জ্বলদর্চি

রবীন্দ্রনাথের নন্দলাল /অর্ণব মিত্র


রবীন্দ্রনাথের নন্দলাল 
অর্ণব মিত্র 


বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর সাথে চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসু-র প্রথম আলাপ হয় ১৯০৯ সালে,জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। আলাপ হয়েছিল চিত্রকলা-চর্চায় তার গুরু ঠাকুরবাড়ির বিখ্যাত শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মাধ্যমে। এরপর নন্দলাল বসু প্রায়ই আসতেন জোড়াসাঁকোয়। তখন ঠাকুরবাড়ির দক্ষিণের বারান্দা ছিল অবনীন্দ্রনাথ সহ ঠাকুর পরিবারের ও অন্নান্য  শিল্পীদের স্টুডিয়ো বা ছবি আঁকার জায়গা। এখানে নন্দলাল বসু নতুন ‘বেঙ্গল স্কুল’ ধারার সাথে পরিচিত হন। 

  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৯ সালে শান্তিনিকেতন-এ  ছবিআঁকা  শিক্ষার  কেন্দ্র ‘কলাভবন’ শুরু করেন। তিনি চেয়েছিলেন কলকাতা বা শহর থেকে দূরে ও প্রকৃতি-র মধ্যে একটি ছাদের তলায় শিল্পচর্চা-র একটি কেন্দ্র গড়ে উঠুক তার প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী-তে।  কএকবছর  তার পরিবারেরই সদস্য ও শিল্পী অসিত হালদার এই কেন্দ্রে ছবি আঁকা শেখালেও শেষমেশে রবীন্দ্রনাথ  ‘কলাভবন’–এর প্রথম অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেন  নন্দলাল বসু-কেই । এরপর ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর মৃত্যুর পর আরও এক দশকের  বেশি সময় নন্দলাল বসু  ‘কলাভবন’-এ শিল্পশিক্ষকের পদে থেকেছিলেন  ও আলাপের পর তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে  বিশ্বকবির সাথে তার এই সম্পর্ক ক্রমস্য গভীরতর হয়েছিল।  


১    
নন্দলাল বসু জন্মেছিলেন ১৮৮২ সালে বিহারের মুঙ্গেরে। ছোট বেলা থেকেই গ্রামে কুমোরদের মাটিরকাজ ও পুতুলগড়া- দেখে শিল্পের প্রতি তার কৌতূহল তৈরি হয়। ১৮৯৮ সালে কিশোরে বয়সে তিনি কলকাতায় চলে আসেন ও এরপর ১৯০৫ সালে ‘কলকাতা আর্ট স্কুল’-এ ছবিআঁকা শেখার জন্য ভর্তি হন। এখানে এসে তিনি প্রথমে শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এঁর সাথে  ও পরে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ঠাকুরবাড়ির অন্য শিল্পীদের  শিল্পচর্চার সমন্ধে জানতে পারেন । জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সাথে তার সম্পর্কও বাড়তে থাকে। 

  ঠাকুরবাড়ির দক্ষিণের বারান্দায় তার অবনিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সূত্রে ভাগিনী নিবেদিতা-র সাথেও পরিচয় হয়। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে তার নিয়মিত যাতায়াত শুরু হয়। এই সময়  ১৯০৯ সালে একটি কাজের জন্য ডাক এল রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকেই । কবির কাব্যগ্রন্থ ‘চয়নিকা’ –র জন্য ছবি  এঁকে দিলেন নন্দলাল । এই কাজটির মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের সাথে যে সংযোগ তৈরি হল তা তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিল । 

 সেই বছরই ভারতে আসেন লেডি হেরিংহাম । অজন্তা গুহাচিত্রের প্রতিলিপি বানানোর জন্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভাগিনী নিবেদিতা তথা প্রাচ্য-শিল্পবিদদের পরামর্শে তিনি ও আরও কয়েকজন শিল্পী ‘অজন্তা গুহাচিত্রের ’প্রতিলিপি বানানোর জন্য মহারাস্ত্রের অউরঙ্গাবাদে  যান।  সেখান থেকে তিনি ফিরে আসেন ১৯১১ সালে । এরপর   ১৯১৪ সালে রবীন্দ্রনাথ  তাকে আহ্বান করলেন শান্তিনিকেতনে। এই তরুণ শিল্পীকে সম্মান জানাতে বিশ্বকবি লিখলেন কবিতা –‘তোমার তুলিকা রঞ্জিত করে / ভারত ভারতী চিত্ত’ ।

এরপর ১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথ চিত্রকলা চর্চার জন্য জোড়াসাঁকোয় ‘বিচিত্রা’ স্টুডিও তৈরি করেন। ‘বিচিত্রা’ স্টুডিওতে নন্দলাল বসুর নিয়মিত যাতায়াত ছিল। এরপর  ১৯১৬ সালে কবির আহ্বানে তিনি শিলাইদহে যান। এখানে  গ্রামবাংলার পরিবেশে নন্দলাল বসু অনেক স্কেচ করেন। 

  এরপর ১৯১৯ সালে ‘কলাভবন’ শুরু হয় ও পরের বছর থেকে অর্থাৎ ১৯২০ থেকে নন্দলাল বসু  পাকাপাকি ভাবে কলাভবনের সাথে যুক্ত হন। এই সময় থেকে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- এর কথামত শান্তিনিকেতনে  তার প্রতিষ্ঠিত ‘কলাভবন’-এর অধ্যক্ষের  দায়িত্ব নেন। তবে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতায় তার প্রতিষ্ঠিত ‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্ট’-এর কাজের জন্য নন্দলাল বসুকে কলকাতায় ডেকে পাঠান। কিন্তু ইট-কঙ্ক্রিটের কলকাতা শহর নয়,নন্দলাল বসু শান্তিনিকেতনের খোলা পরিবেশ ও প্রকৃতি-র মধ্যে অনেক সাবলীল ভাবে  শিল্পচর্চা ও শেখানোর উৎসাহ পান ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর সান্নিধ্যে কলাভবনেই থেকেযান। 

  এরপর ১৯২৪ সালে বিশ্বকবির সাথে নন্দলাল বসু চিন ও জাপান ভ্রমণ করেন। কবির মাধ্যমে সেই সময়ের চিন ও জাপানের বিভিন্ন শিল্পমাধ্যম ও ধারার সাথে সরাসরি তার পরিচয় হয় । 

 শিল্প সমালোচক অশোক মিত্র তার ‘ভারতের চিত্রকলা’ বইতে লিখছেন নন্দলাল প্রথম যখন শান্তিনিকেতন গেলেন তখন ধ্রুপদী ছাদের গড়নে শিল্পসূত্রের নির্দেশ অনুযায়ী ছবি আঁকার পদ্ধতির তুলনায়  রবীন্দ্রনাথ নন্দলালকে চারিদিকের দৃশ্যমান জগত থেকে বিষয় নিয়ে ছবি আঁকতে উৎসাহ দেন।                                                                       
  এই বিষয়ে ও রাবিন্দ্রীক পরিবেশে নন্দলাল বসুর শিল্পীমনের বিকাশ সম্মন্ধে এই সময়ের বিখ্যাত শিল্পী রামানন্দ বন্ধ্যোপাধ্যায়-সহ আরও শিল্পীদের মত এই যে গুরুদেব ও শান্তিনিকেতনের এই পরিবেশ না-পেলে তার প্রতিভা হয়ত এভাবে বিকশিত হতনা । 

কলাভবন-এ ১৯২২ সালে আসেন ভিয়েনার শিল্পইতিহাসবিদ স্টেলা ক্রামরিশ।  তিনি সেই সময়ের পশ্চিমের বিভিন্ন শিল্পকলার ধারা ও  তার প্রভাব  সম্পর্কে বক্তৃতা দেন ।রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে সেই সময় নন্দলাল বসু যোগ দিয়েছিলেন স্টেলা ক্রামরিশ-এর সেই বক্ত্রিতাগুলিতে।

  এছাড়া রবীন্দ্রনাথে ১৯২৬ সালে জয়পুরের শিল্পী নরসিংহ লাল-কেও দুবার আমন্ত্রণ জানান কলাভবনের মুরাল বা ভিত্তিচিত্র বানানোর জন্য ও শিক্ষকরুপে এই পদ্ধতি শিখাবার জন্য। শান্তিনিকেতনের ‘পাঠভবনে’র দোতালায় ও নিচতলার দেওয়ালে নরসিংহ লাল ও নন্দলাল বসু এই ভিত্তিচিত্রগুলি বানিয়েছিলেন।এই ছবিগুলিতে নন্দলাল বসু রবীন্দ্রনাথ রচিত নৃত্যনাট্য ‘নটীর পূজা’-র দৃশ্যায়ন করেন ও স্থানে স্থানে বিশ্বকবির কবিতার কেলিগ্রাফিক ব্যবহারও দেখা যায়।  এরপর ১৯২৮ সালে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের বসবাসের জন্য নতুন নির্মিত  ‘নন্দন’ বাড়ির দেওয়ালে মুরাল  এঁকেছিলেন । 

  ১৯৩১ সালে রবীন্দ্রনাথ  শিশুশিক্ষার জন্য লেখেন ‘সহজপাঠ’ বইটি । শিশুদের অক্ষর পরিচয়ের জন্য লেখা (দুই খন্ডে) এই ছড়াগুলির  অলঙ্করণের দায়িত্ব দেন তিনি নন্দলাল বসু-কেই।  লিনোকাট মাধ্যমে সাদা-কালোয়  এই ছড়াগুলির  দৃশ্যময় রুপ আজও জনপ্রিয়।             

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নন্দলাল বসু –কে নিয়ে লেখা একটি প্রবন্ধে তার সমন্ধে লেখেন ‘নন্দলালকে সঙ্গে করে নিয়ে একদিন চিনে জাপানে ভ্রমন (১৯২৪)করতে গিয়েছিলুম।আমার সঙ্গে ছিলেন আমার ইংরাজ বন্ধু এলমহরস্ট ।তিনি বলেছিলেন নন্দলালের সঙ্গ একটা এডুকেশন। তার সেই কথাটি একেবারেই যথার্থ। নন্দলালের শিল্পদৃষ্টি অত্যন্ত খাঁটি,তার বিচারশক্তি অন্তরদর্শী’। 

  এই প্রবন্ধের আরেকটি জায়গায় তিনি লিখছেন ‘যারা ছাত্ররুপে তার কাছে আসবার সুযোগ পেয়েছে তাদের আমি ভাগ্যবান বলে মনেকরি – তার এমন কোন ছাত্র নেই এ কথা যে না অনুভব করেছে ও স্বীকার না করে। এ সমন্ধে তিনি তার নিজের গুরু অবনীন্দ্রনাথের প্রেরণা আপন স্বভাব থেকেই পেয়েছেন সহজে।’ 

এছাড়া তিনি লেখেন যে ‘শিল্পী ও মানুষকে একত্র জড়িত করে আমি নন্দলালকে নিকটে দেখেছি। বুদ্ধি হৃদয় নৈপুণ্যে অভিজ্ঞতা ও অন্তর্দৃষ্টির  এরকম সমাবেশ অল্পই দেখা যায়।তার ছাত্র যারা তার কাছে শিক্ষা পাচ্ছে তারা একথা অনুভব করে এবং তার বন্ধু যারা তাকে প্রত্যহ সংসারের ছোট বড় নানা ব্যাপারে দেখতে পায় তারা তার ঔদার্যে ও চিত্তের গভীরতায় তার প্রতি আকৃষ্ট।’

 শিল্পের পৃষ্টপোষক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর মূল্যায়ন করতে গিয়ে নন্দলাল বসু লেখেন ‘আমরা যতদূর জানি তাতে ভারতের শিক্ষাক্ষেত্রে কলাচর্চাকে উপযুক্ত স্থান দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ’। 
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর কলাভবনে নন্দলাল বসুর শেষ ব্যচ ছিল ১৯৫২ সালে। এরপরেও তিনি শান্তিনিকেতন ছেড়ে যাননি । সেখানেই তার মৃত্যু হয় ১৯৬৬ সালে।

তথ্যসুত্র- 
অশোক মিত্র ‘ভারতের চিত্রকলা’, 
শিলাদিত্য পত্রিকা ‘নন্দলাল বসু’ সংখ্যা, 
রামানন্দ বন্ধ্যোপাধ্যায়- প্রবন্ধ ‘নন্দলাল বসু’ (আনন্দবাজার পত্রিকা)
‘নন্দলাল বসু - বিচিত্রা থেকে কলাভবন’ মৃণাল ঘোষ / কৃত্তিবাস শারদীয়া ১৪২৮

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇



Post a Comment

0 Comments