জ্বলদর্চি

মাটিমাখা মহাপ্রাণ। আঠারো/শুভঙ্কর দাস

মাটিমাখা মহাপ্রাণ। আঠারো
শুভঙ্কর দাস 

"আপনারে দীপ করি জ্বালো
দুর্গম সংসার পথে অন্ধকারে দিতে হবে আলো"

হিরন্ময় বাগানবাড়িতে এসে থমকে দাঁড়ালো। বাগানবাড়ির মধ্যে একটি ছোট সরোবর আছে,তার চারিপাশে নারকেল-ঝাউ-আকাশমণির ঘনছায়া। তারই পাশে একটি গাছের নিচে কুমার স্যর মাদুর পেতে প্রতিদিন বিকেলে পড়ান এবং আলোচনাসভা বসান। অথচ বাগানবাড়ির গৃহটি দোতলা,সুন্দর আসবাবে সাজানো। ইচ্ছে করলেই তার যেকোনো একটি কক্ষে পাঠদান করা সম্ভব। কিন্তু কুমার স্যর এই সরোবরের ধারে গাছতলায় মাদুরে বসে পড়াতে পছন্দ করেন। কখনো কখনো মাদুর ছাড়াই ঘাসে বসে আলোচনা সভা বসিয়ে দেন। 
অথবা সেই বাগানের কোনো না স্থানে কুমার স্যর কোনো না কোনো  কাজে ব্যস্ত থাকতে  ভালোবাসেন।
তিনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন বাগানে ফুলের গাছের পরিচর্যা করতে।
কখনো বা মাদুরে বসে একাই গীতার শ্লোক দৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করছেন। 
হিরন্ময় সেই গাছের তলায় গিয়ে দেখল,মাদুর পাতা আছে,কিছু বইপত্র একপাশে রাখা।কুমার স্যর নেই। অর্থাৎ দেখেই মনে হল, এতক্ষণ তিনি এখানেই পড়ছিলেন, কোনো বিশেষ কারণে কোথাও চলে গেছেন!

এই হিরু, আজ তো পড়াশোনা হবে না মনে হচ্ছে!  কারণ তোমার মাস্টার ছুটে গেছেন গান্ধিজিকে দর্শন করতে, বললেন গঙ্গাধর। 

কিন্তু সে তো দেরি আছে,বাবার মুখে শুনলাম বিকেলের দিকে আসবেন,এখন তো সবে দুপুর গড়াল

সে খেয়াল তোমার মাস্টারের নিশ্চিত আছে,কিন্তু তিনি হচ্ছেন অমরনাথের সেই তীর্থযাত্রীদের মতো,পা-গাড়ি ছাড়া যে কোনো গাড়িতে চড়েন না!তাই সেই কলেজ স্ট্রিটে উদ্দেশ্য হাঁটা শুরু করে দিয়েছেন, যেখান দিয়ে গান্ধিজি ইউনিভার্সিটি হলে আসবেন, বলে উঠলেন গঙ্গাধর 

এই রোদে এতটা পায়ে হেঁটে!  বিস্মিত হল হিরন্ময়। বাবাকে বলে কিছু টাকা গাড়ি-ভাড়ার জন্য টাকা দিলে ভালো হত কুমার স্যরকে,এটা করতে পারলাম না,মনটা খারাপ লাগছে খুব!

গঙ্গাধর একটু এগিয়ে এসে হিরন্ময়ের কাঁধে হাত রেখে সস্নেহে  বলে উঠলেন,হিরু,মন খারাপ রেখো না,এই যে বাগানবাড়িটি দেখছো,ফুলের গাছ,বড় বড় গাছ,সরোবর, এই সুন্দর বাতাস,পরিষ্কার আকাশ এরা কেমন জানো,এরা নিতে জানে না,শুধু দিতে জানে,তোমার কুমার স্যরটি ঠিক এদের মতো,তিনি শুধু সকলকে দিতে এসেছেন, বুঝেছো..

হিরন্ময় শুনল এবং নীরবে মাথা নাড়ল। তারপর সেই গাছতলার মাদুরের কাছে যেখানে কুমার স্যর বসে পাঠদান করেন,সেই শূন্য  আসনের দিকে তাকিয়ে থাকল। 

মহাসমুদ্রে মিলিত হওয়ার জন্য যেমন ছোট ছোট নদী আকুল আগ্রহ-স্রোতে ছুটে চলে,তেমনি গান্ধিজিকে দর্শন করার জন্য কুমারচন্দ্র হাঁটতে হাঁটতে, না, প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে কলেজ স্ট্রিটে এসে পৌঁছালো। তাঁর মুখ দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে,জামা প্রায় ভিজে।এসে দেখলেন,প্রচুর মানুষজন রাস্তার দুধারে অপেক্ষমান।এবং যা জানল,দু'ঘন্টা বাকি আছে আসতে  গান্ধিজির, তা শুনে কুমারচন্দ্র খুব খুশি হল।অর্থাৎ দু'ঘন্টা কেন, যদি সারাদিন রৌদ্রে অপেক্ষা করতে হয়,তাতেও কিছু যায় আসে না!
পাশেই একটি বড় বইদোকান,তার সামনের অংশটিতে শেড আছে।সেখানে বেশকিছু লোক রোদ থেকে বাঁচবার জন্য দাঁড়িয়ে আছে এবং একে-অপরের সঙ্গে নানা ধরণের কথাবার্তায় ব্যস্ত।
একটি লোক এই গরমে কোট-প্যান্ট এবং মাথায় একটি হ্যাট পরে সেখানেই দাঁড়িয়ে, লোকটিকে এই রোদে-ধূলায় অতি সাধারণ পোশাক-পরিহিত মানুষজনের পাশে বড় বেমানান লাগছে।
লোকটির মুখেচোখে বিরক্তি ও উদ্বেগ ছড়িয়ে আছে।
সেই লোকটি হঠাৎ কুমারচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে সামান্য ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে উঠলেন,এই যে মিস্টার,এইরকম সুইমিং পুল-ঝাঁপানোর মতো দাঁড়িয়ে আছেন কেন? এমন ভাব করছেন,যেন গান্ধিজি এসেই প্রথমে আপনাকে খোঁজ করবেন! সরে যান, সরে যান,পেছনের দিকে

কুমারচন্দ্র নীরব এবং নিজের স্থান থেকে একটুও সরলেন না!

কোট-প্যান্ট লোকটি এবার একটু গলায় জোর এনে বলে উঠলেন,  ইউ ডোন্ট হিয়ার? কী বললাম, সরে দাঁড়ান,যিনি আসছেন,তিনি কি আপনার মতো হেঁজিপেঁজি লোক,চোখের সামনে দিয়ে মস্ত বড় গাড়ি চলে যাবে,সামনে - পিছেন পুলিশ থাকবে,অবশ্য আমি যেখানে আছি,হয়তো এদিকে একবার তাকালে এখানেও গাড়িটি থামতে পারে,কারণ আমি গোহত্যানিবারণ সমিতির মুখ্য। তাই রাস্তার ঐ ধার থেকে সরে দাঁড়ান, যাতে আমাকে গান্ধিজি যাওয়ার সময় পরিষ্কার দেখতে পান।

কেন?  আপনাকে দেখলেই গান্ধিকি কি শত শত গরু দান করবেন? এ কি গরুবিতরণী সভা চলছে! একটি লম্বা-রোগা নাকটা বেশ উঁচু লোক বইয়ের দোকানের ছায়া থেকে সরে এসে কুমারচন্দ্রের পাশে এসে দাঁড়ালেন এবং বলেই চললেন,শুধু সরে যান, যান,কেন উনি সরবেন,আমার নাম কানাই চক্রবর্তী, এই কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাতে বই বিক্রি করি,যে পারবে, যেখানে দাঁড়াতে পারবে,ফুটপাত কারও একার নয়!

কোট-প্যান্টের লোকটি  চেঁচিয়ে বলল,আর ইউ ম্যাড!গরু আর বই এক হল?

কানাইও গলার স্বর তুলে বলল,জানি তো এক নয়, গরুগুলোকে মানুষ করার জন্য এতো বই বেরোচ্ছে.. বিকোচ্ছে...

কী আমাকে গরু বলা,একথা বলেই কোট-প্যান্ট এগিয়ে আসতে গিয়ে পায়ের কাছে একটি ইটে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়লেন সামনের রাস্তায়.. 
কী হল?  কী হল? সকলে চেঁচিয়ে উঠল,কিন্তু কেউ কাছে গিয়ে তোলার চেষ্টা করল না। কেউ আবার পেছন থেকে বিদ্রূপ করে বলল,ঠিক হয়েছে, তখন থেকে বড় বড় বাতেলা দিচ্ছিল,বাবু! কেউ বলল,ওহ্ একেবারে সাহেব সেজে চলে এসেছে, কী বাহাদুরি,যেন ওর ঐ হ্যাট-ম্যাট দেখে গান্ধিজি একেবারে বুকে জড়িয়ে ধরবেন,যতসব!
নানা কথার ফুলঝড়ির মধ্যে লোকটি পড়ে কাতরাচ্ছে, তাঁর হাতের আঙুল দিয়ে রক্ত পড়ছে!
তখন কুমারচন্দ্র এগিয়ে গিয়ে তাকে তুলে ধরলেন এবং পকেট থেকে রুমাল বের করে রক্ত মুছিয়ে দিয়ে বললেন,একটু জল খাবেন?
বলেই কুমারচন্দ্র কাছের দোকান থেকে জলের মগটা এনে তাকে খেতে দিলেন এবং তুলে ধরলেন। 
খুবই যত্নশীল কণ্ঠে বলে উঠলেন,আপনার কষ্ট হচ্ছে কী?তাহলে আমার হাতটি শক্ত করে ধরুন,চলুন
কোট-প্যান্টের মুখেচোখে অবাক হওয়ার ছাপ। যাকে দূর দূর করেছিলেন এবং পেছনের সরে সরে যেতে বলছিলেন,সেই মানুষটি বিপদের সময় এগিয়ে এলো। কুমারচন্দ্র সেই লোকটিকে ধরে ধরে পেছনের দিকে একটি মিষ্টিদোকানের বেঞ্চে শুইয়ে দিল।মুখে বললেন,এখানে বিশ্রাম নিন।ঠিক হয়ে যাবেন।
কানাই চক্রবর্তী ভীড়ের মধ্যে এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়ালো,ঘটনা ঘটার পরেই তিনি ভীড়ের মধ্যে মিশে গেছিলেন,কারণ তাঁর সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে লোকটি পড়ে গেছিলো,এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দেখে,বলে উঠল,একেবারে গোবেচারা লোক গো, আহ্ কেমন মুখ থুবড়ে গরুর মতো পড়ে গেল,আহ্ আহ্

তাঁর কথা বলার ধরণে অনেকেই হেসে উঠল।
এসবের মধ্যে একটা জিনিস লক্ষ্য করা গেল।কুমারচন্দ্র যেখানে দাঁড়াচ্ছেন,সেখানেই সকলে সম্ভ্রমে সরে দাঁড়াচ্ছে। 
সহসা শোনা গেল ঐ তো আসছেন! তিনি আসছেন! জয় গান্ধিজি কী? বন্দেমাতরম!  জয় গান্ধিজি কী! 
 কুমারচন্দ্রকে আর ভীড় ঠেলতে হল না,তিনি আসা মাত্র কয়েকজন সরে দাঁড়ালো।
সকলেই রাস্তার দিকে তাকিয়ে আগ্রহে ভরে দেখছেন। দুপাশে মানুষজন ভীড় করে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে দেখছে,না,কোনো বড় গাড়ি নয়, সামনে বা পেছনে কোনো পুলিস নয়, কোনো ঠাট-বাট-পোশাকের বহর নয়, জনগণের মধ্যে থেকে জনগণের মতো অতি সাধারণ  একজন হেঁটে এলেন।
পায়ে চটি,মাথায় পাগড়ি,অতি অল্প দামের খদ্দেরের পোশাক,গায়ের অনুজ্জ্বল, দোহারা চেহারা,মাথায় কদমছাঁট চুল, নাকের ওপর গোল চশমা, হাতদুটো বুকের সামনে নমস্কারের ভঙ্গিতে এগিয়ে যাচ্ছেন আবার কখনো কারও কাছে গিয়ে গায়ে হাত রেখে আপনজনের মতো দু'একটা কথাও বলছেন।
কুমারচন্দ্র বিস্মিত হয়ে গেলেন।
এ কে?  এই তিনি! যাঁর জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার জাঁদরেল শাসক ইংরেজ পর্যন্ত পরাস্ত হয়েছে, যাঁর উপস্থিতি এক সাধারণ স্থানকে তীর্থ করে তুলছে, গোখলে বলেছিলেন নাকি ভারতবর্ষের কোনো কোনো নেতা হিমালয়ের মতো,কোনো কোনো নেতা সমুদ্রের মতো, কিন্তু হিমালয়ে সকলে চড়তে পারে না,আবার সমুদ্রে ডোবার ভয় থাকে,কিন্তু যদি নেতৃত্বে গঙ্গা হয়ে ওঠে,তাহলে সারা ভারতবর্ষ তাতে স্নান করে পুণ্য অর্জন করতে পারে,কুমারচন্দ্রের গান্ধিজিকে সেই গঙ্গানদীর মতো মনে হল! 

কুমারচন্দ্র স্থির দৃষ্টিতে গান্ধিজি নামক অদ্ভুত লোকটিকে দেখতে লাগলেন। তিনি হেঁটে যাচ্ছেন,আর কুমারচন্দ্রের মনে হচ্ছে, যেন সামনে একটি ভয়ংকর শক্ত প্রাচীর ছিল,সেই প্রাচীর জাতপাত,কুসংস্কার এবং পরাধীনতার গ্লানি দিয়ে এমন মজবুত, যাকে ভাঙা তো দূর একটা ইটও খসানো অসম্ভব, কিন্তু এই সাধারণ মানুষের মতো দেখতে লোকটি যেন যত এগিয়ে যাচ্ছে, ততোবেশি পথ তৈরি হয়ে যাচ্ছে। 

সহসা সামনে একটি গোলমাল শোনা গেল।কৌতূহলী দর্শকের ঠেলাঠেলি ও চাপাচাপির ফলে একটি বৃদ্ধা ঠেলে খেয়ে একেবারে গান্ধিজির সামনে হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ল।রাস্তার ধুলোবালি তার মুখেচোখে লেগে গেল,বৃদ্ধাটি আর্তনাদ করে উঠল,মাগো! সঙ্গে সঙ্গে গান্ধিজি এগিয়ে গিয়ে নিচু হয়ে সেই বৃদ্ধাকে তুলে ধরলেন,তারপর স্নেহময় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,মাঈ,আপ ঠিক হ্যায় না? কোই তকলিফ নেহি হ্যাঁ না?
বৃদ্ধা অবাক।
তাকে যে কেউ এমনভাবে সাহায্য করতে পারে,তার জানা ছিল না।সকলে বলেছিল,একজন এমন মানুষ আসছে,তার দেখা পাওয়াটাই দেবতা দর্শনের মতো,তাই সেও ভিক্ষা করা ছেড়ে দেখতে এসেছিল, কিন্তু নিচু জাত বলে কেউ ঠিকমতো দাঁড়াতে দিচ্ছিল না সামনে, সকলেই ঘৃণা ও বিরক্তসহ তাড়িয়ে দিচ্ছিল।
বৃদ্ধা একজন ভিখিরি এবং তার চেয়ে বড় কথা নিচু জাতের,ফলে আশেপাশে অনেকেই এই দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠল। একি! একজন নিচু জাতের মহিলাকে গান্ধিজি ছুঁয়ে দিলেন।কমবেশি সকলেই খুব অস্বস্তিতে পড়ে গেছে!
কুমারচন্দ্র ছুটে গিয়ে ঘটনাটি দেখলেন।
গান্ধিজি বৃদ্ধাকে তুলে দাঁড় করালেন তারপর তার শতছিন্ন কাপড়টি দেখে পাশের একজনের হাতে রাখা শালটি চেয়ে সেই বৃদ্ধাকে দিয়ে দিলেন।ঐ শালটি পূর্বের কোনো সভামঞ্চে উপহার হিসেবে দিয়েছিল।
তারপর নিজেই বিড়বিড় করে বলে উঠলেন,সব সে প্যাহেলে হামারা দেশবাসীকো অন্দর সে খাড়া হোনা শিখনা পড়েগা.. এই সচ হ্যায়,এই সচ হ্যায়।
বলতে বলতে এগিয়ে গেলেন গান্ধিজি।
কুমারচন্দ্র স্পষ্ট কথাটি শুনলেন এবং বুঝতে পারলেন।
তিনি যেন একটা ঘোরের মধ্যে  আছেন,সহসা শুনলেন সেই কানাই চক্রবর্তী ভীড়ের মধ্যে চেঁচিয়ে আবৃত্তি করছে,

"যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে
মুক্ত করো হে বন্ধ 
সঞ্চার করো সকল কর্মে
শান্ত তোমার ছন্দ। 
চরণপদ্মে মম চিত নিঃস্পন্দিত করো হে
নন্দিত করো,নন্দিত করো হে
নন্দিত করো করো হে।
অন্তর মম বিকশিত করো 
অন্তরতর হে।

আহ্ কী সুন্দর! এই কবিতার চরনগুলো কুমারচন্দ্রের ভেতরটা নাড়িয়ে দিল।এত সুন্দর লেখা,আজকের এই পুণ্যতীর্থের একজন সত্যিকারের মানুষকে দেখে ঠিক এইরকম ভাবই জেগে উঠেছে বুকে,অন্তরে,আহ্, অন্তর মম বিকশিত করো/ অন্তরতর হে" কী অপূর্ব!  যেন চারিপাশের প্রখর রৌদ্রকে ছায়াশীতল করে দিচ্ছে! 
কার লেখা?
কুমারচন্দ্র ছুটে গিয়ে সেই কানাই চক্রবর্তীকে জড়িয়ে ধরল।

বন্ধু,কী শোনালেন,এমন কবিতা কার বলুন তো? আমি তো বলার জন্য কিছু ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না! আবেগে কুমারচন্দ্র অস্থির। 
কানাই চক্রবর্তী একটু চমকে গেছে,সে দেখেছে, এই মানুষটিকে একটু অন্যরকম। সে বেশ উৎসাহ পেয়ে বলল,আরও জানি,শুনুন বন্ধু, 

আচ্ছা, বন্ধু আপনার নাম?

আমার নাম কুমারচন্দ্র। 

আচ্ছা, বেশ বেশ সেখানে করমচাঁদ এখানে কুমারচাঁদ, বাহ্ বাহ্ শুনুন বন্ধু 

"কী লয়ে বা গর্ভ করি
ব্যর্থ জীবনে।
ভরা গৃহে শূন্যে আমি
তোমা বিহনে।
দিনের কর্ম ডুবেছে মোর
আপন অতলে 
সন্ধ্যাবেলার পূজা যেন
যায় না বিফলে।
নামাও নামটাও আমার তোমার
চরণতলে।"

শেষ করে কানাই চক্রবর্তী জিজ্ঞেস করল,কেমন বন্ধু? 
এটাও তো মনের কথা,কী সুন্দর করে বললে বন্ধু, " দিনের কর্ম ডুবেছে মোর / আপন অতলে / সন্ধ্যাপূজা যেন/ যায় না বিফল"
আহ্, সত্যি একটা কথা জিজ্ঞেস করি,এ কী আপনার লেখা?

আরে দোর বন্ধু, এমন লেখা কি যে-সে লিখতে পারে!

এ হল নোবেলজয়ী কবির লেখা

রবীন্দ্রনাথ 

হ্যাঁ বন্ধু, বইটির নাম তো নিশ্চিত জানো?

গীতাঞ্জলি 

একদম, আরে বন্ধু, আপনি নিজেই একজন বর্ণচোরা আম, সবই জানেন,অথচ আমাকে এমনি এমনি প্রশংসা করে চলেছেন, আরে আপনি চাইলে সোজা একটা ট্রেন ধরে শান্তিনিকেতন চলে যান,আপনি হাত পেতে চাইলে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ আপনাকে গীতাঞ্জলি গিফট করতে পারেন,এমন উপহার ক'জন আর পায়? কারণ কী জানেন বন্ধু,রবীন্দ্রনাথ শুধু ভারতবর্ষের নয়, এশিয়ার মধ্যে প্রথম নোবেল...

কথাটি শেষ হল না! কানাই চক্রবর্তী চোখ বন্ধ করে বলে যাচ্ছিল,খুলে দেখল, তার পাশ দিয়ে একটা আচ্ছন্ন মানুষের মতো কুমারচন্দ্র  হাঁটতে শুরু করে দিয়েছে,যেন কোনো হুঁশ নেই! 
কানাই চক্রবর্তী একটু চেঁচিয়ে বলে উঠল, আরে বন্ধু, এখন তো শান্তিনিকেতন যাওয়ার কোনো ট্রেন নেই যে... যাঃ বাবা, এ কী লোকরে...
কুমারচন্দ্র সোজা গিয়ে সামনের একটি বই দোকানে গিয়ে দাঁড়াল।একটা গীতাঞ্জলি দিন তো, কত দাম?

পনেরোটা? দোকানদার উত্তর দিল।

প-নে-রো টা-কা!  কুমারচন্দ্র ফতুয়ার পকেট ঘেঁটে দেখল,মোট সাড়ে চারটাকা আছে। তাঁর মনে হয়েছিল,এই বই না কিনে বাগানবাড়িতে ফিরবে না,কিন্তু তাঁর পক্ষে কেনা খুবই কঠিন।
তিনি হতাশ ও বিমর্ষ হয়ে ফিরে আসছিলেন।হাঁটতে হাঁটতে মুখস্থর মতো বলতে লাগলেন," কী লয়ে বা গর্ব করি / ব্যর্থ জীবনে।/ ভরা গৃহে শূন্য আমি / তোমা বিহনে। "
সহসা পিঠে একটা হাতের স্পর্শ পেলেন।
ঘুরে দেখলেন সেই কোট-প্যান্ট পরিহিত গান্ধিজি দর্শনকারী গোহত্যানিবারণ সমিতির সভ্য।

আপনার কাছে একটা অনুরোধ ছিল

বলুন? কুমারচন্দ্র মৃদু অবাক।

আপনার মতো মানুষ এই কলকাতা শহরে বিরল, লোকের বিপদে কমবেশি সকলেই  ঠাট্টা-ইয়ার্কি করে,সেখানে আপনি অন্য ধাতুতে গড়া,আমাকে যেভাবে সাহায্য করলেন।আমি ধন্যবাদ জানাতে এসেছি 

ওহ্ আচ্ছা,ভালো থাকুন, কী জানেন,সব চে প্যাহেলে হামারা  দেশবাসীকো অন্দর সে খাড়া হোনা পড়েগা..

মানে? 

ওহ্ না, কিছু নয়,আসছি নমস্কার বলেই কুমারচন্দ্র চলে যাচ্ছিলেন।

শুনুন, আরও একটা অনুরোধ ছিল

বলুন?

এইটি আপনাকে নিতে হবে, দয়া করে না বলবেন না

কী?

এইটি, বলেই কোটের পকেট থেকে একটা গীতাঞ্জলি বই বের করলেন,সদ্য কেনা হয়েছে  বোঝাই যাচ্ছে 

আপনার বই? বাহ্, আমার কেনার ইচ্ছে ছিল,কিন্তু... 

আমি সব জানি,আমি দূর থেকে আপনাকে লক্ষ্য করছিলাম,আপনি পয়সার অভাবে কিনতে পারেননি! এটা আমি আপনার জন্য কিনেছি

মানে? অবাক কুমারচন্দ্র  

মানে কিছুই নয়, এই বইটি আপনার কাছে থাকা দরকার, যাতে আমাদের মতো অসংখ্য অন্ধের চোখ খুলে দিতে পারেন!

না,না,আমি নিতে পারব না,বরং আমাকে যদি পড়তে ধার দেন,আর ঠিকানা বলেন তো,আমি আপনার বাড়িতে ফেরত দিয়ে আসব

সে তো আপনি আমার বাড়িতে অবশ্যই আসবেন,কিন্তু এটা আমি আপনার জন্য কিনেছি,আর না করবেন না,প্লিজ, ইউ টেক দিস, মাই হার্টলি উইশেস!

বলেই বইটি কুমারচন্দ্রের হাতে দিয়ে দিয়ে লোকটি হাতজোড় করে নমস্কার করল।এবং চলে গেল।

কুমারচন্দ্র স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন এবং তাঁর চোখে বইয়ের খোলা পাতায় চলে গেল,পড়তে লাগলেন

"মুক্তি?  ওরে মুক্তি কোথায় পাবি,
মুক্তি কোথায় আছে।
আপনি প্রভু সৃষ্টিবাঁধন পরে
বাঁধা সবার কাছে।
রাখো রে ধ্যান থাক্ রে ফুলের ডালি
ছিঁড়ুক বস্ত্র, লাগুল ধুলাবালি
কর্মযোগে তাঁর সাথে একটা হয়ে
ঘর্ম পড়ুক ঝরে।"

ক্রমশ...

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments