জ্বলদর্চি

ভানুমন্দির ও ভবিতব্য দেবতা /অলক জানা

ভানুমন্দির ও ভবিতব্য দেবতা 

অলক জানা 

খুব ছোটোবেলা, বলতে 'অচল', 'অপর', 'মুখ্য', 'মাণিক্য'-এর পাঠ শেষ করে "সহজপাঠ" বইটি হাতে পাওয়ার অনুভূতি স্পষ্ট না হলেও বেশ কিছুটা এখনো মনে আছে। বইয়ের ওপরে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামটির প্রতি কেমন একটা অনির্বচনীয় আবেগ জড়িয়ে পড়লো। বিশেষত "ঠাকুর" শব্দটি অর্থে ভগবান ভগবান ঘোর। তখন সাহস করে কাওকে জিগ্যেস করিনি, আসলে এটি রবীন্দ্রনাথের পদবী। তখন রবীন্দ্রনাথ মানেই ঠাকুর দেবতা মনে করতাম। নন্দলাল বসুর সাদাকালো রেখাচিত্র, এবং  "জল পড়ে পাতা নাড়ে" কিংবা "কাল ছিল ডাল খালি" র সরলতম আচড় তখন তার গুরুত্ব গভীরতা না বুঝলেও এখন বোধে বুদ্ধিতে বোঝার চেষ্টা করি। 

    তারপর কত সময় কতভাবে খরচ হয়ে গেছে। সরল-সিধা পরিস্থিতিগুলো ক্রমশ জটিল কুহকের সৃষ্টি করে দিনযাপনের সুস্থ প্রহরকে করেছে বিপন্ন বিষাদ। সামলে নিতে শিখে গেছি। কোন কিছু নিয়ে এখন আর তেমন বিব্রত হই না। হওয়ার ছিল তাই হয়েছে --এটাই সান্ত্বনা।

  ব্যাকরণ ভাঙ্গা মেঘবৃষ্টির প্রহরে এখন স্পর্শ করি রবীন্দ্রনাথ। শোকে তাপে প্রেমে বিচ্ছেদে একটাই নির্ভরযোগ্য দৈব আশ্রয় আমার রবীন্দ্রনাথ। তাকে বলেছি। তাকে মানে, আমার ভেতরের সেই বোহেমিয়ান কঙ্কালকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আমাদের তেত্রিশকোটি দেবতার মধ্যে আর এক জীবন্ত দেবতা। নিজস্ব মন্ত্রও রয়েছে গীতবিতানের শ্লোক, তাঁকে নির্দিষ্ট করে পূজা করার জন্য। কেবল মন্দির নেই। 

  আচ্ছা এরকমটা তো ভাবাই যেতে পারে?  অদূর ভবিষ্যতে সারা পৃথিবীতে শিব শীতলা কালী মনসা গীর্জা মসজিদ মন্দিরের মতো রবীন্দ্রমন্দির বা ভানুমন্দির গড়ে উঠেছে। তাঁর রচিত সৃষ্টির স্বচ্ছ ধারায় অবগাহন করে লাখো লাখো রবীন্দ্র অনুরাগী ভক্তবৃন্দ পেরিয়ে যাচ্ছেন ফ্যাসিবাদী পুঁজিবাদী রঙ নিশানার রক্তচক্ষু। সেই দিন আসবে, আসতে বাধ্য। আসাই সমীচীন। সেই সত্য বহন করে এখনো সমানে ছায়ারৌদ্রে বেজে যাচ্ছে গীতবিতানের মুগ্ধ সুর ! 

  রবীন্দ্রনাথ আমার মননে মজ্জায় সতত উজ্জ্বল। বাংলা শব্দভাণ্ডারে এমন কোন বিশেষণ নেই যা রবীন্দ্রনাথের নামের পূর্বে বসিয়ে তাঁর প্রতিভার গভীরতা ও ব্যাপকতা খানিক মাপা যায়। একটি বিস্ময়ের নাম রবীন্দ্রনাথ। বলাবাহুল্য, অমৃত বলে যদি কিছু থেকে থাকে রবীন্দ্র জীবনাদর্শ ও রবীন্দ্রসংগীত আস্বাদন তারো অধিক। কারণ রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি চিন্তন এবং যুগান্তকারী দূরদর্শীতাকে পাথেও, আশ্রয়-হাতিয়ার করে এই মুহূর্তে পৃথিবীর প্রায় এক কোটি মানুষ প্রতিদিন রুটি রুজির জোগাড় করেন। সেই সারণীতে রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী, গবেষক, নৃত্যশিল্পী, প্রকাশক সহ পর্যটন শিল্পে প্রসিদ্ধ তীর্থক্ষেত্র জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি ও শান্তিনিকেতনকে জড়িয়ে যারা সূর্যোদয় সূর্যাস্তের সাক্ষী। তেমন যোগাযোগ যাতায়াত নানান বিকিকিনি বিপণনের সঙ্গে যারা জড়িয়ে আছেন। এদের মধ্যে প্রায় সবাই একবাক্যেই স্বীকার করেন, রবীন্দ্রনাথের জীবনভর কর্মকাণ্ডের জন্য তাদের অস্তিত্ব এখনো অটুট ও বর্ণাঢ্য। 


  সুতরাং রবীন্দ্রমন্দির বা ভানুমন্দির গড়ে তোলার চেষ্টা বা দায় কেবল রবীন্দ্র অনুরাগীদের নিলে হবে না। সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী মানুষ সরকার ও সংস্কৃতি প্রেমীরা যদি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে আসেন তবে সেই চেষ্টা ও পরিকল্পনা অবশ্যই আকার পাবে। সেই অমৃতত্বের আস্বাদ আমি হয়তো নিয়ে যেতে পারবো না আমাদের উত্তরসূরী শ্রীকৃষ্ণ জয়ন্তী জন্মাষ্টমীর মতোই পঁচিশে বৈশাখকেও শ্রদ্ধা ও ভক্তিরসে উপভোগ করতে পারবেন।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments