জ্বলদর্চি

রবির জীবনে দ্বিতীয় প্রেম /ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত


রবির জীবনে দ্বিতীয় প্রেম

ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত

কিশোর রবির মনে প্রথম প্রেমের জোয়ার এনে দিয়েছিল বোম্বের এক মেয়ে, আন্না তড়খড়; রবি তাঁর নাম দিয়েছিল নলিনী। একথা তিনি স্বীকার করে ১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি অতুলপ্রসাদ সেন ও দিলীপকুমার রায়ের কাছে স্মরণ করেছেন, “তখন আমার বয়স বছর ষোলো। আমাকে ইংরেজি কথা বলা শেখানোর জন্যে পাঠানো হলো বম্বেতে একটি মারাঠি পরিবারে।... সে পরিবারের নায়িকা একটি মারাঠি ষোড়শী।... যেমন শিক্ষিতা, তেমনি চালাক-চতুর, তেমনি মিশুক।... আমার সঙ্গে সে প্রায়ই যেচে মিশতে আসত। কত ছুতো করেই সে ঘুরত আমার আনাচে কানাচে। আমাকে বিমর্ষ দেখলে দিতো সান্ত্বনা, প্রফুল্ল দেখলে পিছন থেকে ধরত চোখ টিপে”।
যদিও আনার সঙ্গে রবির ভালোবাসা অঙ্কুরিতো হয়েছিলো, কিন্তু পল্লবিত হয়নি। তবে বিলেত যাওয়ার প্রস্তুতিপর্ব অর্থাৎ আদব-কায়দা, ইংরেজিতে কথা বলা, কিশোর রবিকে পুরোটাই গ্রুম করে দিয়েছিল আন্না।
কিশোর রবিকে ইংলন্ডে পাঠানো হয়েছিল ব্যারিস্টারি বা আই সি এস পরীক্ষার জন্য। এতদিন মেজোবউঠানের স্নেহচ্ছায়ায়, ঘরের আরামে রবির ভগ্নহৃদয় কাব্যটি এগিয়ে চললেও পড়াশোনা যে খুব বেশি এগোচ্ছে না সেটা কিছুদিনের মধ্যেই লক্ষ করছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। তাই বন্ধু তারকনাথ পালিতের উদ্যোগেই রবিকে লন্ডনে পাঠানো হল। 
ওদিকে রবির মোটেই ভালো লাগত না নিয়ম আর পাঠক্রম অনুযায়ী আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া শেখার পদ্ধতিকে। ভালো লাগতো শুধু ইংরেজির অধ্যাপক হেনরি মর্লির সাহিত্যের পাঠ। তবে হ্যাঁ, রবি বলত, কিছু যে শেখার মতো পাইনি তা বলব না, গ্ল্যাডস্টোনের বাগ্মিতায় আমি অভিভূত। 
কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য দুজন নীলনয়না পুষিবেড়ালের সঙ্গে সরস বন্ধুত্বে জড়িয়ে পড়ল রবি। মাঝখানে কিছুদিন বার্কারদের বাড়িতে কাটিয়ে তাদের দাম্পত্য ঝগড়ায় বিপর্যস্ত রবি আশ্রয় নিল লুসি স্কটদের পরিবারে। বিলেতের এই পরিবারটি হয়ে উঠল তার আপনজনের মতো। বিশেষত মাতৃস্নেহবঞ্চিত রবিকে মিসেস স্কট তার অসীম স্নেহের বন্ধনে বেঁধে ফেললেন।
রবি তাঁর নতুন বৌঠানকে চিঠিতে লিখতে থাকে, “টর্কি থেকে বহুদিন হল আমরা আবার লণ্ডনে এসেছি। এখন আমি ক—র পরিবারের মধ্যে বাস করি। তিনি, তাঁর স্ত্রী, তাঁদের চার মেয়ে, দুই ছেলে, তিন দাসী, আমি ও টেবি বলে এক কুকুর নিয়ে এই বাড়ির জনসংখ্যা। মিস্টার ক—একজন ডাক্তার। ... অমায়িক স্বভাব, অমায়িক মুখশ্রী। মিসেস ক—আমাকে আন্তরিক যত্ন করেন। শীতের সময় আমি বিশেষ গরম কাপড় না পারলে তাঁর কাছে ভর্ৎসনা খাই।... 
এমন সময় রবিকে গরম জলের সেক দিতে এসে লুসি ও জেসি নানারকম খুনসুটি শুরু করে দেয়, তাদের চঞ্চলতায় রবির সংকোচ কেটে যাচ্ছে। রবিও বেশ ওদের সঙ্গে খুনসুটিতে মেতে ওঠছে।
রবি নতুন বৌঠানকে লিখছে “যাই হোক, আমার এই পরিবারের সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। সেদিন মেজো মেয়ে আমাকে বলছিলেন যে, প্রথম যখন তারা শুনলেন যে, একজন ভারতবর্ষীয় ভদ্রলোক তাদের মধ্যে বাস করতে আসছে, তাদের ভারি ভয় হয়েছিল । যেদিন আমার আসবার কথা সেই দিন মেজে ও ছোটো মেয়ে, তাদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে পালিয়ে গিয়েছিলেন । প্রায় এক হপ্তা বাড়িতে আসেন নি। তার পর হয়তো যখন তারা শুনলেন যে, মুখে ও সর্বাঙ্গে উল্কি নেই, ঠোট বিধিয়ে অলংকার পরে নি, তখন তারা বাড়িতে ফিরে এলেন।... রবি লুসির কথা শুনে মজা করে বলেন, “ও তোমরা ইন্ডিয়ান বলতে রেড ইন্ডিয়ান ভেবেছিলে, দাঁড়াও না, একদিন ওরকম সেজে দেখাব তোমাদের। আবার পালাতে হবে”।
রাতে সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখতে দেখতে ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেল রবির। বাইরের ঘরের সোফায় এসে বসল। এ বাড়ির সকালটা কীভাবে শুরু হয়, কে জানে। সব চুপচাপ। সবাই ঘুমোচ্ছে।...
রবিকে দু-একটা খবর পড়ে শোনাতে শোনাতে কফিপর্ব শুরু হয়ে যায়। লুসি ও জেসি নেমে এসে বাবার গালে চুমু দিয়ে সকাল শুরু করে।
সব শেষে ব্রেকফাস্ট টেবিলে যোগ দিলেন মিসেস স্কট। সাড়ে নটার মধ্যে জলখাবার পর্ব শেষ। একটু হাসিঠাট্টার পরেই মেয়েদের তাগাদা দেন স্কট আন্টি। সবাই কাজে লেগে পড়ো। হাতে দস্তানা পরে আন্টি নিজে দাসীদের নিয়ে একতলা থেকে চারতলা পর্যন্ত ঝাড়মোছ করান। রান্নাঘরে গিয়ে রুটিওলা, তরকারিওলা, মাংসওলার বিল দেখে পাওনা মেটান। কর্তার সঙ্গে পরামর্শ করেন। রান্নার তদারক করেন। বড় মেয়েটিও তার সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে।
লুসি কিন্তু গানবাজনাও করে, বাড়িতে সে একমাত্র গাইয়ে-বাজিয়ে। গানের আসরে আজকাল রবিও সোৎসাহে যোগ দিচ্ছেন।
লুসির খেয়ালে হঠাৎ একটি নতুন খেলা শুরু হল কিছুদিন। প্ল্যানচেট-চর্চা। এরমধ্যে রবি ভরতি হয়েছেন লন্ডনে ইউনিভার্সিটি কলেজে ইংলিশ পড়ার জন্য। এখানে রবির সহপাঠী তারকের ছেলে লোকেন। বয়স কম হলেও অদ্ভুতভাবে তেরো বছরের লোকেনের সঙ্গে আঠারো বছরের রবির বন্ধুত্ব খুব জমে উঠল অচিরেই। লুসিকে বাংলা শেখাতে গিয়ে রবি যখন শব্দের ব্যুৎপত্তি নিয়ে হোঁচট খাচ্ছেন, তখনও তার সাহায্যকারী লোকেন পালিত।
রবির সন্দেহ হয় শুধু লুসি নয়, জেসিও যেন তার প্রতি একটু বেশিই মনোযোগী। বাগানের গাছের ফাঁকে, ছাদের দক্ষিণমুখো ঘরে, পিয়ানোর রিডের ওঠা-নামায়, প্ল্যানচেটের আঙুল ছোঁয়ায় কী যে মধুর রহস্য পল্লবিত হয়ে ওঠে, রবি সবটা যেন বুঝতে পারেন না।
স্কটকন্যাদের সঙ্গে রবির মাখামাখি বন্ধুত্বের কাহিনি কিছুটা পল্লবিত হয়ে ক্রমে দেবেন ঠাকুরের কানেও এসে পৌঁছল। মহর্ষি রবিকে নির্দেশ দিলেন দেশে ফিরতে। কিছুদিন এলোমেলো বিলেত ভ্রমণের পরে সবে যখন ইংলিশ ক্লাসের শিক্ষক মি. মরলির পড়ানোয় আকর্ষিত হয়েছেন রবি, তখনই তার দেশে ফেরার ডাক এল।
স্কট আন্টি রবির হাত ধরে কেঁদে ফেললেন বিদায়কালে। রবির মনেও শেষ কদিন চলল অসহ্য টানাটানি। মালতীপুঁথির খাতা নানারকম আঁকিবুকি করতে করতে রবি লিখলেন তার বেদনার ভাষ্য,
“ফুরালো দুদিন। 
কেহ নাহি জানে এই দুইটি দিবসে–
কি বিপ্লব বাধিয়াছে একটি হৃদয়ে।
দুইটি দিবস চিরজীবনের স্রোত দিয়াছে ফিরায়ে–
এই দুই দিবসের পদচিহ্নগুলি
শত বরষের শিরে রহিবে অঙ্কিত।
যত অশ্রু বরষেছি এই দুই দিন
যত হাসি হাসিয়াছি এই দুই দিন
এই দুই দিবসের হাসি অশ্রু মিলি।
হৃদয়ে স্থাপিবে চির হাসি অশ্রু”। (বসন্ত বরষা)
তবে লুসির একটা অবদান ছিল, সে রবিকে বেশকিছু ইংরেজি, আইরিশ আর স্কটিশ গান শিখিয়েছিল। এগুলোর প্রভাবেই দেশে ফিরে রবি এসব গানের অনুকরণে বেশকিছু গান রচনা করেছিল। অপেরা দেখে এসে দেশে ফিরেই 'বাল্মীকি প্রতিভা' [১৮৮০] আর কয়েক বছর পরে 'মায়ার খেলা' [১৮৮৮] লিখেছিল। 
নিজের বেদনা চেপে রেখে, ব্যারিস্টার বা আই সি এস হওয়ার চেষ্টায় জলাঞ্জলি দিয়ে, দুই নীলনয়নার হৃদয়ে দাগা দিয়ে ১৮৮০ সালের বসন্তকালে দেশে ফিরে এল রবি। অবশেষে প্রেমের ভাঙা গড়া খেলায় প্রবাসী প্রেমিকাকে নিয়ে রচনা করতে হল বিচ্ছেদের পঙ্ক্তিমালা-
কিন্তু আহা, দুদিনের তরে হেথা এনু,
একটি কোমল প্রাণ ভেঙ্গে রেখে গেনু।
তার সেই মুখখানি-কাঁদো কাঁদো মুখ,
এলানো কুন্তল জালে ছাইয়াছে বুক...
এরপর, রবি দ্বিতীয়বার বিলেতে যায় ১৮৯০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। সেবারে রবি লিখেছিল ডায়েরি। তা থেকে জানা যায়, দ্বিতীয় প্রেমের অনুরাগে ১১ সেপ্টেম্বর রবি আবার গিয়েছিল তাঁর বহু স্মৃতিবিজড়িত ডক্টর জন স্কটের বাড়িতে। সেখানে গিয়ে শুনল, স্কট পরিবার সেখানে আর থাকে না। তারা চলে গেছে দক্ষিণ লন্ডনের উপকণ্ঠে। রবি তাঁর তখনকার মনের অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে “১১ সেপ্টেম্বর। সকালবেলায় আমাদের পুরাতন বন্ধুদের সন্ধানে বাহির হওয়া গেল। প্রথমে, লন্ডনের মধ্যে আমার সর্বাপেক্ষা পরিচিত বাড়ি দ্বারে গিয়ে আঘাত করা গেল। যে দাসী এসে দরজা খুলে দিলে তাকে চিনি নে। তাকে জিজ্ঞাসা করলুম আমার বন্ধু বাড়িতে আছেন কি না। সে বললে তিনি এ বাড়িতে থাকেন না। জিজ্ঞাসা করলুম কোথায় থাকেন? সে বললে, আমি জানি নে, আপনারা ঘরে এসে বসুন, আমি জিজ্ঞাসা করে আসছি। পূর্বে যে ঘরে আমরা আহার করতুম সেই ঘরে গিয়ে দেখলুম সমস্ত বদল হয়ে গেছে - সেখানে টেবিলের উপর খবরের কাগজ এবং বই - সে ঘর এখন অতিথিদের প্রতীক্ষাশালা হয়েছে। খানিকক্ষণ বাদে দাসী একটি কার্ডে লেখা ঠিকানা এনে দিলে। আমার বন্ধু এখন লন্ডনের বাইরে কোন্-এক অপরিচিত স্থানে থাকেন। ভারী নিরাশ হৃদয়ে আমার সেই পরিচিত বাড়ি থেকে বেরলুম।
মনে কল্পনা উদয় হল, মৃত্যুর বহুকাল পরে আবার যেন পৃথিবীতে ফিরে এসেছি। আমাদের সেই বাড়ির দরজার কাছে এসে দ্বারীকে জিজ্ঞাসা করলুম— আমার সেই অমুক এখানে আছে তো? দ্বারী উত্তর করলে— না, সে অনেক দিন হল চলে গেছে। চলে গেছে?  সেও চলে গেছে! আমি মনে করেছিলুম কেবল আমিই চলে গিয়েছিলুম, পৃথিবী-সুদ্ধ আর সবাই আছে। আমি চলে যাওয়ার পরেও সকলেই আপন আপন সময়-অনুসারে চলে গেছে। তবে তো সেই-সমস্ত জানা লোকেরা আর-কেহ কারও ঠিকানা খুঁজে পাবে না! জগতের কোথাও তাদের আর নির্দিষ্ট মিলনের জায়গা রইল না। ... একবার ইচ্ছে হল, অন্তঃপুরের সেই বাগানটা দেখে আসি - আমার সেই গাছগুলো কত বড়ো হয়েছে। আর সেই ছাতের উপরকার দক্ষিণমুখো কুঠরি, আর সেই ঘর এবং সেই ঘর এবং সেই আর-একটা ঘর। আর সেই-যে ঘরের সম্মুখে বারান্দার উপর ভাঙা টবে গোটাকতক জীর্ণ গাছ ছিল - সেগুলো এত অকিঞ্চিৎকর যে হয়তো ঠিক তেমনি রয়ে গেছে, তাদের সরিয়ে ফেলতে কারও মনেও পড়ে নি”।

 ঋণ: রবিজীবনী – প্রশান্ত কুমার পাল। রবীন্দ্রজীবনকথা – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। রবীন্দ্ররচনাবলী। কবির বউঠান – মল্লিকা সেনগুপ্ত।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments