জ্বলদর্চি

পদ্মপাতায় শিমুল-২৪/সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

পদ্মপাতায় শিমুল-২৪

সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

মুলন্দ, মহারাষ্ট্র

দুখী মন মেরে শুন মেরা কহনা

হিমান্তর যে সন্দেহবাতিক রোগ আছে সেটা কলকাতায় থাকতেই টের পেয়েছিলাম। চুপচাপ সয়ে গেছি। ভেবেছিলাম মুম্বাইয়ে তো হিমান্তর মেজ ভাই অনন্ত থাকবে না তখন নিশ্চয় আর কোনও ঝামেলা হবে না। ছোট ভাই সুমন্ত ছিল সবার উলটো। চুপচাপ, ঠাকুর বিশ্বাসী। মাঝে মাঝে বলত সুমন্ত আর ওর মা যে, “এ বাড়িতে বিয়ে দিয়ে ঠিক করে নি তোদের বাড়ি থেকে।”

কিন্তু মুলুন্দে গিয়েও নিস্তার পেলাম না। কে যেন বিশ্বাস ভেঙ্গে দিয়েছে।

মাস খানেক যেতে না যেতেই যে আমার জীবনে ঝড় বইতে শুরু করেছে, তা কিন্তু বুঝতে পারি নি।

মাটির নিচে অন্ধকার রাজ্যের অধিবাসী উইপোকার রাজত্ব শুরু হয়ে গেল আমার নতুন জীবনে। মধ্যে মধ্যে আলোর কামনায় তাদের পক্ষোদগম হলে আর রক্ষা নেই। তার পিচকারির মুখে জলের মত গহ্বর পরিত্যাগ করার জন্য বার হয় যখন তখন। পাখার শক্তি থেকে অহঙ্কারই হয় বেশি। হি্মান্তদের বাড়ির অনেকটা সেই অবস্থা।

রক্ষণশীল জমিদার বাড়ির সকলে অকস্মাৎ সব অবরোধ সরিয়ে আলোর নেশায় ঐ পতঙ্গগুলোর মতোই ফরফর করে উড়তে শুরু করল। বুঝতাম কম। হি্মান্তদের বাড়ির অনেকটা সেই অবস্থা।

একদিন অফিস থেকে ট্রেণে আসবার সময় কলকাতার কারুর সাথে আলাপ হয়েছে। তার হাতে মদের বোতল আর মাছের ফিলেট। হি্মান্ত সাংঘাতিক মদ খেত। বাড়িতে কোনদিন কাউকে মদ ছুঁতেও দেখি নি। এই অবস্থায় অজানা একজনকে দেখে তো-আমার চাপা আর্তরব। দৌড়ে কিচেনে চলে গেছি। একটু পরে হিমান্ত আসলে তাকে বলি গলা চেপে যে, “একে কেন এনেছো? সাথে মদের বোতল? আমার একদম ভালো লাগছে না।”

-“আরে খুব বড়লোকের ছেলে ও-এখানে এসেছে রামকৃষ্ণ মিশনে । বলল, “দাদা-একটু ড্রিঙ্ক না খেলে কি চলে?” বলে নিজেই কিনেছে। এত আনসমার্ট হলে কি করে চলবে শিমুল—কাল ছুটি তো আসবে আমাদের নিয়ে যাবে মুম্বাই সিটি-তে। কিছুই তো চিনি না আমরা। তাই না?”

যাই হোক-আমি আর বাইরে যাই নি-কিন্তু পরের দিন এলো ঠিক দশটায়। বড় রেস্টোরান্টে নিয়ে গেল-বিল দেবার আগে... 'টয়লেট থেকে আসছি' বলে টুক করে কেটে পড়ল। যাই হোক, হিমান্ত-ই বিল মিটিয়ে দিল। এরপর ব্লু ফ্লিম দেখতে নিয়ে গেল-চারিদিকে শুধু মদের গন্ধ।

ওখানে পানের দোকানের লোকটা আমায় দেখছিল বারে বারে। হিমান্তকে বলল, “সাব-ইয়ে যায়গা অচ্ছি নেহি-আপলোক বাপাস যাইয়ে।” শুনলো না-- আমার কেমন যেন ভয় করতে শুরু হল। হাফ টাইমে হিমান্ত কে বললাম- “আমার মাথা ঘুরছে, বমি আসছে-বাড়ি যাব”। কি ভাগ্যি আমার কথা শুনলো। বেড়িয়ে আসলাম হল থেকে। সাথের ছেলেটা আমাদের ট্রেণে তুলে দিয়ে বলল, “কাল আসছি দাদা।”

না আর আসে নি-আমার মুখ চোখ দেখে বুঝতে পেরেছিল-এ সাধারণ মেয়ে নয়।

আজ মন চেয়ে দেখি মনে...কোথায় শুরু ... কোথায় শেষের ক্ষণে

একদিন দুপুরবেলা একটু বেশি মত্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরল হি্মান্ত। দরজা খুলে তার মুখে মদের গন্ধ পেয়ে আমি আরো নার্ভাস হয়ে গেছিলাম। একটু মাথা ঘুরে গেছিল। দেওয়াল ধরে নিয়েছিলাম। মুলুন্দ অনেকটা আমেরিকার মতো। দুপুরে মেয়ে/পুরুষ সবাই কাজে যায়। কাজেই সেই অবস্থায় তাকে দেখে আমি কাঁপতে শুরু করেছি।

হঠাৎ আমাকে অসভ্যভাবে বলতে শুরু করে, “ মদ খেলে পিতৃ্ত্বশক্তি কমে যায়, এই যদি দুই বাড়ির সবার সন্দেহ হয়, তাহলে আলাদা কথা।”

আমি তো অবাক-কি বলছে? হঠাৎ এ কথা বলছেই বা কেন? পরে ভাবলাম, ওর বাড়ি থেকে তখন সবাই জানতে চাইছেন কবে আমাদের সন্তান হবে। যেটা স্বাভাবিক। বিয়ের দু বছর হতে চলেছে তখন।

ওর মা-এর রিউমাটয়েড হার্ট ছিল। অনন্ত, মটরসাইকেল কিনবে বলে টাকা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে ন'দার কাছে। হি্মান্ত-এর বাবা হাবেভাবে চেয়েছেন কলকাতার ম্যান্ডেভিলি-তে ফ্ল্যাট কেনার জন্য কিছু টাকা। অথচ বিয়ের সময় কিছুই দাবী করেন নি ওনারা। রাজকীয় ভাবে বিয়ে হয়েছিল, হবেই বা না কেন? বলো? হওয়া তো স্বাভাবিক।

মুলুন্দে থাকাকালিন ওখানেই হিমান্তের আসানসোলের বন্ধুর স্ত্রী শিপ্রা রোজই প্রায় আসত পাশের শহর থানে থেকে মুলুন্দের ফ্ল্যাটে। ওর বর ওকে মান্থলি পাস করে দিয়েছিল। আমি তখন রান্না করতে ভালো পারতাম না-ও রান্না করে দিয়ে যেত-নয়ত বাড়ী থেকে নিয়ে আসত।

একদিন এই অশান্তির সময় সকালে এসে আমাকে দেখে বলে, “বেশ শরীর খারাপ লাগছে তো? কি হয়েছে, শিমুল? আমাকে বলো। আমাদের সাধ্যমত তোমাকে হেল্প করব। তোমার দাদা দেবুদা আছে, যে তোমাকে নিজের বোন ভাবে। চিন্তা কোরো না।”

শিপ্রার গল্প একটু করি...

শিপ্রা দেবুদার সাথে প্রেম করত বলে ওর বাড়ি থেকে ওকে হাইয়ার সেকেন্ডারীর পর আর পড়তে দেয় নি। কারণ দেবুদা ছিল কায়স্থ আর শিপ্রারা ছিল ব্রাহ্মণ। রান্না বান্না , সেলাই এইসব শিখত মায়ের কাছে । আর ওর মা বাবারা ওর জন্য ছেলের সন্ধান করত। কিন্তু নিজের দিদি আর জিজুর সাহায্যে ওদের বিয়ে হয়। ওকে নিয়ে খুব সুন্দর একটা প্রেমের গল্প লেখা যায়—দারুন দেখতে ছিল। আমি ওকে লক্ষ্মী ঠাকুর বলতাম আর ও আমাকে জয়া ভাদুড়ি বলত।

ওর প্রশ্নের জবাবে আমি কিছুই বলতে পারি নি-চোখের তলায় কালি দেখে সে চুপি চুপি জানিয়ে দেয় কলকাতায় দাদাদের। সে জানত হি্মান্তরা ভাল ফ্যামিলি না, কারণ তার ছোট মাসীকে ওদের মামার বাড়ির ফ্যামিলির লোক পাগল সাজিয়ে রেখেছে ।

একদিন আমাদের মুলুন্দের বাড়ি আসলে এ্যলবাম দেখছিল। দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করে... “এ কে হয় হিমন্তদার?” বললাম... ওর কলকাতার মামাদাদুর ছেলে।

তখন বলে, “একদম ভালো ফ্যামিলি নয় গো এরা শিমুল। আমার নিজের দাদুর অবস্থা ভাল ছিল না। কিন্তু মাসী খুব সুন্দর দেখতে বলে ওরা সেধে বিয়ে দিয়ে নিয়ে গেছে। বাপের বাড়ি গরীব, তাই মাসীকে বাপের বাড়ি যেতে দেয় না। শিপ্রা আমাকে জানাল যে, 'আমার দাদু/দিদা আদরের ছোট মেয়েকে অষ্টমঙ্গলায় নিয়ে আসতে গেছিলেন। ওনারা বললেনঃ “আমরা ওকে যেতে দেব না। ওর মাথার গোলমাল আছে।” এমন কি দাদু/দিদাকে দেখতেও দেন নি ছোটমাসিকে। দাদু বলেছিলেন যে, “আমরা মেয়েকে ডাক্তার দেখাবো। আমাদের মেয়ে আমাদের দিয়ে দিন।”

আমাকে যখন নিয়ে গেছিল ওর মামাদাদুর বাড়িতে-আমি দেখেছিলাম-রাতে সিনেমা দেখার সময় ওর পায়ে শেকল দিয়ে মিডিয়া রুমে এনেছিলেন ওনারা। ওনাদের নামে স্কুল, কলেজ, স্ট্রীট আছে-নামগুলো না-ই বা বললাম। সেই ফ্যামিলিতে বিয়ে হয়েছিল শিপ্রার ছোট মাসীর এবং আমার।

তখন আমার ছোদ্দি থাকত পুনায়।

ছোটজামাইবাবু একবার আমাদের মুম্বাই-এর ফ্ল্যাটে এসে ব্যাপারটাকে আঁচ করতে পারলেন। আমাকে নিয়ে যেতে চাইলেন কয়েকদিনের জন্য, কিন্তু রাজি হয়নি হিমান্ত। তারপর পুনায় ফিরে গিয়েই বাড়িতে চিঠি লিখে জানালেন, “শিমুলকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মুলুন্দ থেকে নিয়ে আসতে। নাহলে বলা যায় না শিমুলের কপালে কি লেখা আছে। আমরা না হারিয়ে ফেলি শিমুলকে।”

ছোদ্দির যখন বিয়ে হয় তখন আমি নয় বছরের -তাই জামাইবাবু আমাকে মেয়ে বলতেন।” এর মধ্যে হিমান্তর মেজ ভাই মটরসাইকেল কিনবে বলে বারে বারে ন'দার কাছ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা চাইছে।

আবার একদিন হিমান্ত ভর দুপুরবেলা মদ খেয়ে হাজির হল ফ্ল্যাটে। আমি তো অবাক। এখন কেন এল বাড়িতে আবার? বাড়িতে কাউকে মদ ছুঁতেও দেখিনি। দুই দাদা তখন আমেরিকায়। দরজা খুলেই মুখে মদের গন্ধ পেয়ে আমি খুব ভয় পেয়ে গেছি।

আমাকে কী বলল জানো? “আমি এলাম দেখতে শিপ্রার বর দেবব্রত এসেছে কিনা।”

কান্ড! ঠকঠক করে কাঁপছি তখন। আমার মাথা বনবন করে ঘুরতে আরম্ভ করেছে। যে মেয়ে ছেলেদের সাথে কথা বলতে গেলে গলা কেঁপে যায়। সেই মেয়েকে কি বলছে? যে দেবব্রত এর কথা বলছে তার বউ শিপ্রা তো আমার খুব বন্ধু। আর ওরা থাকে মুম্বাইয়ের থানে শহরে। ট্রেণে করে গেলে প্রায় পঁচিশ তিরিশ মিনিট লাগে। আবার ফ্ল্যাটের তিন তলায় অগ্নিশ-দাকে নিয়েও বলছে, যে আমাকে বোন বলে ডাকে। যার মারাঠি বৌ মিনাক্ষীদি আমাকে নিজের ননদ ভাবে। শুরু হল মানসিক অত্যাচার। পুরুষ-নারী, টিনেজ যে কেউ আমাকে ভাল বললেই সন্দেহ শুরু হত।

একটা মারাঠী দম্পতি ছিল আমাদের ফ্ল্যাটের তিন তলায়। ওনাদের দুই ছোট ছেলে বিট্টু আর আক্কু। হিন্দী ইংলিশ কিছুই বলতে পারতেন না ভাবীজি। ওনাকেও সন্দেহ করত। সরল মনে বলতাম “ওরা তো মেয়ে বলে আমাকে।” কে কার কথা শোনে।

ওর নিজের আর এক মামাদাদুর আঠারো বছরের ছেলে “বৌদি বৌ্দি” করে ভালোবাসত। ওনারা থাকতেন পাওয়াই, মুম্বাই। মামাদাদু ছিলেন পাওয়াই আই.আই.টি-এর প্রিন্সিপাল। সেখানেও সন্দেহ। এইটাই বোধহয় বনেদী বাড়ির ইকোয়েশন। জানি না সহজ সরলভাবে মানুষ হয়ে আজকালকার দিনে এইরকম পরিস্থিতিতে যে কেউ পড়তে পারে।

মামাদাদু বললেন, “এখানে হিন্দি 'দাগ' সিনেমার শুটিং হবে। শিমুলকে রেখে যাও-আমাদের কাছে থাকবে আর দেখতে পাবে তাহলে... কিভাবে শুটিং হয়।”

রাখা তো দূরের কথা, একরকম জোর করেই আমাকে নিয়ে আগেই বেড়িয়ে পড়ল। খুব ঠান্ডা মনের আমি। কিছুই বুঝতাম না তাই হয়ত সব কিছু হেসে উড়িয়ে দিতাম।

প্রায় রোজই অফিস থেকে বাড়ি এসে দরজা খুললেই বলত, “আমি রোজ ভাবি তুমি বোধহয় স্যুইসাইড করেছো। এত তোমাকে বলছি কিন্তু তুমি কেন স্যুইসাইড করছ না, বুঝতে পারছি না? অন্য কোন মেয়ে হলে ঠিক এতদিনে করে ফেলত। তার মানে তোমার অন্য কারুর সাথে নিশ্চয়-ই সম্পর্ক আছে।”

আশ্চর্য কোন চিৎকার নয়, চেঁচামিচি নয়-ঠান্ডা মাথায় সব কথা বলে চলেছে। একটুও মিথ্যে বলছি না।

...আমি তো জানি-বটি বলেছিল কিছু কিছু।

আশ্চর্য কি জানো? আমার কিন্তু একটুও ভয় করে নি। ঠাকুর মা স্বামীজির অশেষ কৃপা পেয়েছিলাম। আর আমার মা বাবা আমাকে আগলিয়ে রেখেছিলেন।

--তখনই আমার চোখে আর মনে এক অনুচ্চারিত জিজ্ঞাসা,...' সুইসাইড?' সুইসাইড কেন করব? আমি তো কোন অন্যায় করি নি। স্যুইসাইড কি ভাবে করে? স্যুইসাইড তো জীবজন্তু ও করে না। করে কী?

যেখানে বাঘের ভয় সেখানে যেমন সন্ধ্যা হয়, তেমন প্রয়োজনের সময় বুদ্ধিও খুলে যায়। আমার মাথাতেও সময়োচিত বুদ্ধি এসেছিল। আগে সবাই বলত প্রয়োজনই হল আবিষ্কারের জননী। কিন্তু কোন জবাব দি নি।

তখন এই 'আমি' ছিলাম না। এই 'আমিকে' তৈরী করেছে এক বর্বর সমাজ। নয়ত যখন অফিসে থাকত-পুলিশে খবর দিতে পারতাম... কত মেয়ে আজ এইভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে।

ভেবেছিল সারাদিন বাড়িতে একা থাকে এইসব চিন্তা করে কিছু একটা অঘটন করে বসবে। আর পেয়ে যাব চল্লিশ হাজার ডলার তার সাথে আরো কিছু ডলার। ব্যানার্জ্জী বাড়ির মান -ইজ্জত রাখার এইটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় অস্ত্র। টাকাই কি জীবনের সব পলাশ? বিয়ে করে একটা জীবন বরবাদ করার কী দরকার ছিল। আমাদের বাড়ি থেকে তো জোর করে নি বরং সে'জ'দা বাধা দিয়েছিল যখন বিয়ের আগে ওদের বাড়িতে থাকার কথা বলেছিল।

যাই হোক, ছিল আমার অসীম জেদ। ছোট হলেই বা। তখন আমি এত কথা বলতাম না। গুনগুন করে গান গাইতাম দেখে বলত, “আমি তোমাকে সন্দেহ করছি আর তুমি গান গাইছ, মাথা খারাপ নাকি তোমার? পা...গ...ল একটা।”

অবাক হয়ে শুনতাম শুধু। তাও আমি কোন জবাব দিতাম না। কোথা থেকে যে এত শক্তি পেতাম জানি না। দিনের পর দিন খেতাম না। কারণ আমি জানতাম, 'জেদ আর সহ্যশক্তি না থাকলে জয়ী হওয়া যায় না। তাই জেদ আর সহ্যশক্তি আজও আমার গর্ব, আমার প্রেরণা। তবে কোনদিন অপমানকে আমি বরদাস্ত করতে পারি না, সে যতই প্রিয় মানুষ হোক না কেন!

হয়ত একদিন আমি হারিয়ে যেতাম নিজের হাতেই সেইদিনগুলো্ট... শিপ্রা যদি না জানাত দাদাদের ম্যান্ডেভিলিতে। ও কায়দা করে আগেই ম্যান্ডেভিলির ঠিকানা নিয়েছিল এই বলে যে, “তোমার ছোদ্দার জন্য মেয়ে খুঁজছে তোমাদের বাড়ি থেকে বললে সেদিন, আমাকে ঠিকানা দাও। আমার বাপের বাড়িতে পাঠাব-তাহলে ওরা তোমাদের বাড়িতে যোগাযোগ করবে। আমার ছোট বোন ও আমার মতন সাদা সিধা। আমরা মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি তো।”

একটু ঢোঁক গিলে, “কান্না পায় কেন জানো? সব মেয়েরাই একটা সুন্দর সংসার এর স্বপ্ন দেখে। আমিও দেখেছিলাম। ওই মুলুন্দে থাকাকালিন কিছু জিনিস না থাকা সত্ত্বেও নিপুণ করে সাজিয়েছিলাম দেখে আমার আমেরিকা থেকে আসা ন'দাদা বটির জন্য মেয়ে দেখতে গিয়ে আমার কথা বলেছিল। সেই দাদার সাথেও সন্দেহ করত-তুমি ভাবতে পারছো? আমি মাথা নীচু করে কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে রইলাম কেন? বাবার বয়সী আমার ন'দাদাকেও সন্দেহ? আমি যদিও এ কথা বাড়ির কাউকে বলতে পারি নি কারণ-আমার অন্তরের বিধি নিষেধ। আমার লজ্জা আর আমার মান-সম্মান।

তাই আজ তোমাকে সব বলে অনেকটা শান্ত হলাম। আমার প্রিয় লেখিকা আশাপূর্ণা দেবী বলেছিলেনঃ “সুখের বদলে সম্মান বিকাইয়া দেওয়া যায় না। সুখ বিদায় হোক, সম্মান থাক জীবনে।” সুখ তো ছিলই না, ছিল অপমান। তখন থেকেই আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি আজও মাঝে মাঝে।

-- ইশ! ছিঃ ছিঃ। মন খারাপ কোরো না শিমুল। বলে ফেলো -দেখবে অনেক হালকা লাগছে। পলাশের ও গলা ধরে গেল। আমার শুনেই তো হাত পা সব কাঁপছে...

আমার কোনদিন অনেক জিনিসের দাবি ছিল না। তুমি সেটা এতদিনে বুঝতে পারছ তাই না? আমরা মেয়েরা সবাই কিন্তু আলাদা - আলাদা হলেও, কোথাও যেন আমরা সবাই এক! সকলেই ভিতু, আদুরে, সেণ্টিমেণ্টাল। দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা এই অনুভূতি গুলোর ভিতর দিয়ে আমরা প্রিয় মানুষটিকে খুঁজে পেতে চাই। প্রিয় মানুষকে পেলেও লজ্জা, সংকোচ, হেরে যাওয়ার ভয় এই বোধগুলি অদৃশ্য দড়ি দিয়ে মনটাকে বেঁধে রাখে। যে সততা, আন্তরিকতার জন্য এত কষ্ট পেতে হয়, তার যে কোন মূল্য নেই, বুঝতে পারতাম না তখন। কারণ তখন বোঝার মত সে বয়স ছিল না।

এইভাবে কষ্ট পেয়ে বাঁচার কোনও মানে নেই। জীবনে রূঢ় হতে চেয়েছি। মানুষকে দূরে রাখতে চেয়েছি- মানুষের সহানুভূতি আর তাদের হিংসার ভয়ে। ক্রমে জীবনে হলাম রুক্ষভাষী, কথায় কথায় রাগ হতে আরম্ভ হল। যদিও সেটা প্রকাশ করতাম না।

তর্ক করা স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেল, কিন্তু আসল আর পরিবর্তন হল না। যদিও তখনও আমাদের বাড়িটা বাড়ি ছিল। সবাই সবার জন্য ভাবত, ভালোবাসা ছিল।

--তুমি কি একটুও বুঝতে পারো নি? তুমি সরল সাদাসিধে ছিলে নয়ত গোড়াতেই ভুল ধরা পড়ে যেতো। আমি বিশ্বাস করি, “চাঁদের অতরূপ বলেই তাতে কলঙ্কের কালো দাগ। পদ্ম অত সাদা বলে তাতে কালো ভ্রমর বসে।” পলাশ এই কথাকটা বলেই গলা ঝেড়ে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

--গোড়াতেই সব ভুল ধরা পড়ে না, পলাশ। সব ভুল যদি সঙ্গে-সঙ্গে ধরা পড়ে যেতো তাহলে মানবজাতির ইতিহাস কীভাবে লেখা হতো? মন তো আর মেঘ নয়! ঠিকানা হীন জীবন তো তার কাম্য নয়! জীবন তো বড্ড ছোট । বড্ড পলকা । ঠিক সাবান জলের বুদবুদের মতো । যতক্ষণ ভেসে থাকে । ফেটে যাওয়ার আগে মিলিয়ে যাওয়ার আগে, আরোও একটিবার নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার নামই তো জীবন । জীবন মানেই তো নদী। নদী চাইলেই কিন্তু মানুষের কাছে যেতে পারে না।

পড়লাম অথৈ জলে। হিমান্ত সন্দেহ শুরু করল, কিন্তু কেন? নানারকম মানসিক অত্যাচার শুরু হল। অদ্ভুত! কোনরকম রাগারাগি, চিৎকার ঝামেলা নয়-শান্ত মাথায় সব কথা বলত । বাড়ির লোকজন অবশ্য সেসব জানতে পারে নি। কাউকে বলতে পারি নি। জানি না কেমন যেন একটা লজ্জা আর অভিমান পেয়ে বসল। রেখেছিলাম ছুরির মতো বিঁধে থাকতে মনে-দিকচিহ্নহীন, শব্দহীন...

(চলবে)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments