জ্বলদর্চি

পঁচিশে বৈশাখ || জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়

রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনের স্মৃতিকথা

পঁচিশে বৈশাখ   ||  জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়

জাগরণের দিন আসছে গুরুদেব,আপনার জন্মের পুণ্যদিন,রবীন্দ্রজয়ন্তী। আমাদের তৈরি হতে হবে। প্রস্তুতি চাই ছাত্রী শ্রাবণী একাই অনর্গল গেয়ে দেবে দশ খানা গান যার মধ্যে শ্রাবণী সেনকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয় আরও আছে শেলী,লিপিকা,পায়েল, দীপিকা,পৃথা.....

  আবৃত্তির জন্য অরূপ,বিপুল,ঋক,পলাশ,প্রীতম,পপি, সাধনা,পিংকু.... হাতে আরও কতজন একটা গীতি আলেখ্য লিখে নিতে হবে আর হাস্যকৌতুকে কয়েকটি নাটিকা জয়ন্তী উৎসব একেবারে জমে যাবে।সুপারহিট।পরিপূর্ণ রাবীন্দ্রিক।

  আমাদের তো এটাই সবচেয়ে বড়ো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, তার মান উন্নত করতেই হবে।তাই লেগে পড়া অগ্রজ সহকর্মী দেবুদাকে সঙ্গে নিয়ে প্রাথমিক একটা সভা ডাকতে হবে। ছেলেমেয়েরা থাকবে,থাকবেন শিক্ষক-শিক্ষিকা-শিক্ষাকর্মীরা।হেডস্যার লঘুচালে দুটো কথা বলেই সব দায়িত্ব তুলে দেবেন দেবুদা আর আমার উপর।তারপর মিটিমিটি হাসবেন,ভাবখানা এই,এবার সামলাও তো বাপু রাজের ঝামেলা! দেবুদা ছাত্রছাত্রীদের ডেকে আনবেন, তাদের সঙ্গে বারবার আলোচনা করে,তাদের করণীয় ও নিষেধকথা বুঝিয়ে দিয়ে তুলে দেবেন আমার হাতে আর আমি তাদের প্রস্তুতিতে আমার সর্বশক্তি নিয়োগ করে আমার শিক্ষক তরণী মল্লিক মশাইয়ের উত্তরাধিকার প্রকাশ করবো।তরণীবাবু আসলে ছিলেন সুন্দরবনের শম্ভুনগর হাই স্কুলের আইএসসি পাশ বাংলার শিক্ষক,আমার সহকর্মী । ডিগ্রিতে নয়,গুণমানে তাঁর মতো বাংলা শিক্ষক গোসাবা-বাসন্তী অঞ্চলে বেশি ছিলেন না।তাঁর ভালোবাসা ছিল বাৎসল্য মেশানো আর আমি তাঁকে আমার শিক্ষকই জানতাম।হাতে ধরে সহকারীকে শিখিয়েছিলেন কীভাবে কচিকাঁচাদের নিয়ে সার্থক একটি অনুষ্ঠান করানো যায়।নগরউখড়া হাই স্কুলে রবীন্দ্রজয়ন্তী এবং অন্যান্য অনুষ্ঠান পরিচালনায় আমি নিজেকে তরণীবাবুর উত্তরসূরিই ভাবতাম।

     উল্লেখ করার মতো আর একটা বিষয় ছিল  ২৫ শে বৈশাখ আমাদের অনুষ্ঠান হতো ঘটেপটে মানে কেবল কবিগুরুকে শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানানোর দিন।তারপর গ্রীষ্মের ছুটি পড়ার ঠিক আগের দিন হতো সেই পূর্ণাঙ্গ নিবেদন।আমি বলতাম, 'অজস্র রবিফুলে রবির পুজো।'
আপনি জানতেও পারেন না গুরুদেব বৈশাখী কোকিলের ডাকে আপনার নাম লেখা আমাদের গম্ভীর সাজা শিক্ষকদের গুরু-বাক্যবন্ধ আর বিগলিত চপলমতি শিক্ষকের রস-রসিকতার কথা পুরো ১৮০° কোণে থাকলেও পুরোটাই রবীন্দ্রনাথ। আমাদের করুণ দেবনাথের দুই বিঘা জমির কান্নার সঙ্গে খোকনের হাস্যকৌতুক বেশ মানিয়ে যায়।

  আমাদের বৈশাখের রবিগান আলেখ্য আবৃত্তি নাটক বক্তৃতা সব মিলেমিশেই রবীন্দ্রনাথ।

প্রস্তুতির কোনো খামতি নেই। আবৃত্তি, গান,আলেখ্য,বক্তৃতা, নাটিকা সবকিছুর রিহার্সাল চলছে। বারবার সংশোধন, বকাবকি,হাসাহাসি সবই চলছে।একবার আমাদের অনুষ্ঠান অবলম্বনে একটি দীর্ঘ রম্যরচনা লিখেছিলাম যা শুনে হাসির হিল্লোল ওঠে।

  নির্ধারিত দিনের আগের দিনটি থাকতো প্রবল উত্তেজনার ও দুশ্চিন্তার। আমাদের এই কদিনের আন্তরিক প্রস্তুতি সাফল্যের আলোয় আলোকিত হবে তো? ছেলেমেয়েরা তাদের সাধ্যের সীমায় কৃতকার্য হবে তো? কোনো বিভ্রাট হবে না তো?..... এমন হাজার আশঙ্কায় কণ্টকিত থাকতাম আমরা।

বেশ মসৃণভাবেই অনুষ্ঠান শেষ হতো,দু-একটা ভুল চুক খুব কিছু আলোকিত হতো না।সাফল্যের জন্য ধন্যবাদ অভিনন্দন শুভেচ্ছায় ভরিয়ে দিতেন হেডস্যার সমেত প্রবীণ ও নবীন শিক্ষককুল ও অভিভাবক-অভিভাবিকাগণ।ছাত্রছাত্রীদের মুখে পরিতৃপ্তির ছাপ দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়তাম।প্রায় একমাস পর আবার বিদ্যাঙ্গনে সবাই জড়ো হবে।প্রথমদিন একটু সাফল্যের স্মৃতিকথার পরই ছদ্মকাঠিন্যের মোড়কে নিজেদের মুড়ে ফেলে কঠোর শৃঙ্খলায় ক্লাসের পড়া শুরু হয়ে যাবে।

   এখানেও রবীন্দ্রনাথ মানে খানিক আনন্দ তৃপ্তি এবং মুক্তি।মুক্তির নাম পঁচিশে বৈশাখ।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments