জ্বলদর্চি

তুর্কী নাচন--১৭/মলয় সরকার

তুর্কী নাচন

মলয় সরকার

পর্ব- ১৭ (পূর্ব প্রকাশিতের পর)


এতক্ষণ এত রাজঐশ্বর্য, দামী জিনিষের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে মন যেন কেমন ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল। বুঝতে পারলাম, ক্রমাগত ঐশ্বর্যেও একটা ক্লান্তি আসে, তখন মন চায় সেই প্রকৃতির নিজের হাতে গড়া সবুজ ঘাসের গালিচা, ঘন নীল জলের সৌন্দর্য।বাইরে বেরিয়ে এলাম।আমি সাধারণ মাটির মানুষ।  ছেলেবেলা থেকে রাজা মহারাজার গল্প, রূপকথার গল্প অনেক শুনেছি।এখন মনে হচ্ছে, সেগুলো গল্পেই ভাল আমার জন্য, বাস্তবে নয়। এখানে এসে যেন মন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।  

আমাদের এখানে ছেড়ে দিয়ে গাইড ছেলেটি বলল, এখানে আপনারা যতক্ষণ ভাল লাগে দেখুন। আমি যাই। কাল সকালে আসব দেখতে নিয়ে যাব এখানকার বিখ্যাত গ্রাণ্ড বাজার। বললাম, ঠিক আছে, যাও। বেলাও অনেকখানি ঢলে এসেছিল। শরীরও ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল।

এখান থেকে বেরিয়ে আমরা দুজনে পড়ন্ত বেলায় একটা বেঞ্চে বসলাম সামনের মানুষজনকে দেখব বলে। বসতেই বুলবুল বলল, আজ বসব এককাপ বেদানার রস নিয়ে। ভাবলাম , যাই নিয়ে আসি।

 সেই বেদানার রসে চুমুক দিতে দিতে বুলবুল গেয়ে উঠল, ‘ বেদনায় ভরে গিয়েছে পেয়ালা, নিয়ো হে নিয়ো, হৃদয় বিদারি হয়ে গেল ঢালা, পিয়ো হে পিয়ো–’ আমি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলাম, ‘ বেদানার রসে ভরেছে পেয়ালা প্রিয়া হে পিয়ো-’ । হেসে উঠল ও। সত্যিই খুবই সুন্দর বেদানার রস, টলটলে মদের মতই রঙীন।

সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে শিশুরা, আশেপাশে নানা পর্যটক , অনেকেই ভিড় জমাচ্ছে ফোয়ারার চারিদিকে। বেশ একটা চলমান পৃথিবীর সিনেমার মত। আমরা আরাম করে অলস ভাবে বসে শুধু দেখে যাচ্ছি। আকাশ পরিষ্কার নীল। আমরা ‘চিত্ত ভাবনা হীন’। মনের মধ্যে তখনও পাক খেয়ে যাচ্ছে তোপকাপি প্রাসাদের রাজ ঐশ্বর্য।আসলে চেষ্টা করছিলাম, সেই সব ঐশ্বর্যের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে সাধারণ মানুষদের মধ্যে মানসিক  ভাবে ফিরে আসতে।

 সামনের ফোয়ারাটি অনেকটা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের  সামনে “ফাউন্টেন অফ জয়ের” মত । চারধারে প্রচুর মানুষ গোল করে দাঁড়িয়ে এর সৌন্দর্য উপভোগ করছে। তার আশে পাশে নানা ফেরিওয়ালা নানা জিনিষ বিক্রি করছে, ঠিক আমাদের দেশের মতই।এখানে কেনা বেচা হয় এখানকার মুদ্রা লিরাতে। এক লিরার বর্তমান দাম ভারতীয় মুদ্রার প্রায় পৌনে সাত টাকার সমান।।বেদানার রস হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ বসে বসে মানুষের চলমান জীবনের সাক্ষী হয়ে থাকলাম। আর কোন কাজ নেই আজ। ঠিক করলাম সন্ধ্যায় আর একবার আসব শুধু ঐ ফোয়ারা দেখতে।
 


পরে শুনেছিলাম, ২০১৬ সালের ১২ই জানুয়ারী এক আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে সকাল সাড়ে দশটায় , ঠিক ওই জায়গাতেই মারা গিয়েছিলেন ১৩ জন সাধারণ নিরীহ মানুষ এবং আহত হয়েছিলেন ১৪ জন। এই ভয়ানক হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে নিজের অজান্তেই কেঁপে উঠেছিল আমার বুক, অনেক দূরে নিজের দেশে ঘরে বসে । মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গিয়েছিল সেই সমস্ত সাধারণ মানুষদের কথা ভেবে। হতেও তো পারত, এই ঘটনা আমাদের উপরেও।ঠিক ওই খানেই তো বসেছিলাম আমরা। আর আজ শুধু আমাদের বদলে হয়ত  অন্য কিছু মানুষ। এটুকুই যা তফাত ! যদি আমাদের উপর ঘটত এরকম একটি ঘটনা, তাহলে—-?  ভাবতে পারছিলাম না। কি জানি সুস্থ মানুষ হঠাৎ কেমন হয়ে যায়, কি করে হয়ে যায় এমন খুনী,যে কোন ব্যক্তিগত আক্রোশ বা প্রতিহিংসা ছাড়াই কিছু মানুষের রক্তস্নানে উদবুদ্ধ হয়ে ওঠে!

সন্ধ্যাবেলা এখানে আবার ফিরে আসার জন্য আমরা একটু বিশ্রাম নিতে গেলাম হোটেলে।

সন্ধ্যায় দেখি যথেষ্ট ভিড় ঐ ফোয়ারাকে ঘিরে। জলের ঝির ঝির শব্দ আর তার সাথে শিশুদের কলকাকলি,  ফেরিওয়ালাদের নানারকম আওয়াজ, আর হাল্কা আবছা একটা মোহময়ী আলো সব মিলিয়ে জায়গাটাকে একটা রহস্যময়তায় মুড়ে রেখেছে।বেশ উঁচু জলের ফোয়ারা। সেগুলো আবার পর্যায়ক্রমে চালু হচ্ছে বন্ধ হচ্ছে আপনাআপনি বেশ তাল রেখে। তার সঙ্গে একই ভাবে তাল রেখে চলছে ফোয়ারা জলে আলোর খেলা। সে আলো কখনও লাল, কখনও সাদা বা নীল কিংবা বেগুনী। বেশ একটা যাদুমাখা পরিবেশ তৈরী হয়েছে। তার সঙ্গে দুপাশে অদ্ভুত আলোয় সেজেছে আয়া সোফিয়া এবং ব্লু মস্ক। গাছে গাছেও রয়েছে সুন্দর আলোর ছোঁয়া। রাত যত বাড়ছে, অল্প একটা ভিজে ঠাণ্ডা আমেজ আসতে লাগল হাওয়াতে। ক্রমশঃ ভারী হয়ে উঠছে বাতাস। 

আমরা ধীরে ধীরে ফেরার পথ ধরলাম। সামনে দিয়ে তখনও চলেছে ট্রাম ঘরঘর আওয়াজ তুলে তার সুন্দরী লাস্যময়ী চেহারা আর নানা ধরণের যাত্রীকে নিয়ে। খাওয়ার  দোকান গুলো হয়ে উঠেছে জমজমাট। আমরা একটা দোকানে গিয়ে রুটি আর মাংসের একটা পদ নিয়ে ফিরে এলাম। ট্রামে টিকিট নিজেই কাটতে হয় । রাস্তার পাশেই ট্রামের ছোট প্ল্যাটফর্ম আছে আর তার সাথেই আছে স্বয়ংক্রিয় টিকিট কাটার মেসিন। 
গ্রাণ্ড বাজার

পরদিন একটু বেলা করেই উঠলাম। আজ বিশেষ কিছু দেখার নেই। যাব গ্রাণ্ড বাজার। গাইড ছেলেটি এল কিছু পরে। ওর সঙ্গে এলাম গ্রাণ্ড বাজারের সামনে। বেশ ঘিঞ্জি জায়গা। এত বড় বাজার , যার ইতিহাস আর খ্যাতি পৃথিবী জোড়া, তার ঢোকার মুখটি কিন্তু বিশাল কিছু নয়।তবে দেখলেই বোঝা যায় এটি বেশ প্রাচীন। একে তুরস্কের ভাষায় বলা হয় Kapalıçarşı (কাপালিকারসি) অর্থাৎ ঢাকা বাজার।ঢোকার মুখটা আসলে, আমার যে ধারণা ছিল তার সাথে মিলল না।এটা অবশ্য গাইডকে জিজ্ঞাসা করা হয় নি যে, এটাই প্রধান দরজা কি না। এর তো অনেক দরজা আছে , বললে বিশ্বাস হবে না , মোট একুশটা দরজা আছে। তার মধ্যে চারটি প্রধান দরজা আছে। আমরা যে দরজাতে ঢুকেছিলাম, সেটা সম্ভবতঃ প্রধান দরজা নয়।তার মাথায় সম্ভবতঃ তুর্কী ভাষায় কিছু লেখা আছে।তবে  ঢোকার মুখেই দেখি বেশ কিছু বিদেশী মুদ্রা বদলের দোকান আছে। অর্থাৎ বিদেশী পর্যটক এখানে যথেষ্টই আসেন।

অবশ্য আসবেন না-ই বা কেন, যার এমন পৃথিবী বিখ্যাত নাম। আর, তথ্য দেখতে পাচ্ছি, এটি নাকি পৃথিবীর সমস্ত বড় বড় এবং ছাদওয়ালা এবং ঢাকা বাজারগুলির মধ্যে অন্যতম।আমরা দেখেছি  মেক্সিকোর গুয়াদালাহারা তে ল্যাটিন আমেরিকার সবচেয়ে বড় বাজার, Mercado Libertad বা San Juan de Dios Market, যেটি ৪০০০০ বর্গ মিটার জায়গার উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। এবং প্রায় ৩০০০ দোকান আছে। তবে হ্যাঁ , এটি অনেক আধুনিক, তৈরী হয়েছে মাত্র সেদিন, ১৯৫৮ সালে। আর সেই  পঞ্চদশ  শতাব্দীতে তৈরী এই বাজার প্রায় ৪০০০ দোকান নিয়ে ৩০৭০০ বর্গমিটার জায়গার উপর দাঁড়িয়ে আছে। এখানে প্রতিদিন প্রায় আড়াই লক্ষ থেকে চার লক্ষের মত দর্শক আসেন।২০১৪ সালের হিসাব অনুযায়ী পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী মানুষ এই বাজারে আসেন, এবং সেই সংখ্যাটা নিতান্ত হেলাফেলার মত নয়, মোট নয় কোটি বারো লক্ষ পঞ্চাশ হাজার।  ইস্তানবুলে এসেছি আর গ্রাণ্ড বাজারে ঢুকি নি, এটা বললে লোকে গায়ে থুতু দেবে। 

ঢোকার মুখেই আলাপ হল একটি হায়দরাবাদের তেলেগু তরুণ দম্পতির সঙ্গে। তারাও একদিনের জন্য এসেছে বেড়াতে।থাকে দুবাই তে।তারাও এসেছে দুদিনের ছুটিতে। সঙ্গে একটি বাচ্ছা। অল্প দুচারটে কথা হল তাদের সঙ্গে। বাচ্চাটি ছটফট করছে এর তার তরুণী মা তাকে সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে। বাবাটিরও একই অবস্থা । কাজেই এই অবস্থায় তাদের সঙ্গে দেশের কথা আলোচনা করার সময় নয়, সেটা বুঝে আর বেশি আলাপে গেলাম না । পা বাড়ালাম বাজারের দিকে। 

মোটামুটি প্রায় সারা ইস্তানবুল শহরে যা যা বিশেষ দর্শনীয় ছিল, সেগুলি ঘুরে দেখলাম, বহু মানুষের সঙ্গেও কথা বললাম। আসলে আমি খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম , বিখ্যাত লেখক ওরহান পামুকের দেখা ‘হুজুন’ বা শহরের আনাচে কানাচে যে দুঃখময়তার ছাপ উনি লক্ষ্য করেছেন, তার ছাপ কোথাও চোখে পড়ে কি না।  অবশ্য ওনার চোখ নিশ্চয়ই আমার মত নয়, তবু আমার চোখে হুজুন কেন, তার কিছুই চোখে পড়ে নি। বরং এখানকার জীবন বেশ উচ্ছ্বল ব্যস্ত, সহানুভূতিশীল ( আমি অনেক জায়গাতেই তার প্রমাণ পেয়েছি)। জানি না আমি দু দিনের পর্যটক আর উনি এখানে জন্মেছেন বা বড়  হয়েছেন নানা ঘাত প্রতিঘাত সয়ে। ওনার দেখা আর আমার দেখার তফাত তো থাকবেই।


এর পর ঢুকব ইস্তাম্বুলের বিখ্যাত গ্রাণ্ড বাজারের ভিতরে। সঙ্গে থাকুন–

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments