জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোক গল্প—গ্রীণল্যাণ্ড (এস্কিমো)/চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোক গল্প—গ্রীণল্যাণ্ড (এস্কিমো)

চিন্ময় দাশ 

বাতাসের জন্ম

গ্রামের একেবারে একটেরে একটা বাড়ি। সে বাড়িতে থাকে এক কাঠুরিয়া আর তার বউ। কোন ছেলেপুলে নাই তাদের। দুজনেই কেবল থাকে বাড়িটাতে।
ছেলেপুলে না থাকলে যা হয়। কাঠুরিয়া বউয়ের মনে ভারি দুঃখ। সব সময় মন ভার করে থকে বউটা।
একদিন সকাল বেলা। কুড়ুল ঘাড়ে নিয়ে কাজে বের হচ্ছে কাঠুরিয়া। বউটা বলল—কোন দিকে যাবে গো আজ?
কোন দিন তো এমন জানতে চায় না। আজ আবার কী হোল? এই ভেবে, কাঠুরিয়া বলল—কেন বল তো? 
--আজ তুমি প্রথমে তুন্দ্রা (বরফে ঢাকা শূণ্য প্রান্তর)র দিকে যাও। 
-- কেন বলো তো? তুন্দ্রা এলাকায় কেন? 
বউ বলল—তুন্দ্রা এলাকা পার হলেই, একটা পাহাড়তলিতে পৌঁছাবে। সেখানে একটা গাছ দেখতে পাবে। একেবারেই একটা ফাঁকা জায়গায় গাছটা। চোখে পড়তে অসুবিধা হবে না। একটা পুরুষ্টু দেখে ডাল কেটে নিয়ে এসো। 

কাঠুরিয়া অবাক এমন কথা শুনে—গাছের একটা ডাল! ডাল দিয়ে কী করবে? 
মুখ আলো করে, বউ বলল—একটা পুতুল বানাবে ডালটা থেকে। আমাদের তো ছেলেপুলো নেই। সেই পুতুলকেই ঘরে রাখবো ছেলে হিসাবে।

বউয়ের মনে যে কষ্ট, ভালো করেই জানে কাঠুরিয়া। কিছু না বলে, তুন্দ্রার দিকেই রওণা হয়ে গেল সে।
ঘর থেকে বেরিয়ে বরফে পা দিয়েছে, অমনি এক অবাক ব্যাপার। ঝলমলে একটা আলোর রেখা পাতা হয়ে আছে বরফের উপর। ঠিক যেন পৃথিবীর বুকেও একটা ছায়াপথ বানিয়ে দিয়েছেন বিধাতা পুরুষ।
দেখাই যাক, কোথায় নিয়ে যায় পথটা। সেই আলোর রেখা ধরে এগোতে লাগল কাঠুরিয়া। বউ যেমনটি বলেছিল, পাহাড়তলিতে এসে হাজির হল সে। 
আর, কী আশ্চর্য! সত্যি সত্যিই সেখানে, একেবারে অনেকটা ফাঁকা জায়গার মাঝখানটিতে, ঝাঁকড়া একটা উইলো গাছ!

একটা ডাল কেটে নিয়ে বাড়ি ফিরে এল কাঠুরিয়া। 
এবার বাটালি আর হাতুড়ি নিয়ে বসে পড়ল লোকটা। বেশ যত্ন করে পুতুল বানাতে লাগল। অবশেষে ডাল থেকে পুতুল গড়ে উঠল। ছোট্ট ফুটফুটে একটা শিশু। 
এদিকে তার বউও চুপ করে বসে ছিল না। সারা দিন ধরে পুতুলের জন্য দুটো জামা বানিয়ে ফেলেছে সে। একটা জামা পুতুলকে পরানো হোল। একটা তোলা রইল পরের বারের জন্য। 

আনন্দ ধরছে না যেন বউয়ের মুখে। কী উচ্ছ্বলতা চোখে-মুখে, কাজে আর কথায়। কৌতুকের গলা করে, স্বামীকে বলল—এই যে বাবামশাই, এক সেট থালা-বাটি বানিয়ে দাও এবার। খাওয়া-দাওয়া করবে না আমাদের ছেলে? 
খুশি যেন ঝরে ঝরে পড়ছে গলা থেকে। এবার তাতে একটু বিরক্তই হোল লোকটা—কী হবে এসব করে? দিন কি বদলে যাবে না কি আমাদের? 
বউ বলল—বলছো কী তুমি? বদলাবেই তো! কথা বলবার লোক ছিল না ঘরে। এবার কথা বলব। খেলা করব। কত আনন্দ করব ছেলেকে নিয়ে! দিন বদলাবে না? আলবাৎ  বদলাবে।

বউকে খুশি করবার জন্য, এক সেট থালা-বাটি আর গ্লাশ বানিয়ে দিল কাঠুরিয়া। 
রাত নামলে, বউ এসে দরজার পাশটিতে বেঞ্চি পাতল একটা। তার উপর বসিয়ে দিল পুতুলটাকে। খাবার, জল সব সাজিয়ে দিল পুতুলের সামনে। 
নিজেরা খাওয়া সেরে, আলো নিভিয়ে, বউ বলল—এসো, আমরা এবার শুয়ে পড়ি।
তখন বোধ করি মাঝরাত হবে। কিসের যেন খুটখাট শব্দ। স্বামীকে ঠেলা দিয়ে জাগিয়ে, বউ বলল—শুনতে পাচ্ছো? নিশ্চয় পুতুলটা। 
ধড়ফড় করে উঠে পড়ল দুজনে। আলো জ্বালল। বাইরে এসে দুজনেই অবাক। থালায় খাবার নাই। জল নাই গ্লাশে। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এদিক ওদিক কী যেন দেখছে পুতুলটা।
বউ তো আহ্লাদে আটখানা একেবারে। কী করবে আর কী না করবে—ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছে না। আনন্দে ডগমগ। পুতুলটাকে বুকে জড়িয়ে, আদর করে, তার যেন আশ মেটে না। 

এভাবে কতক্ষণ চলবার পর, আবার শুতে গেল দুজনে। পুতুল-ছেলেকে বেঞ্চের ওপর বসিয়ে দিয়ে গেল আবার।
ভালো করে ঘুম হোল না তাদের বাকি রাতটা। কখন সকাল হবে। কখন আবার আদর করবে পুতুলকে বুকে জড়িয়ে। রাত কেটে গেল এই ভাবনাতেই।
সকালে ঘুম ভেঙে উঠে, কোথায় আনন্দ, কোথায় পুতুলকে আদরযত্ন? চোখ কপালে উঠে গেল দুজনের। পুতুলটা বেঞ্চিতে নাই!
গেল কোথায়? গেলই বা কেমন করে? সারা বাড়ি খোঁজা হোল তন্ন তন্ন করে। চিহ্নটুকুও নাই কোথাও। গেল কোথায়!
উঠোনে নেমে, এবার অবাক হয়ে গেল দুটিতে। বরফের উপর ছোট ছোট পায়ের ছাপ আঁকা। উঠোন পেরিয়ে বেড়ার গেট। গেট পেরিয়ে, রাস্তায় নেমেছে ছাপটা। ছাপ এগিয়ে গিয়েছে সামনে দূরের দিকে। 

যে পথ ধরে গতকাল কাঠের খোঁজে গিয়েছিল কাঠুরিয়া, ছাপটা গিয়েছে সে দিকেই। রাতের সেই ছায়াপথ মাড়িয়ে চলে গিয়েছে তাদের পুতুল-ছেলে।
হয়েছে কী, সত্যিই কাঠুরিয়ার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে পুতুলটা। সেই কোন ভোরবেলায় বেরিয়েছে। তার পর সারা দিন হাঁটাহাঁটি। চলেছে তো চলেছেই।
দিন শেষ হয়ে এসেছে এখন। এখানে আকাশ মিশে গিয়েছে মাটিতে। সামনে আর পথ নাই। চার দিক কেমন আকাশের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা।
সামনেরটা পূর্ব দিক। সেখানে আকাশের গায়ে গোল একটা ফুটো। চামড়ার মত কিছু দিয়ে আটকানো। তবে, পুতুলটা দেখল, মাঝে মাঝেই ফুলে ফুলে উঠছে ঢাকনাটা। যেন পেছন দিক থেকে কেউ চাপ দিচ্ছে সেটার উপর।

জায়গাটা কেমন একেবারে শুনসান। সাড়াশব্দটি নাই কারও। একটু বাতাস হলে, ভালো হোত। ভাবতে লাগল  পুতুলটা। 

আসবার সময়, একটা ছুরি এনেছিল কাঠুরিয়ার বাড়ি থেকে। ছুরি দিয়ে গর্তের মুখে চাপা দেওয়া ঢাকনাটা একটু কেটে দিল সে। ফুটোয় চোখ রেখে দেখে, ওপাশে আরও একটা দুনিয়া। যেন একেবারে এ পাশের পৃথিবীটার মতই।

কিন্তু সমস্যা হোল, এখন আর দাঁড়ানো যাচ্ছে না ফুটোটার সামনে। হু-হু করে হাওয়া ঢুকে আসছে ঝড়ের মত। একেবারে উড়িয়ে নিয়ে যাবে, এমন হাওয়া। 
তাড়াতাড়ি ফুটোটাকে আটকে দিল পুতুল। বলল—এত জোরে বইছ কেন? অবশ্য কখনও কখনও জোরে বইবে বইকি! তবে, কখনও ধীরেও বইবে। মাঝে মাঝে বইবারও দরকার নাই। বুঝেছো?
চার দিকই তো আকাশের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। এবার সেই দেওয়াল বরাবর হাঁটতে লাগল পুতুল। পূর্ব-দক্ষিণ কোণে পৌঁছে দেখল, সেখানে আরও একটা ঢাকনা দেওয়া ফুটো। ঠিক আগেরটার মতই। এটাও ফুলে ফুলে উঠছে পেছনের চাপে। 

যেই ঢাকনাটা খানিক কেটে দিয়েছে, ঝোড়ো হাওয়া ঢুকে আস্তে লাগল সাথে সাথে। হাওয়ার এমনই দাপট, এক পাল হরিণ, গাছপালা, ঝোপঝাড়—সব ঢুকে পড়ল হুড়মুড় করে।

তাড়াতাড়ি গর্ত বন্ধ করে দিল পুতুল। বাতাসকে ধমকে বলল—অনেক ক্ষমতা থাকতেই পারে তোমার। তা বলে, সব সময় জোরে বইবে কেন? কখনও ধীরেও বইবে। মাঝে মাঝে বইবারও দরকার নাই। একঘেয়ে জিনিষ কি ভালো? পৃথিবীর বাসিন্দারা মাঝে মাঝে একটু অন্য রকম তো চাইবেই। 

দেওয়ালের গা ধরে চলেছে পুতুল। এবার এসে হাজির হোল দক্ষিণে। সেখানের ফুটোটা কাটতেই, বাইরে দেখল, একটা সমুদ্র। তার ঢেউয়ের ঝাপটায়, গলগল করে জল ঢুকে পড়ল ভিতরে। তাড়াতাড়ি ঢাকনা বন্ধ করে, আগের মতই সমঝে দিল বাতাসকে।

পশ্চিমের দেওয়ালে পৌঁছে, ঢাকনা কাটতেই, কী বিপদ, কী বিপদ! বৃষ্টি, বাজ, বিদ্যুতের ঝলকানি। আর ঝোড়ো বাতাসের ঝাপটা। দাঁড়িয়ে থাকাই দায়! 
তাড়াতাড়ি ঢাকনা বন্ধ করে, একই হুকুম জারি করে দিল বাতাসকে। 

এবার চলল উত্তর-পশ্চিমে। সেখানে আরও বিপদ। ঢাকনা কাটতে না কাটতেই, কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস, গুঁড়ো গুঁড়ো তুষার, বরফ ঢুকে পড়তে লাগল ভিতরে। সব যেন দল বেঁধে ঝাঁপিয়ে এসে পড়ল এক সাথে। হাড় পর্যন্ত কেঁপে যায়—এমনই অবস্থা। পুতুলের তো কাহিল দশা। অর্ধেক শরীর বরফ হয়ে গেল যেন। 
তাড়াতাড়ি ঢাকনা চাপা দিয়ে, উত্তর মুখে রওণা দিল পুতুল।

কিন্তু উত্তরে আরও ঝামেলা। এমনই কনকনে ঠাণ্ডা, দাঁড়ানোই দায়। সেদিকের ঢাকনা কাটতেই তীরের ফলার মত ঠাণ্ডা বাতাস, বরফ সব ভিতরে এসে ঢুকে পড়ল। চার দিক জুড়ে কেবল বরফ আর বরফ। যেন অর্ধেক পৃথিবীই ঢেকে আছে ধবধবে সাদা বরফের চাদরে।

তাড়াতাড়ি ঢাকনা বন্ধ করে দিতে হোল। খুব নাজেহাল হতে হয়েছে এত ক্ষণ। একটু সহবত শেখানো দরকার বাতাসকে। তাকে ডেকে বলল—মন দিয়ে শোন। একটা কথা বলি। সব সময় বইবার দরকার নাই তোমার। কেবল শীত কালের মাঝামাঝি সময় এলেই বইবে। যাতে মানুষজন বিপদে না পড়ে। আগে থেকে তৈরি হয়ে নিতে পারে সবাই। শেষ বারের মত বলে গেলাম। অন্যথা না হয় যেন।

এই বলে, দ্রুত পায়ে পৃথিবীর মাঝামাঝি জায়গায় নেমে পড়ল পুতুলটা। সেখানে মাটি সমতল। বাতাস একটু উষ্ণ। ঘাড় তুলে, উপরের আকাশটার দিকে তাকিয়ে দেখল। যেন সরু সরু অজস্র বাঁকানো খুঁটির ঠেকনায় ভর দিয়ে ঝুলে আছে আকাশটা। তবে, কত না অজানা জিনিষ দিয়ে সাজানো শরীর আকাশের! ভারি সুন্দর আর ছোট-বড় ঝিকমিকে জিনিষ সব। কী জিনিষ, কে জানে! 

কাজ সারা হয়ে গেছে। এবার ফিরে যাওয়ার পালা। 
হাঁটতে হাঁটতে কত পথ পার হোল, কত দেশ। তার পর এক সময় কাঠুরিয়া মা-বাবার বাড়িতে এসে পৌঁছালো পুতুল। এখন থেকে এটাই তো তার নিজের বাড়ি। ছেলেকে ফিরে পেয়ে, দুজনেই আনন্দে আটখানা।
তার পর বহু কাল এই গ্রামেই কেটে গেল পুতুলের। একদিন বুড়ো হয়ে মারা গেল তার বাবা মা। 
তখন কিন্তু জলে পড়ে গেল না পুতুলটা। পড়শিরা এসে নিয়ে গেল তাকে। যত্ন করে রেখে দিল তাদের ঘরে। তারা জানত, এই পুতুলই আবহাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল তাদের জন্য। এই পুতুলের ফরমান মতই, দুনিয়া জুড়ে ছ’রকম বাতাস বয় সারা বছরে। আকাশের গায়ে গুণে গুণে ছ’টা ফুটো বানিয়ে দিয়ে এসেছিল যে পুতুলটা। তাতেই বারো মাসে ছ’টা ঋতুর জন্ম হয়েছে—গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত আর বসন্ত। ছ’রকম বাতাস বয় সারা বছরে। এই নানারকম বাতাস আর ঋতুগুলো তো এই পুতুলের হাতেই তৈরি। 

অনেক অনেক বছর পড়শীদের বাড়িতেই থেকেছিল পুতুলটা। কিছুকাল এই বাড়ি। কিছু কাল ঐ বাড়ি। সবাই এসে আদর করে ডেকে নিয়ে যেত তাকে। খাতির-যত্ন করেই রাখত সকলে।
কিন্তু কাঠের পুতুল তো! কত দিন আর টিকবে? একদিন নষ্টই হয়ে গিয়েছিল শেষমেশ। 

তখন বাবারা ছুটেছিল তুন্দ্রা পাড়ি দিয়ে। উইলো গাছের ডাল কেটে এনে নতুন পুতুল বানিয়ে দিয়েছিল তাদের ছেলেমেয়েদের। সেদিন থেকে ঘরে ঘরে পুতুলের কদর বেঁচে রইল। পুতুলের পাকা ঠাঁই হয়ে পৃথিবীর গেল ঘরে ঘরে।       
   
( ১০০ বছরেরও আগের কথা। উত্তর আমেরিকার গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে, ক্লারা কার্ণ বেলিশ নামের জনৈকা লোকগল্প সংগ্রাহক, গল্পটি সংগ্রহ করেছিলেন। ১৯২২ সালে একটি গল্পসংগ্রহে প্রকাশিতও হয়েছিল গল্পটি। 
পরে, সেই গল্পের কাঠামো নিয়ে, অজস্র গল্প রচিত হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায়। শোনান হয়েছে শিশুদের।
আমরা এই গল্পটি তৈরি করেছি বাংলার শিশুদের জন্য।)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments