জ্বলদর্চি

চাঁপাচন্দন/ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -২২

চাঁপাচন্দন

ভাস্করব্রত পতি

"আমি যদি দুষ্টুমি করে / চাঁপার গাছে চাঁপা হয়ে ফুটি, / ভোরের বেলা মা গো, ডালের ‘পরে / কচি পাতায় করি লুটোপুটি, / তবে তুমি আমার কাছে হারো, / তখন কি মা চিনতে আমায় পারো। / তুমি ডাক, ‘খোকা কোথায় ওরে।' / আমি শুধু হাসি চুপটি করে।" -- লুকোচুরি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

কখনও কখনও দুষ্টুমির এই চাঁপা ফুল হয়ে ওঠে এক হারিয়ে যাওয়া লৌকিক উৎসবের অন্যতম উপকরণ। এই উৎসবকে কোথাও বলা হয় 'চাঁপাচন্দন', কোথাও বা 'জৈষ্ঠ্যচম্পক'। আবার 'চম্পক চতুর্দশী' নামেও পরিচিত। মূলতঃ জৈষ্ঠ্য মাস জুড়ে এই লৌকিক উৎসবটি কুমারী মেয়েরা পালন করে স্বামী সংসারের শ্রীবৃদ্ধি, সুস্বাস্থ্য, আয়ু বৃদ্ধি এবং ধনসম্পদ বৃদ্ধির কামনায়। শ্রীমতী নিরুপমা দেবী ভারতী পত্রিকায় ( বৈশাখ,১৩১৯ ) তাঁর "পল্লীবালিকাদের উৎসব" প্রবন্ধে 'চাঁপাচন্দন' সম্পর্কে লিখেছিলেন, "চন্দনে হরির চরণ অঙ্কিত করিয়া ততোধিক শুভ্র মল্লিকা ও সূবর্ণ বর্ণ চম্পক দ্বারা বিবাহিত বালিকারা হরিহরের পূজা করে"। এখানে অবশ্য তিনি এই উৎসবটিকে বৈশাখে উদযাপিত হয় বলে জানিয়েছেন।

চাঁপাচন্দনে হরিহরের আরাধনায় মহিলাদের মুখে শোনা যায় -- "চাঁপা চন্দনে পূজলে হরি / শোক দুঃখ না পায় নারী / জন্মিয়ে না দেখি যেন বন্ধুর মরণ / জন্মিয়ে না দেখি যেন গুরুর মরণ / জন্মিয়ে না দেখি যেন স্বামীর মরণ / স্বতন্ত্র শয্যা নিঃসতা ঘর / শঙ্খ সিন্দুর অক্ষয় অমর / বৈশাখে চাঁপা গঙ্গার জল / এই পেলে তুষ্ট হন মহেশ্বর" (সূত্র - ড. শীলা বসাক, শ্রীমতী নিরুপমা দেবী)। এখানে 'নিঃসতা ঘর' অর্থে যে সংসার সপত্নীহীন।

বৈশাখ মাস থেকেই চাঁপা চন্দনের জন্য সংগ্রহ করে রাখতে হয় ৬৪ টি কনকচাঁপা ফুল। এবার সেই ফুলগুলিতে চন্দন মাখিয়ে শুকনো করতে হয়। এই চন্দন মাখানো শুকনো চাঁপা ফুলই জৈষ্ঠ্য মাস জুড়ে পরিচালিত লৌকিক উৎসব চাঁপাচন্দনে কাজে লাগে। শুধু কনকচাঁপা ফুল নয়, বৈশাখ মাস থেকেই সংগ্রহ করে রাখতে হয় নদীর পলিমাটি।

এবার এই পলিমাটি দিয়ে জৈষ্ঠ্য মাসের প্রথম দিন থেকে সারা মাস জুড়ে প্রতিদিন সকালে বানানো হয় শিবলিঙ্গ। একটি সুদৃশ্য রেকাবের উপর সেটিকে বসিয়ে  কাঁচা দুধ ঢালা হয়। এরপর ঘি এবং মধু মাখানো হয়। আর আগে থেকে সংগৃহীত চাঁপাফুল ও চন্দন দিয়ে পূজো করা হয়। আর শিবপূজার সময় কুমারীদের মুখে শোনা যায় -- "চাঁপা চন্দন দিয়ে চাঁপা ব্রত করি / সুখ বিনে দুঃখ না পায় নারী / পায়ে নূপুর পরি ভালো / সোয়ামী সুখে জগৎ করি আলো / নিঃসন্তানের সন্তান চাই / নিঃভায়াদির ঘর / শঙ্খ যেন হয় অজয় অমর / এই বর মাগি আমি শিবের চরণতলে / মরণ হয় যেন স্বামীর কোলে"।

হিন্দু শাস্ত্রমতে চাঁপা ফুল হল দীর্ঘজীবন, পবিত্রতা এবং উর্বরতার প্রতিক। আর তাই স্বামী, পুত্র, পরিজনের দীর্ঘ জীবনের কামনায় মহিলাদের পূজার উপকরণে স্থান পেয়েছে চাঁপা। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছেও জনপ্রিয়তা পেয়েছে এই চাঁপা। জৈনদের কাছেও চাঁপা ফুল পবিত্র ফুল। জৈনদের ২০ তম তীর্থঙ্কর মুনিসুব্রতর কাছে এটি CHAITYA VRUKSA। তেমনি স্বর্গের পারিজাত ফুল আসলে নীল চাঁপা। 

সাধারণত দক্ষিণ ভারতে এই চাঁপা ফুল শিবের পূজায় ব্যবহৃত হয়না। তবে বিষ্ণুপূজা সহ গনেশ পূজা, অনন্তপদ্মনাভ ব্রত পূজা, শ্রী ভেঙ্কটেশ পূজা, স্বর্ণ গৌরী ব্রত পুষ্প পূজা, শ্রী শনিপ্রদোষা ব্রত পূজা, মার্গ শীর্ষ মহালক্ষ্মী ব্রত পূজা, বৈকুণ্ঠ চতুর্দশী ব্রত পূজা, শ্রীকৃষ্ণ পূজা, নিত্যসোমাভরা ব্রত পূজা, শ্রী সূর্যনারায়ণ পূজাতে চাঁপা ফুল ব্যবহৃত হয়। ড. পি. এন. রবীন্দ্রন চাঁপার ধর্মীয় দিক নিয়ে জানিয়েছেন, "Champa or Champak flower is widely used in temples for worship। Champa trees are planted often in temple premises, and it is known to be a favourite of Krishna। Siva likes the offering of Champa, but seldom used in his worship .... Champa flower is one of the five floral arrows of the love god, Kamdeva। Champaka flower is the favorite of goddess Lalithambika, and she adorns her hair with Champaka, Ashoka and Punnaga flowers।" দক্ষিণ ভারতে না হলেও পশ্চিম বাংলার মহিলারা এই স্বর্গীয় ফুল দিয়েই শিবের আরাধনা করে চাঁপাচন্দন ব্রতে।

'অ্যানােনেসী' পরিবারভুক্ত MICHELIA CHAMPAKA বা চাঁপাগাছ বহু রকমের হয়। তবে অনেকেই এর পরিচয় কমই জানি। ১) কাঁঠালিচাঁপা -- Artabotrys odoratissismus। হলুদ রঙের ফুলে পাকা কাঁঠালের গন্ধ মেলে। ২) জহুরিচাঁপা -- ছোট আকারের গাছ। ফুলের খুব মিষ্টি গন্ধ। ৩) ভুঁইচাঁপা -- Koemperia rotunda। সংস্কৃতে একে বলে ভূমিচম্পক এবং হিন্দিতে বলে মুখজালি। গরমকালে জলাভূমিতে ঘাসের মাঝে জন্মায়। ৪) বনচম্পক -- অরন্যজাত গাছ। ৫) গোবরিয়াচাঁপা। ৬) দুলালচাঁপা -- Hedychium coconarium। সাদা রঙের ফুল হয়। ৭) কনকচাঁপা -- Pterospernum acerifolium। বড় বড় পাতা। গাছগুলো বড় আকারের হয়। ফুলগুলিও বড় বড় এবং গন্ধযুক্ত। সংস্কৃতে একে বলে দ্রুমোৎফল, পরিব্যাধ এবং কর্ণিকার। ৮) দুলিচাঁপা -- Magnolia pterocarpa। বাংলাদেশের চট্টগ্রামে জন্মায়। চাঁপাকে চেনা যাবে দীপপুষ্প, পীতপুষ্প, হেমপুষ্প, স্বর্ণপুষ্প, ভৃঙ্গমহী, শীতলচ্ছদ, ভ্রমরাতিথি, স্থিরগন্ধ, চাম্পেয়, সুভগ, হেমাহ্ব, বনদীপ, সুকুমার নামেও। চাঁপাকে কথ্য ভাষায় অনেকে চম্পা বা ‘চম্পক' বলে। কবিগুরুর "স্নেহ স্মৃতি"তে রয়েছে "সেই চাঁপা, সেই বেলফুল, / কে তোরা আজি এ প্রাতে / এনে দিলি মোর হাতে / জল আসে আঁখিপাতে, হৃদয় আকুল। / সেই চাঁপা! সেই বেলফুল!"

কবি নিত্যানন্দ চক্রবর্তীর 'মনসামঙ্গল'-এও বহুবার এসেছে চাঁপা গাছের প্রসঙ্গ -- “ভারে ভারে সাজাইয়ে / বেহুলার ছটি ভাইয়ে / কেঁদে চলে বেহুলা লাগিয়া / বিপ্র নিত্যানন্দ বলে /  উত্তরিল চাঁপাতলা / কাঁদে সতী ভায়েরে দেখিয়া।” 

ছবি -- দেবাশীষ জানা

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

3 Comments