জ্বলদর্চি

মাটিমাখা মহাপ্রাণ। বাইশ/শুভঙ্কর দাস


মাটিমাখা মহাপ্রাণ। বাইশ
শুভঙ্কর দাস 


"বাণীশূন্য ছিল একদিন
জলস্থল,শূন্যতল,ঋতুর উৎসবমন্ত্রহীন
শাখায় রচিলে তব সংগীতের আদিম আশ্রয় 
যে গানে চঞ্চল বায়ু নিজের লভিল পরিচয়
সুরের বিচিত্র বর্ণে আপনার দৃশ্যহীন তনু
রঞ্জিত করিয়া নিল,অঙ্কিল গানের ইন্দ্রধনু"

কথাটি শুনে দেবেন যেন আকাশ থেকে পড়লেন!
তিনি ভাবতে পারছেন না,এমন সিদ্ধান্ত কেউ নিতে পারে! পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য যে মানুষ দিনরাত অল্প আহার করে,স্বল্প পয়সা খরচ করে,নানারকম অভাবে-আঘাতে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে,নিজের সাধ্যাতীত পরিশ্রম করে কলকাতার মতো জায়গায় এগিয়ে গেল সম্মান নিয়ে,সেই আবার তাকেই পায়ে ঠেলে দিচ্ছে! 
আর মাত্র একটা পরীক্ষা, এমন কি  বি. এস. সি. অনার্সের টেস্ট পরীক্ষায় সফল হয়েছে দারুণভাবে,তারপর ফাইনাল দিলেই গ্রাজুয়েট হয়ে যাবে।এমনি তে দেবেন জানেন তাঁর ভাইটি পড়াশোনায় ভালো,রেজাল্ট ভালো হবেই,তাহলে যেকোনো একটা সরকারী চাকরি একেবারে পাকা হয়ে যাবে।সংসারের হাল ফিরে যাবে।
তারপর দেবেন গাঁয়ের কত জনকে কতবার তাঁর ভাইয়ের গ্রাজুয়েট হওয়ার ভবিষ্যৎ আনন্দ আগাম বলে বেড়িয়েছে,সেসব অপমানের  ধূলায় মিশে যাবে!
মাদুরের ওপর বসে থাকা কুমারচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে দেবেন ধরা গলায় বলে উঠলেন, ভাইটি,আরও একবার ভাব,এই পরীক্ষার পর তোর যা চিন্তা ভাবনা, যা আছে, তাই করিস,এতদিন কষ্ট করলি,আর এই পরীক্ষার মুখে এমন করলে চলে!

 কিন্তু দাদা,মন যে সায় দিচ্ছে না।

  মনের সব কথাই কি মোরা সবসময় মেনে চলি,তুই তো দেশের কাজ করতে চাইছিস,সে তো ভালো কথা,তা বলে পরীক্ষা না দিয়ে কী এমন দেশসেবা হবে বলতে পারিস?

দাদা,আমি কোনোদিন তোমার মুখের ওপর কোনো কথা বলিনি,তবে তুমি একটা কথা বোঝোনি,আমি তোমার ভাই কুমার,আমার পরীক্ষা না দেওয়া শুধু আমার কাছে,তোমার কাছে বা আমার বাড়ির কাছে নয়, একটা আন্দোলনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ একটা স্রোতের কাছে বিন্দু কিছুই নয়, আবার দেখো, বিন্দু বিন্দু জল দিয়েই একটা স্রোতপ্রবাহ তৈরি হয়।আমরা একের পর এক যদি এই বৃটিশ সরকারের স্কুল-কলেজ ছাড়ি,তবেই ওদের হুঁশ ফিরবে।ওরা দারুণ ধাক্কা খাবে।।তারপর একদিন এই অত্যাচারী শাসকের দম্ভের প্রাচীরকে চূর্ণ দেবে।

  কথাগুলো এমনভাবে বললেন কুমারচন্দ্র দেবেন তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলেন।

কিন্তু সূর্যকান্ত পরীক্ষা দিচ্ছে, সেও তো তোর মতো দেশকে ভালোবাসে..সে তোর বন্ধু,  সে কি বোকা? ধীরকণ্ঠে বলে উঠলেন দেবেন। আরও যোগ করলেন,তার কাছে দেশের সঙ্গে সঙ্গে নিজের স্বপ্নও গুরুত্বপূর্ণ। যেটা তুই দেখেছিলি,কিন্তু মাঝপথে হারিয়ে গেছে! 

স্বপ্ন! বলেই উঠে দাঁড়াল কুমারচন্দ্র। আমি কী স্বপ্ন দেখি জানো দাদা, এমন একটি দেশের, যেখানে প্রতিটি মানুষ সমাজ-সংসারের যেখানেই থাকবে মাথা উঁচু করে বাঁচবে,আমি স্বপ্ন দেখি, এমন সকালের, যেখানে স্বাধীনতার জন্য, ভাতের জন্য, মাথা গোঁজবার ঠাঁইয়ের জন্য এবং আত্মসম্মানবোধের জন্য যা যা পরীক্ষা তাতে সবাই পাশ করে যাবে... আমি শুধু নিজের জন্য স্বপ্ন দেখি না,আমি স্বপ্ন দেখি সেই দিনের,যেখানে যেন গাইতে পারি এই গান,
এক সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন
এক কার্যে সঁপিয়াছি সহস্র জীবন
বন্দে মাতরম 
আসুক সহস্র বাধা, বাধুক প্রলয়
আমরা সহস্র প্রাণ রহিব নির্ভয়
বন্দে মাতরম 
আমরা ডরাই না ঝটিকা-ঝঞ্ঝায়
অযুত তরঙ্গ বক্ষে সহিব হেলায়
বন্দে মাতরম 
টুটে তো টুকুক এই নশ্বর জীবন
তনু না ছিঁড়িবে কভু এ দৃঢ় বন্ধন
বন্দে মাতরম

 গাইতে গাইতে কুমারচন্দ্রের চোখে জল এসে গেল।
দেবেন ভাইয়ের আবেগ এবং স্পষ্ট   উচ্চারণে মনে মনে অবাক হয়ে গেলেন।তিনি বাসুদেবপুরের গরুচরানো, লোকের ঘরে মজুরখাটা মুখচোরা যে কুমারকে চিনতেন,এ যেন সে নয়,এমন আশ্চর্য পরিবর্তন লক্ষ্য করে দেবেন কিছুক্ষণ নীরব রইলেন।এবং এটাও তিনি বুঝলেন,তাঁর ভাইয়ের এই পথনির্বাচনে কোনো মেকিতা বা চালাকি নেই, একেবারে সততা ও সাহসের এক বিরাট সমুদ্র লুকিয়ে আছে।
আজকে নিজের ভাইয়ের প্রতি একটা আলাদা শ্রদ্ধার জায়গা তৈরি হয়ে গেল।

শুধু মৃদুকণ্ঠে কুমারের গায়ে আলতো করে হাত দিয়ে বলে উঠলেন,বাবার কথা মনে পড়ে,বাবা যখন বেঁচে ছিলেন,প্রায় বলতেন,কুমারটার পড়াশোনার প্রতি যা রোখ,তোরা দেখবি,একদিন ও বিরাট মানুষ হবে!

  কুমারচন্দ্র দাদার দিকে ঘুরে ফতুয়ার পকেট থেকে দেড়শো টাকা বের করে দেবেনের হাতে দিয়ে দিলেন।দেবেন আবার অবাক।পরীক্ষা ফিসজ বাদব যা টাকা দিয়েছিলেন,তার সবটাই ফেরত দিয়েছেন কুমার।
সেই সময় লক্ষ্মীদেবী পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।
তারপর কুমারচন্দ্র ভরাট কণ্ঠে বলে উঠলেন, দাদা দুঃখ করো না,পরীক্ষা না দিয়ে আমি যদি এ-আন্দোলনে যোগ দিই তা হলে স্বর্গ থেকে বাবা আমাকে আশীর্বাদ করবেন।
লক্ষ্মীদেবী এগিয়ে এসে কুমারচন্দ্রের মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে বলে উঠলেন,মায়ের যন্ত্রণা যে ছেলে বুঝতে পারে,আবার সেই যন্ত্রণা দূর করার নিজেকে সঁপে দিতে পারে,তার কোনো পরীক্ষা-ফরীক্ষা লাগে না বাবা,এগিয়ে যা... 

কুমারচন্দ্র মাকে প্রণাম করে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল,সহসা পেছনে ঘুরে মায়ের দিকে তাকিয়ে কুমারচন্দ্র বললেন,মা, আগে আমি ভাবতাম,আমার ঘরে ফেরার একটাই পথ,কিন্তু এখন পথে নেমে বুঝেছি,এই দেশটাই আমার ঘর আর যেখানেই যাই,সেটাই আমার ঘরে ফেরার পথ।'এক সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন'

 কুমারচন্দ্র বেরিয়ে গেলেন।
তিনি হাঁটতে লাগলেন,তাঁকে এখনই একবার ভূঞ্যারাচক যেতে হবে। সেখানে একজন তাঁর অপেক্ষায় দিন গুনছে। এ-ই পথে নামার আগে একটিবার সেই নারীটিকে জানানো দরকার।
যখন কুমারচন্দ্র মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে ভূঞ্যারাচক পৌঁছে গেলেন,তখন দুপুর গড়িয়ে গেল।তার কারণ মাঠের রাস্তা পেরিয়ে যেই বড় মেঠোরাস্তায় উঠেছে,সেই খানে বৃহৎ সরোবরের ধারে একটি তেঁতুল গাছের তলায় কুমারচন্দ্রের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল আব্দুল ফকিরের, গাছতলায় বসে ছোট ছোট গাঁয়ের ছেলেমেয়েদের অদ্ভুত সব গল্প বলছিলেন।
কুমারচন্দ্র গাছের কাছে এসে থমকে দাঁড়ালেন,গাছটি আড়াল করে শুনতে লাগলেন আব্দুল ফকিরের কথা...

  একটু কেশে নিয়ে বলে যাচ্ছেন,তারপর জানো তো সেই ছেলেটি কী করল?

কোন্ ছেলেটি ফকিরকাকা?বাচ্চাগুলো সমস্বরে জিজ্ঞেস করল।

সেই যে নাম যার সুশীল,তার বয়স মাত্র ১৪, সে কিন্তু ছোট হলেও দারুণ সাহসী।কোনো রাক্ষস-খোক্ষসকে ভয় পায় না।একটি ভয়ংকর রাক্ষস আছে,তার নাম ছিল কিংসফোর্ড। তার নির্দেশে রাক্ষসবাহিনী একবার প্রচণ্ড মারধর করেছিল নিরীহ ও অসহায় মানুষের ওপর।যাকে পারছে,মোটা মোটা লাঠি দিয়ে, বড় বড় বন্দুকের বাঁট দিয়ে মেরে মেরে রক্ত বের করে দিচ্ছে, সেই সময় সুশীল সেখানে ছিল,সে এগিয়ে গিয়ে একজন রাক্ষসের নাকে দুম করে ঘুষি চালাও, চিৎকার করে বলে,অন্যায়ভাবে মারবে যতখুশি,চাগিয়ে আবার দেবো ঘুষি।

ঠিক ঠিক, রাক্ষসকে মারাই দরকার, বাচ্চারা খুশিতে ফেটে পড়ল।আচ্ছা, ফকিরকাকা,সুশীল কি ঘুষি মেরে পালিয়ে গেল?

  না, না, তোমরা জানো, সুশীল কত  সাহসী, সে দাঁড়িয়ে রইল। তাকে ধরে নিয়ে গেল রাক্ষসেরা তাদের সর্দার কিংসফোর্ডের কাছে।এইসব শুনে মহারাক্ষসের মুখ রাগে লাল হয়ে গেল।দাঁতে বের করে বলল,একে ১৫ ঘা চাবুক মারো, এখুনি।
সুশীলের জামা খুলে নেওয়া হল,তারপর তার পিঠে সপাং সপাং করে গুণে গুণে  ১৫ ঘা চাবুক চলল। সুশীলেরা সারা পিঠ দিয়ে রক্ত ঝরতে লাগল। সুশীল কিন্তু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল..

আহ্!  বাচ্চারা মৃদুস্বরে সমবেতভাবে সমব্যথী হয়ে উঠল।
তারপর কী হল?

 সুশীল মার খেতে খেতে অজ্ঞান হয়ে ধুলোয় লুটিয়ে পড়ল। তখন সেই মহারাক্ষস কিংসফোর্ড কী করল জানো,এগিয়ে এসে বুট দিয়ে সুশীলকে উলটে দেখে,নিজের রথে চড়ে চলে গেল,যাওয়ার আগে বলে গেল,কেউ যেন একে জল খেতে না দেয়!
এবার বলো তোমরা,এই রাক্ষসকে কি মারা উচিত নয়?

 বাচ্চাদের মধ্যে একজন উঠে দাঁড়িয়ে গলার শিরা ফুলিয়ে বলে উঠল,মুই যদি একটা বেতের লাঠি পেতি,তাহলে ঐ কিংসাই রাক্ষসের পিঠে ডুগডুগি বাজাইতি...

তার বলার ধরণ দেখে সকলে হেসে উঠল।

কিন্তু তাতে যে হিংসা আরও বেড়ে যেত,তখন একে-অপরকে  মারধর করতে করতে শেষে দেখা যেত, বেতের লাঠিগুলো সব আছে,আর মার দেওয়া ও খাওয়ার লোক একটাই নেই! 
কুমারচন্দ্র গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে কথাগুলো বলল।


  রান্নাঘরের সামনে বসে তেল মাখছিলেন রমানাথ। তিনি স্নানে যাবেন।
তার আগে সব ব্যবস্থা ঠিকঠাক আছে কি না দেখে নিচ্ছেন। আজ গৃহে একটা আয়োজন করা হয়েছে। রমানাথ ভোর ভোর উঠে বাজার-হাট করে এনেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়ের মোট এগারোজন এবং এই অঞ্চলে যাঁরা পাঠশালার প্রথম ধাপ উচ্চ নম্বরসহ পাশ করেছে,তাদের দ্বিপ্রাহরিক ভোজনের ব্যবস্থা করেছেন। বাচ্চারা ভালোমন্দ তো খেতেই পায় না,তাদের জন্য এই আয়োজন। রমানাথ এবং তাঁর আদরের কন্যা চারু বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে এসেছেন। 

কই গো, এবার কিন্তু সকলে এসে পড়বে,দেখো, আমি উঠোনে সকলের জন্য পরিষ্কার কাপড় পেতে দিয়েছি। ওতেই বসে খাওয়া করবে।আহ্ আজ যা আনন্দ হচ্ছে না! 

 কিন্তু কোনো উত্তর রান্নাঘর থেকে এলো না। সদর দরজা দিয়ে রমানাথের স্ত্রী ঢুকলেন,হাতে এক তাড়া কলাপাতা। তাতে খাওয়া হবে।
সবই করেছো,কিন্তু কিসে খাওয়া হবে সে কথা ভুলে গেছো!

ও হরি তাই তো! তা বেশ করেছো,এতো দারুণ পাতাগুলো, একেবারে থালার মতো দেখতে।দাও ধুইয়ে আনি পুকুরঘাট থেকে 

থাক দরকার নেই, আমি ধুইয়ে নিয়ে এসেছি 

 তা তুমি কলাবাগানে গেলে,তাহলে রান্নাঘর সামলাচ্ছে কে? 

নিজেই উঠে গিয়ে দেখো না,যে এ বাড়িতে সবচেয়ে ভালো পনিরের ঝোল করতে পারে,সেই 

চারু! 

হ্যাঁ,কিন্তু এই পনির যে লোকটা খেতে সবচেয়ে ভালোবাসে, সেই যদি আজকে আসত,তাহলে চারুর রান্নাটা সার্থক হত!

 আসবে গিন্নি, আসবে, তোমার জামাই একবারে ভোম ভোলা, একবার কোনো কাজে রোখ হলে আর রেহাই নেই, এই যে পাঠশালা চলছে,তা কি আমি একাই কিছু পারতাম,যা চাইছি,মাস্টারের অভাব,কে পড়াবে? হঠাৎ দেখি, একজন লোক কলকাতা থেকে এলো,বললে,কুমার স্যর পাঠিয়েছেন,আমি পড়াব। পড়ানোর কাজে কী নিষ্ঠা।
মেয়েগুলোর জন্য বই চাই,সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতে ডাকযোগে এসে গেল,এক তাড়া বই 
এরকম লোক কোথায় পাবে গো?
এখানে সে নিজে উপস্থিত নেই,তাতেই এমন কাজ করে চলেছে,একেবারে সত্যিকারের দ্রোণাচার্যের মতো...

সত্যি, জামাই এতো কিছু জোগাড় করে কী করে?

জিজ্ঞেস করেছিলাম,বললে,কলকাতার একটি সেবায়তন সংস্থা আছে,তাদের কাছে বলে-কয়ে এই সব ব্যবস্থা করেছে..

সত্যি পারে বটে!

  তারপর রমানাথ উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল,এই দেখো না,গত মাসে একটা চিঠি পেলাম,তাতে জানলাম,এই মাসে তোমার জামাই গ্রাজুয়েট হয়ে যাবে!

গাজুয়েট! কী জিনিস গো?জর্জ-ম্যাজিস্টার গোছের কিছু?

রমানাথ হেসে বললে,না গো না,লাটসাহেব নয়, এ হল ডিগ্রি, মানে হল পড়াশোনা ভালো করার স্বীকৃতি। 

ওহ্ তাই,তা ওসব পড়ে কি জর্জ- ম্যাজিস্টার হওয়া যায় তো?

হ্যাঁ,তা অবশ্য যায়

 তাহলে ঐ একই হল,আচ্ছা,যাই হোক,জর্জ-ম্যাজিস্টেট মাথায় থাকুক,সে তো আর আসছে না,শুধু শুধু চারুর সামনে বলো না,কষ্ট পাবে,
যাও, যাও স্নান সেরে এসো

আচ্ছা, দেখি দাঁড়াও চারুর কতদূর হল? বলেই রমাবাথ রান্নাঘরের দিকে ঘুরতেই দেখলেন,খুন্তি হাতে রান্নাঘরের দরজার কাছে চারু দাঁড়িয়ে আছে। চোখে জল।কোমরে গোঁজা কাপড়ের প্রান্তভাগ দিয়ে চোখটা মুছে নিল।
অর্থাৎ সকল কথা সে শুনেছে। 

রমানাথ একটু প্রস্তুত হাসি হেসে বলে উঠলেন,কী হলোরে মা? চোখে কিছু পড়েছে?

চারু শুধু অস্ফুট স্বরে বলল,আজ বাড়িতে পাঠশালাভোজন হচ্ছে, কিন্তু গুরুদক্ষিণার একটা ব্যবস্থা থাকলে ভালো হত!

 বলেই সে আবার রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।
রমানাথ গিন্নির বিষণ্ন মুখের দিকে একবার তাকিয়ে পুকুর ঘাটের দিকে চলে গেলেন।

 দ্বিপ্রাহরিক সময়ে রমানাথের গৃহের দৃশ্যটি অতি মনোরম। মোট পরেনোজন বালক-বালিকা সারিবদ্ধভাবে খেতে বসেছে।তাদের চোখে-মুখে দারুণ অবাক করা আনন্দ। এরকম যে ঘটনা তাদের জীবনে ঘটতে পারে,এটা তারা ভেবেই দেখেনি কোনোদিন। তারা যে এক আশ্চর্য ব্যাপারে ডাক পেয়েছে, তাই নিয়ে নিজেদের মধ্যে কলতান করেই চলেছে।

রমানাথ পাশে বসে সব তদারকি করছেন।সহসা তিনি বলে উঠলেন,একি মা, মোট তো পনেরোটা পাতা লাগবে,তুই ষোলোটা করেছিস কেন? আমরা সবাই পরে খাব,আগে এই বাচ্চাগুলো পেট ভরে খাক...

না,বাবা ওটা থাক,ওটা নিবেদন... মৃদুস্বরে বলে উঠল,চারু 

  রমানাথ মেয়ের কথা শুনে বিস্মিত হলেন। তিনি মুখে কিছু বললেন না। শুধু চারুর মায়ের দিকে চেয়ে বলে উঠলেন,ওগো, শুধু ভাত পড়লে কী হবে? দাও পর পর যা আছে...

ঠিক সেই সময় রোদে পুড়ে ঘেমে-নেয়ে ধুলো পায়ে প্রবেশ করলেন কুমারচন্দ্র। 
প্রথমেই রমানাথকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে হাতের জিনিসপত্র সব উঠোনে নামিয়ে রেখে বলে উঠলেন, বাবা,এতো দারুণ খাওয়া দাওয়া চলছে,এদের দেখে আমারও খুব খিদে পেয়ে গেছে.. 
দাঁড়ান আসছি,বলেই কুমারচন্দ্র চট করে পাশের পুকুরে গিয়ে ভালো করে হাতমুখ ধুয়ে ফিরে এসে সেই ফাঁকা আসনটিতে বসে পড়লেন। 

এখানে কেউ কি বসবে বাবা?

রমানাথের চোখে জল এস গেল, মুহূর্তে মুছে নিয়ে মৃদুস্বরে আপনমনে বলে উঠলেন,না,বাবা যার জন্য পাতা ছিল,সেই এসে বসেছে,তারপর জোর গলায় বললেন,তুমি বসো বাবা,কেউ বসবে না, খুব রোদ মাথায় করে এসেছো,আগে খেয়ে নাও,তারপর কথা সব হবে।
ওগো চারুর মা,এসো বেরিয়ে দ্যাখো, এই দ্যাখ কে এসেছে? হরি, হরি, কে এসেছে, দ্যাখো!আজকের আয়োজন সার্থক হয়ে গেলো গো!

রাত্রি দশটার মতো হবে।
তবে গাঁয়ে-গঞ্জে সন্ধে নামলেই গভীর রাত্রি মনে হয়। বিছানার ওপর কুমারচন্দ্র বসে প্রদীপের আলোয় বই পড়ছিলেন। মাঝেমধ্যে জানালার বাইরে তাকিয়ে জ্যোৎস্নায় ভরা আকাশ দেখে মনটা প্রসন্ন হয়ে উঠল।উঠোনের কাছে রজনীগন্ধার ঝাড় আছে,তা থেকে একটা মিষ্টি সুভাস আসছে। কুমারচন্দ্র বিছানা থেকে নেমে সেই জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন।সেই রজনীগন্ধার ফুলগুলি দেখার চেষ্টা করলেন।
এতো সুন্দর গন্ধ! 
চাঁদের আলো,কী সুন্দর ফুলের গন্ধ, তারপর সুবৃহৎ সরোবর থেকে একটা আলতো ঠান্ডা বাতাস আসছে।দূরের কোনো গাছ থেকে একটা প্যাঁচার ডাক শোনা গেল। উঠোনের কাছে চোখ যেতেই, সেইখানে দশবারোটি চরকা দেখতে পেলেন, চাঁদের আলো পড়ে চরকাগুলো কী অপূর্ব দেখতে লাগছে। রমানাথবাবুর বাড়িতে চারুর সঙ্গে অনেকেই চরকায় সুতো কাটে।
চারুর কথা মনে হল,এখনও আসেনি,মানে কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত আছে। সংসারে প্রতিটি সময় কোনো না কোনো না কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখে,তা কুমারচন্দ্রের খুবই ভালো লাগে।
সহসা কুমারচন্দ্রের মনে হল, একটু অন্ধকার নেমে এলো না!
দেখলেন, একটা মেঘ কোথা থেকে উড়ে এসে চাঁদের ওপর কালো পর্দা চড়িয়েছে...তার ফলে রজনীগন্ধা-সরোবর সবে কালো ছায়া পড়েছে..
চোখের সামনে হারিয়ে যাচ্ছে! 
হঠাৎ তাঁর মনে হল, এই দেশটাও চাঁদের মতো, রজনীগন্ধা ফুলের মতো,সরোবরের জলের মতো সুন্দর। 
কিন্তু ইংরেজ নামক কালো মেঘে সেই দেশটা অন্ধকারে ঢাকা পড়ে আছে।
সেই মেঘ যে সরাতে যাবে,তার ওপর নেমে আসবে লাঠি-বন্দুকের মার,রীতিমতো অত্যাচার,জেল-জরিমানা।
আহ্ সুশীলকে কীভাবে মারল?
অবশ্য সেখানেই সবকিছু শেষ নয়, প্রফুল্ল ও ক্ষুদিরাম বলে দুজন চরমপন্থী এর প্রতিশোধ নিয়েছে, কিন্তু এইরকমভাবে কি মেঘ সরানো যাবে?
তাতে তো মেঘের আরও বজ্র-বিদ্যুৎ বেড়ে যাবে,তারপর আমাদের সোনার দেশ ছারখার করে দেবে!
মারের পর মার চলবে!
কত প্রাণ অকালে চলে যাবে!
সহসা কুমারচন্দ্রের আব্দুল ফকিরের গানটা মনে পড়ল।

" আমায় বেত মেরে কি মা ভুলাইবি
আমি কি মার সেই ছেলে? "

সেই ছেলে!  ঠিক, যতই বেত মারুক,আমরা বেতে ভয় পাবো না,ভুলব না,আমরা দেশকে ভালোবাসবো, দেশের মানুষকে ভালোবাসবো.. 

সহসা দরজার কাছে শব্দ হল...
মৃদু চুড়ির শব্দ পাওয়া গেলো।কুমারচন্দ্র অন্যমনস্ক হয়ে বিড়বিড় করেছিলেন, ভালোবাসতে হবে...ভয় পেলে চলবে না,যতই মারুক,বলেই আপন মনে গান গেয়ে উঠলেন,

"ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে,ততই বাঁধন টুটবে
মোদের ততই বাঁধন টুটবে
ওদের যতই আঁখি রক্ত হবে মোদের আঁখি ফুটবে 
ততই মোদের আঁখি ফুটবে।"

তিনি  তাই দরজা খোলা ও একজনের আগমনের এসব শব্দ শুনতে পাননি!

গানটি ভালো তো বেশ,কার লেখা?

একটু চমকে উঠলেন কুমারচন্দ্র।
পেছন ঘুরে তাকালেন কখন চারু এসে দাঁড়িয়েছে।
সহসা ঘর যেন আলোয় ভরে গেল।জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখলেন,মেঘ সরে গেছে। চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঘরে।
চারুশীলা একটি নতুন শাড়ি পরে এসেছে।পায়ে আলতা।হাতে চুড়ির সংখ্যা বেশি।মাথায় টানা আলতো ঘোমটা।মুখের কিছুটা দেখা যাচ্ছে।বেশ সুন্দর লাগছে।

আরে তুমি,কখন এলে?

এই গান শুনছিলাম, দাঁড়িয়ে, আপনাকে তাই ডাকিনি

আর গান,এই হেঁড়ে গলায় গান মানে তো যেন দূর বাঁশবনে শেয়াল ডাকছে,বলে মৃদু হাসলেন কুমারচন্দ্র 

আমার কিন্তু ভালো লেগেছে, এ গান কার লেখা?

কেন, যাঁর লেখা তার বই তোমাকে পাঠিয়েছিলাম,পড়োনি? 

এক একটা সামান্য পোস্টকার্ড, এক একটা বই কুমারচন্দ্র যখন কলকাতা  থেকে পাঠাতেন,তা চারু শীলা যে রাতদিন কতবার পড়েছে,তার ইয়ত্তা নেই!  সে সব কি বলে বোঝানো যায়!
চিঠির প্রতিটি কথা মুখস্থ। 

মুখে শুধু বলল,ওহ্ রবীন্দ্রনাথ 

হ্যাঁ,একদম ঠিক

আচ্ছা, উনি তো কত বড় জমিদার,কলকাতার মানুষ,তবু একটা প্রশ্ন জাগে!

কী প্রশ্ন?  আচ্ছা তার আগে তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? বস বিছানায়, বসো 

সে কি!  তা হয় নাকি,আপনি দাঁড়িয়ে আছেন,আমি বসতে পারি

তাতে কী? বসো 

না

আচ্ছা, বেশ, এই আমি বিছানায় বসলাম,তুমি এবার বসো,হলো তো? 

চারুশীলা মৃদু পায়ে এগিয়ে গিয়ে কুমারচন্দ্র যেখানে বসলেন,তাঁর পায়ের কাছে মেঝেতে বসে পড়ল।

সঙ্গে সঙ্গে কুমারচন্দ্র বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালেন,এ কি! এরকম করে বসলে কেন?

কেন? কী হয়েছে? মা সবসময় বলেন,পতির চরণতল হল স্বর্গ, আমি তো স্বর্গে বসতে গেলাম

না,চারু,এরকম করো না।কোনো স্বর্গ টর্গ নয়, এই মাটির পৃথিবীতে মানুষ হয়ে দাঁড়ানোই সবচেয়ে সার্থক।তারপর কুমারচন্দ্র একটু এগিয়ে চারুশীলাকে দুহাতে তুলে দাঁড় করিয়ে বললেন,আমাদের দেশের মেয়েদের দীর্ঘদিন পায়ের তলায় পিষে রাখা হয়েছে এবং হচ্ছে, এখন তোমাদের মাথা তুলে দাঁড়ানোর সময়।তোমরা না দাঁড়ালে এই দেশ দাঁড়াবে না। 
এখানে বিছানায় বসো।

না, আমি এখানেই ঠিক আছি,বলেই চারুশীলা মেঝেতে বসে পড়ল।

আচ্ছা, তাহলে ঠিক আছে, আমিও বসব
বলেই কুমারচন্দ্র ধপ্ করে মেঝেতে বসে পড়লেন,তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী, আমি যেমন যা করব,তোমার অর্ধেক, তেমনি তুমি যা করবে...

কথাটা শেষ হতে দিল না,চারু,বলে উঠল,অর্ধেক নয়, আমার কিছু নেই, কাজ নেই, আপনি যা করবেন,আমিও তাই মনপ্রাণ দিয়ে সবটা করব...

কুমারচন্দ্র মনে মনে খুশি হল।

তা কী প্রশ্ন ছিল তোমার রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে? 

বলছি,উনি কলকাতায় থাকেন,অথচ মোরা যেমন বলি, দেখুন তেমনই গানে 'মোদের' শব্দ লেখেন,মোদের ততই বাঁধন টুটবে,কোথায় লিখলেন না তো 'আমাদের ' কী করে লিখলেন, তাই ভাবি!

বেশ! দারুণ ভেবেছো তো,আসলে কী জানো,রবীন্দ্রনাথ হলেন কবি,সত্যিকারের কবি,তিনি সর্বজ্ঞানী, সবচক্ষু, তিনি সবকিছু জানেন

কিন্তু কী করে?

অনুভূতি দিয়ে, তিনি প্রগাঢ় অনুভূতি দিয়ে সবকিছু দেখতে পান,আমাদের শুধু মুখমণ্ডলে চোখ থাকে,কিন্তু তাঁর মনেও চোখ আছে,যেমন তুমি অনুভূতি দিয়ে বুঝে গেছিলে,যে আমি আসবই,তাই কেমন আমার জন্য খাবার সাজিয়ে রেখেছিলে..

সে তো  আমি রোজই...

বলেই থেমে গেল চারুশীলা। লজ্জায় মুখটি নামিয়ে ফেলল।

সে যাই হোক, বলছি রবীন্দ্রনাথের বই পাঠালাম,যে কবিতা মুখস্থ করতে বলেছিলাম,তা কি হয়েছে? 

মানে,এই রাতের বেলায় আমাকে এখন আবৃত্তি শোনাতে হবে নাকি?

আবৃত্তি নয়, চারু,তা অনুভব, পারবে বলতে? সেই যে লেখা ছিল,'অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো...

চারুশীলা মৃদু হাসলেন,এইরকম এক অদ্ভুত লোকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে, সত্যি বিয়ের পর এই প্রথম এতো কাছাকাছি দুজনে এসেছে। এমনভাবে কথা বলছেন যেন,রোজই কথা হয়, দেখা হয়, আর এই চাঁদঢালা সুগন্ধি রাতে কবিতা শোনাতে হবে।সখীরা বার বার এই বলে ক্ষেপিয়েছে,ভাই চারু,তোর বর যা পড়ুয়া,দেখবি,বউয়ে কথা ভুলে গিয়ে বই নিয়েই সারাজীবন কাটিয়ে দেবে,তারপর একদিন মারাত্মক পাশ টাশ দিয়ে একেবারে কালাপানি পারে চলে যাবে,সেখানে গিয়ে বিলিতি মেম বিয়ে করে এনে তোকে দাসী করে রাখবে!
কিন্তু তার তো কিছুই তা মনে হচ্ছে না! চারুশীলার আশ্চর্যের রকমের ভালোলাগা লাগছে। একটা আবেশ কাজ করছে মনে মনে...

সে চোখ বন্ধ করে বলতে শুরু করল,

"রাত্রি এসে যেথায় মেশে
দিনের পারাবারে
তোমায় আমায় দেখা হল
সেই মোহনার ধারে
সেইখানেতে সাদায় কালোয়াত
মিলে গেছে আঁধার আলোয়
সেইখানেতে ঢেউ ছুটছে
এপারে ঐপারে।

নিতল নীল নীরব মাঝে 
বাজল গভীর বাণী
নিকষেতে উঠল ফুটে
সোনার রেখাখানি
মুখের পানে তাকাতে যাই
দেখি দেখি দেখতে না পাই
স্বপন সাথে জড়িয়ে জাগা
কাঁদি আকুল ধারে"

কিছুক্ষণ নীরবতা।
শুধু চাঁদের আলো, রজনীগন্ধার সুগন্ধি এবং মায়ামৃদঙ্গ বাতাস বইতে লাগল সেই প্রদীপজ্বালা ছোট্ট ঘরে।

কিন্তু চারু, আমি তো তোমাকে এটা বলতে বলিনি,আমি তো " বিশ্বজনের পায়ের তলে ধূলিময় যে ভূমি/ সেই তো স্বর্গভূমি" বলতে বলেছিলাম... 

আবার নীরবতা।

তারপর চারুশীলা বলে উঠল,কী জানি,আমার এখন এটাই বলতে ইচ্ছে হল... 

সহসা একটা বাতাস এসে চারুশীলার ঘোমটা খুলিয়ে দিল...


ক্রমশ....

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments