জ্বলদর্চি

ভারতবর্ষ ও ধর্ম/ সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম 
পর্ব-৫২


ভারতবর্ষ ও ধর্ম

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ব্যক্তির চরিত্র ও ধর্ম বিচার করে ঋকবেদের 'পুরুষসুক্ত প্রেক্ষাপটে রেখে এবং মনুস্মৃতিকে অবলম্বন করে ব্যাক্তি মানুষকে চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত করার পিছনে যে উদ্দেশ্য ছিল, তার সামাজিক দিকটি উপেক্ষা করা যায় না। জাতিগত ও শ্রেণীগত বৈষম্যকে বড়ো করে না দেখে বৃত্তিগত দিক দিয়েই এই শ্রেণী বিভাজন বিচার করলে দেখা যাবে, ব্যক্তিবৈষম্যের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়েই সমাজজীবনের সুস্থিতি রক্ষার প্রয়োজনে এই বিভাজন অত্যন্ত কার্যকরী হয়েছিল।

  অপরদিকে এক শ্রেণি থেকে অন্য শ্রেণিতে উন্নীত হবার ক্ষেত্রে কোথাও প্রতিবন্ধকতা না থাকার ফলে মানুষের আত্মিক বিকাশ কোনোভাবেই বাধাপ্রাপ্ত হয়নি, যদিও কিছু কিছু ব্যতিক্রম এই বহুস্তরীয় ব্যঞ্জনাময় শুভ ভাবনার স্ফূর্তিতে কালিমা লেপন করেছিল। সেই ব্যক্তিক্রমই, যার প্রভাব অবশ্য এখনও বর্তমান। ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শুদ্র বিভাজন মানুষের অন্তর্গত ঐশ্বর্যকে কখনই সংকুচিত করেনি। সব মানুষ একই রকম বা সমান শারীরিক মানসিক শক্তি ও দক্ষতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না, তাই তার নিজস্বতার সার্বিক জাগরণে বৃত্তিগত শৃংখলার সুষম বিকাশের ভিতর দিয়ে মানুষকে ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ- এই চারটি জৈবিক জীবন পরিচালনার স্তরগুলিতেও কোথাও মানুষের অগ্রগমন প্রতিহত হয়নি। পরবর্তীকালে এই সুসংহত সমাজজীবন পরিকল্পনায় অহংকেন্দ্রিক ব্যভিচারের অনুপ্রবেশ ঘটতে দেখা যায় এবং ভারতীয় মানুষের উজ্জীবনে বাধা সৃষ্টি হয়। এর পিছনে ক্ষুদ্র রাজনৈতিক অভিপ্রায় ও দুরভিসন্ধিগুলির ভূমিকা কম নয়। এর ফলে জাতিদাঙ্গা, ধর্মবিরোধ ও ভেদবুদ্ধির উদয় হয়। 

  জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানব জীবন সুশৃংখলভাবে আত্মশক্তি বিকাশের লক্ষ্যে এগিয়েছে এবং প্রতিটি মানুষ যে বিশ্বজীবনের অংশ তা উপলব্ধি করতে শিখিয়েছে। অহিংসা অস্তেয় ব্রহ্মচর্য অপরিগ্রহ ধর্ম পালনের মধ্য দিয়ে এবং নিয়ম শৌচ সন্তোষ ও তপস্যা এবং অধ্যয়ন সহযোগে মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনকে পরিশীলিত করেছে। ভারতীয় জীবনের নৈতিক চারিত্রিক সামাজিক বৈশিষ্ট্যগুলির প্রতি আকৃষ্ট হয় দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ ম্যাক্সমুলার উক্তিটি করেছিলেন তা প্রণিধানযোগ্য:

 "If one would ask me under what sky the human mind has most fully developed its precious gifts, has scrutinized most profoundly the greatest problems of life, and has,at least for some, provided solutions which deserves to be admired even by those who have studied Plato and Kant, I would indicate India. 
And if one would ask me which literature would give us back (us Europeans,who have been excessively fed on Greek and Roman thought,and on that of a semetic race) the necessary equilibrium in order to make our inner life more perfect,more comprehensive more universal,in short,more human, a life not only for this life, but for a transformed and eternal life,once again I would indicate India."

  পন্ডিত ম্যাক্সমুলারের ভারতবর্ষ সম্পর্কে এই উপলব্ধির সারবত্তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। ভারতবর্ষকে এই আত্মিক বিকাশের স্তরে পৌঁছতে সহস্র সহস্র শতাব্দের মানবসভ্যতার শ্রেষ্ঠতম আত্মিক সম্পদগুলিকে আত্মসাৎ করতে হয়েছে। সিন্ধুসভ্যতার যুগ থেকে উনবিংশ শতাব্দ পর্যন্ত, প্রাক-আর্যযুগ (খ্রিঃ পূঃ ৩০০০-২০০০),বৈদিক যুগ (খ্রিঃ পূঃ ২০০০-৬০০) ও উপনিষদের যুগ (খ্রিঃ পূঃ ৬০০- খ্রিঃ ৩০০) পর্যন্ত কালসীমায় মানুষের সামাজিক ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক  ক্ষেত্রে যে বিবর্তন ঘটেছে তার মধ্যে প্রবর্তিত হয়েছে নানা ধর্ম। খ্রিঃ পূঃ ৪০০-২০০ শতাব্দের ধর্মীয় ও দার্শনিক মতবাদগুলির সূত্র ধরেই আবির্ভূত হয়েছে বৈশেষিক সাংখ্যযোগ- পূর্ব মীমাংসা ও বেদান্ত, শৈবধর্ম ভাগবত ও শ্রীকৃষ্ণ আশ্রিত ভক্তিবাদ; রামায়ণ ও মহাভারত- এই দুই মহাকাব্যকে আশ্রয় করে সাধারণ মানুষের মধ্যে নতুন করে ঘটেছে ধর্মবোধের জাগরণ।

  এই সময়েই জৈন ও বৌদ্ধধর্মের অন্যান্য ধর্মস্রোতের মধ্যে টিকে থাকা সম্ভব হয়েছে; খ্রিঃ পূঃ ৪০০-২০০ মধ্যেই ধর্মীয় মতবাদগুলি ভারতবর্ষের জাতীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনকে পরিপ্লাবিত করেছে। 

  খ্রিস্টপূর্ব ৪০০-২০০ শতাব্দের মধ্যে শ্রীমদ্ভগবদগীতার রচনাকাল, যা হিন্দুধর্মের বুনিয়াদকে দৃঢ় করেছে। রামায়ণ ও মহাভারত সমসাময়িক কালেই রচিত। মহাভারতের রচনাকাল কোনো একটি বিশেষ শতাব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ শতাব্দ থেকে খ্রিঃ ৪০০ শতাব্দের মধ্যে মহাভারত বহু সংযোজনের মধ্য দিয়ে কলেরব বৃদ্ধি করেছে। গ্রিক পার্থিয়ান শকদের উল্লেখ রামায়ণ গ্রন্থে থাকায় এই মহাকাব্যের রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব ২০০ শতাব্দের আগে নয়।
 
 রামায়ণ মহাভারতের মতোই আদিতে গীতিকাব্য ছিল এবং রাম একজন জনজাতিভুক্ত সম্প্রদায়ের মানুষ ও নায়ক। চরিত্রগুণে এই দুই মহাকাব্যের মধ্যে প্রভুত মিল লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তীকালে রাম বুদ্ধ অবতার এবং বিষ্ণু অবতার রূপে পরিগণিত হন।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments