জ্বলদর্চি

গ্রামের শহুরে রূপকথা/একবিংশ পর্ব : পয়সার যুগ/সুরশ্রী ঘোষ সাহা

গ্রামের শহুরে রূপকথা

একবিংশ পর্ব : পয়সার যুগ

সুরশ্রী ঘোষ সাহা

১ টাকা মানে ১৬ আনা। আর ঐ ১৬ আনায় হত কত কত কিছু। ১ আনা মানে আবার ৬ পয়সা। তখন ১ পয়সার মুদ্রাও প্রচলিত ছিল। তার সাথে ছিল ২ পয়সার মুদ্রা, ৫ পয়সার মুদ্রা, ১০ পয়সার মুদ্রা, চার আনার মুদ্রা, আট আনার মুদ্রা, আর ১ টাকার মুদ্রা। বাজারে কোন জিনিসের দাম যদি দুই আনা হতো, তবে খরিদদার দোকানদারকে একটি ১০ পয়সার কয়েন মুদ্রা ও একটি দুই পয়সার মুদ্রা মিলিয়ে ১২ পয়সা দিতেন। মানে, ১২ পয়সা হলো দুই আনা। যদি কোনো জিনিসের মূল্য ৫ আনা হতো, তবে চার আনা মুদ্রার সাথে একটা পাঁচ পয়সার মুদ্রা যোগ করে দিতেন খরিদদার।

 দাম তো চিরকাল বেড়েই চলেছে। কড়ি দিয়ে কিনলাম-এর যুগও এসেছে। এসেছে জিনিস পত্র আদান-প্রদানের যুগ। সেই সব সময়ের কথা থাক। আরো অনেক পরের এমন একটা সময়ের কথা বলি, যখন এক সের মুশুরী ডাল ১ টাকা আট আনা দরে বিক্রি হতো। ১ মণ ধান মওসুমে ২০-২২ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। একটা দেশী বড় মুরগী ১ টাকা থেকে দুই টাকায় পাওয়া যেত। খাটি দুধের মিষ্টি চার আনায় কিনে আনা হত। বাড়িতে অতিথি এলে ছেলেপুলেদের হাতে ১টা টাকা দিয়ে বাড়ির কর্তা বলতেন, যা মিষ্টি নিয়ে আয়। সেই টাকায় শাল পাতায় করে দোকানদার চার রকমের চারটে মিষ্টি দিত। যা একটা প্লেটে সাজিয়ে দেয়া হতো অতিথিকে, এবং সেই মিষ্টি খুব একটা ছোট সাইজের ছিল না। প্রায় সময় অনেকেই একসাথে চারটে মিষ্টি খেয়ে শেষ করতে পারত না। কি সুস্বাদু ছিল সেই খাটি দুধের ছানার মিষ্টি, যার ঘ্রাণই ছিল আলাদা।

  কথাগুলো জেঠিমার মুখে শুনতে শুনতে আমার মনে পড়ে যায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'অর্ধেক জীবন' বইয়ের একটা অংশ। যেখানে সাহিত্যিক লিখেছেন, তাঁর শৈশবে তিনি পথে মৃত ব্যক্তিদের সাথে খই আর পয়সা ছড়াতে দেখতেন। এমনই একদিন দেখলেন, একটা শবমিছিল চলে গেল নবকৃষ্ণ স্ট্রিটের দিকে, হঠাৎ রাস্তার পাশে ময়লা জলের মধ্যে সাদা মতন কী যেন চকচক দেখছে। সাধারণত কাঙালি বস্তির ছেলেরা সেসব কুড়িয়ে নেয়, ভদ্রলোক বাড়ির ছেলেদের যা কখনোই মানায় না। লোভ কি জাগে না? জাগে। কিন্তু বাড়ির কেউ দেখতে পেলে মার খাবার ভয়ে নিজের লোভকে সংবরণ করতে হয়। লেখকের দেখা সেই সিকিটা তখনও কাঙালিদের চোখে পড়েনি। লেখক লিখছেন, 'গা ঝিমঝিম করে উঠল। এরকম একটা সিকি দেখে উপেক্ষা করে চলে যাওয়া সম্ভব? এক সিকিতে অন্তত আটখানা ঘুড়ি, ষোলোখানা বেগুনি, চারখানা আইসক্রিম, অন্তত পাঁচটা বুড়ির মাথার পাকাচুল, পাঁচটা খাতা, আরো কত কী। এদিক ওদিক তাকিয়ে টপ করে তুলে নিলাম সিকিটা।'

 লেখকের স্মৃতিচারণের এক টুকরো অংশে ধরতে পারি কী সস্তার দিনই না ছিল তখন। বাচ্চা থেকে বুড়ো সবার কাছেই সেই সময়ের একটা সিকির মূল্য ছিল কতখানি। মনে পড়ে, আমাদের ছোটবেলায় মা সিনেমা দেখতে গেলে সাথে করে নিয়ে যেত না। তখন বড়দের সিনেমা বাচ্চাদের দেখার পারমিশন মিলত না। আমাদের খুশি করার জন্য হাতে সামান্য কিছু পয়সা দিয়ে যেত। দশ পয়সা হাতে পেলে আমরা যা খুশি করতে পারতাম। এখন বাচ্চাদের ততখানি খুশি করতে পঞ্চাশ টাকা হাতে দিতে হয়। তাতেও তাদের মন ভরে না। আমাদের শৈশবে দু'পয়সায় গোল গোল হজমি গুলি পাওয়া যেত। মুখে পুরে চুষতে চুষতে অনেকটা সময় পার করে দেওয়া যেত। এক পয়সায় লেবু লজেন্স কিনতাম। তিন পয়সা নিয়ে দোকানী এক টুকরো কাগজে কালো রঙের কারেন্ট নুন দিতেন। ঠিক পুরো কালোও নয়, স্লেট স্লেট রং। জিভের গোড়ায় ঠেকালে টাকনা থেকে পা অব্দি শিউরে উঠত। বড় হয়ে দেখলাম সে জিনিস বিক্রি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। পাঁচ পয়সা দিয়ে তখন ছোটো আঙুল ভাজা, আর দশ পয়সায় বড় আঙুল ভাজা কিনে খেয়েছি। তাকে ঠিক আঙুল ভাজা কেন বলা হত, সেই রহস্য আজও উদঘাটন করতে পারিনি। স্কুলে পাঁচ পয়সা নিয়ে গিয়ে কত দুপুরে টিফিনবেলায় আমসি, আলুকাবলি কিনে খেয়েছি। আবার পাঁচ পয়সাতেই নানা রঙের ছোটো মৌরি লজেন্সের প্যাকেট, দশ পয়সায় বড় প্যাকেট কিনেছি। নানা মুখরোচক দেশী বিদেশী ক্যাডবেরিদের পাশাপাশি এই বস্তুটি নিজেকে টিকিয়ে রাখার লড়াই আজও চালিয়ে যাচ্ছে। জেলি লজেন্স জিনিসটিও পুরনো। এখন এক টাকায় একটা পাওয়া যায়, তখন কুড়ি পয়সায় চারটে জেলি লজেন্স কেনা যেত। এখন দু টাকায় একটা এক্লেয়ার্স মেলে, আমাদের শৈশবে ত্রিশ পয়সায় পাওয়া যেত। 

 এখন গরিবের খাদ্য তালিকায় ফল জোটে না তার আকাশছোঁয়া দামের জন্য। যখন যা সিজেনাল ফল উঠুক সবেরই বিরাট দাম। তার উপর কোন উৎসব পার্বণ থাকলে তো কথাই নেই। অথচ আগে মানুষের কাছে ফল কেনাটাও ছিল সাধ্যের মধ্যে। দশ পয়সায় বড় কুল, পনেরো থেকে কুড়ি পয়সায় বিলিতি আমড়া কিংবা কামরাঙা কিনে বাচ্চা - কিশোররা নুন ঝাল মেখে খেত। যদিও ফল কিনতে হত খুবই কম। বাড়িতে বাড়িতে তখন নানা ফল গাছ থাকত। সেই ফল পেড়ে কিংবা চুরি করেই যাবতীয় ভিটামিন প্রোটিন শরীরে এসে যেত। এখন সে জায়গায় মানুষের বাড়িতে টবে টবে ফুলের গাছ দেখা যায়। বাড়ি লাগোয়া অত জমিই-বা কোই! যেটুকু জমি থাকে, তাতে বাহারি গাছ করা যায় মাত্র।

 ঘরে ঘরে তখন লক্ষ্মীর ভান্ডার রাখার চল ছিল খুব। খুচরো পয়সা সেই ভান্ডারে জমিয়ে রেখে, কোন বড় প্রয়োজনে সেই ভাঁড় ভেঙে ফেলা হত। দেখা যেত, এক দু'পয়সা করেই প্রচুর টাকা জমে গিয়েছে তাতে। যা দিয়ে অনেক কিছু করা সম্ভব হত তখনকার দিনে। শুধু নিজেদেরই শখ পূরণ নয়, অন্যদেরও সাহায্য করা চলত। নিজেদের শখ বলতে যে বিশাল কিছুই ছিল না। বড়জোর কাছের সিনেমা হলে উত্তম-সুচিত্রার ছবি  দেখতে যাওয়া। দেখতাম, কোন এক সময়ে বাড়িতে ঠিকে ঝিয়ের কাজ করত, তারপর বহুকাল আর করে না, বয়সের ভারে কিংবা অন্য কোন কারণে, এমন মানুষ বিপদের দিনে মায়ের কাছে ছুটে আসত টাকা চাইতে। মা লুকিয়ে রাখা জমানো টাকা থেকে তুলে দিত কিছু। ছেলেপুলেদের জন্য দিত খাবার। আর তার জন্য গায়ের কাপড়.... আমাদের বাড়িতে শৈশবে যে দুধ আসত, সেই দুধ নিজের সন্তান ও কাজের মানুষের সন্তানদের মধ্যে সমান ভাবে ভাগ করে খেতে দিতে দেখেছি। সময়ের সাথে সাথে জিনিস পত্রের ভেজালের পাশাপাশি মানুষের মধ্যেও ভেজাল মিশে গেছে এখন। সেই রকম খাঁটি মানুষই এখন কোথায়! আমিই কি মায়ের মতো হতে পেরেছি! 
                                                                               ক্রমশ...

ছবি: লেখিকা

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments