জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-২০/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ২০
শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 শ্রীরামকৃষ্ণের অপার্থিব ভালোবাসায় বাঁধা পড়লেন গঙ্গাধর মহারাজ। পরবর্তী সময়ে তিনি বলেছেন, “ ঠাকুর যাকে ভালোবাসতেন, তাকে শনি-মঙ্গলবার আসতে বলতেন, শনি-মঙ্গলবার ধ্যানজপ অধিক করতে বলতেন। বলতেন--শনিবার মধুবার।” গঙ্গাধর মহারাজ যখন কিশোর বয়স্ক সেইসময় কলকাতা মহানগরীতে নাটক অভিনয়ের একটা চল দেখা যায়। নাট্যসম্রাট গিরিশচন্দ্র ঘোষ এই বিষয়ে একটি নতুন ধারার, নতুন ভাবের প্রবর্তনায় অগ্রণী ভূমিকা নেন। তাঁরই পুত্র সুরেন্দ্র ঘোষ(দানী)ছিলেন গঙ্গাধর মহারাজের পাড়ার বন্ধু। মূলত তাদের নেতৃত্বে একটি থিয়েটার দল তৈরি হয়। দলের সকলেই ছিল সমবয়সি। এই দলটি কাগজের স্টেজ তৈরি করে   বাস্তবিকই একদিন জনসমক্ষে থিয়েটার শো করল। গঙ্গাধর মহারাজ ‘সীতার বনবাস’-এ কুশ, ‘লক্ষ্মণ-বর্জন‘-এ কালপুরুষ, ‘দক্ষযজ্ঞ’-এ শিবের ভূমিকায় অভিনয় করে দর্শকদের মুগ্ধ করেন। গঙ্গাধর মহারাজের পিতা যথাসময়ে পুত্রের উপনয়ন ক্রিয়া সমাপন করেন। উপনয়ন পরবর্তী সময়ে বালক গঙ্গাধরের দৈনন্দিন জীবনযাপনে সমূহ পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল। একজন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের পালনীয় কঠোর নিয়মসমূহ তিনি ঐকান্তিক নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পন্ন করতে থাকলেন। প্রতিদিন চারবার গঙ্গাস্নান, স্বপাক হবিষ্যান্ন গ্রহণ, কম্বলে শয়ন এইগুলি করতে লাগলেন। এর সঙ্গে যুক্ত হল মুখশুদ্ধি হিসাবে হরীতকী খাওয়া। বাল্যবন্ধু হরিনাথের কাছে হরীতকী বিষয়ে প্রশংসাসূচক দু'টি শ্লোক শুনে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হন। যদিও এই বিষয়ে বাড়াবাড়ি করার ফলে তাঁর ঠোঁটদুটো সবসময় সাদা হয়ে থাকত। শ্লোকগুলি এইরকম--“হরীতকীং ভুংক্ষ্ব রাজন মাতেব হিতকারিণী।/ কদাচিৎ কপ্যতে মাতা নোদরস্থা হরীতকী।।/ হরিং হরীতকীঞ্চৈব গায়ত্রীং জাহ্নবীজলম্।/ অন্তর্মলবিনাশায় স্মরেদ ভক্ষেজ্জপেৎ পিবেৎ।।--হে রাজন্, হরীতকী ভক্ষণ কর, উহা মাতার ন্যায় উপকারী। মাতা বরং কখনও ক্রুদ্ধা হন, কিন্তু উদরস্থ হরীতকী কদাপি অনিষ্ট করে না। অন্তরের মলিনতা দূর করিবার জন্য শ্রীহরির স্মরণ, হরীতকী ভক্ষণ, গায়ত্রী জপ ও গঙ্গাজল পান করিবে।” বাল্যবন্ধু হরিনাথ চট্টোপাধ্যায় গঙ্গাধর মহারাজের চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন। তিনিই ছিলেন তাঁর ধর্মজীবনের প্রথম সঙ্গী। এই হরিনাথই উত্তরকালে শ্রীরামকৃষ্ণের আরেক পার্ষদ, সন্ন্যাসী সন্তান-- স্বামী তুরীয়ানন্দ।
 এক শনিবার গঙ্গাধর দক্ষিণেশ্বরে এসে উপস্থিত হয়েছেন। ঠাকুর তাঁর ঘরের পাশে পশ্চিম দিকের গোল বারান্দায় একটি মাদুর পেতে বসলেন। এরপর নিতান্ত বালকস্বভাব হওয়ায় সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লেন। গঙ্গাধরের পরনের কাপড়ে কোমরের বাঁধন আলগা করে দিয়ে নির্দেশ দিলেন সুখাসনে বসে ধ্যান করবার। কিছুক্ষণ পরে গঙ্গাধরকে বললেন, “একেবারে ঝুঁকে বসতে নেই, আবার খুব টান হয়েও বসতে নেই।” এই দিনটিতেই গঙ্গাধরের জিহ্বায় বীজমন্ত্র লিখে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে দীক্ষাদান করেন। ঠাকুরের অপার কৃপা বর্ষিত হল তাঁর উপর। গঙ্গাধর যেহেতু ছেলেবেলা থেকেই কৃচ্ছ্রসাধনে নিষ্ঠাবান ছিলেন, সেই কারণে ঠাকুর খুব বেশি প্রাণায়ামের পরিবর্তে তাঁকে প্রত্যহ গায়ত্রী জপ করতে বলেন। সঙ্গে সঙ্গে এও জানান, “তুই ছেলেমানুষ, তোর অত বুড়োপনা ভাব কেন?” এর অর্থ এই নয় যে ঠাকুর এই বিষয়গুলি(হবিষ্য, গায়ত্রী জপ, গঙ্গাস্নান, হরীতকী ভক্ষণ ইত্যাদি) সম্পর্কে অশ্রদ্ধার ভাব পোষণ করতেন। বরং অন্য ভক্তদের কাছে বলতেন,“বাপু, তোমরা তো এদের এই জন্মটাই দেখছ, আগের জন্মের কথা তো জান না। সেই জন্মে এরা যে সংসারধর্ম শেষ করে এসেছে।... সত্ত্বগুণের যখন উদয় হল, তখন এই সব (ত্যাগ-তপস্যার ভাব)হয়।” ঠাকুরের কথায় গঙ্গাধরের অন্তরে উদ্ভূত সংশয় দূর হয়। কেননা ঠাকুরের কথায় তিনি প্রথমে সেটাই মনে করেছিলেন। সংশয়ের মেঘ কেটে যাওয়ায় হবিষ্যাদির প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা বহুগুণ বর্দ্ধিত হল। দক্ষিণেশ্বরে ‌শ্রীরামকৃষ্ণ সন্নিধানে পরম আনন্দে দিন অতিবাহিত লাগল তাঁর। কখনও কখনও সেখানে রাত্রিবাস করতেন ঠাকুরের নির্দেশে। উল্লেখযোগ্য আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতাসমূহ তাঁর অন্তরকে ঈশ্বর ভাবনায় একাগ্র করে তুলল। ত্যাগ ও পবিত্রতাময় ভাবী সন্ন্যাস জীবনের অমোঘ বীজ এইভাবে রোপিত হয়েছিল। যার মূল কারিগর ছিলেন নিঃসন্দেহে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব।
 গঙ্গাধরের মতো সরল ঈশ্বরপ্রেমী তরুণ বয়সিদের মন কাদার তালের মতো কোমল ছিল, ঠাকুর নিজের মতো করে তাঁদের গড়ে নিতেন। পরম কারুণিক ঈশ্বরপুরুষ ভাবী ভাবান্দোলনের মূল কারিগরদের নিজ হস্তেই গড়ে তুলেছিলেন। গঙ্গাধর মহারাজের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। দক্ষিণেশ্বরে ৺মা ভবতারিণী মন্দিরে গিয়ে গঙ্গাধর দেখতেন দক্ষিণ দিকে মাথা করে শিব শায়িত। বাইরে থেকে শুধুমাত্র মহাদেবের শিরোদেশটিই দৃশ্যমান হত। দেবাদিদেবের মুখমণ্ডল কখনও দর্শিত হত না। গঙ্গাধরের মনে হত শিবের মাথাটি যেন সোনার জটা জড়ানো। অন্তর্যামী ঠাকুর তাঁকে একেবারে ভবতারিণী মন্দিরের ভিতরে নিয়ে গেলেন একবার। সেখানে গিয়ে মায়ের পদতলে শায়িত শিবকে দেখিয়ে বললেন--“দ্যাখ্, দ্যাখ, এই চৈতন্যময় শিব কি করে শুয়ে আছেন!” গঙ্গাধরের তৎক্ষণাৎ অনুভব হল সত্যই চৈতন্যময় শিব শুয়ে আছেন! পরবর্তী সময়ে এই প্রসঙ্গে স্মৃতিকথায় তাৎপর্যপূর্ণভাবে লিখেছিলেন--“এতদিন ভাবতাম যে সব জায়গায় যেমন শিব, এও তেমনি। কিন্তু একি! এ যে জীবন্ত দর্শন করছি! সে যে কী আনন্দ ঠাকুর প্রাণে ঢেলে দিলেন, তা মুখে আর কি বলব! আমাকে যে কী দেখালেন ঠাকুর--এই ভাবতে ভাবতে দিনটা যে কোন দিক দিয়ে গেল , তা জানতেও পারলাম না। ঠাকুরও ভাবে কত গান গাইলেন।”(স্বামী অখণ্ডানন্দ--স্বামী অন্নদানন্দ) এই সময়ের স্মৃতি সম্বন্ধে তিনি বলতেন,“আহা! ঠাকুরের কাছে একদিনের জন্য যে বসেছে, এক ক্ষণের জন্য যে তাঁর পা-দুটি কোলে তুলে নিয়েছে সে ধন্য! ঠাকুরের ঘরটি ভগবদ্ ভাবের, ধর্মভাবের উদ্দীপনায় ভরা--সবাই অল্প-বিস্তর অনুভব করত। শত শত জন্মের সাধনা সেই ঘরটিতে বসে বসেই হত। মুহুর্মুহু ভাবসমাধি--এই ভাঙে তো এই হয়। সেসব কি ভুলবার! তাঁর এক একটি কথায় বেদ-বেদান্ত বোঝা কত সহজ হয়ে যেত।” শ্রীরামকৃষ্ণের চরণ দু'টি অবশ্য তিনি শুধু কোলে তুলেই ক্ষান্ত হননি, ঠাকুরের পায়ের বুড়ো আঙুলের ডগা দিয়ে কপালে উর্ধ্বপুণ্ড্র তিলক দেওয়ার মতো ঘসতে থাকলেন। ঠাকুর হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেন, “ও কি কচ্ছিস রে?” গঙ্গাধর উত্তর দেন--“কেন, আপনি যে বলেন যারা সাত্ত্বিক তারা গঙ্গাস্নান করতে করতে গঙ্গাজলে তিলক দেয়, আর যারা রাজসিক তারা সিঁদুর, শ্বেত, রক্ত ও গোপীচন্দনের তিলকে সর্বাঙ্গ ভরে দেয়। আমিও আজ সেই সাত্ত্বিক তিলক দিচ্ছি। এর চেয়ে সাত্ত্বিক তিলক আর আছে কি!” শ্রীরামকৃষ্ণ চরণকেই তিনি জ্ঞান, ভক্তি, বিবেকরূপী গঙ্গার উৎস বলে অনুভব করেছিলেন। স্মরণে চলে আসে বহুল প্রচলিত একটি গানের এই কথাগুলি--“...জাহ্নবী তীরে তৃষ্ণা কাতর অন্ধ যে জন খোঁজে সরোবর,/ রামকৃষ্ণপূত গঙ্গা ব্রহ্মানন্দ সাগরে ধায়;/হোক অবসান ব্যর্থ প্রয়াণ, এস ছুটে এস ধরি গো পায়।”

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments