জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প—উত্তর আমেরিকা (এস্কিমো)/চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প—উত্তর আমেরিকা (এস্কিমো)

চিন্ময় দাশ

বেঁটে খাটো মানুষজন

অনেক অনেক কাল আগের কথা। তখনও সাদা চামড়ার মানুষেরা এসে দখল নেয়নি দেশটার। নিজের দেশে নিজের মতো করে বাস করত এস্কিমো মানুষেরা। 
    বেশ বড়সড় এক গ্রাম। একটা নদী বয়ে গেছে গ্রামের পাশ দিয়ে। জনাকয়েক লোক এসে বসে ছিল নদীর পাড়ে। নিজেদের মধ্যে খোসগল্প করছিল লোকগুলো।
    হঠাৎ লোকগুলোর চোখে পড়ল, একটা নৌকা ভেসে আসছে নদীর বুক বেয়ে। কিন্তু অবাক ব্যাপার! নৌকায় কোন লোকজন দেখা যাচ্ছে না তো! এমনটা কী ক'রে হয়? 

    লোকগুলো আরও অবাক হোল, নৌকাটা যখন কাছাকাছি এলো। লোক আছে নৌকায়। কিন্তু তাদের চেহারা এতটাই ছোট, যে চোখে পড়ে কি পড়েই না। একটা লোক, আর সাথে তার বউ আর পুঁচকে একটা ছেলে।
নদীর পাড়ে কতকগুলো মানুষকে বসে থাকতে দেখে, থেমে গেল নৌকাটা। থেমে রইল খানিক সময়। তার পর নৌকা এসে পাড়ে লাগল। যখন নেমে এল লোকগুলো, তাদের চেহারাগুলো দেখা গেল। দেখে, পাড়ের লোকগুলো তো হেসেই বাঁচে না। এতো ছোটখাটো মানুষ আবার হয় না কি? চোখ কপালে উঠে গেল তাদের। 
পাড়ের উপরে উঠে এল যখন, তাদের চেহারাগুলো পুরোপুরি ভালো করে দেখা গেল। এতটাই ছোট তাদের চেহারা, মানুষ বলে ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। সামনের লোকটা যে কোটটা পরে আছে, নিশ্চয়ই একটা শেয়ালের চামড়াতেই হয়ে গেছে সেটা। বড় জোর দুটো খরগোশের চামড়া লেগেছে তার বউয়ের পোষাক বানাতে। আর বাচ্চাটার কোট? মনে হয়, যেন একটা ইঁদুরের চামড়াই যথেষ্ট। 

    হবে নাই বা কেন? বাবা আর মায়ের শরীর খুব বেশি হলে হাতখানেক লম্বা। আর বাচ্চাটা? হলফ করে বলে দেওয়া যায়, হাতের চেটোর চেয়ে কোন অংশে একটুও বড় নয়।
    কিন্তু আসল চমক তখনও বাকি ছিল। এবার যা ঘটল, দেখে হতবাক হয়ে গেল সবাই। কেবল তিনটে লোকই আসেনি নৌকাটায়। একটা স্লেজগাড়িও নৌকায় চাপিয়ে এনেছে তারা। এ গাঁয়ের লোকেরা যে স্লেজ ব্যবহার করে, তার চেয়ে কোন অংশেই ছোট নয় তাদেরটা। নিজেদের পোঁটলা-পুঁটলিগুলো সেটার উপর চাপানো। 

    অবাক কাণ্ডটা ঘটে গেল সকলের চোখের সামনে। পোঁটলা-পুঁটলি শুদ্ধ স্লেজটার একটা কানা ধরে নামিয়ে আনল লোকটা। যেটা করতে কয়েকজন লোক লাগত এই গাঁয়ের। একা একা নামানো কারোর সাধ্যে কুলোত না কোন মতেই। অথচ ঐ চেহারার একাই একটা লোক করল কাজটা! এবং করল একেবারে অবলীলায়!
এতক্ষণ সবাই হাসাহাসি করছিল ওদের নিয়ে। ঘটনাটা দেখে, নিমেষে হাসি মুছে গেল সবার মুখ থেকে। উলটে একটা সমীহ বোধ হচ্ছে নবাগতদের জন্য। ছোট্ট ঐটুকুন চেহারায় এত শক্তিও থাকতে পারে! 
গ্রামের একটা বাড়িতে থাকতে দেওয়া হোল লোকগুলোকে। সবাই সাদরে গ্রহণ করেছে পরিবারটিকে। নবাগতরাও বেশ মানিয়ে নিয়েছে এখানে। তাদের যেন মনেই হয় না, নতুন দেশে নতুন লোকজনের সাথে বাস করছে। গ্রামের সবার সাথেই বেশ মনের মিল হয়ে গেছে তাদের।

    কিন্তু সেই যে কথায় বলে না—সুখের দিনের আয়ু বেশি লম্বা নয়। একদিন সত্যিই তাই ঘটে গেল। 
    বিপত্তিটা ঘটল একেবারে আচমকাই। মাঠে খেলা করছিল পুঁচকে ছেলেটা। হঠাৎই কোথা থেকে একটা কুকুর এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাচ্চাটার উপর। ওইটুকুন তো শরীর। প্রায় চিবিয়ে খেয়ে ফেলবার যোগাড়।
    সবাই ঝটপট করে হামলে পড়ল কুকুরটার ওপর। কোনও রকমে বাচ্চাটাকে ছাড়ালও কুকুরের মুখ থেকে। কিন্তু ততক্ষণে বাচ্চাটা আর বেঁচে নাই।
    বাচ্চাটার বাবাও ছিল কাছেপিঠেই। তার চোখের সামনেই ঘটে গেল কাণ্ডটা। লোকটা রাগে অন্ধ হয়ে ছিটকে উঠে এল। কুকুরটার লেজ ধরে শূণ্যে ঘোরাল দু-চার পাক। তার পর প্রচণ্ড আছাড় একটা গাছের গায়ে। টুকরো টুকরো হয়ে গেল কুকুরটার শরীর। 
    একমাত্র ছেলে মারা পড়েছে। কিন্তু লোকটা কিংবা তার বউ কিচ্ছু বলল না কাউকে। এমনকি কুকুরের মালিককেও বলল না কিছু। ঘরের দাওয়ায় বসে বসে কাঠের বাক্স বানাল একটা। সুন্দর কারুকাজ করল বাক্সটার গায়ে। 
    ছেলের ছেঁড়াখোঁড়া শরীরটাকে যত্ন করে বাক্সের ভিতর শোয়ালো। নতুন একটা পোষাক এনে ঢেকে দিল যত্ন করে। যা কিছু খেলনাপাতি ছিল ছেলের, মা ভেতর থেকে একটা একটা করে এনে, সব ভরে দিল বাক্সে। 
বাবা মা দুজনে বেরোল ঘর থেকে। বাবা বাক্সটা নিয়েছে। দু'হাতে আঁকড়ে ধরে আছে বুকে। মা চলেছে পেছনে পেছনে। আজ তাদের গতি বড্ড ধীর। 
গোটা গ্রাম আজ স্থির হয়ে আছে বরফের মত। বোবা হয়ে গেছে সবাই। যেন সন্তান হারিয়েছে তারাও। কথাটিও সরছে না কারও মুখ থেকে।  

ধীরে ধীরে নদীর ধারে গিয়ে পৌঁছল দুজন ছোট্ট মানুষ। বাক্সটা মায়ের হাতে ধরিয়ে, বরফ খুঁড়ল লোকটা। পুঁতে দেওয়ার আগে, বাক্সটাকে সে কী জড়াজড়ি দুজনে মিলে। কী আকুলি বিকুলি! দেখলেই বোঝা যায়, বুক ফেটে যাচ্ছে দুজনের। 
যাওয়ার সময় যেমন, ফিরে এল ঠিক তেমনটি ভাবেই। মাথা নীচু। মুখে রাটিও নাই দুজনেরই। 
দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল গোটা গ্রাম। যেন পাথর হয়ে গিয়েছে আজ তারা। বুক ফেটে যাচ্ছিল কান্নায়। যেন তারাও হারিয়েছে তাদের সন্তানকে।
    তার পর? বাবা মা দুজনে ঘরে বসে রইল টানা চার দিন। একটি কথাও বলল না কারও সাথে। কারও সাথে দেখাও করল না তারা। গোটা গ্রামও বোবা হয়ে রইল কয়েকটা দিন।

    ঠিক পাঁচ দিনের দিন, ঘর থেকে বেরুলো দু’জনে। সাথে নিজেদের পোঁটলা-পুঁটলি। গুটি গুটি পা ফেলে হেঁটে গেল নদীর দিকে। সেদিনও একটি কথাও কইল না কারও সাথে। যে পথ ধরে এসেছিল এই গ্রামে, সেই পথেই রওণা হয়ে গেল চোখের জল ফেলতে ফেলতে। নদীতে নৌকা ভাসিয়ে চলে গেল দুটিতে। 
    সেদিন গ্রামের সবাই চলেছে তাদের পেছন পেছন। গোটা গ্রামটাই সেদিন এসে ভেঙ্গে পড়েছে নদীর পাড়ে। অনেকেরই চোখ ছলছল। আসলে, তারা ভালোবসে ফেলেছিল আগন্তুক পরিবারটিকে।
    ভাসতে ভাসতে নৌকাটা যতক্ষণ দেখা গেল, পাড়ে দাঁড়িয়েই রইল গোটা গ্রাম। 

    গাঁয়ের মোড়লও ছিল সেই ভীড়ের ভিতর। সে বলল—শোন বাছারা, একটা কথা বলি তোমাদের। মানুষ তার চেহারায় বেঁটে না লম্বা, ছোট কি বড়—সেটা কোনও কথাই নয়। কথা হোল, তার চালচলন, কথাবার্তা ভালো কি মন্দ, সেটা বিচার করা। চালচলন দিয়েই বিচার করতে হয় মানুষকে। চেহারার মাপ দিয়ে নয়। আর, শেখার কিছু থাকলে, ছোটর কাছ থেকেও শিখতে হয়।
    সত্যি সত্যিই শিখেছিল গ্রামের লোকেরা। আগে তাদের স্লেজ ছিল লম্বাটে গড়নের। বানাতে হোত লম্বালম্বি ভাবে, কাঠের তক্তা জুড়ে। বড় বড় গাছ লাগত তার জন্য। বড় গাছ জোগাড় করতে ভারি হয়রাণ হতে হত সবাইকে। বেঁটে মানুষদের স্লেজ ছিল আড় দিকের, ছোট তক্তা দিয়ে জোড়া। 
    ছোট মাপের তেমন কাঠ পাওয়া যায় সহজেই। বড় মাপের গাছ খুঁজে খুঁজে হয়রাণ হতে হয় না এখন আর। এখন নতুন নিয়মে, ছোট মাপের কাঠ দিয়েই স্লেজ বানায় গ্রামের লোকেরা। 

    গ্রামের লোকেরা শিখেছিল আরও একটা জিনিষ। এত দিন পরিবারের কেউ মারা গেলে, মরা দেহটা তুন্দ্রায় বরফের উপর রেখে আসা হোত। বুনো জন্তু-জানোয়ার খেয়ে নিত দেহটাকে। এখন সেসব আর করে না কেউ। এখন যত্ন করে কাঠের বাক্স বানায় তারা। সেই বাক্সে সাধ্যমত কারুকাজও করে কেউ কেউ। যেমনটা করেছিল বেঁটে মানুষটি। তারপর দল বেঁধে নদীর পাড়ে যায়। যত্ন করে কবর খোঁড়া হয়। বরফের নীচে কবর দিয়ে আসে বাক্সটাকে। ঘুম পাড়িয়ে আসে প্রিয়জনটিকে।
    শুধু তাই নয়। ঘরে ফিরে এসে, চার দিন শোক পালন করে সবাই। 
    এ সব করে, কারণ পরিবারটিকে ভালো বেসে ফেলেছিল তারা। ভালো লেগেছিল তাদের শোভন রীতিগুলোও। 

    আজও শিকারে বেরোয় গ্রামের লোকেরা। কাজ সেরে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে আসে। তখন তারা অন্ধকার হয়ে আসা তুন্দ্রার দিকে তাকায়। কখনও কখনও তাদের হয়তো চোখে পড়ে, দু’-চার জন বেঁটেখাটো মানুষ হেঁটে যাচ্ছে বরফের উপর দিয়ে। হাতে তীর-ধনুক। 
    কিন্তু কেউ কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করলে, বরফের আড়ালে কোথায় যেন মিশে যায়। আর চোখে পড়ে না। 
    ভারি ভালো মানুষ তারা। কোন দিন কারও ক্ষতি করেনি। এই গ্রাম থেকে চলে যাওয়ার দিন থেকে একটি কথাও বলা যায়নি তাদের কোনও একজনের সাথে। ক্ষমা চাওয়া হয়নি কুকুরটার বেয়াদপির জন্য। সত্যি বলতে কী, ঘটনাটার জন্য আজও মরমে মরে আছে গোটা গ্রাম। 

    তবে, গ্রামের যারা হরিণ শিকারে যায়, কখনও কখনও পাহাড়তলির দিকে বরফের উপর ছোট ছোট গর্তের সারি চোখে পড়ে তাদের। আর কিছু না, বেঁটে মানুষদের পায়ের ছাপ ওগুলো।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments