জ্বলদর্চি

কবিতা অ্যাভিনিউ-১৫/ বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

কবিতা অ্যাভিনিউ 

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায় 

পর্ব -১৫ 

‘তৃণময় শান্তি হব আমি’ এই অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে কবি শঙ্খ ঘোষ তাঁর  কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন এবং আমৃত্যু তিনি এই অভিমুখ থেকে বিচ্যুত হননি। একদিকে ভালোবাসার কাছে বিনম্র হয়ে মাটি ও মানুষের সাথে ঘাসের মতো মিশে যেতে চেয়েছেন তিনি। অন্যদিকে সমস্ত আঘাতকে বুকের মধ্যে সযত্নে পুষে রেখে,সহ্য করে  শুদ্ধ থেকে শুদ্ধতর মানুষ হয়ে উঠেছেন। এই শুদ্ধতার প্রয়োজন হয়েছে এইজন্যই যে পরিশুদ্ধ হৃদয় ছাড়া মানুষকে যেমন ভালোবাসা যায় না, সেরকমই শুদ্ধ বিবেক ছাড়া ঘটমান এবং প্রবহমান অন্যায়ের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত কবিতা লেখা যায় না। তিনি দেখেছেন, অনুভব করেছেন নীতিহীনতার কারণে ‘ বহুস্বর স্তব্ধ পড়ে আছে ’।মানবতার সপক্ষে তাঁর উচ্চারণ। সাম্য এবং মুক্তির আকাশই তাঁর অন্বেষণ।তাই তিনি মুক্তচিন্তার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, হয়ে উঠেছেন সমাজবিবেক। শুধুমাত্র কবিতা লেখাই কি কবির কাজ? কোন কবিতা ? যে কবিতার ভেতর    অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ-“ আমার যতটুকু সাধ্য, সবিনয়ে ততখানি কাজ করে যাওয়াই আমার ভবিতব্য- আমার বলাও আমার কাজ- তার ফলে কতটা হলো সেটা এই মুহূর্তে আমার বিবেচনার বিষয় ন। লেখার পক্ষে এই হল আমার এক ও একমাত্র ভাবনা’। এই ভাবনাই তাঁর কবিতার সূতিকাগার।  

আজকের  চলমান গদ্যের এই পর্বে কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতায় প্রেম কীভাবে আলোকিত হয়েছে আমাদের দৃষ্টি থাকবে এই জিজ্ঞাসা বলয়ের দিকে । কীভাবে বহুবর্ণে প্রতিফলিত হয়েছে তার স্বরূপ, এই অন্বেষণ থেকেই এই পর্বের কিছু কথা। প্রজ্ঞা এবং আবেগের সুচারু সংমিশ্রণের মধ্য দিয়ে অন্তর্জীবনের উন্মোচন ঘটিয়েছেন তিনি। ভালোবাসার এক আশ্রয় খুঁজেছেন গভীরভাবে , এবং মনের ভেতর সেই ভূমিকে তিনি স্পর্শ করেছেন-     

‘বাড়ি কি পেয়েছ তুমি ?
আমি তো পেয়েছি 
মনে-মনে,’ 
পেয়েছেন বলেই তার মনে আত্মচেতনার উদ্ভাস। পেয়েছেন বলেই তিনি কত অনায়াসে লিখতে পারেন 
‘ আচ্ছা চলি, দেখা হবে।
কোনখানে দেখা হতে পারে?
কোথাও ঠিকানা আছে? কোনো অভিজ্ঞান? কোনো ছুতো? 
কীভাবে বলবে তবে উঠে এসো, গান গাও, বাঁচো’।
কবি শঙ্খ ঘোষের প্রেম ভিন্ন এক মাত্রা নিয়ে আসে। আমাদের চৈতন্যজগতে রেখে যায় মোলায়েম স্পর্শ।   
দুপুরে রুক্ষ গাছের পাতার
কোমলতাটুকু হারালে 
তোমাকে বকব, ভীষণ বকব আড়ালে।
এই কোমলতার নামই তো ভালোবাসা। যে কবি বলতে পারেন-‘তোমার দুঃখের পাশে বসে আছি’  তিনি মানুষ অন্তর ছুঁয়ে আছেন। তিনি অনুভব করেছেন-‘ দেখেছি তো হঠাৎ নিরালা অবকাশে/ মানুষ এখনও কত বিসারী  মেঘের মতো নেমে আসে মানুষের পাশে’ তাই কোন রুক্ষতার ভেতরে মানুষের  হারিয়ে যাওয়া চলে না। নিবিড় স্পর্শে এই কবিতা সমস্ত কালের সমস্ত বয়সের মানুষের অন্তরে নরম পলিমাটির অক্ষরে  প্রেমের স্বাক্ষর রেখে যায়।  

অন্য একটি কবিতার কথা বলি যেখানে ভালোবাসার উপর সময়ের ছায়া এসে পড়েছে। এই কবিতা একটি বিশেষ সময়ে লেখা হলেও সময়  অতিক্রম করে এই কবিতাটি হয়ে উঠেছে  চিরকালীন। বিপ্লবের জন্য মেয়েটি ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমেছিল। হয়তো সে ঠিকানার সন্ধান পাবে এই ছিল তার দৃঢ় প্রত্যয়। কিন্তু শেষ অবধি সে মিলিয়ে গেল রাস্তায়।    

সেই মেয়েটি আমাকে বলেছিল
সঙ্গে এসো, বেরিয়ে এসো, পথে।
আমার পায়ে ছিল দ্বিধার টান
মুহূর্তে সে বুঝেছে অপমান
জেনেছে এই অধীর সংকটে 
পাবে না কারো সহায় একতিলও –
সেই মেয়েটি অশথমূলে বটে 
বিদায় নিয়ে গাইতে গেল গান।

আমি কেবল দেখেছি চোখ চেয়ে
হারিয়ে গেল স্বপ্নে  দিশাহারা 
শ্রাবণময় আকাশভাঙা  চোখ।
বিপ্লবে সে দীর্ঘজীবী হোক
এই ধ্বনিতে জাগিয়েছিল যারা
তাদেরও দিকে তাকায়নি সে মেয়ে
গ্লানির ভারে অবশ করে পাড়া 
মিলিয়ে গেল দুটি পায়ের শ্লোক।

সত্যিই কি মিলিয়ে গেল? রাস্তার অনুসন্ধান করতে এসে রাস্তাতেই কি হারিয়ে গেল তার স্বপ্ন? তবু কবিতার ভেতর তার পায়ের শ্লোক যেন বেজে চলেছে এখনও। এরকমই সময় চিহ্নিত আরেকটি কবিতার কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে- ‘ কথা বলেছিল শাদা তিন বুড়ি/ সকালবেলার প্রথায়/ সবদিক এত চুপচাপ কেন/ সেই ছেলেগুলি কোথায়?

সময় পেরিয়ে গেছে। সত্তরের সেই গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরে ফেলবার অগ্নিবর্ষী আহ্বান, আজ তার কোন অবশেষ নেই। যেদিন যারা যুবতী ছিল, আজ তাদের চামড়া শিথিল হয়েছে। শাদা হয়ে গেছে চুল। কিন্তু আজও তারা খুঁজছে সেই তেজী যুবকগুলিকে।এভাবেই প্রেমকে বিভিন্ন আশ্রয়ের ভেতর সময়ের চিহ্নসহ তিনি তাকে শাব্দিক  আকৃতি দিয়েছেন। আরোও একটি কবিতার কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। ভূমধ্যসাগর। বাঙলা ভাষায় তো বটেই সারা পৃথবীতেও এরকম প্রেমের কবিতা খুব বেশি লেখা হয়নি। 

‘ কলঙ্কে রেখো না কোন ভয়
এমন কলঙ্ক নেই যা এই দেহের চেয়ে বড়ো
এমন আগুন নেই  যা আরো দেহের শুদ্ধি জানে

ধূপের মতন দীর্ঘ  উড়ে যায় মেঘাচ্ছন্ন দিন
তোমারও  শরীরে আজ মিলে যায় সমুদ্রের রঙে 
আমাদের দেখা হবে ভূমধ্যসাগরে’। 

প্রেমের বিচিত্র রূপ এবং গতিপথ সঞ্চারিত হয়েছে তাঁর অজস্র কবিতায়। শঙ্খ ঘোষ আমার কাছে বিস্তৃত পৃথিবী।এই পৃথিবীকে দেখে কৌতুহল আর বিস্ময় অন্তহীন। কখনো ফুরোয় না।  তাঁর সব কবিতা পড়া বা আত্মস্থ করা তো অনেক শ্রম ও সাধনার বিষয়। অজস্র কবিতার কাছে পৌছানোই  হয়নি আমার। তবু আমার সীমাবদ্ধ পাঠ্যসূচি থেকে কিছু কবিতা তুলে ধরলাম।  
  
 ১ 
যুবতী কিছু জানে না, শুধু 
প্রেমের কথা বলে
দেহ আমার সাজিয়েছিল
প্রাচীন বল্কলে।
আমিও পরিবর্তে তার
রেখেছি সব কথা;
শরীর ভরে ঢেলে দিয়েছি 
আগুন, প্রবণতা। 

বলিনি কখনো ?
আমি তো ভেবেছি বলা হয়ে গেছে কবে।
এভাবে নিথর এসে দাঁড়ানো তোমার সামনে
সেই এক বলা
কেননা নীরব এই শরীরের চেয়ে আরও বড়ো
কোনো ভাষা নেই
কেননা শরীর তার দেহহীন উত্থানে জেগে
যতদূর মুছে নিতে জানে
দীর্ঘ চরাচর
তার চেয়ে আর কোনো দীর্ঘতর যবনিকা নেই।
কেননা পড়ন্ত ফুল,চিতার রুপালি ছাই, ধাবমান শেষ ট্রাম 
সকলেই চেয়েছে আশ্রয়
সেকথা বলিনি? তবে কী ভাবে তাকাল এতদিন
জলের কিনারে নিচু জবা?
শূন্যতাই জানো শুধু? শূন্যতার ভিতরে এত ঢেউ আছে
সেকথা জানো না ? 

বুক পেতে শুয়ে আছি ঘাসের উপরে চক্রবালে
তোমার ধানের মুখ ধরে আছি আর্ত দুই ঠোঁট
তুমি চোখ বন্ধ করো,আমিও দুচোখ ঢেকে শুনি
যেন কোন তল থেকে উঠে আসে পাতালের শ্বাস 
সমস্ত দিনের মূর্ছা সেচন পেয়েছে এইখানে
মুহূর্ত এখানে এসে হঠাৎ পেয়েছে তার মানে
নিজের পায়ের চিহ্ন নিজে আর মনেও রাখেনি
আমিও রাখিনি কিছু, তবু হাত রাখে পিছুটান 
মাটিতে বসানো জালা, ঠাণ্ডা বুক ভরে আছে জলে
এখনও বুঝিনি ভালো কাকে ঠিক ভালোবাসা বলে।

নিবেই যখন গেলাম আমি, নিবতে দিয়ো হে পৃথিবী
আমার হাড়ে পাহাড় করো জমা-
মাটি আকাশ বাতাস যখন তুলবে দু’হাত,
আমার হাড়ে 
অস্ত্র গড়ো, আমায় করো ক্ষমা।

ওরা যে ঝড়ের দিনে অপমানে –শাপে
আমারই দু-হাতে রাখে হাত
ওরা যে আলোর দিনে ঘৃণা ভরে ইস্পাত
পরস্পরের দেহে
ওরা যে বনের পাশে বসে ছিল আগুন জ্বালিয়ে
শরীরের সব পাতা একে একে খসে পুড়ে যায়
অথবা গোপন ঘরে দেওয়ালে রেখেছে নীলা 
নারীদের শব
এইসব ক্ষতি সে তো আমারই দেহের ক্ষয়,
আজ মনে হয় 
প্রতিশ্রুত শেষ ভালোবাসা-  
যতবার সরে যাই জেগে ওঠে বুদ্ধের দু-চোখ। 

তুমি সেই দেশ  তুমি আমার সর্বংসহা দেশ
উদাসীন  যাকে খুব সহজেই ভুলে যেতে পারি
তবু তুমি ধরে রাখো আমার পায়ের কাছে মাটি 
ঘাটে ঘাটে জ্বেলে রাখো আকাশপ্রদীপ সারি সারি
যে-কোনো ভাটির টানে মোহনায় ছুটে যেতে যেতে
তোমার কথা যে আমি কখনো ভাবিনি এক তিলও
সে কথাও জেনেও তবু থেকেছ আমারই পাশে পাশে
কী-বা আসে  যায় হাতে কে কোথায় দিল বা না- দিল।
শিয়রে ভয়াল ঘোর পটভূমি করেছে বিকাশ
হাজার হাজার চোখে তারাদের তবুও  পাহারা
দু’ধারে সজল চুপ, তার মাঝখানে তুমি একা
দাঁড়াও, দাঁড়িয়ে থাকো। ঘুমোক, ঘুমাতে চায় যারা।

মনের মধ্যে ভাবনাগুলো ধুলোর মতো ছোটে
যে কথাটা বলব সেটা কাঁপতে থাকে ঠোঁটে।

আজ তুমি, যে তুমি অপমান আর বর্জনের নিত্য পাওয়া নিয়ে তবুও
মুঠোয় ধরেছ আমাকে, আমাকেই, আমাকে
সেই তুমি আমার অন্ধ দুচোখ খুলে দাও, যেন সইতে পারি
এই বিপুলা পৃথিবী, এই বিপুলা পৃথিবী, বিপুলা পৃথিবী… 
 
 ফিরে যাব ঘরে 
যখন সহস্র পূর্ণ হবে
আয়তবান এই দশ দিক গাঢ়তর স্বরে 
ফিরে নেবে ঘরে 
এখন আজানু এই উদাসীন মাঠে মাঠে  আমার সকাল
তুমি দিয়েছিলে ভার আমি তাই নির্জন রাখাল। 

১০ 
তোমার কোন ধর্ম নেই, শুধু
শিকড় দিয়ে আঁকড়ে ধরা ছাড়া
তোমার কোন ধর্ম নেই, শুধু
বুকে কুঠার সইতে পারা ছাড়া
পাতালমুখ হঠাৎ খুলে গেলে
দু-ধারে  হাত ছড়িয়ে দেওয়া ছাড়া
তোমার কোন ধর্ম নেই, এই
শূন্যতাকে ভরিয়ে দেওয়া ছাড়া।

১১
আমি উড়ে বেড়াই আমি ঘুরে বেড়াই
আমি সমস্ত দিনমান পথে পথে পুড়ে বেড়াই 
কিন্তু আমার ভালো লাগে না যদি ঘরে ফিরে না দেখতে পাই
তুমি আছো, তুমি।
প্রসাধিত প্রবঞ্চনার বিপরীতে হৃদয়ের কথা শুনিয়েছেন তিনি। উজাড় করে দিয়েছেন অন্তরের নির্যাস। আজ যখন চারদিকে দীর্ঘায়ত অমাবস্যা চলছে প্রসারিত হচ্ছে  হিংসার  বাতাবরন।পরিকল্পিত মারণযজ্ঞ চলছে। এই চূড়ান্ত কঠিন সময়ে মানুষের হাতে হাত রাখতে হবে। কারণ জেগে থাকাই এখন ধর্ম। ভালোবাসাই এখন আমাদের সাধনা। 
 হাতের উপর হাত রাখা খুব সহজ নয়
সারাজীবন বইতে পারা 
সহজ নয়
 একথা খুব সহজ 
কিন্তু কে না জানে 
সহজ  কথা ঠিক ততটা সহজ নয়।
তিনি ভালোবেসে মানুষের হাতে হাত রাখতে পেরেছেন।  (চলবে)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments