে কদমতলায়
মিলিত হও।
৫
কখনো অসৎ থাবা অকস্মাৎ উত্তোলিত হলে
দেখি সেই বিম্বিত পশুর
দর্পিত হিংস্র চোখ আমাকে লক্ষ্য করে জ্বলে।
৬
কবিতা বোঝে না কোন সঙ
অভিনেত্রী নটিনারী নাটের মহল
তার মনে কতটুকু রঙ?
ও পাড়ার সুন্দরী রোজেনা
সারা অঙ্গে ঢেউ তার, তবু মেয়ে
কবিতা বোঝে না।( অবুঝের সমীকরণ)
৭
তিরের ফলার মতো
নিক্ষিপ্ত ভাষার চিৎকার
বাঙলা, বাঙলা
কে নিদ্রামগ্ন আমার মায়ের নাম উচ্চারণ করো ?
৮
আমরা যেখানে যাবো শুনেছি সেখানে নাকি নেই
বাঁচার মতন জল, জলস্রোত, বর্ষণ হবে না
নি-পাখি ভীষণ নীল দগ্ধদেশে উদ্ভিদহীনতা
হা হা করে দিনমান। বাতাসের বিলাসী
বিরোধে
বিহঙ্গ বিব্রত হয়
৯
বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল
পৌরুষ আবৃত করে জলপাই পাতাও থাকবে না
তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিও সেই ফল
জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে হবে চিরচেনা…
চরের মাটির মতো খুলে দাও শরীরের ভাঁজ
উগোল মাছের মাংস তৃপ্ত হোক তোমার কাদায়।
১০
মুকুন্দরামের রক্ত মিশে আছে এ মাটির গায়
ছিন্ন তালপত্র ধরে এসো সেই গ্রন্থ পাঠ করি
কত অশ্রু লেগে আছে এই জীর্ণ তালের পাতায়…
ধ্রুপদের আলাপনে অকস্মাৎ ধরেছি খেউড়
ক্ষমা করো, হে অবলা, ক্ষিপ্ত এই কোকিলের গলা,
তোমার দুধের বাটি খেয়ে যাবে সোনার মেকুর
না- দেখার ভান করে কতবার দেখবে চঞ্চলা…
ললিত সাম্যের ধ্বনি ব্যর্থ হয়ে যাবে বারবার
বর্গিরা লুটেছে ধান, নিম খুনে ভরে জনপদ
তোমার চেয়েও বড়ো, হে শ্যামাঙ্গী, শস্যের বিপদ…
শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে কিরাতেরা উঠিযেছে হাত
হিয়েন সাঙের দেশে শান্তি নামে দেখো
প্রিয়তমা,
এশিয়ায় যারা আনে কর্মজীবী সাম্যের দাওয়াত
তাদের পোশাকে এসো এঁটে দিই বীরের তকোমা…
১১
জ্ঞানের প্রকোষ্ঠে দেখো ঝুলে আছে বিষণ্ণ বাদুড়
১২
আমাদের কলাকেন্দ্রে, আমাদের সর্ব কারুকাজে
অস্তিবাদী জিরাফেরা বাড়িয়েছে ব্যক্তিগত গলা…
১৩
ভুলে গেছি নিজের কী নাম
কী নামে ডাকত লোকে , কোন গ্রামে ছিল বাড়িঘর।
১৪
নিরাসক্ত ব্যথা ও বিস্বাদ
ফোঁটা ফোঁটা ঝরে যাক। দেখা যাক কেমনে সে চায়
আমাকে আরাম দিতে, নিয়ে যেতে আমার স্পন্দন।
১৫
মানুষের শিল্প সে তো নির্বোধের নিত্য কারিগরি
রুমালের আঁকা দাগে রঙিন সুতোয় ফুল তোলা
সাপের অলীক চিত্রে নির্বিষ সাজানো দড়ি
কাদার মূর্তিতে কারও সাধ্যমতো আঁটা পরচুলা…
১৬
পৃথিবীর সবচেয়ে দামী ছিল আমাদের কয়েকটি কবির হৃদয়
আল মাহমুদের কবিতা শুধু কবিতা নয় মানুষের অন্তরলোক এবং বহিবৃত্তের এক অনুপম সমন্বয় গড়ে উঠেছে তাঁর চিন্তাস্থাপত্যে। অস্তিত্বের প্রতিটি উচ্চারণের উপর এসে পড়েছে পরিচিত জগতের আলো যা জীবন অনুধ্যানের জন্য একান্ত জরুরি। ব্যক্তিজীবন এবং যৌথজীবনের ব্যপ্তি ও গভীরতার মধ্যে তাঁর অবাধ ও প্রাণময় সাঁতার। সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির, নিজের কাঠামোর সাথে নিজের অন্তর্গত আমির বহুস্বরিক আদানপ্রদানের মধ্য দিয়ে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন জীবনের সমগ্রতা। ( চলবে)
0 Comments