জ্বলদর্চি

মাটিমাখা মহাপ্রাণ। একুশ/শুভঙ্কর দাস

মাটিমাখা মহাপ্রাণ । একুশ

শুভঙ্কর দাস 

"ও তুই রক্তমাখা চরণতলে একলা দলো রে
যদি আলো না ধরে,ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি ঝড়বাদলে আঁধার রাতে দুয়ার দেয় ঘরে
তবে বজ্রানলে 
আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা জ্বলো রে..."

কলকাতায় ফিরে এসে কুমারচন্দ্র বি. এস. সি. ক্লাসের চতুর্থ বার্ষিক শ্রেণির পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতিতে মন দিলেন। ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছে মনের ভেতর থেকে বাতিল করলেও পড়াশোনা করে স্কলারশিপ নিয়ে বিলেতে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো পড়তে যাবেন,এই স্বপ্ন বুকের মধ্যে লালন-পালন করতে লাগলেন। একটি নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশে তাঁর বাসাটি ছিল,সেখানে একটি জামরুল গাছের নিচে বসে পড়াশোনা করা এবং ভবিষ্যতের স্বপ্ন পূরণ করার জন্য নানারকম পরিকল্পনা ভাবা চলত। 

সবচেয়ে বড় কথা,দাদা দেবেন এবার যখন বাড়ি থেকে কলকাতায় ফিরছিল,হাতে ধরে অনুরোধ করেছে,ভাই কুমার,আমাদের বংশে,আমাদের গাঁয়ে এতখানি পড়াশোনা কেউ করেনি, তুই যদি প্রথম শ্রেণিতে পাশ করতে পারিস,তাহলে আমার কীরকম মনে হবে জানিস,আমি যেন এই গাঁয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকব,মাথা আকাশে ঠেকে যাবে,আর কাতারে কাতারে লোকজন শীতলাতলায় ঘাড় উঁচু করে আমাকে অবাক বিস্ময়ে দেখতে থাকবে।

এই কথা শুনে কুমারচন্দ্র মৃদু হেসে ছিলেন।
কিন্তু মনে মনে ভেবেছিলেন,তাঁর পড়াশোনা নিয়ে দাদা দেবেন কতখানি বুক বেঁধে রেখেছে, সত্যি এইরকম দাদা ক'জনের ভাগ্যে জোটে। যা টাকা লাগছে,ঠিক মাসটি ফুরোলেই পাঠিয়ে দিচ্ছে, আবার চিঠিতে এইকথা লিখে দেয়, বই কেনা অথবা পড়াশোনার জন্য অতিরিক্ত খরচ লাগলে যেন অবশ্যই বলে দেয়,জমিদারবাবুকে বলাই আছে,প্রয়োজনে তিনি ঋণ দেবেন।

এমন কি দেবেন যে জমিদারের বাড়িতে সেরেস্তায় কাজ করেন,সেই জমিদারের ঋণ দেওয়ার কথাও হুবহু চিঠিতে তুলে পাঠিয়েছে। যাতে কুমারচন্দ্র  নিশ্চিত মনে পড়াশোনা কাজ চালিয়ে যেতে পারে!
এছাড়াও গাঁয়ের এমন কোনো লোক নেই, যাকে দেবেন নিজের ভাইয়ের পড়াশোনার বলেননি! তাও কুমারচন্দ্রকে চিঠিতে জানিয়ে রেখেছেন।
পড়ন্ত রোদের বিকেলে কুমারচন্দ্র সেই সব চিঠি আপনমনে পড়েন এবং একটা আশ্চর্য আনন্দে সুদূরমগ্ন অভিযাত্রী হয়ে বসে থাকেন।

কুমারচন্দ্র দাদার স্বপ্ন পূরণ করবেই, তাই তিনি এইসময় টিউশন একটু কমিয়ে দিয়েছেন।কিন্তু একটা ব্যাপার তাঁর চোখে পড়ল,হিরন্ময় ইদানিং কম আসছে!
বন্ধু গঙ্গাধর বাড়ি গেছেন,তাই জিজ্ঞেস করার লোক নেই। 
সবচেয়ে বড় কথা কলেজে যাওয়ার পথে,কলেজের মধ্যে, আবার কলেজ স্ট্রিটে বইদোকানের রাস্তায় কেমন একটা থমথমে ভাব! সেই আগের প্রাণোচ্ছল কলকাতা যেন নয়, কী একটা ভয়ংকর কিছু ঘটে গেছে, তার যেন সুদূরপ্রসারী প্রভাব চলছে,রাস্তাঘাটে,কলেজের ক্যান্টিনে, বইদোকানে,লাইব্রেরিতে একটা যেন ভয়ার্ত ফিসফিসানি চলছে লোকজনদের মধ্যে... 
কী হল? কী এমন ঘটল?
একদিন কুমারচন্দ্র নিজেই চলে গেলেন মুরলিধর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গৃহে। কী হল? নিজেই ব্যাপারটা অনুসন্ধান করবেন।

সেখানে পৌঁছে কুমারচন্দ্র দেখলেন,মুরলিধরবাবু বিছানার ওপর বসে আছেন এবং একজন ডাক্তার তাঁকে দেখছেন।
অতি সাদরে কুমারচন্দ্রকে বসতে বললেন মুরলিধর।

আরে আজ কোন্ দিকে সূর্যোদয় হল? স্বয়ং কুমারবাবুর আমার মতো নগণ্যের গৃহে আগমন ঘটেছে! মুখ তুলে বললেন মুরলিধর। 

কেন এমন বলছেন,আমি তো আপনার সহযোগিতায় এতো স্বচ্ছন্দে ও সানন্দে পড়াশোনার কাজ করতে পারছি,এ জিনিস ভুলতে পারি!

সে তো আমার সৌভাগ্য, যে লোককে আজ নিমন্ত্রণ করলে এক সপ্তাহ পার করে উপস্থিত হন,তিনি তো সাধারণ মানুষ নন!

আসলে কুমারচন্দ্রকে বার বার মুরলিধর বন্দ্যোপাধ্যায় গৃহে আমন্ত্রণ করে খাওয়াতে চান,কিন্তু কুমারচন্দ্র সংকোচে আসতে পারেন না,তিনি নিজের হাতে রান্না করে খান,তাও বেশির ভাগ দিনই আলুসিদ্ধ ভাত, ডাল।খুব বড়জোর ছোটো ছোটো মাছ কিনে আনেন। অথবা কোনোদিন শুধু মুড়ি খেয়ে কাটিয়ে দেন।এসবই মুরলিধর জানেন,তাই একটু ভালোমন্দ খাওয়ানোর জন্য প্রায় গৃহে ডাকেন,কিন্তু কুমারচন্দ্র অন্য রকম।তিনি হাস্যমুখে এসব এড়িয়ে যান। বলেন,গরিবের পেটে সব সহ্য হয়,ঘি-ভাত সহজে পাচ্য হয় না!

আচ্ছা, হিরন্ময় ভালো আছে তো? গত সপ্তাহে ও তো পড়তে যায়নি!

হ্যাঁ,ভালো আছে,এখন মামাবাড়িতে গেছে,গিন্নিও গেছেন,আমি আপনাকে খরব দিতে যাব,সহসা এদিকে কিছু কাজ পড়ে যাওয়ার যেতে পারিনি!
তারপর এই তো আমাদের অবস্থা! 

আপনার কিছু হয়েছে কি?

না,না,আমি ঠিক আছি,আলাপ করিয়ে দিই,ইনি নন্দলাল ভট্টাচার্য, আমার বন্ধু, ডাক্তার। আর বুঝতেই পারছেন,বন্ধু হলেও ডাক্তার যখন তখন একটা খবরদারির বদভ্যাস যাবে কোথায়? জোর করে প্রেসার মাপতে লেগেছে! 

কুমারচন্দ্র ডাক্তারের দিকে হাতজোড় করে নমস্কার জানিয়ে বলে উঠলেন,এমন বন্ধু ক'জনের ভাগ্যে মেলে!

ডাক্তার এবার মুখ খুললেন,আমরা কিন্তু তবুও দুর্ভাগা,কারণ কী জানেন? আমাদের শাসনের জন্য যাঁদের পেয়েছি, তাঁরা এই দেশের মানুষের প্রকৃত বন্ধু নয়।

কথাগুলো বলা মাত্র নন্দলালের চোখ বিষাদময়। 
মুরলিধরবাবুও যেন মুষড়ে পড়লেন।

কী ব্যাপার বলুন তো?

মুরলিধর কিছুই বললেন না,শুধু বিছানার পাশ থেকে 'বসুমতি' পত্রিকার একটি বিশেষ সংবাদ পাতাটি খুলে কুমারচন্দ্রকে পড়তে দিলেন।
চোখ বোলালেন কুমারচন্দ্র।

সে কি! রবীন্দ্রনাথ নাইটহুড উপাধি ত্যাগ করেছেন!

হ্যাঁ,তিনি বড়োলাট লর্ড চেমসফোর্ডকে চিঠিটি লিখেছেন।

চিঠিটির বয়ান তো ভীষণ দুঃখের আগুন থেকে লেখা,এরকম ভাষা তো একজন কবি-মানুষের সত্যিকারের উপলব্ধি ছাড়া প্রকাশ হওয়া সম্ভব নয়, "হতভাগ্য প্রজাদের ওপর ব্রিটিশ শাসকের এমন সামঞ্জস্যহীন তীব্র দমননীতি ও তাদের মৃতদেহ বহন করার পদ্ধতি নিশ্চিতভাবে কোনো সভ্য সরকারের ইতিহাসে বিরল...."
এই চিঠির শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন," এই নির্মম ঘটনাবলী আমাকে বেদনাদায়কভাবে বাধ্য করেছে মহামান্য সরকারের কাছে আবেদন জানাতে যাতে আমার নাইটহুড উপাধি থেকে মুক্ত করা হোক অবিলম্বে..."

চিঠিটি শেষ করার পর গৃহের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এলো।তিনজন একে-অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে বিষাদময়তায়...

তারপর ডাক্তার নন্দলাল ভট্টাচার্য পুরো ঘটনাটি তুলে ধরলেন...

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংরেজ সরকার প্রতিশ্রুতি দেয়,যদি এই যুদ্ধে ভারতীয়রা সহযোগিতা করে,তাহলে তাদের স্বরাজশাসন প্রদান করা হবে। সেই মতো ভারতবাসী ইংরেজ সরকারকে সহযোগিতা করে। কিন্তু যুদ্ধের পর ইংরেজ রাজশক্তি বিশ্বাসঘাতকতা করে।ফলে সারাদেশে একটা মারাত্মক অসহিষ্ণুতার আন্দোলন শুরু হয়।গান্ধীজি ইংরেজ রাজসরকারের এই ব্যবহারে মর্মাহত হন।তিনিও আন্দোলনের হুমকি দেন। সেই আন্দোলনকে অবদমিত করার জন্য রাউলাট আইন চালু করে সরকার। এই আইনে সভা-সমিতি ও রাজনৈতিক কার্যকলাপ রাজদ্রোহিতা বলে ঘোষিত হয়। এই আইন বলে যে কোনো ভারতীয়কে বিনা বিচারে কারারুদ্ধ করা যাবে।এ ঠিক যেন চিড়িয়াখানায় খাঁচাবন্দী পশুপাখির ওপর চাবুক মারার পদ্ধতি। সারাদেশে একটা বিরুদ্ধতার ঝড় বয়ে গেল।দেশব্যাপী হরতাল পালিত হল।পঞ্জাবের জনপ্রিয় নেতা ডা. সত্যপাল ও ড. কিচলুকে গ্রেপ্তার করে অন্তরীণ করে। তারপর আবার পঞ্জাব ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে,নির্বিচারে গুলিও চালায়।
ঠিক সেই সময় পঞ্জাবের শাসক জেনারেল ডায়ার, সমস্তরকম সভা-সমাবেশ বন্ধ করার নোটিশ জারি করেন।

কিন্তু প্রতিবাদে উত্তাল জনগণ নববর্ষের বৈশাখী উৎসবের দিনে অর্থাৎ ১৯১৯ এর ১৩ এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগে একটি সভা ডাকেন।

তার মানে প্রায় দুমাস আগের ঘটনা.. বলে উঠলেন কুমারচন্দ্র, তারপর?

তারপর সেই সভায় মারাত্মক ঘটনাটি ঘটে যায়। সভাস্থলটি আসলে একটি বাগান। তার চারপাশে উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা।একটিই মাত্র প্রবেশপথ ছিল। সভা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই জেনারেল ও'ডায়ার প্রবেশপথে দেড়শো সেনা দাঁড় করিয়ে দেন।তারপর সভা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ও'ডায়ারের নির্দেশে নিরস্ত্র জনতার ওপর নির্বিচারে সৈন্যদের মেশিনগানের গুলি ছুটে আসে।একবার ভাবুন,চারিপাশে অজস্র নিরপরাধ, নিরস্ত্র মানুষ,এমন কি মহিলা ও শিশুসহ সবার ওপর এলোপাথাড়ি গুলি চলছে।বেরোবার পথ নেই। পালিয়ে বা লুকিয়ে থাকারও জায়গা নেই। বাগানের ভেতর অবস্থিত কূপে ঝাঁপিয়ে বাঁচতে গিয়েও মরল প্রচুর মানুষ।বিশাল উঁচু পাঁচিল টপকাতে গিয়ে অনেকের পিঠে-মাথায় গুলি ছুটে এসে লাগল, এমন অবস্থা দাঁড়াল একসময় সেই সৈন্যদের গুলির সামনে অসহায়ভাবে সঁপে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না! 

একি নৃশংসতা! আঁতকে উঠলেন কুমারচন্দ্র।

আরও শুনুন,সেদিন সরকারী হিসেবে মানুষ মারা গিয়েছিল প্রায় চারশো জন এবং গুলি হাতে-পিঠে-পায়ে-কোমরে লেগে প্রবল যন্ত্রণায় ছটপট করতে করতে মাঠেই পড়েছিল দেড় হাজার জন মানুষ।
অবশ্য বেসরকারি হিসেবে বলছে,সেদিন মানুষ শুধু মারাই গেছিল এক হাজারের বেশি...

এর কোনো প্রতিকার নেই? এই বর্বর শাসকের গালে একটা আগুন ধরানো চড় মারার প্রয়োজন, সেই কাজ করেছেন রবীন্দ্রনাথ, তিনি জমিদারবাড়ি সন্তান,কিন্তু এই নাইটহুড ত্যাগের পর আমাদের লোক হয়ে গেলেন,দেখা হলেই কবির পা ছুঁয়ে প্রণাম করব, মুরলিধরবাবু যেন উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।

সবচেয়ে বড় ব্যাপার, এইরকম ভয়ংকরকম অন্যায়-অত্যাচারের পর ইংরেজ রাজসরকার কী করলেন জানেন? সারা পাঞ্জাবে মার্শাল জারি করলেন।অমৃতসর,লাহোরসহ পাঞ্জাবের বড় বড় শহরে জল ও বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়। বলতে গেলে পুরো পঞ্জাবকে অবরুদ্ধ করে দেওয়া হয় এবং নির্দেশ জারি করে, পথে-ঘাটে নেটিভদের অর্থাৎ ভারতীয়দের দেখলেই বেত মারা হতে থাকল, দেড়মাস এই মারাত্মক সংবাদ পঞ্জাবের বাইরে আসেনি!কারণ সবরকম সংবাদপত্রের ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা ছিল।

কুমারচন্দ্রের চোখে জল। তিনি নীরবে ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,আমাদের ভাই-বোনেদের অবস্থা শুনে আমার যেন বুকের মধ্যে একটা কান্নার স্রোত বয়ে যাচ্ছে! 
তারপর চোখে মুছে জিজ্ঞেস করলেন,গান্ধীজি কী করছেন?

তিনি বড়োলাট রিডিংকে পত্র লেখেন,সাতদিনের মধ্যে ভারতীয়দের ওপর নিপীড়ন বন্ধ না হলে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করবেন। 

রিডিংকে কেন?

কারণ বৃটিশ সরকার তখন বড়োলাট চেমস ফোর্ডকে সরিয়ে রিডিংকে নিয়ে আসেন,তবে এখনও পর্যন্ত রাইলাট আইন স্থগিত হয়নি!

আইন কি স্থগিত, এই সরকারকে স্থগিত করে দেওয়া দরকার,বলেই কুমারচন্দ্র উঠে দাঁড়ালেন। 

কথা বলতে বলতে বাড়ির চাকর লুচি-মিষ্টি এবং ফলমূলের পাত্র টেবিলে সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কুমারচন্দ্র সেদিকে তাকালেন না,শুধু মুখে বললেন,আমাকে ক্ষমা করবেন।
একটিও দানা আমার মুখে রুচবে না!
বলেই কুমারচন্দ্র বেরিয়ে গেলেন।
ডাক্তার নীরবে কুমারচন্দ্রের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
কিছুদিন পরেই কলকাতায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে কংগ্রেসের অধিবেশন।এই প্রথম একটি অধিবেশনের গুরুত্ব এমনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল যে,মানুষের জীবনযাপনের মধ্যে এইরকম কোনো সভা এবং সভার নির্দেশের অপেক্ষায় সকলেই উৎকর্ণ ও আগ্রহী। 
কুমারচন্দ্র নিজের ভেতরে একটা আগুনের আভাস পাচ্ছিলেন, তিনি কলেজে যাচ্ছেন, কিন্তু ক্লাসে মনস্থির করতে পারছেন না,তাঁর সর্বদা মনে হচ্ছে, একটা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মধ্যে আছেন,তাঁর বুকে-পিঠে অসংখ্য তীর গেঁথে আছে।
এ কেমন শাসন?
এ কেমন হত্যাপুরী?
এ কেমন সভ্য সরকার? 
কুমারচন্দ্র রাতে ভালো করে ঘুমোতে পারেন না! দিনের বেলা একাই হেঁটে কলেজ স্ট্রিট চলে যান,সেখানে গিয়ে বসুমতি, সন্ধ্যা,যগান্তর পত্রিকা এবং কংগ্রেসের লিফলেট সংগ্রহ করেন।রবীন্দ্রনাথের নাইটহুড ত্যাগের চিঠিটি পড়ে পড়ে মুখস্থ হয়ে গেল।
সর্বদা একটা অস্থিরতা কাজ করছে,সেটা যত দিন অধিবেশনের দিন এগিয়ে আসছে,ততোবেশি হতে লাগল।
আরও একটি কথা কুমারচন্দ্রের মনে হতে লাগল,এই মহানগরে বাস করার জন্য তিনি এইরকম দেশের সাংঘাতিক অবস্থার কথা জেনেছেন,কিন্তু তাঁর জেলা মেদিনীপুর, তাঁর গ্রাম বাসুদেবপুর, সেইখানের কী অবস্থা?
সেখানে কি এইসব সংবাদ পৌঁছে গেছে? সেখানকার মানুষজন কি দেশের এ-ই করুণ কাহিনি কোনোদিন জানবে না!
তাদের জাগানোর জন্য কেউ কি এগিয়ে আসবে না!
তাদের মানুষের মতো মানুষ হওয়ার মর্যাদা,দেশের জন্য দেশের সম্বন্ধে সম্পূর্ণ জানা,দেশের মানুষকে নিজের ভাইবোন ভাবা,এসব কি কোনোদিন হবে না!

তারপর একদিন সেপ্টেম্বর মাসে ওয়েলিংটন স্কোয়ারে বসল কংগ্রেসের প্রতিবাদী অধিবেশন। কুমারচন্দ্র সভা শুরু হওয়ার দু'ঘন্টা আগে সেখানে উপস্থিত। একেবারে সভামঞ্চের সামনে গিয়ে  বসে  রইলেন।
পঞ্জাবকেশরী লালা লাজপত রায় এই সভার সভাপতি।
তিনি মধ্যমণি বসে ছিলেন।তাঁর পাশেই বসে আছেন কংগ্রেসের তাবড় তাবড় নেতাগণ,মতিলাল নেহেরু, চিত্তরঞ্জন দাশ,বিপিনচন্দ্র পাল,সুভাষচন্দ্র বসু,এম. এ আনসারি, মদনমোহন মালব্য প্রভ্তি।
কুমারচন্দ্রের চোখ খুঁজছিল,সেই মানুষটিকে, যাঁকে কলেজস্ট্রিটের রাস্তায় দেখে প্রকৃত নেতার সংজ্ঞা বুঝেছিলেন।
লালা লাজপত রায় জালিওয়নাবাগের মর্মান্তিক ঘটনার কথা উল্লেখ করে সকলে অশ্রুসজল করে তুললেন।
একের পর এক নেতা যা বক্তব্য বললেন,তাতে একটা কথাই পরিষ্কার, এই বর্বর সরকার যা করল,তাতে এদের এই দেশ শাসন করার আর কোনো অধিকার নেই। এই সরকারের সঙ্গে কোনো সহযোগিতা করা চলবে না!
এইসব শুনে ও দেখে কুমারচন্দ্র একটা জিনিস পরিষ্কার অনুভব করলেন,এর আগেও তিনি কংগ্রেসের সভায় অংশগ্রহণ করেছেন,কিন্তু এই সভা একেবারে আলাদা,এখানে সত্যি সত্যি একটা কর্মযোগের সূচনা হয়েছে। 
তারপর তাঁর চোখ স্থির হয়ে গেল,যখন মঞ্চে বক্তব্য দিতে উঠলেন, গান্ধীজি।
কী সর্বনাশ! এতক্ষণ তিনি জনগণের মধ্যেই বসে ছিলেন,তাই চোখে পড়ছিল না!
তিনি চারিদিকে তাকিয়ে নিয়ে ধীর কণ্ঠে বলে উঠলেন, একটি মাত্র উপায়ে এই সরকারকে পর্যদুস্ত করা সম্ভব, তা হল অসহযোগ।এবং তা সত্য ও অহিংসা দিয়ে করতে হবে। সবসময় মনে রাখা দরকার,এই দেশ আমাদের, বৃটিশ-সরকারের নয়,এই দেশকে শুধু মুক্ত করা নয়, তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের। আমি এমন এক ভারত গড়ে তোলার কাজে প্রয়াসী,যাকে দেশের দরিদ্রতম লোকটিও নিজের দেশ বলে মনে করবে এবং যাকে দেশ বলে গড়ে তেলা হবে,তার কাজে তারও অবদান ব্যর্থ হবে না! এই কাজে আগে এগিয়ে আসতে হবে ছাত্রদের,কারণ তারাই এই দেশের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি।সকল রকম সরকারী স্কুল-কলেজে পরিত্যাগ করে রাস্তায় এসে দাঁড়াতে হবে।

লালা লাজপত রায় এই স্কুল-কলেজের পরিত্যাগের প্রশ্নে সহমত ছিলেন না,তিনি মনে করতেন,এতে দেশ ও দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পিছিয়ে যাবে।
তাঁর কথা উত্থাপন হতেই সভায় বেশ গুঞ্জন শুরু হল।কেউ সহসা চিৎকার করে উঠল,এইভাবে আমরা জালিওয়াবাগ সহ্য করে নিলে আরও দেশে নতুন করে জালিওয়নাবাগ হবে! 
গান্ধীজি গলায় জোর এনে শুধু বললেন,এই শিক্ষার চেয়ে রাস্তার ইট ভাঙার কাজও ভালো।
সঙ্গে সঙ্গে সমর্থনের জন্য ধ্বনিত হল করতালি।
কুমারচন্দ্রের গান্ধীজির এই কথাটি  অন্তর ছুঁয়ে গেল।
অবশ্য সভায় শুধু স্কুল-কলেজ ত্যাগের প্রস্তাব গৃহীত হল না,তার সঙ্গে যুক্ত করা হল,কাউন্সিল থেকে পদত্যাগ, আইন ব্যবসা বর্জন,শিক্ষাব্যবস্থার স্বদেশীকরণ,জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, সরকারী আমন্ত্রণ ও চাকরিকে প্রত্যাখ্যান,বিলাতি দ্রব্য বর্জন, বিলিতি বস্ত্রের পরিত্যাগ,প্রচুর পরিমাণে স্বদেশী ভাণ্ডার চালু এবং তার জন্য ঘরে ঘরে চরকার প্রচলন ,অর্থনৈতিক বয়কট,শ্রমিক সংগঠনের গুরুত্ব, হিন্দু মুসলমান ঐক্য এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মহিলাদের স্বীকৃতি। 
কিন্তু এইসব প্রস্তাব একের পর এক শোনানো হচ্ছে, অথচ কেউ তার সমর্থনে কোনো কর্মধারা প্রকাশ করছে না!
গান্ধীজি তখন আবার উঠে বললেন,এই সব শুধু কাগজ কলমে সীমাবদ্ধ রাখলে আমাদের পাণ্ডিত্যের জাহির সম্ভব হবে,কিন্তু পরাধীনতার পাপ দূরীকরণ সম্ভব নয়, এগিয়ে আসতে হবে সেই সত্য  পণ নিয়ে... 

গান্ধীজির কথাগুলো শেষ করার আগেই মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন একজন বলিষ্ঠ পুরুষ।তাঁর উন্নত বক্ষ,মাথা স্থির,কালো কোর্ট পরিহিত,দাঁড়ানোর ভঙ্গিটিতে একটা রাজকীয় আভিজাত্য প্রকাশিত, তিনি সহসা সভার উদ্দেশ্য হাত তুলে নমস্কার জানিয়ে বলে উঠলেন,আমি আজ থেকে ব্যারিস্টারী ছেড়ে দিলাম,যতদিন ইংরেজ সরকার পদানত না হবে আদালতের মুখ দর্শন করব না।

এই কথায় সভায় যেন একটা প্রতিবাদের ঝড়ো হাওয়া বইতে লাগল,সকলের মুখে উচ্চারিত হল,বন্দেমারতম্। 
ইংরেজ সরকার নিপাত যাক।

কুমারচন্দ্র সেই মানুষটিকে দেখে মুগ্ধ হলেন।ভাবলেন,ইনি নিশ্চিত কলকাতার কোনো বড়লোকের সন্তান!কী তেজদীপ্ত পুরুষ!

সহসা একটা কণ্ঠ শুনে কুমারচন্দ্র পেছন ঘুরে দেখে প্রমথনাথ বসে আছেন। তিনিও মেদিনীপুরের ছেলে,কলকাতায় পড়াশোনা করতে এসেছেন। কী অদ্ভুত!  এতদিন বাদে এই সভায় সাক্ষাৎ। 
ভাই কুমার, যিনি এখুনি অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন করে মোটা মাইনের ব্যারিস্টারি ছেড়ে দিলেন,কে জানিস?

না,কে ইনি?

আরে আমাদের মেদিনীপুরের মানুষ,বিলেত ফেরত নামকরা ব্যারিস্টার,তাঁকে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র কী বলে ডাকেন জানিস?

কী? 

মুকুটহীন রাজা

কে ইনি? কুমারচন্দ্র কৌতূহলে ফেটে পড়লেন...

আরে ইনি বীরেন্দ্রনাথ শাসমল।

কুমারচন্দ্র নামটা কয়েকবার উচ্চারণ করলেন,তারপর বললেন,আমি পথ পেয়ে গেছি...


ক্রমশ....

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments