জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোক গল্প—চীন (যাদু তুলির আঁচড়)/চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোক গল্প—চীন

যাদু তুলির আঁচড়

চিন্ময় দাশ 

এক গ্রামে এক ছেলে ছিল। তিন কুলে কেউ ছিল না তার। থাকবার মধ্যে ছিল কেবল অভাব। ঘরে ভাত ছিল না ছেলেটার। দু’বেলা মুখে দেবার দু’মুঠো দানা জুটত না সব দিন।

 গাঁয়ের মোড়ল তাকে বাড়িতে নিয়ে গেল গরু চরাবার জন্য। সকালে বেরিয়ে যায় গরুর পাল নিয়ে। ফিরতে ফিরতে সেই বিকেল। তখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে জোরটুকুও থাকত না ছেলেটার।
গরীব হলে কী হবে, ভারি দয়ালু ছেলে সে। কারও কোন কাজে লাগতে হবে? তখন সে এক পায়ে খাড়া। আর ছিল একটা নেশা, ছবি আঁকা। ফুরসৎ পেলেই ছবি আঁকতে লেগে যায়। কোথায় আঁকছে, কী আঁকছে, সে ভাবনা নাই।

 একদিন কাজের শেষে ঘরে ফিরেছে। শুয়ে শুয়ে সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখল ছেলেটা। এক বুড়ো এসে একটা তুলি ধরিয়ে দিল তার হাতে। বলল—যেমন তোমার নেশা, তেমনি তোমার আঁকবার হাতটিও। ভারি ভালো লাগে তোমার ছবি দেখে। এই নাও, তোমার জন্য একটা তুলি এনেছি আমি। এই তুলি দিয়ে যা আঁকবে, তাই সত্যি হয়ে যাবে। তবে একটা পরামর্শ দিয়ে রাখি, ছবি আঁকবে কেবল গরীব মানুষদের জন্য।। নিজের জন্য আঁকবে না কোন দিন। তখন কিন্তু কিছুই ঘটবে না। মনে রেখো, এটা কিন্তু যাদু তুলি।

 সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখল, সত্যি সত্যি বালিশের কাছে একটা তুলি রাখা। পুরো ব্যাপারটা তাহলে স্বপ্ন না কি সত্যি— বুঝে উঠতে পারল না ছেলেটা। তবে, একটা ব্যাপার দেখল, যা আঁকে, সত্যি হয়ে যায় সব। 
সেবার খুব খরা হোল। চাষের জল নাই গরীব চাষীদের। অমনি একটা ভরা নদী এঁকে ফেলল সে। যাদু তুলিতে আঁকা। তাই, যা হবার তাই হোল। সত্যি সত্যিই নদী হোল একটা। জল থই থই করছে সে নদীতে। চাষীরা মহানন্দে সেচ দিতে লেগে গেল জমিতে। সবাই খুশি ছেলেটার উপর।

  কারও হয়ত হাল-বলদ নাই চাষের। খেতে মাটি তৈরি করা দায় হয়ে উঠেছে। সাথে সাথেই তুলি নিয়ে বসে পড়ল ছেলেটা। এক জোড়া বলদ আর জুৎসই দু’খানা লাঙ্গল আর জোয়াল এঁকে ফেলল। আঁকা শেষ হল, আর অমনি দুটো বলদ হাঁটতে লাগল ছবি থেকে বেরিয়ে। লাঙ্গল ঘাড়ে নিয়ে চাষীও চলল পিছন পিছন।
এক জনের ঘরে পানীয় জলের অভাব। বড়সড় একটা কূয়ো এঁকে তার হাতে ধরিয়ে দিল। লোকটা বাড়ি ফিরে দেখল, আস্ত একটা কূয়ো তার উঠোনে। জল টলটল করছে তাতে। সারা বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল।
একদিন পাশের গ্রাম থেকে একটা লোক এসে হাজির। বলল-- বাড়িতে ছিঁচকে চোরের ভারি উৎপাত। আজ এটা নিয়ে যাচ্ছে। কাল ওটা নিয়ে যাচ্ছে। রাতের ঘুম মাথায় উঠেছে বাড়িশুদ্ধ লোকের। কিছু একটা বিহিত করে দেবে? 

  তাকে বাঘের মত মুশকো একটা কুকুর এঁকে দিল ছেলে। কুকুরের দাপটে, সেদিন থেকে চোর-বাটপাড়ের আনাগোনা বন্ধ হয়ে গেল গোটা পাড়ায়। 
এবার হোল কী, যখনই কোন অভাবী মানুষ কোন সঙ্কটে পড়ে, সোজা এসে ছেলেটার কাছে হাজির হয়। সেও বসে পড়ে যাদু তুলি নিয়ে। যুৎসই একটা ছবি এঁকে, হাতে ধরিয়ে দেয়। সব মুশকিল আসান হয়ে যায় তাতে।
বেশ দিন কেটে যাচ্ছিল এভাবে। একদিন হঠাৎই এক ঝামেলা। তিন-চারটে ষণ্ডা-গুণ্ডা লোক এসে একেবারে পাঁজাকোলা করে তাকে তুলে নিয়ে গেল মালিকের ঘরে। কী না, তার নাকি দুধেল গাই পাওয়া যাচ্ছে না। 
একটাই কথা মালিকের—নিশ্চয় তুই লুকিয়ে রেখেছিস। তোরই কীর্তি এটা।

ছেলেটাকে ঘরে আটকে রেখে দিল মালিক। আসল ব্যাপার হোল, ভারি লোভি লোক এই মালিক। আর তেমনি বদমায়েস। একটাই ভাবনা তার, যাদু তুলিটা হাতিয়ে নেওয়া। তা যদি পারা যায়, অনেক টাকা-কড়ি সোনা-দানা করে নিতে পারবে। 
মালিক নিজেই লুকিয়ে রেখেছে গাইগরুটাকে। ছেলেটাকে আটক করেছে মিথ্যে অভিযোগে। শেষে তার তুলি কেড়ে নিল—দিন-রাত শুধু তুলি আর তুলি! তাতে কাজে কি আর মন থাকে নাকি? এটা রইল আমার হেফাজতে। আগে আমার গাইগরু ফেরত এনে দে। তবে পাবি।

 তুলি হাতে এসে গেছে। আনন্দ ধরে না মালিকের। ফূর্তির চোটে বড়সড় এক ভোজসভারও আয়োজন করে ফেলল সে। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, গাঁয়ের দু’-চারজন মুরুব্বিকেও নেমন্তন্ন করে আনল তাতে। আসল কথা একটাই। যাদু তুলি দিয়ে প্রচুর টাকাকড়ি করে নেবে সবার সামনে। ট্যারা হয়ে যাবে সবাই। গোটা এলাকায় কদর বেড়ে যাবে তার।
উপাদেয় সব খাবার দেওয়া হয়েছে। এমন সব খাবার  কেউ চোখেও দেখেনি কোন দিন। খুব প্রশংসা করতে লাগল সকলে।

 এবার মালিক বসল ছবি আঁকতে। সবার সামনে। মনে সাধ, তাক লাগিয়ে দেবে সবাইকে। লোকটা কেবল টাকা-পয়সার ছবি আঁকছে। মূল্যবান গয়নাগাঁটি। ঘড়া ঘড়া সোনার মোহর। দামি দামি মণি-মুক্তো। এঁকেই যাচ্ছে।  
কিন্তু রাশি রাশি ছবিই আঁকা হল কেবল। ছবি থেকে না বেরুল কোন মোহর, না মণি-মুক্তো। সব ভোঁ-ভোঁ। কোত্থাও কিচ্ছুটি নাই। কাগজের ছবি কাগজ হয়েই রয়ে গেল।
মাথায় তো আকাশ ভেঙ্গে পড়ল মালিকের। ভোজের জন্য প্রচুর খরচা হয়ে গেছে। সবই কি তাহলে জলে গেল? একটা টাকাও উশুল হোল না। 
এক বুড়ো ছিল তার কুটুম্বদের মধ্যে। বুড়ো হেসে বলল—যার তুলি, তার হাতেই সাজে। ছবি আঁকা তোমার কম্ম নয়।
চিড়িক করে উঠল লোকটার মাথা। রাগে গরগর করতে করতে ঘর থেকে বের করে আনল ছেলেটাকে— হয় আমার গরু ফেরত দে। নয়ত আমার কথা মত ছবি এঁকে দে কয়েকটা।
বুড়োমানুষটা ভীড়ের ভিতর থেকে বলল—যেমন লোক, তার সাথে তেমন ব্যবহারই করা উচিত।
মালিক শুনে ভাবল, ছেলেটার ওপর যে চাপাচাপি করা হচ্ছে, বুড়ো সমর্থন করছে সেটাকে। ছেলেটা কিন্তু অন্য ইঙ্গিত পেয়ে গেল কথাটা শুনে। সাথে সাথে একটা ফন্দি এসে গেল তার মাথায়।
মালিককে বলল—গরু আমি লুকায়নি, সে তুমিও ভালো করেই জানো। কিন্তু গরীব মানুষ আমি। তোমার ক্ষমতার কাছে তো পারবো না। যাকগে, তোমার কথামত ছবিই এঁকে দিচ্ছি। তবে, একটা শর্ত আছে। মানো যদি, তবেই আঁকব ছবি। 
মালিক তো ভারি খুশি—বল, তোর কী শর্ত।
ছেলেটা বলল—গাঁ-শুদ্ধ সবার সামনে কথা দিতে হবে, আঁকবার পর কথার খেলাপ করবে না তুমি। 
মালিক হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ছেলেটা নিশ্চয় ছেড়ে দেওয়ার কথাই বলবে। তাতে আপত্তি কীসের। টাকা-পয়সা পেয়ে গেলে, একে আটকে রাখার দরকারটা কী? মালিক রাজী হয়ে গেল।
বলল—একটা সোনার পাহাড় এঁকে দে আমাকে। যখনই মন চাইবে-- যাবো, আর ঝুড়ি ভরে সোনা নিয়ে আসব।
ছবি আঁকতে বসল ছেলেটা। কিন্তু কোথায় পাহাড়? দেখতে দেখতে একটা গভীর সমুদ্র ফুটে উঠল তার ছবিতে। নীল জল থইথই করছে তাতে।
দেখে তো মাথা খারাপ হবার জোগাড় লোকটার। এই মারে, কী সেই মারে। বলল—এটা কী হোল? বললাম পাহাড় আঁকতে, সমুদ্র আঁকলি কেন? মরবার সাধ হয়েছে আমার হাতে? 
একটুও ঘাবড়াল না সেই ছেলে। হাসি মুখ করে বলল—অত ব্যাস্ত হলে চলে? ধৈর্য ধরে বসো না একটুখানি। কী করছি দ্যাখো বসে বসে। 

  এবার সমুদ্রের অন্য পাড়ে একটা পাহাড় আঁকল। বেশ বড়সড় করেই আঁকল পাহাড়টাকে। সোনালি রঙ বোলানো হোল যখন, পুরো পাহাড়টা যেন গনগন করে জ্বলে উঠল, রাঙা সূর্যের মত।
সামনে নীল সমুদ্র। তার ওপারে, ঝলমল করে উঠল সোনালী পাহাড়টা। আস্ত একটা সোনার পাহাড় দেখে, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল সবার। 
মালিক তো আনন্দে লাফিয়ে উঠল। এত বড় একটা পাহাড়, আগাগোড়া সোনা দিয়ে মোড়া। আর, সেটা কি না তার নিজের! আহ্লাদে বিস্ময়ে বুক ফেটে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে লোকটার।
একটু ধাতস্থ হয়ে বলল—কিন্তু অত দূরে আঁকলি কেন পাহাড়টা। যাব কী করে ওখানে? 
--সেটা কি তোমার ভাবনা? সব ব্যবস্থাই করে দেব আমি। বললাম না, চুপটি করে বসে থাকো। আর, বসে বসে দেখতে থাকো কেবল। বলেই আবার তুলি ধরল ছেলে।
আঁকছে আর বলছে—ঘরের পাশটিতে সোনার পাহাড় হলে, আগলে রাখতে পারবে? যার যখন লোভ হবে, চুপিসারে গিয়ে, এক ঝুড়ি কেটে নিয়ে পালাবে। জানবে কী করে? পাহারাদার বসাবে? নিজেই তো সে সোনা কাটবে। আর এত সোনার মালিক হয়ে, তুমি রাজার হালে ঘরে বসে আয়েস করবে, না নিজে যাবে পাহাড়ের তলায় বসে পাহারাদারি করতে? সব কাজ ভেবে চিন্তে তবেই করতে হয়। আমি মুখ্যু-সুখ্যু অভাবী মানুষ। যতটুকু বুঝি, তাই করে দিচ্ছি। ফল তো তুমিই ভোগ করবে। বসে বসে দ্যাখো না, কী করে দিই। 
কথা শেষ হওয়ার আগেই, একটা জাহাজ ফুটে উঠল সমুদ্রের বুকে।    

  আট-দশখানা পালের বিশাল এক জাহাজ। মাঝি-মাল্লা। লোক-লস্কর। সব ভর্তি জাহাজটাতে। যেন হুকুম করলেই নোঙর তুলে ভেসে পড়বে সমুদ্রে।
ছেলে বলল— এই নাও জাহাজ। যখন ইচ্ছে, তখনই ভেসে পড়তে পারবে। এতো সোনা নিয়ে করবেটা কী? দেশ-বিদেশে যাবে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে। যেমন যায় সব বড় বড় বণিকেরা । সারা পৃথিবী ঘুরে দামি দামি জিনিষপত্র নিয়ে আসবে। তবেই আয়েস করে থাকতে পারবে। কত বড়লোক হয়ে যাবে তুমি। দেশের রাজার চেয়েও বড়।
মালিকের যেন ধৈর্য ধরছে না—কবে ভাসাতে পারব জাহাজটা?
ছেলেটার চটজলদি জবাব—কবে কী গো? মাঝি-মাল্লা সবাই তো তৈরি। মন চাইলে, এখনি রওণা দাও। সোনার পাহাড় বলে কথা। একবার ছুঁয়ে না দেখলে, রাতে ঘুমোতেই পারবে না তুমি। 
নিজে তো উঠলই, নেমন্তন্ন খাওয়া লোকেরাও চলল তার জাহাজে চেপে। নিজের কয়েকজন স্যাঙ্গাতকেও সাথে নিয়ে নিল মালিক। সবারই ভাবনা, সোনা না পাওয়া যাক, আস্ত একটা সোনার পাহাড় চোখে দেখাও কম ভাগ্য না কি? 
গোটা গ্রাম এসে ভীড় করে দাঁড়িয়েছে সমুদ্রের পাড়ে। এমন অবিশ্বাস্য ব্যাপার কেউ দেখেনি কোন দিন। 
রাজহাঁসের মত ভেসে চলেছে জাহাজখানা। গভীর মাঝ সমুদ্রে পৌঁছল যখন জাহাজ, আবার তুলি ধরল ছেলেটা। সমুদ্রের উপরে ঝকঝকে আকাশ ছিল। সেই আকাশে কয়েকটা কালো মেঘ এঁকে দিল। যেন কয়েকটা দামাল বুনো মোষ। বড় বড় কয়েকটা ঢেউ আঁকল সমুদ্রে। যেন আকাশ ছুঁয়ে ফেলবে তাদের মাথা। 
সকলের চোখের সামনে ঘটছে সব। জাহাজটাকে এক্কেবারে খেলনার মত কিছুক্ষণ লোফালুফি করল ঢেউগুলো। তার পর? সমুদ্রের অতল জলের কোন তলায় যে সেঁধিয়ে গেল আস্ত জাহাজটা, কোন চিহ্নই আর রইল না কোথাও। সাথেসাথে সমুদ্রও একেবারে শান্ত।
ছেলেটা? তার খবর জানা গিয়েছিল অনেক দিন পরে। শোনা গিয়েছিল, জাহাজডুবির দিনে, মালিকের বউ আর মেয়েও পাড়ে দাঁডিয়ে দেখছিল সব। তাদেরও চোখের সামনে ঘটেছে সবকিছু। 

লোকেরা বলে, মেয়েটা নাকি তার মাকে ধরে পড়েছিল—এমন শক্তিশালী তুলি আছে হাতে। সারা জীবন নিজের জন্য আঁকেনি কিছুই। পরের ঘরে গরু চরিয়েছে দু’বেলা দুটি খাওয়ার জন্য। এমন লোভহীন মানুষ দেখেছ কখনও? একেই বিয়ে করব আমি। 
শোনা কথা, বিয়েটা না কি হয়েও ছিল। সেই বিয়েতে নেমন্তন্নের ভোজ খেয়েছিল কেবল গ্রামের যত গরীব-গুর্বোরাই। আবারও বলছি, লোকেদের বলা কথাই শুনেছি আমরা। যাচাই করা হয়নি। তাই, সত্যি-মিথ্যের দায় আমাদের নয় কিন্তু।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments