আবীর ভট্টাচার্য্য
এমন সব কুর্চিগন্ধী বৈশাখী ভোরে, ঘুম ঘুম চোখের পাতায় শিশিরের মতো অশ্রূ জমে অকারণেই, অসূর্যম্পশ্যা মনও আলোকপিয়াসে ডানা মেলতে চায় সুদূর দিগন্তে। বাড়ির পাশের গাছগাছালি থেকে ভেসে আসা নাম না জানা বনপাখীর ডাকে, মহুল ঝরে পড়ে নিকোনো গাছতলে, শালের ঋজু শরীরেও জাগে পেলব শিহরণ; মিলন বাসনা নয়, বিরহ বেদনাও নয়, স্মৃতিমেদুরতায় আক্রান্ত হয় মন।
মনে পড়ে, সেই কোন ফেলে আসা শৈশবে, কি যেন এক অনিন্দ্য দ্যোতনায় সহজপাঠের আবৃত্তির সুরে, মায়ের পরিয়ে দেওয়া শাড়িতে পা জড়িয়ে পড়ে গিয়েও আবার উঠে ফিরে 'মম চিত্তে নিতি নৃত্যে'-র মনোবন্ধনে, কালবৈশাখী বেলায় জানালা পারের তান্ডব দেখে 'ঐ যে ঝড়ের মেঘে'-র অনুভুতি দোলায়, আরও একটু বড়ো হয়ে সুরূপা চিত্রাঙ্গদারূপে 'অর্জুন, তুমি অর্জুন!'-এর ঐকান্তিক নিবেদনে, অথবা বেহাগবদ্ধ রাগমুর্চ্ছনায় 'প্রভু তোমা লাগি আঁখি জাগে;দেখা নাই পাই…'-এর মগ্ন সুরালাপে মনোগহনে যে বাঁশি বেজেছিলো, তা যেন আজীবনের অচ্ছেদ্য বন্ধন-সাথী আমার।
ছোট্ট থেকেই সারাদিন যাঁর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে থাকে যাপন, ছোট নদীর তিরতির বয়ে চলার উচ্ছাসে, 'আনন্দ-বসন্ত-সমাগমে' মাধবীলতার দোলনে, অথবা সামাজিক দ্বিচারিতায় 'বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে' কাঁদলে যাঁর কথা আর গানে আশ্রয় খুঁজে ফেরে মন; তাঁকে কোন বিশেষ দিনে স্মরণ করার যৌক্তিকতা কোথায়! তাঁর কাছে আত্মনিবেদনে কোন যোগ্যতা লাগে কি?
না। লাগে না। অন্ততঃ বাঙালিনীর তো কখনই লাগেনা।
তাই, বাঙালিনীর এক এবং একমাত্র প্রেমিক, দেবতা অথবা ঈশ্বর তো তিনিই। পিতা হয়ে, বন্ধু হয়ে, পুত্র হয়ে তিনি জীবন ভরে মিলে থাকেন সময়ে-অসময়ে, শৈশবের পূণ্যিপুকুর ব্রত উচ্চারণে, কৈশোরের প্রথম সেই কাঙ্খিত চিঠিটি পাওয়ার উত্তেজনায়, যৌবনের কামনাদীপ্ত সৌকর্যে, পরিপূর্ণ জীবনের কাজে-অকাজে, দায়ে দায়িত্বে, বেলাশেষের বিচ্ছেদ বেদনায় তিনি ছুঁয়ে থাকেন সর্বদাই গোপন সংরাগে, অনেক না পাওয়া জীবনের মৃৎকলসখানি সেই অমৃত স্বচ্ছতোয়া ঝর্ণাধারায় ভরে ওঠে তাই নির্জন উৎসবে...'হে মোর দেবতা, ভরিয়া এ দেহ-প্রাণ…'
বস্তুতপক্ষে, সততঃ শুভেচ্ছাব্রতী যে হৃদয়ে তিনি বেঁধে রাখেন চিরায়ত জীবনতান, 'দুয়ারে দাও মোরে রাখিয়া নিত্যকল্যাণকাজে হে'...,আর্য ঋষির প্রজ্ঞায় মিলিয়ে দেন 'সকল দ্বন্দ-বিভেদ মাঝে জাগ্রত' ভাতৃত্ববোধ, তাতে তাঁর দেবত্ব থেকে যায় সংশয়াতীত।
তবু কখনও তিনি নিজে কিন্তু দেবতা হতে চাননি আমাদের, চেয়েছেন সাথী হতে, কবি হতে, বন্ধু হতে…'জীবনে জীবন যোগ করা,নাহলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পশরা…'
সংশয়াকুল মনের আহ্বানে
'দেবতা জেনে দূরে রই দাঁড়ায়ে,
আপন জেনে আদর করি নে…'- এই ব্যথা যখনই ঘনিয়ে ওঠে,কবির চিরবিহঙ্গী মন ডানা মেলে মুক্ত সঞ্চরণে,
"শুধায়ো না মোরে তুমি মুক্তি কোথা, মুক্তি কারে কই,
আমি তো সাধক না, আমি গুরু না।
আমি কবি আছি,ধরণীর অতি কাছাকাছি
এপারের খেয়ার ঘাটায়।"
তবু যতই একথা বলুন,এই যে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই কল্যাণময়তার অন্বেষণ,অসহ বিয়োগের মধ্যেও সহনীয়তার সন্ধান, সে তো তাঁরই মহত্তম দান।
জীবন ভরে আঘাত পেয়েছেন বিস্তর; কিন্তু কোন ক্ষয়, বিচ্ছেদ অথবা বিদায় কখনও তাঁকে জীবনবিমুখ করেনি। ক্ষয়কে গ্রহণ করূছেন সংহত মনে, 'অন্ধকারের দুয়ার পেরিয়ে' তার উত্তরণ ঘটিয়েছেন নব নব সৃষ্টি সুধারসে। তিনিই আমাদের শিখিয়েছেন,
'আমি স্বভাবতই সর্বাস্তিবাদী-অর্থাৎ আমাকে ডাকে সকলে মিলে,আমি সমগ্রকেই মানি। আমি মনে করি, সমস্তের মধ্যে সহজে সঞ্চরণ করে সমস্তের ভিতর থেকে আমার আত্মা সর্বস্তরের স্পর্শলাভ করে সার্থক হতে পারবে।' এমন ঋদ্ধ যাঁর উচ্চারণ, 'সমানা ব আকুতি, সমানা হৃদয়ানি ব…' যাঁর জীবনানুভব, তাঁর কাছে স্বচ্ছন্দ্যেই নামিয়ে রাখি জীবনভার,জীবনদায়ও; জানি,'মেলাবেন, তিনি মেলাবেন।'
সত্যিই, মানবজীবনের এমন কোনও ক্ষেত্র নেই, এমন কোনও বিষয় নেই, যেখানে তিনি তাঁর স্নেহকরস্পর্শ রাখেন নি। ভাষাহীনে ভাষা দিয়েছেন, অক্ষরে অক্ষরে প্রেম-সঞ্জীবন করেছেন, মননে সমৃদ্ধি দান করেছেন, জীবনময় সাধনায় অভাজনের শিক্ষা ও ক্ষুধা নিরসনে ঐকান্তিক প্রয়াস সাধন করেছেন, জাতিকে গ্লানিমুক্ত চেতনায় ঋদ্ধ করতে চেয়েছেন।
কিন্তু কখনও কোন ক্ষুদ্রতা অথবা নঙর্থক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রশ্রয় দেননি। তাই দেখি, মহাভারতের কুন্তী যখন জটীল রাজনীতির ফেরে কর্ণ সন্দর্শনে গঙ্গাতীরে পৌঁছন, রবীন্দ্রনাথের কুন্তী আসেন চিরন্তনী ভাগ্যবিড়ম্বিতা এক অসহায়া মা হয়ে,
'বঞ্চিত যে ছেলে,তারি তরে চিত্ত মোর দীপ্ত দীপ জ্বেলে…'
একই কথা চন্ডালিকার জন্যও। লৌকিক গাথায় এক সাধারণী চন্ডালিনী তার মানুষী কামনায় বৌদ্ধ শ্রমণকে চেয়েছিলো; তার উন্মত্ত কামনাদাহের শক্তিতে পদানতও করেছিলো মানবের দেবত্বকে, কিন্তু উদ্ভ্রান্ত দয়িত যখন এসে পৌঁছালো কন্যার দ্বারে, প্রেমসিঞ্চিত হৃদয় মানবতার এমন পরাজয় মেনে নিতে পারলো না;
'তোমারে করেছি অসম্মান,তবু প্রনাম,তবু প্রনাম'...
তার প্রেমযাঞ্চা অতীন্দ্রিয় রূপ পেল, ফিরিয়ে দিলো অনুশোচনায় দীর্ণ ব্যথাক্লিষ্ট প্রিয়তমকে... বড়ো করলে তাকে, বড়ো করলে নিজেকেও। ফিরে গেল আনন্দ আপন কল্যাণময় জীবনব্রতে, তার গমনপথের দিকে অবিচল চাওয়াখানি শুধু অনিত্য হয়ে রইলো কবির সৃষ্টিতে।
সত্যিই,তাঁর দীক্ষায় দীক্ষিত আমরা তো জানিই, যাঁকে বড়ো জেনে হৃদয়ে ধারন করতে চেয়েছি, তার সাধারন হওয়া বুকে যে বড়ো বেদনার মতো বাজে।
আমাদের আজন্মলালিত রবীন্দ্র ভাবাদর্শে প্রেম তাই আনন্দস্বরূপ; প্রেম জাগৃতি প্রেরণা...
'তাই তোমার আনন্দ আমার পর,তুমি তাই এসেছ নীচে…'
যুগল সম্মিলন ছাড়া খন্ডিত,অসম্পুর্ণ প্রেমে তৃপ্তি কোথায়!..
প্রেম যে চিরঋণী আপনারই হরষে…
যিনি শিখিয়েছেন, যিনি দিয়েছেন এই জীবনবীক্ষা, লৌকিক প্রেমকে 'কল্যাণে আদিষ্ট,মঙ্গলে প্রতিষ্ঠ' করে এক উচ্চতর মহিমা দান করেছেন,তাঁকে অস্বীকার করি, সাধ্য কি!
তবু জীবন এগোয়, আমরা বড়ো হই, ব্যক্তিগত স্বার্থ-সংঘাত-আবর্তে মনে মনে খন্ড হই, ক্ষুদ্র হই, অযথা অবান্তর সব প্রশ্ন করতে শিখি। হয়তো মানুষ হিসেবে, কবি হিসেবে তূল্যমূল্য বিচার করতে চাই দেবতার। বিতর্কে, জিজ্ঞাসায় ব্যতিব্যস্ত করে তুলি আপনাকে; তিনি সময় দেন, তিনি আড়ালে হাসেন…
দিনশেষে যখন আবার সব বিচার নেমে আসে পূজায়, দিনান্তের গোধুলী দৃষ্টিমায়ায় আকাশ অঙ্গনে মৃদু আলোকিত ছায়াপথে অগুন্তি তারার সাথে ধ্রূব নক্ষত্রালোকে জ্বলে ওঠে আশৈশবের সেই মুগ্ধ আকুতি…অমীমাংসিত রয়ে যায় তুচ্ছাতিতুচ্ছ ভগ্ন সব হিসেবদায়; শর্তহীন সমর্পনে,আভূমিষ্ট প্রনামে নিবেদন করি,
'বড়ো বিস্ময় লাগে,হেরি তোমারে,
কোথা হতে এলে তুমি হৃদিমাঝারে'
...কালো ঘুচিয়ে আলোর জয় হয়; নিশ্চিন্ত তিনি অনাবিল স্নেহ বিছিয়ে হাসেন, বৈশাখের তপ্ত দীপক-দাহে, শ্রাবণের অঝোর মল্লার-ধারায়, পরজিয়া উতল চৈতীমায়ায় আমরা পথ হাঁটি পায়ে পা মিলিয়ে অনন্তকাল….তাঁকে চাওয়া আমাদের ফুরায় না, পাওয়াও ফুরায় কি!...কে জানে!...
8 Comments
Darunnnnnnnnnnnn hoacha pipimoni. ❤️ Rabindra nath ka ato sundor kora tula dhoracho,khub sundor hoyeche pipimoni ❤️
ReplyDeleteভালোবাসা
Deleteঅসাধারণ বিশ্লেষণ।। খুব ভালো লাগলো।
ReplyDeleteভালোবাসা
Deleteঅসাধারণ লেখা। আমাদের হৃদয় জুড়ে যাঁর নিঃশব্দ পদচারণা, তিনিই তো একমাত্র ঠাকুর। তোমার লেখা অনবদ্য আবীর।
ReplyDeleteআমার প্রাণভরা শুভেচ্ছা, ভালোবাসা
Deleteতোমার শব্দ চয়ণ, ভাষাবিন্যাস বরাবরই মুগ্ধ করে। বাঁধিয়ে রাখবার মতো দেখা। রেখে দিও সযত্নে। মাঝে মাঝে খুব দিয়ে খানিক অবগাহনের শান্তি নিয়ে যাব।
ReplyDeleteতোমার শব্দ চয়ণ, ভাষাবিন্যাস বরাবরই মুগ্ধ করে। বাঁধিয়ে রাখবার মতো দেখা। রেখে দিও সযত্নে। মাঝে মাঝে খুব দিয়ে খানিক অবগাহনের শান্তি নিয়ে যাব।
ReplyDelete