জ্বলদর্চি

গ্রামের শহুরে রূপকথা--২০/সুরশ্রী ঘোষ সাহা

গ্রামের শহুরে রূপকথা

সুরশ্রী ঘোষ সাহা

বিংশ পর্ব : বিবাহ অনুষ্ঠান 


আগেকার সময়ে গ্রামের ছেলেমেয়েদের বিয়ে নিয়ে কিছু লিখতে ইচ্ছে হল। তাই জেঠিমার কাছে জানতে চেয়েছিলাম সে বিষয়ে। 

 জেঠিমার প্রথম কথাটাতেই চমকে উঠলাম এটা শুনে যে, একে অপরকে বিয়ের আগে একবারও না দেখেই তাদের বিয়ে হয়েছে। তখন সমাজে এটাই চল ছিল। বর তার হবু কনেকে দেখতে যেতে পারত না। দেখতে যেত, বাড়ির অন্যান্য গুরুজনরা। তাদের পছন্দই শেষ কথা ছিল। একেবারে ছাদনাতলায় শুভ দৃষ্টির সময় স্বামী-স্ত্রী প্রথম একে অপরের মুখ দেখেছে। 

 জেঠিমার বলা দ্বিতীয় কথাটাতেও কম চমকালাম না। একবার নয়, প্রায় দু'বার বিয়ের মত অনুষ্ঠান হয়েছে। যাকে তখন বলা হত, দ্বিরাগমন। 

জেঠিমা বলল- 
 বিয়ের পর, নয় দিনের মাথায় আমার বাপের বাড়ির লোক আমাকে নিয়ে গেল। শরীর খারাপ হওয়া অর্থাৎ মাসিক হওয়া পর্যন্ত ওখানেই ছিলাম। তখন এটাই নিয়ম ছিল। মাসিকের সময় স্বামীর মুখ দেখা যাবে না। মাসিক মিটলে শ্বশুরবাড়িতে খবর দেওয়া হল। ঠাকুর মশাই বলে রাখা ছিল। আমাদের স্বামী-স্ত্রীকে বসিয়ে বেশ কিছু পুজো-আচ্চা ও নিয়মকানুন পালন হল। বরুনাণ পাড়ার এক মুসলিম বাড়িতে তখন পাল্কি ছিল। সারা বছরের জন্য বেহারাও রাখা থাকত। আমার শ্বশুর মশাই ওখানে বলে রাখতেন। পালকি চেপে তোর জেঠু আর আমি শ্বশুর বাড়িতে এলাম... দ্বিরাগমন হল। 

 আমাদের বৌভাত হয়েছিল খুব ছোট করে। বিয়ের পরদিনই তখন বৌভাত অনুষ্ঠান হয়ে যেত। নতুন বৌকে দিয়ে 'পায়েস কাঠি' অনুষ্ঠান পর্ব দেওয়া হত। অর্থাৎ রেঁধে রাখা পায়েসে বউ একটা কাঠি ঘুরিয়ে দেবে। তারপর বেশ কিছু আত্মীয়-পরিজন ও নিমন্ত্রিত গ্রামবাসী বসে সেই পায়েস ও বাকিসব খাওয়া দাওয়া সারত। সেই রাতটা শুধু বর-বউ একে অপরের মুখ দেখত না। তার পরের দিন থেকে একসাথে শুতো। আমাদের কোন ফুলশয্যার অনুষ্ঠান হয়নি, জানিস? তখন জাঁকজমক ভাবে কিছু করার তো মানুষের তেমন ক্ষমতা ছিল না। 

 আমার যখন বিয়ে হয়, তখনো গ্রামে আলো আসেনি। আমাদের বাড়িতে তখন একটা হ্যাজাকের আলো ছিল। বিয়ে উপলক্ষে আরো কয়েকটা হ্যাজাক ভাড়া করে আনা হয়েছিল। ওগুলো এক ধরণের কেরোসিনের বাতি। তবে হ্যারিকেন লম্ফের চেয়ে অনেক বেশি আলো দিত। স্টোভে যেমন পাম্প দেওয়া হয়, অমনভাবে ওতে পাম্প দিয়ে দিয়ে আলোকে জ্বালিয়ে রাখতে হত। সেই আলোতেই অনুষ্ঠান বাড়ির সকল রান্না, খাওয়া, বৌয়ের মুখ দেখা সবকিছু হত। 

 বর পাল্কি চেপে বিয়ে করতে যেত, আর পাল্কি করেই বউ নিয়ে ফিরত। কিন্তু কনেযাত্রী - বরযাত্রীরা সব পায়ে হেঁটেই যাতায়াত করত। আর কোন যানবাহন তখনও গ্রামে চলতে শুরু করেনি। 

 বাবার অনেকদিনের শখ ছিল, আমার বিয়েতে সানাই বাদক ভাড়া করে আনবেন। এনেও ছিলেন। বড় বড় অভিজাত বাড়িতে তখন সেটার খুব চল ছিল। তাদের জন্য দুয়ারের একপাশে একটা আলাদা বসার ব্যবস্থা হয়েছিল। সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা আর জহর কোট পরে তারা সকাল থেকে বসে তাদের ফুয়ের মাধ্যমে রাগ সঙ্গীতের আসর জমিয়ে দিয়েছিল। সামনে গিয়ে দাঁড়ালে তাদের গা থেকে হাল্কা মিষ্টি আতরের গন্ধ ভেসে আসত। বহু কাল হল বিয়ে বাড়িতে অমন নহবত আসরের চল উঠে গিয়েছে। সে জায়গায় এখন ক্যাসেট প্লেয়ার বাজছে। 

 প্যান্ডেলের যেখানে রন্ধনশালা করা হয়েছিল, সেখানে একদিকে বামুন ঠাকুর খালি গায়ে পৈতে ঝুলিয়ে বড় বড় কড়াইয়ে লুচি ভাজল, কেউ ছোলার ডাল সাঁতলালো, তার পাশেই আবার হালুইকর রসে চুবিয়ে রসগোল্লা-পান্তুয়া মিষ্টি বানালো। আত্মীয়রা ও পাড়ার ছেলেরা কোমর বেঁধে পরিবেশন করল। আর লাইন দিয়ে মাটিতে বসে মানুষ নিমন্ত্রণ খেল। যেন কোন খাওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে। মাছ, মাংস, মিষ্টি সব কিছু এত চাইতে থাকল মানুষ। তখন রাত সাড়ে আটটা, খাবার শেষ হয়ে গেল। আবার কিছু কিছু পদের রান্না চড়ালো বামুনঠাকুরেরা। বাড়ির লোকেরা শেষের দিকে অনেককিছুই পেল না। তখন মানুষ খেতে পারতও বটে। আর কাউকে বলা হোক, কী না বলা হোক ঝেঁটিয়ে এসে উপস্থিত হত। কোন বাড়িতে একজনকে বলা হলেও বাড়িসুদ্ধু সবাই এসে হাজির হত। সেই দিনের কথা মনে পড়লে আজও হাসি পায়। আমার শ্বশুর বাড়িতে এক ননদ কে কী উপহার দিল, খাতায় লিখে রাখছিল। তখন তো এমনও হত, এক জিনিস কত বাড়ি ঘুরত। আর খুব দামি কিছু উপহার দেওয়ার চলও বিশেষ ছিল না। আমি তো তেমন কিছুই পাইনি। ঐ ঘরে পরার সুতি শাড়ি, কাঁসার বাসন, পেন, বই এইসব। 

 পরের দিকে গ্রামে বিয়ের বা অন্য কোন অনুষ্ঠানে এমন একটা রীতিও আর টিকে থাকল না। ক্যাটারার ঢুকে পড়ল। মিষ্টিটাও দোকান থেকে অর্ডার দিয়ে আনা শুরু হয়েছে। 

 আমি বললাম, তখন নাকি বিয়ের সময় কীসব মাঙ্গলিক টাঙ্গলিক ব্যাপার ছিল গ্রামেগঞ্জে। বলো না সেই বিষয়ে? 

জেঠিমা বলল, জ্যোতিষী যদি ঠিকুজি কুষ্ঠি দেখে বের করত, কোন মেয়ে মাঙ্গলিক, তাহলে তার দোষ কাটানোর জন্য তাকে হয় কুকুরের সাথে নয়তো গাছের সাথে আগে বিয়ে দেওয়া হত। এগুলো কমবেশি গ্রামে আজও আছে। 

আমার হাসি পেল। ভাল জিনিসগুলো সব সমাজ থেকে উঠে গিয়েছে, কিন্তু আজে বাজে নিয়মগুলো আজও মাথা উঁচু করে টিকে রয়েছে। 

অনেক গ্রামে শুনেছি, মেয়ের ও ছেলের বাড়িতে বিয়ের দুদিন আগে থেকে গীত গাওয়ার চল ছিল। সেই বিয়ের গীত-এর ঐতিহ্যও এখন উঠে এসেছে প্রায়। আগে নানা ধরণের বর-কনে খেলা ছিল, যেমন - কড়িখেলা, পাশাখেলা, ভাঁড়কুলোখেলা, কিংবা দুধ আলতাগোলা জলের মধ্যে আংটি ফেলে বর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেবে, কনেকে হাত ঢুকিয়ে তুলে আনতে হবে। কোথাও শ্বশুর বাড়িতে বউ প্রবেশের পর নতুন বউকে পাঁকাল মাছ ধরতে দেওয়া হত। যে বউ ভাল ধরতে পারবে সে ভাল সংসারী হবে। পিছলে গেলে চলবে না। এছাড়া বিয়ের বাসরে গান, ঢেঁকি মোঙলানোর গানও ছিল, আজও কোথাও কোথাও শোনা যায়। তবে, নেমন্তন্ন করার সময় ছড়ার চিঠি, সেই সঙ্গে নাপিতের কণ্ঠে ছড়া এগুলো বহুল পরিমাণে ছিল। কন্যা সম্প্রদানের বা মধুপর্ক দানের পরে নাপিত যে ছড়া কাটতেন তাকে 'গৌরবচন' বলা হত। ছাদনাতলাতেও ছড়ার চল ছিল। যেমন, অনেক সময়ে বিবাহের শুভদৃষ্টি বা মালাবদলের সময়ে ছড়া কেটে বলা হত, "শুনুন শুনুন মহাশয় করি নিবেদন। / রামসীতার বিবাহ কথা করুন গো শ্রবণ।। / যথাশুনি উলুধ্বনি করুন সকলে। / হর-গৌরীর মিলন হল শুভকালে।।" এইসব তো এখন অধিকাংশই হারিয়ে গিয়েছে। 

 আমাদের গ্রামে বিয়ের দিন ছাদনাতলায় সুন্দর করে আলপনা দেওয়ারও চল ছিল। বড় করে দু’টো উড়ন্ত প্রজাপতি আঁকা হত, চারপাশে থাকত লতাপাতার অলঙ্করণ। বর, কনের বসার পিঁড়িদু’টিও নানা আলপনা দিয়ে সাজানো হত। বর্গাকার ছাদনাতলায় লেখা হত ‘শ্রীশ্রীপ্রজাপতয়ে নমঃ’। আর তার পরেই লেখা থাকত, দুই পঙ্‌ক্তির ছড়া।

 আমাদের সমাজে বিয়ের বাজারে চিরকালই কালো ও খারাপ দেখতে মেয়েদের সাথে পণ্যের মতো আচরণ করা হয়। সেকারণে যৌতুক প্রথা আজও চলে যেতে পারেনি। ঠিকঠাক যৌতুক না পাওয়ায় এখনও বধূহত্যার খবর শুনতে পাই। এখন পণ চাওয়ার ভাষা ও কায়দাটা শুধু বদলেছে। এই প্রসঙ্গে আমার শোনা আগেকার একটা ঘটনা বলি, - আমার পরিচিত এক বয়স্কা মানুষ গল্প করেছিলেন, তাঁকে বিয়ের আগে দাড়িপাল্লার একদিকে বসিয়ে অপরদিকে তাঁর সমান মাপের সোনা রেখে সেই সোনা যৌতুকে দিয়ে তবেই নাকি তাঁর বিয়ে হয়েছিল। 
                                                               (ক্রমশ...) 

ছবি : লেখিকা

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments