জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-২৪/ প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ২৪

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 গুরুভাই স্বামী অভেদানন্দজীর ভাষায় গঙ্গাধর মহারাজ ছিলেন--“patriot, statesman and philanthropist”। আর মুর্শিদাবাদের কেদার-মাটি মহুলায় মৃত্যুঞ্জয় ভট্টাচার্যের চণ্ডীমণ্ডপে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের জন্য চাল বিতরণ করে তাদের ‘বাবা’ কিংবা ‘দণ্ডীঠাকুর’ হয়ে উঠলেন। তিনি যেন শাস্ত্র কথিত এই শ্লোকটির মূর্ত রূপ---কো নু ন স্যাদুপায়োহত্র যেনাহং সর্বদেবিনাম।/ অন্তঃ প্রবিশ্য সততং ভবেয়ং দুঃখভারভাক্।।--অর্থাৎ এই সংসারে এমন কি উপায় আছে যার দ্বারা আমি সকল দুঃখী প্রাণীর শরীরে প্রবেশ করে তাদের দুঃখ নিজেই সতত ভোগ করতে পারি।
 শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের দশম সঙ্ঘগুরু স্বামী বীরেশ্বরানন্দজী মহারাজ একটি মনরোম স্মৃতিচারণ করেছেন। সেটি এইরকম--“গঙ্গাধর মহারাজ একদিন উদ্বোধনে এসেছেন। সবাই তাঁকে ধরে বসল, মহারাজ আমাদের রসগোল্লা খাওয়ান। উনি বললেন, আমার কাছে টাকা পয়সা কোথায়? তোমাদের কি করে রসগোল্লা খাওয়াব? তখন একজন তাঁর ট্যাঁকে টাকা আছে দেখে সেখানে হাত দিয়েছে। তাতে উনি সেই ছেলেটিকে টেনে নিয়ে পাশের ঘরে শরৎ মহারাজের সামনে গিয়ে বললেন, দেখ দেখি কি রকম ছেলে তৈরি করেছ -- ওরা জোর-জবরদস্তি করে আমার কাছে রসগোল্লা খেতে চায়! শরৎ মহারাজ উত্তরে বললেন, ওরা যখন খেতে চাচ্ছে, বেশ তো ওদের খাওয়াও না। তখন গঙ্গাধর মহারাজ বললেন, বাঃ! তুমিও দেখছি ওদের কথায় সায় দিলে! আসলে তিনি খাওয়াবার জন্যই টাকা নিয়ে এসেছিলেন। শুধু আমাদের সঙ্গে একটু রগড় করার জন্য ওরকম করছিলেন। আমরা তাঁর সঙ্গে এভাবে আচরণ করায় তিনি বেশ আনন্দ পেয়েছিলেন।”

  স্বামী অন্নদানন্দ লিখেছেন--“আশ্রমের সাধু ও ব্রহ্মচারীদিগকে লক্ষ্য করিয়া শ্রীশ্রীবাবা তেজ ও বীর্য প্রসঙ্গে বলিতেছিলেন, স্বামীজী বলিতেন--Cannon to the right,/ Cannon to the left,/ Cannon behind,/ Ours is to do and die,/ And not to question why. মৃত্যুই জীবনের পরিণাম। মরব তো বীরের মতো মরব। মৃত্যুর পরেও হাড়ে হাড়ে ভেলকি খেলবে। গুরুবাক্যে শ্রদ্ধা-বিশ্বাস চাই। 
 আমি কিরকম লোক জান তো? আমি স্বামীজীর ভাই--যে সে লোক নই। আমাদের কাছে থেকে তোমাদের হল কি? কাছা ছেড়ে ফের দিয়ে কাপড় পরলেই কি হয়? আমার কাছে যারা থাকবে তাদের খুব কর্মী হতে হবে। মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে ঠাকুরের কাজে প্রাণপণ লেগে যেতে হবে। যদি নিজের সুখভোগ কি আরামের দিকে লক্ষ্য রাখো, তাহলে কিছুতেই শান্তি পাবে না। আশ্রমেরও কোন উপকারে আসবে না। 

 আমি কিছু পারি না, পারব কি পারব না, এইরূপ ইতস্তত করা অন্যায়। সব কাজে এগিয়ে যাবে। না পারলেও চেষ্টা করে দেখবে। গুরুর প্রতি অচল বিশ্বাস থাকলে বিপদ কিছুই করতে পারবে না, সাপে কাটবে না, আগুনে পুড়বে না, বাঘে খাবে না।
 মহাবীর(হনুমান)জন্মেই বললেন, সূর্য খাব। রাম-লক্ষ্মণ বালক বয়সেই তাড়কাকে মেরে জগতে শান্তি স্থাপনে লেগে গেলেন। ”(স্বামী অখণ্ডানন্দকে যেরূপ দেখিয়াছি, সংকলক-স্বামী চেতনানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়)
কি সব অনুপ্রেরণাদায়ী কথা! বাস্তবিকই তিনি ছিলেন ‘স্বামীজীর ভাই’। তাঁর পক্ষে এই গর্ব প্রকাশে কোনও ভুল নেই!

 অখণ্ডানন্দজীর খুব ইচ্ছা ছিল মধ্য এশিয়া, তুরস্কে ঘুরে আসার। ইংরেজ সরকারের রেসিডেন্ট ওইসব জায়গায় ঘুরে নানা তথ্য সংগ্রহের জন্য তাঁকে গুপ্তচরের(Spy)পদ দিতে চায়। তিনি অবশ্য সেসব গ্রাহ্য করেননি। ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন। এদিকে স্বামীজী তাঁকে বারংবার পত্রাঘাত করতে থাকেন। সেইসময় অখণ্ডানন্দজী কাশ্মীরে। চিঠিতে স্বামীজী লেখেন,“গঙ্গা, তোমাকে কতদিন দেখি নি, দেখবার বড় ইচ্ছা হয়েছে চলে এস। তুমি উত্তরাখণ্ডে অনেক ঘুরেছ, তোমার অনেক নির্জন পাহাড় জানা আছে। আমার ইচ্ছা মাঝে কোথাও না ঘুরে তোমার সঙ্গে উত্তরাখণ্ডের কোনও পাহাড়ে গিয়ে একেবারে মগ্ন হয়ে যাই। তপস্যার চেয়ে শান্তি আর নাই। তুমিও আমার সঙ্গে থেকে তপস্যা করবে। শীঘ্র নেমে এস।” স্বামীজীর সঙ্গে তাঁর বহুদিন দেখা হয় নি। উপরন্তু একাধিকবার পত্র পেয়ে তুরস্ক যাওয়ার সংকল্প ত্যাগ করে গাজীপুর রওনা দিলেন। স্বামীজী তখন গাজীপুরে। গাজীপুর পৌঁছে শুনলেন তিনি কলকাতায় ঠাকুরের ভক্ত ও রসদ্দার সুরেশচন্দ্র মিত্রকে দেখতে গিয়েছেন, কারণ সুরেশবাবু গুরুতর অসুস্থ। গাজীপুর থেকে কলকাতায় এসে স্বামীজীর সঙ্গে মিলিত হলেন। সুরেশবাবুর দেহান্ত হলে তাঁরা উত্তরাখণ্ডের দিকে রওনা দিলেন। স্বামীজী তাঁকে বললেন,“দ্যাখ গ্যাঞ্জেস, কোথাও আর নাবা টাবা হবে না। একেবারে উত্তরাখণ্ডে যেতে হবে।” অবশ্য কার্যত তা হয় নি!

 দীক্ষার বিষয়ে একটি ঘটনার কথা জানতে পারা যাচ্ছে শ্রী অমূল্যবন্ধু মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিকথা থেকে। তিনি লিখছেন--“আমার বন্ধু শ্রীমনমোহন বাবুর স্ত্রী দীক্ষার উদ্দেশ্যে মঠে উপস্থিত হইলেন। গঙ্গাধর মহারাজ তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, মা তুমি শ্রীশ্রীঠাকুর-স্বামীজীর বই লীলাপ্রসঙ্গ ও কথামৃত পড়েছ কি? মহিলাটি বলিলেন যে, এখনও তাঁহার পড়ার সুযোগ হয় নাই। মহারাজ তখন বলিলেন, তা হলে তোমাকে আমি কি করে দীক্ষা দিই? তোমাকে এক সপ্তাহ সময় দিলুম, তুমি কোথাও যোগাড় করে লীলাপ্রসঙ্গ পড়ে এস। ঠাকুর সম্বন্ধে তোমার কিছু জানা নাই, ঠাকুরের বিষয়ে জানা না থাকলে আমি দীক্ষা দিই না। তাঁর সম্বন্ধে আগে জানো, তবে তো তাঁর উপর ভক্তি বিশ্বাস আসবে। তখন দীক্ষা নিলে কাজ হবে। তা না হলে কেবল দীক্ষা নিয়ে কি হবে?”(স্বামী অখণ্ডানন্দকে যেরূপ দেখিয়াছি, সংকলক--চেতনানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়) পরবর্তী সময়ে এই মহিলার দীক্ষা হয়েছিল। দীক্ষা দেওয়া সম্বন্ধে একটু কঠোরই ছিলেন তিনি।

১৯৩৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি অপরাহ্ণ ৩টে ৭ মিনিটে মহাসমাধিতে প্রবেশ করেন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের তৃতীয় সঙ্ঘগুরু স্বামী অখণ্ডানন্দজী। অতিরিক্ত পরিশ্রম ও কঠোরতায় তাঁর শরীর বহুকাল আগে থেকেই ভেঙে পড়েছিল। কয়েক বছর ধরে বহুমূত্র ও রক্তচাপজনিত অসুবিধায় কষ্ট পাচ্ছিলেন। দেহাবসানের দিন দুই আগে হঠাৎ তাঁর প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় ১৪ ঘন্টা বন্ধ থাকে। দ্রুত তারযোগে বেলুড় মঠে খবর পাঠানো হয়। তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসবার জন্য বেলুড় মঠ থেকে কয়েকজন সন্ন্যাসী সারগাছি রওনা হন। সেখানে পৌঁছে তাঁরা তাঁকে কিছুটা সুস্থ দেখতে পান। কিন্তু পরদিন পুনরায় অসুস্থ বোধ করেন। এমতাবস্থায় ট্রেনযোগে কলকাতায় নিয়ে আসার সময় রাণাঘাট স্টেশনের কাছে সংজ্ঞালুপ্ত হন। রাত ১০ টার পর ট্রেন কলকাতায় পৌঁছায়। ১টা নাগাদ তাঁকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছয় বেলুড় মঠে। অপরাহ্ণে দেহত্যাগ করেন সে কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। রাত আটটার সময় গুরুভ্রাতা স্বামী প্রেমানন্দজীর সমাধিস্থানের পাশে চন্দনকাঠের প্রজ্বলিত পূতাগ্নিতে তাঁর দেবতনু পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায়।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments