জ্বলদর্চি

আগডুম রাজ্যে -১২/ অলোক চট্টোপাধ্যায়

আগডুম রাজ্যে -১২ 
অলোক চট্টোপাধ্যায়

সর্দার লোকটা ফিরে এল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রায়। গিয়েছিল ধীরেসুস্থে, ফিরল দৌড়ে দৌড়ে। মুখে খুশি উপচে পড়ছে। - কর্তা বেজায় খুশি হয়েছেন। মনে হয় বকশিসও পাওয়া যাবে। এদের এক্ষুনি নিয়ে যেতে বললেন। সঙ্গে কঞ্চিকাঠির চাবুকটাও নিয়ে যাই। বেত মারতে বলবেন নিশ্চয়ই। তখন দুটোকে আচ্ছা করে পেটানো যাবে। 
অন্য উর্দিধারী তক্ষুনি দৌড়ে কোত্থেকে যেন দু-দুটো চাবুক নিয়ে এল। বলল – দুটো চাবুক নিয়ে যাওয়া উচিত। যদি মারতে মারতে একটা ভেঙে যায় কর্তা চটে যেতে পারেন।
বেশ ভয়াবহ চেহারার লিকলিকে দুটো চাবুক নিয়ে, সেই সঙ্গে দড়ি বাঁধা আমাদেরও নিয়ে চলল তারা। চটপটিরও দেখলাম মুখ শুকিয়ে গেছে। বেচারার জন্যে খুব খারাপ লাগছিল। আমার জন্যেই ওকেও চাবুকের বাড়ি খেতে হবে। তারপর অদৃষ্টে আরো কী দুর্গতি আছে কে জানে ! তার চাইতেও বড় প্রশ্ন এদের কর্তাটি কে? 
বাড়ির ভেতর ঢুকেই সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল। একটা লাল রঙের কারুকার্য্য খচিত দরজা ঠেলে যখন ওরা মস্ত একটা হলঘরের মত জায়গায় নিয়ে এল, আমার তখন অবাক হওয়ার আর কিছু বাকি রইল না। ছোটো ছোটো মোড়ার মত আসনে বসে রয়েছেন পন্ডিত বাঞ্ছারাম। তাতে অবশ্য বিশেষ আশ্চর্য্য হবার কিছু ছিল না, কারণ যারা আমাকে খুঁজছে তাদের ভেতর বাঞ্ছারাম অন্যতম। কিন্তু তার পাশেই বসে রয়েছেন, আর কেউ নন, স্বয়ং মুশকিল মামা এবং চকমকি। তবে কি এরাই বিশ্বাসঘাতকতা করে ধরিয়ে দিলেন আমাকে। তাও কি সম্ভব? পাশে তাকিয়ে দেখি চটপটিও যারপরনাই অবাক হয়ে গেছে ওদের দেখে।
বাঞ্ছারাম পণ্ডিত আমাদের দিকে না তাকিয়ে আমাদের রক্ষীদের দিকে নজর ফেরালেন। তার ভুরুদুটো কুঁচকে গেল । বললেন – এদের কোনোরকম হেনস্থা করেছো কি? তোমাদের হাতে চাবুক কেন?
সর্দার বেশ খুশি খুশি মুখে জানাল – আপনি হুকুম দিলেই যাতে চাবকাতে পারি সেই জন্যেই একেবারে সঙ্গে নিয়ে এসেছি কর্তা। আর হেনস্থার কথা? সেসব কিছু করিনি বটে, দড়ি বেঁধে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে নিয়ে এসেছি শুধু। শেষের কথাটা, বেশ বুঝতে পারলাম, ওদের কর্তাকে খুশি করার জন্যেই বলল। কারণ দড়ি বাঁধা থাকলেও আমরা নিজে নিজেই হেঁটে এসেছি, টানাটানি করার দরকার হয়নি।
সে কথা শুনে কিন্তু বাঞ্ছারাম পণ্ডিত আদৌ খুশি হলেন না। বরং খুব বিরক্ত গলায় বললেন – এদের দড়ি দড়া খুলে এখুনি বিদেয় হও। সর্দারের বোধহয় কথাটা ঠিক বিশ্বাস হল না। তাই জিগ্যেস করল – আর চাবকাতে হবে না?
খন খনে গলায় প্রচন্ড ধমক দিয়ে বাঞ্ছারাম বললেন – খুব ইচ্ছে হলে নিজেরা একজন অন্যজনের পিঠে দশ ঘা করে চাবুক মারো। এখন যাও এখান থেকে। আমার কেমন যেন সন্দেহ হতে লাগল বাঞ্ছারাম অস্করম একটু আজব দেখতে আর প্রথম পরিচয়েই আমাকে পাগল বলা ছাড়া সম্ভবত সেরকম খারাপ লোক নয়।
মুশকিল মামা ইতিমধ্যে আমার কাছে উঠে এসেছেন। একটু হেসে বললেন – আমাদের এখানে দেখে খুব অবাক হয়ে গেছো, না? ভাবছ আমি বাঞ্ছারামের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তোমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছি। অবশ্য কিছুটা তাই বটে, তবে সেটা তোমার জন্যেই। আসলে, যে লোকের কথা আমি তোমাকে বলেছিলাম, যার জানা আছে কিভাবে তুমি ফিরতে পারো নিজের জগতে, সে এই বাঞ্ছারাম পণ্ডিতই। ও শুধু মস্ত জ্ঞানী আর আগডুম রাজ্যের প্রধান সভা পণ্ডিতই নয়, একজন ভাল জাদুকরও। আমরা ছেলেবেলার বন্ধুও, একসাথে পাঠশালায় পড়েছি। ওর কাছেই আমরা এসেছিলাম তোমার বিষয়ে আলোচোনা করতে। তোমার সব কথা আর নিজের জগতে ফিরে যাবার ইচ্ছের কথা ওকে জানিয়েছি। ইতিমধ্যেই বাঞ্ছারাম তোমাদের ধরার জন্যে লোক লাগিয়েছিল। ভালই হয়েছে তোমরা নিজেরাই খুব দেরি না করে ধরা পড়ে গেছো।
ইতিমধ্যে চকমকি আমাদের জন্যে দুটো মোড়ার মত আসন এনে দিয়েছে। আমি আর চটপটি তাতে বসলাম। বাঞ্ছারাম পণ্ডিতের মুখোমুখি। ভাল করে আমার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মিহি গলায়, অনেকটা মন্ত্র উচ্চারণের ঢং এ বললেন – আমি প্রথম দিন থেকেই জানি তুমি চোরও নও আর পাগলও নও। নিছক বিদেশি কিংবা বহিরাগতও নও। তুমি আসলে অন্য কালের বা অন্য লোকের বা হয়ত অন্য মাত্রার জগৎ থেকে কোনো এক দৈব দুর্বিপাকে এখানে ছিটকে এসে পড়েছ। 
আমি খুব বিনয়ের সঙ্গে বললাম – আজ্ঞে হ্যাঁ, আমারও তেমনটাই মনে হচ্ছে। তবে ঐ দৈব দুর্বিপাকটা যে কী ঘটনা আর কেমন  করেই বা ঘটল তার কিছুই বুঝতে পারছি না।
-আরে, তুমি আর কি বুঝবে? তিনি একটু বিরক্ত হয়েই বললেন। - এ তো আমি এতবড় পণ্ডিত হয়েও এখনও পর্যন্ত কিচ্ছু বুঝে উঠতে পারিনি। চার ছ’ জন এরকম এল আর গেল। আমিই ফেরৎ পাঠালাম। কিন্তু কি করে পাঠালাম তা আজ অবধি বুঝতে পারলাম না। এই বলে বাঞ্ছারাম খুব বিমর্ষ মুখে চুপ করে গেল।
মুশকিল মামা খুব চিন্তিত ভাবে বললেন – তাহলে ফেরৎ পাঠাও কী করে?
-তার নিয়ম কানুন আছে, পদ্ধতি প্রকরণ আছে, মন্ত্র আছে। বইতে লেখা আছে সে সব। সে সব ঠিক ঠাক করতে পারলে কাজ উদ্ধার হয়। কিন্তু কেমন করে কী হয় তা আমি জানি না।
-আহা, সে সব জানার কী দরকার? আমি একটু উতলা হয়েই বললাম। - ফিরতে পারলেই আমি খুশি।
-এক শর্তে আমি তোমাকে সেখানে ফেরৎ পাঠাব। বাঞ্ছারাম বললেন। - দ্যাখো বাপু, আমাদের প্রাচীন পুঁথি পত্তরে অনেক জটিল কথা লেখা আছে যার সবকিছুর মর্ম এখনো আমরা উদ্ধার করতে পারিনি। সময় মাপাও এইরকম একটা বিষয়। দণ্ড, প্রহর, পল, বিপল, অনুপল এসব শব্দ সেখানে লেখা আছে। কিন্তু তারা কী, কোন কম্মে লাগে, কেমন করে তাদের মাপে আর মেপে ফেললেও যে কী লাভ হয় সে আমরা জানিনা। দেখো বাপু, আমি অনেক রকম জাদু জানি, বিস্তর কলা-কৌশল জানা আছে আমার, নানা প্রকারের বিদ্যে আমার মাথায় গজগজ করছে। কিন্তু ওই যে তোমার সময় মাপার যন্ত্র, ওটা সম্বন্ধে আমি কিচ্ছুটি জানি না।
এই অবধি বলেই বাঞ্ছারামের চোখদুটো ছলছল করতে লাগল। কাঁদো কাঁদো গলায় তিনি বললেন – ওদিকে আবার রাজামশাই সাতদিনের ভেতর ওরকম একটা যন্ত্র চেয়েছেন। না দিতে পারলে নির্ঘাৎ আমার এমন সুখের চাকরিটা চলে যাবে ! শুধু তাই নয়, লোকে বলবে, বাঞ্ছারাম পণ্ডিত আসলে কিচ্ছুই জানেনা, নানা ভড়ং করে এতদিন আমাদের বোকা বানাচ্ছিল।
আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম – সে নিয়ে ভাবছেন কেন? আমি না হয় এই ঘড়িটা আপনাকে দিয়েই দেব। সময় মাপার কায়দাটাও এমন কিছু কঠিন না। এক্ষুনি শিখে যাবেন।
বলতে বলতেই আমি পকেট থেকে ঘড়িটা বের করে তার হাতে দিলাম। তিনিও ভারি খুশি হলেন বস্তুটা দেখে। অল্প কথায় সময় মাপার ব্যাপারটা তাকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম। মুশকিল মামাও পাশ থেকে নিজের সদ্য শেখা বিদ্যে ফলালেন কিছুকিছু। বাঞ্ছারাম কিন্তু ভারি খুঁতখুঁতে। বললেন – না না সব কিছু একদিনে মাথায় গুঁজে দিলে হবে না। তুমি আমাকে রোজ একটু একটু করে বোঝাবে।
আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম – কিন্তু আপনি যে আমাকে ফেরৎ পাঠাবেন বললেন তার কি হবে?
বাঞ্ছারাম বিরক্ত স্বরে বললেন – ধুৎ, সে কি হুট বললেই হবে ? তার তো একটা দিনক্ষণ আছে, না কি? সে সব হিসেব করে তবে তো যাওয়া। অত অধৈর্য্য হলে চলবে কেন? শেষে কোথায় যেতে কোথায় পৌঁছে যাবে তার ঠিক আছে?
আমি থতিয়ে গিয়ে শুধোলাম – কতদিন পরে সেই দিনক্ষণ আসবে?
-বেশি দিন নয়। বাঞ্ছারাম আশ্বাস দিলেন। - এই ধর আর পঁচিশ কি ছাব্বিশ দিন।
-সেটা কেমন করে হিসেব করলে? এবার মুশকিল মামা জানতে চাইলেন।
-আমি অভিজ্ঞতার থেকে জানি এই যে উটকো লোকেদের হুট করে এসে পড়া, এর সঙ্গে শূন্য চাঁদের একটা যোগাযোগ আছে। এরা যখনই এসেছে, দেখা গেছে সেগুলো ছিল শূন্য চাঁদের রাত। আমিও পুঁথি ঘেঁটে ঠিক ওই রাতেই ফেরৎ পাঠানোর প্রক্রিয়া পালন করলে দেখেছি ঠিকমত ফেরৎ যায়। প্রথম প্রথম অন্য সময়ে চেষ্টা করে দেখা গেছে কিছুতেই যায় না, ছিটকে ফিরে আসে। যা বুঝেছি, এই জগতের মধ্যে কোথাও একটা ফাটল বা গুহা মতন আছে যেটা দিয়ে অন্য সময়ের অন্য মাত্রার জগতে যাওয়া আসা যায়। সেটা আকাশে চাঁদ না থাকলেই তৈরি হয় অথবা চাঁদের বাড়া কমার সঙ্গে কমে বাড়ে আর বাড়তে বাড়তে শূন্য চাঁদের রাতে গোটা মানুষ গলার মতন একটা বড়সড় ফাঁক হয়। সেইখানে তাক করে মন্ত্র তন্ত্রের ধাক্কা দিয়ে কাউকে ঠেলে গুঁজে দিলে তারা আগের জায়গায় পৌঁছে যায়।
শূন্য চাঁদের রাত্তির কথাটার মানে বুঝলাম না। সে কথা বলতে মুশকিল মামা বুঝিয়ে দিলেন - এই যে দেখো চাঁদটা একটা ফালির থেকে বাড়তে বাড়তে একটা থালার মত গোল হয়ে যায়, সে হল গোটা চাঁদ। আর ঠিক তার পর থেকে আবার ক্ষয়ে ক্ষয়ে ছোটো হতে হতে একদম হারিয়ে যায়। সেটাকে বলে শূন্য চাঁদ। আমরা গুনে দেখেছি ঐ একটা শূন্য চাঁদ থেকে আর একটা শূন্য চাঁদে পৌঁছোতে মোটামুটি উনতিরিশটা রাত্তির লাগে। গোটা চাঁদের বেলাতেও তাই। তুমি তিন রাত আগে এখানে এমনি এক শূন্য চাঁদের রাতে এসে পৌঁছেছিলে। তোমার জ্ঞান এসেছিল তার পরদিন সকালে।
বুঝলাম এদের গোটা আর শূন্য চাঁদ হল আমাদের পূর্ণিমা আর অমাবস্যা।
-এই কটা দিন তুমি আমাদের সঙ্গেই থাকবে। খুব নরম স্বরে বাঞ্ছারাম পণ্ডিত বললেন আমায়। - তোমার কোনো ভয় নেই। তুমি থাকবে রাজার অতিথি হয়ে, আমি রাজ অনুমতি নিয়ে আমার প্রাসাদের অতিথিশালায় থাকার ব্যবস্থা করব তোমার। আমাকে সময় মাপা শেখানো ছাড়াও তোমাদের দেশের আরো খোঁজখবর জানাবে। যেটুকু বুঝতে পারি জেনে নেব। কেমন রাজি তো?
আমি বললাম – সে খুব ভাল কথা। তবে আমার মত যদি জিগ্যেস করেন আমি কিন্তু চটপটিদের বাড়িতে থাকাই বেশি পছন্দ করব। আপনার এখানে রোজ আসব, কিন্তু থাকব ওখানেই। স্পষ্ট দেখলাম আমার কথা শুনে চটপটি আর চকমকির মুখ ঝলমলিয়ে উঠল।
-তাই হবে। বাঞ্ছারাম হেসে বললেন। - আর, এই কটা দিন যেখানে খুশি তুমি যেতে পারো, কেউ তোমাকে বিরক্ত করবে না। রাজার সেপাইরা তো নয়ই, ফোড়নদাস বা জগঝম্পও নয়।
আমরা, মানে আমি, চটপটি আর চকমকি, বাঞ্ছারাম অস্করম আর মুশকিল মামার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেশ নিশ্চিন্ত মনে রওনা হলাম ওদের বাড়ির দিকে। পথে শুনলাম মেজো কোতোয়াল বনাম জগঝম্পর যুদ্ধে মোটামুটি ফুটবল খেলার মত ড্র হয়েছে। আরো সেপাই এসে পাগলাগারদের বুড়োকে বন্দীশালায় ধরে নিয়ে গেছে। তবে তারা গায়ের জোরে জগঝম্পর সঙ্গে এঁটে উঠতে পারেনি, উল্টে সেই মেজো কোতোয়ালকে থলির মধ্যে পুরে পাগলা গারদে নিয়ে চলে গেছে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments